দুর্গেশনন্দিনী/প্রথম খণ্ড/পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
দিগ্‌গজের সাহস

 বিমলা দ্রুতপাদবিক্ষেপে শীঘ্র মান্দারণ পশ্চাৎ করিলেন: নিশা অত্যন্ত অন্ধকার, নক্ষত্রালোকে সাবধানে চলিতে লাগিলেন। প্রান্তরপথে প্রবেশ করিয়া বিমলা কিঞ্চিৎ শঙ্কান্বিত হইলেন; সমভিব্যাহারী নিঃশব্দে পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছেন, বাক্যব্যয়ও নাই। এমন সময়ে মনুষ্যের কণ্ঠস্বর শুনিলে কিছু সাহস হয়, শুনিতে ইচ্ছাও করে। এই জন্য বিমলা গজপতিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রসিকরতন! কি ভাবিতেছ?”

 রসিকরতন বলিলেন, “বলি তৈজসপত্রগুলা!”

 বিমলা উত্তর না দিয়া মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে লাগিলেন।

 ক্ষণেককাল পরে, বিমলা আবার কথা কহিলেন, “দিগ্‌গজ, তুমি ভূতের ভয় কর?”

 “রাম! রাম! রাম! রাম নাম বল”, বলিয়া দিগ্‌গজ বিমলার পশ্চাতে দুই হাত সরিয়া আসিলেন।

 একে পায় আরে চায়। বিমলা কহিলেন, “এ পথে বড় ভূতের দৌরাত্ম্য।” দিগ্‌গজ আসিয়া বিমলার অঞ্চল ধরিলেন। বিমলা বলিতে লাগিলেন,—“আমরা সে দিন শৈলেশ্বরের পূজা দিয়া আসিতেছিলাম, পরের মধ্যে বটতলায় দেখি যে, এক বিকটাকার মূর্ত্তি।”

 অঞ্চলের তাড়নায় বিমলা জানিতে পারিলেন যে, ব্রাহ্মণ থরহরি কাঁপিতেছে; বুঝিলেন যে, আর অধিক বাড়াবাড়ি করিলে ব্রাহ্মণের গতিশক্তি রহিত হইবে। অতএব ক্ষান্ত হইয়া কহিলেন, “রসিকরাজ! তুমি গাইতে জান?”

 রসিক পুরুষ কে কোথায় সঙ্গীতে অপটু? দিগগজ বলিলেন, “জানি বই কি!”

 বিমল বলিলেন, “একটি গীত গাও দেখি।”

 দিগ্‌গজ আরম্ভ করিলেন,

“এ হুম্-উ, হুম্—সই কি ক্ষণে দেখিলাম
শ্যামে কদম্বেরি ডালে।”

 পথের ধারে একটা গাভী শয়ন করিয়া রোমন্থন করিতেছিল; অলৌকিক শব্দ শুনিয়া বেগে পলায়ন করিল।

রসিকের গীত চলিতে লাগিল—

“সেই দিন পুড়িল কপাল মোর—
কালি দিলাম কুলে।
মাথায় চূড়া, হাতে বাঁশী, কথা কয় হাসি হাসি;
বলে ও গোয়ালা মাসী—কলসী দিব ফেলে”।

 দিগ্‌গজের আর গান হইল না; হঠাৎ তাঁহার শ্রবণেন্দ্রিয় একেবারে মুগ্ধ হইয়া গেল; অমৃতময়, মানসোন্মাদকর, অপ্সরোহস্তস্থিত বীণাশব্দবৎ মধুর সঙ্গীতধ্বনি, তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। বিমলা নিজে পূর্ণস্বরে সঙ্গীত আরম্ভ করিয়াছিলেন।

 নিস্তব্ধ প্রান্তর-মধ্যে নৈশ গগন ব্যাপিয়া সেই সপ্তস্বর পরিপূর্ণ ধ্বনি উঠিতে লাগিল। শীতল নৈদাঘ পবনে ধ্বনি আরোহণ করিয়া চলিল।

 দিগ্‌গজ নিঃশ্বাস রহিত করিয়া শুনিতে লাগিলেন। যখন বিমলা সমাপ্ত করিলেন, তখন গজপতি কহিলেন, “আবার।”

বি। আবার কি?
দি। আবার একটি গাও।
বি। কি গায়িব?
দি। একটি বাঙ্গালা গাও।

 “গায়িতেছি” বলিয়া বিমলা পুনর্ব্বার সঙ্গীত আরম্ভ করিলেন।

 গীত গায়িতে গায়িতে বিমলা জানিতে পারিলেন যে, তাঁহার অঞ্চলে বিষম টান পড়িয়াছে; পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন, গজপতি একেবারে তাঁহার গায়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছেন, প্রাণপণে তাঁহার অঞ্চল ধরিয়াছেন। বিমলা বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন,—“কি হইয়াছে? আবার ভূত নাকি?”

