দুর্গেশনন্দিনী/দ্বিতীয় খণ্ড/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সেই দিবস অনেক রাত্রি পর্যন্ত আয়েষা ও ওস্মান জগৎসিংহের নিকট বসিয়া রহিলেন। জগৎসিংহের কখন চেতনা হইতেছে, কখন মূর্চ্ছা হইতেছে; হকির্ম অনেকবার আসিয়া দেখিয়া গেলেন। আয়েষা অবিশ্রান্তা হইয়া কুমারের শুশ্রূষা করিতে লাগিলেন। যখন দ্বিতীয় প্রহর, তখন একজন পরিচারিকা আসিয়া আয়েষাকে কহিল যে, বেগম তাহাকে স্মরণ করিয়াছেন।
“যাইতেছি” বলিয়া আয়েষা গাত্রোত্থান করিলেন। ওস্মানও গাত্রোত্থান করিবুেন। আয়েষা জিজ্ঞাস করিলেন, “তুমিও উঠিলে?”
ওস্মান কহিলেন, “রাত্রি হইয়াছে, চল তোমাকে রাখিয়া আসি।”
আয়েষা দাসদাসীদিগকে সতর্ক থাকিতে আদেশ করিয়া মাতৃ-গৃহ অভিমুখে চলিলেন। পথে ওস্মান জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কি আজ বেগমের নিকটে থাকিবে?”
আয়েষা কহিলেন, “না, আমি আবার রাজপুত্রের নিকট প্রত্যাগমন করিব।”
ওসমান কহিলেন, “আয়েষা! তোমার গুণের সীমা দিতে পারি না; তুমি এই পরম শত্রুকে যে যত্ন করিয়া শুশ্রুষা করিতেছ, ভগিনী, ভ্রাতার জন্য এমন করে না। তুমি উহার প্রাণদান করিতেছ।”
আয়েষ ভুবনমোহন মুখে একটু হাসি হাসিয়া কহিলেন, “ওস্মান! আমি ত স্বভাবতঃ রমণী; পীড়িতের সেবা আমার পরম ধর্ম্ম; না করিলে দোষ, করিলে প্রশংসা নাই; কিন্তু তোমার কি? যে তোমার পরম বৈরী,—রণক্ষেত্রে তোমার দর্পহারী প্রতিযোগী,—স্বহস্তে যাহার এ দশা ঘটাইয়াছ, তুমি যে অনুদিন নিজে ব্যস্ত থাকিয়া তাহার সেবা করাইতেছ, তাহার আরোগ্যসাধন করাইতেছ, ইহাতে তুমিই যথার্থ প্রশংসাভাজন।”
ওস্মান কিঞ্চিৎ অপ্রতিভের ন্যায় হইয়া কহিলেন—“তুমি আয়েষা, আপনার সুন্দর স্বভাবের মত সকলকে দেখ। আমার অভিপ্রায় তত ভাল নহে। তুমি দেখিতেছ না, জগৎসিংহ প্রাণ পাইলে আমাদিগের কত লাভ? রাজপুত্ত্রের এক্ষণে মৃত্যু হইলে আমাদিগের কি হইবে? রণক্ষেত্রে মানসিংহ জগৎসিংহের ন্যূন নহে, একজন যোদ্ধার পরিবর্ত্তে আর এক জন যোদ্ধা আসিবে। কিন্তু যদি জগৎসিংহ জীবিত থাকিয়া আমাদিগের হস্তে কারারুদ্ধ থাকে, তবে মানসিংহকে হাতে পাইলাম; সে প্রিয় পুত্ত্রের মুক্তির জন্য অবশ্য আমাদিগের মঙ্গলজনক সন্ধি করিবে; আকবরও এতাদৃশ দক্ষ সেনাপতিকে পুনঃপ্রাপ্ত হইবার জন্য অবশ্য সন্ধির পক্ষে মনোযোগী হইতে পারবে; আর যদি জগৎসিংহকে আমাদিগের সদ্ব্যবহার দ্বারা বাধ্য করিতে পারি, তবে সেও আমাদিগের মনোমত সন্ধিবন্ধন পক্ষে অনুরোধ কি যত্ন করিতে পারে; তাহার যত্ন নিতান্ত নিষ্ফল হইবে না। নিতান্ত কিছু ফল না দর্শে, তবে জগৎসিংহের স্বাধীনতার মূল্যস্বরূপ মানসিংহের নিকট বিস্তর ধনও পাইতে পারিব। সম্মুখসংগ্রামে একদিন জয়ী হওয়ার অপেক্ষাও জগৎসিংহের জীবনে আমাদিগের উপকার।”
ওস্মান এই সকল আলােচনা করিয়া রাজপুত্ত্রের পুনর্জীবনে যত্নবান্ হইয়াছিলেন, সন্দেহ নাই, কিন্তু আর কিছুও ছিল। কাহারও কাহারও অভ্যাস আছে যে, পাছে লােকে দয়ালু-চিত্ত বলে, এই লজ্জার আশঙ্কায় কাঠিন্য প্রকাশ করেন এবং দানশীলতা নারী-স্বভাব-সিদ্ধ বলিয়া উপহাস করিতে করিতে পরােপকার করেন। লোক জিজ্ঞাসিলে বলেন, ইহাতে আমার বড় প্রয়ােজন আছে। আয়েষা বিলক্ষণ জানিতেন, ওস্মান তাহারই একজন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “ওস্মান! সকলেই যেন তােমার মত স্বার্থপরতায় দূরদর্শী হয়। তাহা হইলে আর ধর্ম্মে কাজ নাই।”
ওস্মান কিঞ্চিৎকাল ইতস্ততঃ করিয়া মৃদুতর স্বরে কহিলেন, “আমি যে পরম স্বার্থপর, তাহার আর এক প্রমাণ দিতেছি।”
আয়েষা নিজ সবিদ্যুৎ মেঘতুল্য চক্ষুঃ ওস্মানের বদনের প্রতি স্থির করিলেন। ওস্মান কহিলেন, “আমি আশালতা ধরিয়া আছি, আর কত কাল তাহার তলে জলসিঞ্চন করিব?”
আয়েষার মুখশ্রী গম্ভীর হইল। ওস্মান এ ভাবান্তরেও নূতন সৌন্দর্য্য দেখিতে লাগিলেন। আয়েষা কহিলেন,“ওস্মান! ভাই বহিন্ বলিয়া তােমার সঙ্গে বসি দাঁড়াই। বাড়াবাড়ি করিলে, তােমার সাক্ষাতে বাহির হইব না।”
ওসমানের হর্ষোৎফুল্ল মুখ মলিন হইয়া গেল। কহিলেন,—“ঐ কথা চিরকাল! সৃষ্টিকর্ত্তা! এ কুসুমের দেহমধ্যে তুমি কি পাষাণের হৃদয় গড়িয়া রাখিয়াছ?”
ওস্মান আয়েষাকে মাতৃগৃহ পর্য্যন্ত রাখিয়া আসিয়া বিষণ্ণ-মনে নিজ আকাসে-মন্দির মধ্যে প্রত্যাগমন করিলেন। আর জগৎসিংহ? বিষম জ্বর-বিকারে অচেতন শয্যাশায়ী হইয়া রহিলেন।