দুর্গেশনন্দিনী/দ্বিতীয় খণ্ড/পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বিধবা

 তিলােত্তমা কোথায়? পিতৃহীনা, অনাথিনী, বালিকা কোথায়? বিমলাই বা কোথায়? কোথা হইতে বিমলা স্বামীর বধ্য-ভূমিতে আসিয়া দর্শন দিয়াছিলেন? তাহার পরই আবার কোথায় গেলেন?

 কেন বীরেন্দ্রসিংহ মৃত্যুকালে প্রিয়তমা কন্যার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন না? কেনই বা নামমাত্র হুতাশনবৎ প্রদীপ্ত হইয়াছিলেন? কেন বলিয়াছেন, “আমার কন্যা নাই?” কেন বিমলার পত্র বিনা পাঠে দূরে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন?

 কেন? কতলু খাঁর প্রতি বীরেন্দ্রের তিরস্কার স্মরণ করিয়া দেখ, কি ভয়ানক ব্যাপার ঘটিয়াছে।

 “পবিত্র কুলে কালি পড়িয়াছে” এই কথা বলিয়া শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যাঘ্র গৰ্জ্জন করিয়াছিল।

 তিলোত্তমা আর বিমলা কোথায়, জিজ্ঞাসা কর? কতল খাঁর উপপত্নীদিগের আবাসগৃহের সন্ধান কর, দেখা পাইবে।

 সংসারের এই গতি! অদৃষ্টচক্রের এমনি নিদারুণ আবর্ত্তন! রূপ, যৌবন, সরলতা, অমলতা সকলই নেমির পেষণে দলিত হইয়া যায়!

 কতলু খাঁর এই নিয়ম ছিল যে, কোন দুর্গ বা গ্রাম জয় হইলে, তন্মধ্যে কোন উৎকৃষ্ট সুন্দরী যদি বন্দী হইত, তবে সে তাঁহার আত্মসেবার জন্য প্রেরিত হইত। গড়মান্দারণ জয়ের পরদিবস, কতলু খাঁ তথায় উপনীত হইযা বন্দীদিগের প্রতি যথাবিহিত বিধান ও ভবিষ্যতে দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণ পক্ষে সৈন্য-নিয়োজন ইত্যাদি বিষয়ে নিযুক্ত হইলেন। বন্দীদাগের মধ্যে বিমলা ও তিলোত্তমাকে দেখিবামাত্র নিজ বিলাসগৃহ সাজাইবার জন্য তাহাদিগকে পাঠাইলেন। তৎপরে অন্যান্য কার্য্যে বিশেষ ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। এমত শ্রত ছিলেন নে, রাজপুত-সেনা জগৎসিংহের বন্ধন শুনিয়া নিকটে কোথাও আক্রমণের উদ্যোগে আছে; অতএব তাহাদিগের পরাঙ্মুখ করিবার জন্য উচিত ব্যবস্থা-বিধানাদিতে ব্যাপৃত ছিলেন, এজন্য এ পর্যন্ত কতলু খাঁ নূতন দাসীদিগের সঙ্গসুখলাভ করিতে অবকাশ পান নাই।

 বিমলা ও তিলোত্তমা পৃথক পৃথক কক্ষে রক্ষিত হইয়াছিলেন। যথায় পিতৃহীনা নবীনার ধূলিধূসরা দেহলতা ধরাতলে পড়িয়া আছে, পাঠক! তথায় নেত্রপাত করিয়া কাজ নাই। কাজ কি? তিশোতমার প্রতি কে আর এখন নেত্রপাত করিতেছে? মধূদয়ে নববল্লরী যখন মন্দ-বায়ু-হিল্লোলে বিধূত হইতে থাকে, কে না তখন সুবাসাশয়ে সাদরে তাহার কাছে দণ্ডায়মান হয়? আর যখন নৈদাঘ ঝটিকাতে অবলম্বিত বৃক্ষ সহিত সে ভূতলশায়িনী হয়, তখন উন্মূলিত পদার্থরাশি মধ্যে বৃক্ষ ছাড়িয়া কে লতা দৃষ্টি করে? কাঠুরিয়ারা কাঠ কাটিয়া লইয়া যায়, লতাকে পদতলে দলিত করে মাত্র।