 ব্রাহ্মণের বাক্য সরে না, কেবল অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া দেখাইলেন—“ঐ”।

 বিমলা নিস্তব্ধ হইয়া সেই দিকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। ঘন ঘন প্রবল নিঃশ্বাসশব্দ তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল, এবং নির্দ্দিষ্টদিকে পথপার্শ্বে একটা পদার্থ দেখিতে পাইলেন।

 সাহসে নির্ভর করিয়া নিকটে গিয়া বিমলা দেখিলেন,—একটি সুগঠন সুসজ্জীভূত অশ্ব মৃত্যুযাতনায় পড়িয়া নিঃশ্বাস ত্যাগ করিতেছে।

 বিমলা পথবাহন করিতে লাগিলেন। সুসজ্জীভূত সৈনিক-অশ্ব পথিমধ্যে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখিয়া তিনি চিন্তামগ্ন হইলেন। অনেকক্ষণ কথা কহিলেন না। প্রায় অর্ধক্রোশ অতিবাহিত করিলে, গজপতি আবার তাঁহার অঞ্চল ধরিয়া টানিলেন।

 বিমলা বলিলেন, “কি?”

 গজপতি একটি দ্রব্য লইয়া দেখাইলেন। বিমলা দেখিয়া বলিলেন,“এ সিপাহীর পাগড়ী।” বিমলা পুনর্ব্বার চিন্তায় মগ্ন হইলেন, আপনাআপনি কহিতে লাগিলেন, “যারই ঘােড়া, তারই পাগ্ড়ি? না, এ ত পদাতিকের পাগড়ি!”

 কিয়ৎক্ষণ পরে চন্দ্রোদয় হল। বিমলা অধিকতর অন্যমনা হইলেন। অনেকক্ষণ পরে গজপতি সাহস করিয়া ছিজ্ঞান করিলেন, “সুন্দরি, আরস কথা কহ না যে?”

 বিমলা কহিলেন, “পথে কিছু চিহ্ন দেখিতেছ?”

 গজপতি বিশেষ মনােযোগের সহিত পথ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিয়া কতিগণ,—“দেখিতেছি, অনেক ঘোড়ার পায়ের চিহ্ন!”

বি। বুদ্ধিমান—কিছু বুঝিতে পারিলে?
দি। না?
বি। ওখানে মরা ঘােড়া, সেখানে সিপাহীর পাগড়ি, এখানে এত ঘােড়ার পায়ের চিহ্ন, এতে কিছু বুঝিতে পারিলে না?—কারেই বা বলি!
দি। কি?
বি। এখনই বহুতর সেনা এই পথে গিয়াছে।”

 গজপতি ভীত হইয়া কহিলেন, “তবে একটু আস্তে হাঁট; তারা খুব আগু হইয়া যাক্।”

 বিমলা হাস্য করিয়া বলিলেন, “মুর্খ! তাহারা আগু হইবে কি? কোন্ দিকে ঘােড়ার খুরের সম্মুখ, দেখিতেছ না? এ সেনা গড়-মান্দারণে গিয়াছে”—বলিয়া বিমলা বিমর্ষ হইয়া রহিলেন।

 অচিরাৎ শৈলেশ্বরের মন্দিরের ধবল-শ্রী নিকটে দেখিতে পাইলেন। বিমল ভাবিলেন যে, রাজপুত্রের সহিত ব্রাহ্মণের সাক্ষাতের কোন প্রয়োজন নাই; বরং তাতে অনিষ্ট আছে। অতএব কি প্রকারে তাহাকে বিদায় দিবেন, চিন্তা করিতেছিলেন। গজপতি নিজেই তাহার সূচনা করিয়া দিলেন।

 ব্রাহ্মণ পুনর্ব্বার বিমলার পৃষ্ঠের নিকট আসিয়া অঞ্চল ধরিয়াছেন; বিমলা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আবার কি?”

 ব্রাহ্মণ অস্ফূটস্বরে কহিলেন, “সে কত দূর?”

বি। “কি কত দূর?
দি। সেই বটগাছ?”
বি। কোন্ বটগাছ?
দি। যেখানে তোমরা সে দিন দেখিয়াছিলে?
বি। কি দেখিয়াছিলাম?
দি। রাত্রিকালে নাম করিতে নাই।

 বিমলা বুঝিতে পারিয়া সুযোগ পাইলেন।

 গম্ভীরস্বরে বলিলেন, “ইঃ।”

 ব্রাহ্মণ অধিকতর ভীত হইয়া কহিলেন, “কি গা?”

