দেওয়ানা/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।

নবাব সুজা খাঁর ভালোর দিকে পরিবর্তন দেখিয়া আনার-উন্নিসা, তাহাকে তাঁহার অতীত জীবনের ঘটনাগুলি সম্বন্ধে এ পর্য্যন্ত কখনও কোন প্রশ্ন করে নাই। সে অনেক দিক দিয়া ভাবিয়া বুঝিয়াছিল—অতীত তো মরণের গর্ভে। আর ভবিষ্যৎ অন্ধকারের উদরে। বর্ত্তমানই তখন তাহার সম্মুখে সজীব ও জাগ্রত রূপে বিদ্যমান। অতীতের স্মৃতি যখন বিষময়, তখন তাহাকে বিস্মৃতির গর্ভে ফেলিয়া দেওয়াই ঠিক। এইজন্যই বাহারবনুর সঙ্গে পীর মহরমে তাহার সাক্ষাৎ ব্যাপারের সকল কথাই, সে স্বামীর নিকট ইচ্ছা করিয়াই গোপন করিয়াছিল।

 নবাব সুজা খাঁ, বাহারবনুকে লইয়া কক্ষান্তরে প্রস্থান করিলে, আনারের মনে একটা দারুণ সন্দেহের ছায়া জাগিয়া উঠিল। সে ঠিক বুঝিতে পারিল না—তাহার স্বামীর উপর এই শয়তানী বাহারের এতটা প্রভাব কিসের জন্য? আরও তাজ্জব কথা—যে বাহারবাহর সঙ্গে কক্ষ ত্যাগ করিবার সময়, নবাব তাঁহাকে একটীও সান্ত্বনার কথা বলিয়া গেলেন না! আনারউন্নিসা এই সব ঘটনার বিচারে বুঝিল, সেদিনকার বাজি তাহার হার হইরা গিয়াছে।

 কিন্তু এ হারের বাজি কি আবার জিত হয় না? হওয়া সম্ভব, যদি নবাব সুজা বেগ এই ছলনাময়ী বাহারবনুকে জন্মের মত ভুলিতে পারেন। ইহার সহিত সকল সম্পর্ক ত্যাগ করেন।  প্রাণভরা সরলতা, নেত্রে উচ্ছ্বসিত প্রেমরাশি, মুখভরা হাসি, হৃদয়ভরা স্বার্থকলঙ্ককলুষশূন্য অনাবিল, পবিত্রপ্রেম, পত্নীর ধর্ম্মাহ্ণমোদিত কর্ত্তব্য, স্বামী-হৃদয়ের এক সময়ের দুর্ব্বলতাজনিত পদস্খলনের অপরাধ গোপন, এই সবই ত তাহার পত্নীত্বের কর্তব্য। হায়! কি করিয়া সে তাহার স্বামীকে এই ছলনাময়ী স্বৈরিণীর কবল মুক্ত করিবে? কে তাহাকে সে পথ দেখাইয়া দিবে।

 পরক্ষণেই সে ভাবিল—চেষ্টায় না হয় কি? সাধনার ফলেই যে সিদ্ধিলাভ। এই পবিত্র আবাস মন্দিরের অধিষ্ঠিতা দেবী সে। সেই গৃহের রাজরাজেশ্বরী সে। স্বামী তাহার। তাহার পত্নীত্বের একটা কর্ত্তব্য আছে, দাবি আছে, অধিকার আছে—সে অধিকার তাহাকে জীবন পণ করিয়াও বজায় রাখিতে হইবে। নিজের সকল সুখ স্বার্থ, বিলাসভোগ সবই দমন করিয়া সতর্ক প্রহরীর মত, এই স্বামীকে সর্ব্বদা চোখে চোখে রাখিতে হইবে। প্রতি কথায় প্রতি কার্য্যে বুঝাইতে হইবে, যে এই নবাব সুজা খাঁ তাহার সর্ব্বস্ব। পতির উপর স্বাধ্বী পত্নীরই ষোল আনা অধিকার।

 এইরূপ চিন্তায় আনার মনে মনে একটা সাহস পাইল। অন্ধকারময় পথে সে যেন একটু আলোক ছটা দেখিতে পাইল। তাহার হৃদয়ে নারীর স্বভাবসিদ্ধ আত্মগরিমা, পত্নীয় রাজ-রাজেশ্বরীত্ব ভাব ফুটিয়া উঠিল। সে অতি ধীরপদে, অতি সন্তর্পণে তাহার কক্ষ হইতে বাহির হইয়া সুজাখাঁ যে কক্ষে বাহারের সহিত প্রবেশ করিলেন, ঠিক তাহার পার্শ্ববর্ত্তী কক্ষে আত্ম গোপন করিল।