 চল, তিলোত্তমাকে রাখিয়া অন্যত্র যাই। যথার চঞ্চলা, চতুর, রসপ্রিয়া, রসিকা বিমলার পরিবর্ত্তে গম্ভীরা, অনুতাপিতা, মলিনা বিধবা চক্ষে অঞ্চল দিয়া বসিয়া আছে, তথায় যাই।

 এই কি বিমলা? তাহার সে কেশবিন্যাস নাই। মাথায় ধূলিরাশি; সে কারু-কার্য্য-খচিত ওড়না নাই; সে রত্নখচিত কাঁচলি নাই; বসন বড় মলিন। পরিধানে জীর্ণ, ক্ষুদ্র বসন। সে অলঙ্কার-ভার কোথায়? সে অংসসংস্পর্শলোভী কর্ণাভরণ কোথায়? চক্ষু ফুলিয়াছে কেন? সে কটাক্ষ কই? কপালে ক্ষত কেন? রুধির যে বাহিত হইতেছে।

 বিমলা ওস্মানের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন।

 ওস্মান পাঠানটুলতিলক। যুদ্ধ তাঁহার স্বার্থসাধন ও নিজ ব্যবসায় এবং ধর্ম্ম; সুতরাং যুদ্ধজয়ার্থ ওস্মান কোন কার্য্যেই সঙ্কোচ করিতেন না। কিন্তু যুদ্ধপ্রয়োজন সিদ্ধ হইলে, পরাজিত পক্ষের প্রতি কদাচিৎ নিষ্প্রয়োজনে তিলার্দ্ধ অত্যাচার করিতে দিতেন না। যদি কতলু খাঁ স্বয়ং বিমলা ও তিলোত্তমার অদৃষ্টে এ দারুণ বিধান না করিতেন, তবে ওস্মানের কৃপায় তাঁহারা কদাচ বন্দী থাকিতেন না। তাঁহারই অনুকম্পায় স্বামীর মৃত্যুকালে বিমলা তৎসাক্ষাৎ লাভ করিয়াছিলেন। পরে যখন ওস্মান জানিতে পারিলেন যে, বিমলা বীরেন্দ্রসিংহের স্ত্রী, তখন তাহার দয়ার্দ্রচিত্ত আরও আর্দ্রীভূত হইল। ওস্মান কতলু খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্ত্র,[১] এজন্য অন্তঃপুরেও কোথাও তাঁহার গমনে বারণ ছিল না; ইহা পূর্ব্বেই দৃষ্ট হইয়াছে। যে বিহারগৃহে কতলু খাঁর উপপত্নীসমূহ থাকিত, সে স্থলে কতলু খাঁর পুত্ত্রেরাও যাইতে পারিতেন না, ওস্মানও নহে। কিন্তু ওস্মান কতলু খাঁর দক্ষিণ হস্ত, ওস্মানের বাহুবলেই তিনি আমোদর-তীর পর্যন্ত উৎকল অধিকার করিয়াছিলেন। সুতরাং পৌরজন প্রায় কতলু খাঁর যাদৃশ ওস্মানের তাদৃশ বাধ্য ছিল। এজন্যই অদ্য প্রাতে বিমলার প্রার্থনানুসারে, চরমকালে তাঁহার স্বামিসন্দর্শন ঘটিয়াছিল।

 বৈধব্য-ঘটনার দুই দিবস পরে বিমলার যে কিছু অলঙ্কারাদি অবশিষ্ট ছিল, তৎসমুদায় লইয়া তিনি কতলু খাঁর নিয়ােজিত দাসীকে দিলেন। দাসী কহিল, “আমায় কি আজ্ঞা করিতেছেন?”