 বিমলা অস্ফূটস্বরে শৈলেশ্বর-নিকটস্থ বটবৃক্ষের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কহিলেন,—“সে ঐ বটতলা।”

 দিগ্‌গজ আর নড়িলেন না; গতিশক্তিরহিত অশ্বথপত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিলেন।

 বিমলা বলিলেন, “আইস।”

 ব্রাহ্মণ কাঁপিতে কাঁপিতে কহিলেন, “আমি আর যাইতে পারিব না।”

 বিমলা কহিলেন, “আমারও ভয় করিতেছে।”

 ব্রাহ্মণ এই শুনিয়া পা ফিরাইয়া পলায়নোদ্যত হইলেন।

 বিমল বৃক্ষপানে দৃষ্টি করিয়া দেখিলেন, বৃক্ষমূলে একটা ধবলাকার কি পদার্থ রহিয়াছে। তিনি জানিতেন যে, বৃক্ষমূলে শৈলেশ্বরের ষাঁড় শুইয়া থাকে; কিন্তু গজপতিকে কহিলেন, “গজপতি! ইষ্টদেবের নাম জপ, বৃক্ষমূলে কি দেখিতেছ?”

 “ওগো বাবা গো—”বলিয়াই দিগ্‌গজ একেবারে চম্পট। দীর্ঘ দীর্ঘ চরণ—তিলার্দ্ধ-মধ্যে অর্দ্ধক্রোশ পার হইয়া গেলেন।

 বিমলা গজপতির স্বভাব জানিতেন, অতএব বেশ বুঝিতে পারিলেন যে, তিনি একেবারে দুর্গ-দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইবেন।

 বিমলা তখন নিশ্চিন্ত হইয়া মন্দিরাভিমুখে চলিলেন।

 বিমলা সকল দিক্‌ ভাবিয়া আসিয়াছিলেন, কেবল এক দিক ভাবিয়া আইসেন নাই। রাজপুত্ত্র মন্দিরে আসিয়াছেন কি? মনে এইরূপ সন্দেহ জন্মিলে বিমলার বিষম ক্লেশ হইল। মনে করিয়া দেখিলেন যে, রাজপুত্র আসার নিশ্চিত কথা কিছু বলেন নাই; কেবল বলিয়াছিলেন যে, “এইখানে আমার সাক্ষাৎ পাইবে; এখানে না দেখা পাও, তবে সাক্ষাৎ হইল না।” তবে ত না আসারও সম্ভাবনা।

 যদি না আসিয়া থাকেন, তবে এত ক্লেশ বৃথা হইল। বিমলা বিষণ্ণ হইয়া আপনা-আপনি কহিতে লাগিলেন, “এ কথা আগে কেন ভাবি নাই? ব্রাহ্মণকেই বা কেন তাড়াইলাম? একাকিনী এ রাত্রে কি প্রকারে ফিরিয়া যাইব! শৈলেশ্বর! তোমার ইচ্ছা!”

 বটবৃক্ষতল দিয়া শৈলেশ্বর-মন্দিরে উঠিতে হয়। বিমলা বৃক্ষতল দিয়া যাইতে দেখিলেন যে, তথায় ষণ্ড নাই; বৃক্ষমূলে যে ধবল পদার্থ দেখিয়াছিলেন, তাহা আর তথায় নাই। বিমল কিঞ্চিৎ বিস্মিত হইলেন। ষণ্ড কোথাও উঠিয়া গেলে প্রান্তর-মধ্যে দেখা যাইত।

 বিমলা বৃক্ষমূলের প্রতি বিশেষ দৃষ্টিপাত করিলেন; বোধ হইল যেন, বৃক্ষের পশ্চাদ্দিকস্থ কোন মনুষ্যের ধবল পরিচ্ছদের অংশমাত্র দেখিতে পাইলেন; সাতিশয় চঞ্চপদে মন্দিরাভিমুখে চলিলেন; সবলে কবাট করতাড়িত করিলেন?—কবাট বন্ধ। ভিতর হইতে গম্ভীরস্বরে প্রশ্ন হইল, “কে?”

 শূন্য মন্দির-মধ্য হইতে গম্ভীরস্বরে প্রতিধ্বনি হইল, “কে?”

 বিমলা প্রাণপণে সাহসে ভর করিয়া কহিলেন, “পথ-শ্রান্ত স্ত্রীলোক!”

 কবাট মুক্ত হইল।

 দেখিলেন, মন্দির-মধ্যে প্রদীপ জ্বলিতেছে, সঙ্গে কৃপাণ-কোষ-হস্তে এক দীর্ঘাকার পুরুষ দণ্ডায়মান।

 বিমলা দেখিয়া চিনিলেন, কুমার জগৎসিংহ।