 সে দেখিল, নির্জ্জন কক্ষ মধ্যে নবাব সুজা খাঁ চিন্তামগ্নভাবে পাইচারি করিতেছেন। তাঁহার গভীর চিন্তার বিষয়টা কি, তাহা যেন আভাসে ইঙ্গিতে বুঝিতে পারিয়াই, সেই শয়তানী বাহারবানু, এক ক্ষুদ্র সোফার উপর বসিয়া মৃদু হাস্য করিতেছে। অবশ্য চিত্তামগ্ন নবাব সুজা খাঁ, তাহার এ অবজ্ঞাময় অর্থপূর্ণ হাসিটি দেখিতে পাইতেছিলেন না।

 কক্ষমধ্যে কয়েকখানি উজ্জ্বল মুকুর। সমগ্র কক্ষ উজ্জল দীপালোকিত। সুগন্ধি দীপের কম্পিত আলোকমালার চঞ্চল প্রতিবিম্ব, সেই সব মুকুরে পড়িয়াছে। নবাব সুজা খাঁ বাহারবানুর দিকে পিছন করিয়া সেই মুকুরের দিকে চাহিয়া আছেন।

 বাহারবানু মনে মনে কি ভাবিয়া আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার বিচিত্র সৌন্দর্য্যভরা, লাবণ্যমাথা মুখখানির প্রতিবিম্ব নবাব সুজা খাঁর সন্মুখস্থ দর্পণের উপর পড়িল। নবাব সুজা খাঁ, সে লাবণ্যময় মূর্ত্তির ছায়া, দর্পণে দেখিয়া একটু মৃদু হাসিলেন। আর সেই দর্পণগাত্রাবলম্বী ছায়ামূর্ত্তিও যেন তাঁহাকে ব্যঙ্গ করিয়া হাসিয়া উঠিল।

 নবাব মুখ ফিরাইবামাত্র, দেখিলেন বাহারবানু তাঁহার সন্মুখে দাঁড়াইয়া। তিনি তিরস্কার পূর্ণস্বরে বলিলেন—“বাহারবানু! তোমার অনেক অপরাধ আমি ইতি পূর্ব্বে মার্জ্জনা করিয়াছি। অনেক বড় বড় ত্রুটি, উপেক্ষার চক্ষে দেখিয়াছি। কিন্তু তোমার আজ‍্কের অপরাধের কোন মার্জনা নাই।”

 বাহারবানু গম্ভীরমুখে বলিল— “অপরাধ, যে কিসে হইল, জনাব! তাহা ত বুঝিতে পারিতেছি না।”

 সুজা বেগ। যে অপরাধী, সে কি সহজে তার অপরাধের গুরুত্ব বুঝিতে পারে? কেন তুমি এখানে এভাবে আসিলে?

 বাহারবানু। সত্য কথা বলিব কি নবাব! বলিলে তুমি বিশ্বাস করিবে কি?

 সুজা বেগ। কোন কথাই শুনিতে চাহি না। দুষ্ট বুদ্ধি বশে যাহা করিয়া ফেলিয়াছ, তাহা আর ফিরিবে না। তুমি এখনিই এস্থান ত্যাগ কর।

 বাহারবানু। যদি না করি?

 সুজা বেগ। তাহা হইলে বুঝিব, তুমি অতি নিলর্জ্জা। অতি ঘৃণিতা। আত্মসম্ভ্রমের মূল্য জ্ঞান তোমাতে খুব কম!

 বাহারবানু। এখন এ সব কথা বলিবে বই কি? কিন্তু মনে কর সেই দিনের কথা— নবাব সুজা বেগ! সে দিন সমস্ত রাত্রি ধরিয়া সাধাসাধি করিয়া তুমি আমাকে তোমার পার্শ্বে বসাইতে পার নাই। মনে কর, সেই দিনের কথা নবাব—যেদিন আমি তোমার এই নবাবী সম্মান রক্ষার জন্য, প্রেমারার আড্ডায় একদল ওমরাহের সম্মুখে তোমার ইজ্জত বজায়ের উদ্দেশ্যে, আমার কণ্ঠ হইতে বহুমূল্য রত্নহার খুলিয়া, তোমার বাজির দানের ঋণ পরিশোধ করিয়াছিলাম। মনে কর নবাব! সেই দিনের কথা, যে সময়ে আমায় ছাড়িয়া তুমি এক মুহূর্ত্ত কালও থাকিতে পারিতে না। আমি একদিন আরামবাগে না আসিলে, তুমি আমার উদ্যানে গিয়া আমার উপাসনা করিতে। সাধিয়া কাঁদিয়া আমায় তোমার আরামবাগে আনিতে। হায়! এত শীঘ্র কি তুমি সব ভুলিলে?”