 বিমলা কহিলেন, “তুমি যেরূপ কা’ল ওসমানের নিকট গিয়াছিলে, সেইরূপ আর একবার, যাও; কহিও যে, আমি তাঁহার নিকট আর একবার সাক্ষাতের প্রার্থিতা; বলিও এই শেষ, আর তৃতীবার ভিক্ষা করিব না।”

 দাসী সেইরূপ করিল। ওস্মান বলিয়া পাঠাইলেন, “সে মহাল মধ্যে আমার যাতায়াতে উভয়েরই সঙ্কট; তাঁহাকে আমার আবাস-মন্দিরে আসিতে কহিও।”

 বিমলা জিজ্ঞাস করিলেন, “আমি যাই কি প্রকারে?” দাসী কহিল, “তিনি কহিয়াছেন যে, তিনি তাহার উপায় করিয়া দিবেন।”

 সন্ধ্যার পর আয়েষার একজন দাসী আসিয়া অন্তঃপুররক্ষী খােজা-দিগের সহিত কি কথাবার্ত্তা কহিয়া, বিমলাকে সমভিব্যাহারে করিয়া ওস্মানের নিকট লইয়া গেল।

 ওস্মান কহিলেন, “আর তােমার কোন্ অংশে উপকার করিতে পারি?” বিমলা কহিলেন, “অতি সামান্য কথা মাত্র; রাজপুত-কুমার জগৎসিংহ কি জীবিত আছেন?”

 ও। জীবিত আছেন।

 বি। স্বাধীন আছেন কি বন্দী হইয়াছেন?

 ও। বন্দী বটে, কিন্তু আপাততঃ কারাগারে নহে। তাঁহার অঙ্গের অস্ত্রক্ষতের হেতু পীড়িত হইয়া শয্যাগত আছেন। কতলু খাঁর অজ্ঞাতসারে তাঁহাকে অন্তঃপুরেই রাখিয়াছি। সেখানে বিশেষ যত্ন হইবে বলিয়া রাখিয়াছি।

 বিমলা শুনিয়া বলিলেন, “এ অভাগিনীদিগের সম্পর্কমাত্রেই অমঙ্গল বটিয়াছে। সে সকল দেবতাকৃত। এক্ষণে যদি রাজপুত্র পুনর্জ্জীবিত হয়েন, তবে তাহার আরোগা-প্রাপ্তির পর এই পত্রখানি তাঁহাকে দিবেন; আপাততঃ আপনার নিকট রাখিবেন। এইমাত্র আমার ভিক্ষা।”

 ওস্মান লিপি প্রত্যর্পণ করিয়া কহিলেন, “ইহা আমার অনুচিত কার্য্য; রাজপুত্র যে অবস্থাতেই থাকুন, তিনি বন্দী বলিয়া গণ্য। বন্দীদিগের নিকট কোন লিপি, আমরা নিজে পাঠ না করিয়া, যাইতে দেওয়া অবৈধ এবং আমার প্রভুর আদেশবিরুদ্ধ।”

 বিমলা কহিলেন, “এ লিপির মধ্যে আপনাদিগের, অনিষ্টকারক কোনও কথাই নাই। সুতরাং অবৈধ কার্য্য হইব না, আর প্রভুর আদেশ? আপনি আপন প্রভু।”

 ওসমান কহিলেন, “অন্যান্য বিষয়ে আমি পিতৃব্যের আদেশবিরুদ্ধ আচরণ কখন করিতে পারি; কিন্তু এসকল বিষয়ে নহে। আপনি যখন কহিতেছেন যে, এই লিপিমধ্যে বিরুদ্ধ কথা নাই, তখন সেইরূপই আমার প্রতীতি হইতেছে, কিন্তু এ বিষয়ে নিয়মভঙ্গ করিতে পারি না। আমা হইতে এ কার্য্য হবে না।”

 বিমলা ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিলেন, “তবে আপনি পাঠ করিয়াই দিবেন।”

 ওস্মান লিপি গ্রহণ করিয়া পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন।


  1. ইতিহাসে লেখা পুত্ত্র