 নবাব সুজা বেগ কিয়ৎক্ষণ কি ভাবিয়া, অপেক্ষাকৃত ধীর ভাবে বলিলেন—“না ভুলি নাই। কিন্তু আজ তুমি এখানে আসিয়া বড়ই অন্যায় করিয়াছ। এখানে না আসিয়া আরামবাগ হইতেই ত তুমি আমায় সংবাদ দিয়া পাঠাইতে পারিতে।”

 বাহারবানু। সেটা অবশ্য আমি প্রয়োজনীয় বলিয়া বোধ করি নাই।

 সুজা বেগ। কেন?

বাহার। অনেক দিন হইতে এই আনার উন্নিসার সৌন্দর্য্যগৌরবের কথা শুনিয়াছিলাম। তাই তাহাকে একবার দেখিতে আসিয়াছিলাম।

 সুজা বেগ বুঝিলেন, এটা স্তোক বাক্য বই কিছুই নয়। তিনি নীরস হাস্যের সহিত বলিলেন—“বোধ হয় সে তোমার চেয়ে সুন্দরী নয়।”

 এটা কঠোর বিদ্রুপ। চতুরা বাহারবানু, নীরবে এ বিদ্রুপটা সহ্য করিয়া বলিল—“এক্ষেত্রে সৌন্দর্য্যের বিচারক তুমি। একদিন আমাকে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা বলিয়া সপ্তমস্বর্গে তুলিয়াছিলে—আমার চরণে অবনত হইয়াছিলে। তাই, কৌতূহলবশে দেখিতে আসিয়াছিলাম হয়ত এই আনারউন্নিসা আমার চেয়ে খুবই সুন্দরী। তাহা না হইলে সে আমাকে তোমার হৃদয়ের মধ্য হইতে এরূপ ভাবে সরাইয়া দিবে কেন?

 সুজা বেগ সেই কক্ষ মধ্যে পদচারণা করিতে করিতে বলিলেন—“এখন তোমার মনের অভিপ্রায় কি বল দেখি?”

 বাহারবানু। তুমি এখনি আমার সঙ্গে আরামবাগে চল।

 সুজা। হইতেই পারে না। সুলতান দারা লাহোর হইতে আজ ফিরিয়া আসিয়াছেন। আসিয়াই আমাকে তলব করিয়াছিলেন। আমিও দুর্গের মধ্যে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম। তিনি আবার আমাকে সন্ধ্যার পর যাইতে বলিয়াছেন। সুতরাং তোমার সঙ্গে আরামবাগে যাওয়ার সময় আমার নাই।

 বাহারবানু কিয়ৎক্ষণ কি ভাবিল। চিন্তাপীড়িত ভাবে তাহার ওষ্ঠাধর দংশন করিতে লাগিল। তারপর একটা কঠোর হাস্যের সহিত বলিল— “আবার দারার সঙ্গে মাঝামাখি করিতেছ?”

 এই কথা শুনিয়া নবাব সুজা বেগ—চকিতভাবে কক্ষের চারিদিকে চাহিয়া—বাহারের হাতখানি সশঙ্কিতভাবে টিপিয়া দিয়া বলিলেন—“চুপ! দেওয়ালেরও কাণ আছে।”

 বাহারবানু বোধ হয় আরও কিছু বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সুজার এই ঈঙ্গিত যেন তাঁহার বাক্যকথনেচ্ছু ঠোঁট দুটীকে খুব জোরে চাপিয়া ধরিল।

 সে কেবলমাত্র বলিল—“ভাল, এখন আমি বিদায় লইতেছি। কিন্তু তোমার সহিত একবার নির্জ্জনে সাক্ষাৎ হওয়া খুবই প্রয়োজন।”

 সুজা বেগ—বাহারবানুকে আলিঙ্গন নিপীড়িত করিয়া সহাস্যমুখে বলিলেন—“কাল রাত্রে তুমি আরামবাগে যাইও, আমি সেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করিব।”

 “সেই ভাল”—এই দুটীমাত্র কথা বলিয়া নবাব সুজা খাঁর দিকে একটী বক্রদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া, বাহারবানু আর কিছু না বলিয়া সেই কক্ষ ত্যাগ করিল।

 নবাব সুজা বেগ ও বাহারবানুর মধ্যে যাহা কিছু ঘটিল, পার্শ্বস্থ কক্ষে অতি সংগোপনে থাকিয়া একজন তাহার সবই লক্ষ্য করিল। তাঁহাদের উভয়ের কেহই তাহা জানিতে পারিলেন না।

 এ গুপ্ত কথা শ্রবণকারী আর কেউ নয়, নবাব সুজা বেগের নব পরিণীতা পত্নী আনারউন্নিসা বেগম।