দেওয়ানা/নবম পরিচ্ছেদ
নবম পরিচ্ছেদ।
নবাব সুজা বেগের শেষ পত্রখানি হইতেই, এই মহাঝড়ের উৎপত্তি হইয়াছে! পত্রের ব্যাপারটা কি, আমাদের একটু খুলিয়া বলিতে হইবে।
জামাল খাঁ, নিজে একজন রত্নব্যবসায়ী। তাঁহার সময় যখন ভাল ছিল, তখন তিনি এই ব্যবসায়ে বেশ দুপয়সা উপায় করিয়াছিলেন। তাঁহার ক্ষুদ্র প্রাসাদ তুল্য বর্ত্তমান বাড়ীখানি, গৃহের সাজসজ্জা, সবই তখনও তাঁহার এক সময়ের উন্নত অবস্থার পরিচয় দিতেছে।
অতিরিক্ত লাভের আশায়, প্রায় লক্ষাধিক মুদ্রা মূল্যের কয়েকখানি বহুমূল্য হীরক, তিনি দাক্ষিণাত্যের মুসলমান রাজাদের নিকট বিক্রয় করিবার জন্য, দৌলতাবাদে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে, দস্যুদলের কবলগত হওয়ায়, তাঁহার, বহুমূল্য রত্নগুলি লুণ্ঠিত হয়—তবে কোন গতিকে তাঁহার প্রাণটা বাঁচিয়া যায়। তিনি বহুদিন পরে, বহু কষ্টে, রুগ্ন ও ভগ্ন দেহে বিষণ্ণ মনে, আবার গৃহে ফিরিয়া আসেন।
সর্ব্বাপেক্ষা কষ্টের কথা এই, যে দস্যু লুণ্ঠিত পণ্য মধ্যে কয়খানি বহুমূল্য হীরক, তাঁহার নিজের সম্পত্তি নহে। তাহার মধ্যে, তাঁহার অন্তরঙ্গ বন্ধু মধ্যে গণ্য, আরও দুইজন মহাজনের কয়েকখানি হীরা ছিল। তিনিই তাঁহাদিগকে অধিক লাভের প্রলোভন দেখাইয়া, এই হীরা গুলি লইয়া গিয়াছিলেন।
ফিরিয়া আসিবার পর, মহাজনেরা, হীরা বিক্রয়ের ফলাফল কি হইল, তাহা জানিবার জন্য তাঁহার কাছে যাতায়াত করিতে লাগিল। তিনি পীড়িত ও শয্যাগত, সুতরাং কেহই তাঁহার সাক্ষাৎ পাইল না। এই সঙ্গে মহাজনদের মনেও একটা সন্দেহের ছায়া ফুটিয়া উঠিল।
জামাল খাঁ রোগ মুক্ত হইবার পর তাহাদের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করিয়া বলিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যখন মানুষকে আশ্রয় করে, তখন তাঁহার সত্য কথাও মিথ্যা হইয়া দাঁড়ায়। সুতরাং এই কয়জন পাওনাদার মহাজন, তাঁহার একান্ত অন্তরঙ্গ বন্ধু হইলেও, তাঁহার কথায় বিশ্বাস করিল না। বরঞ্চ রাজদ্বারে তাঁহার নামে অভিযোগ আনিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কোন ক্রমেই তিনি তাহাদের শান্ত করিতে পারিলেন না।
ইমানদার যে, তার পক্ষে ইজ্জত বড় বালাই। যাহারা চিরদিনই এই ইমানদারীর গৌরব রাখিয়া আসিয়াছে, তাহারা ঠিক বুঝিতে পারে, বেইজ্জত হইবার অবস্থা আসিলে, মনের অবস্থা কিরূপ শোচনীয় হয়।
পূর্ব্বেই বলিয়াছি, নবাব সুজা বেগের মাতা রুকিনা বিবি, তাঁহার দূর সম্পর্কীয়া আত্মীয়া। তিনি এই রুকিনা বিবির নিকট হইতে অনেক চেষ্টায়, পঞ্চাশ সহস্র মুদ্রা সংগ্রহ করিয়া, বিদ্রোহী বন্ধু মহাজনদের দিয়া ইজ্জত রক্ষা করেন। বলা বাহুল্য, এই টাকার জন্য রুকিনা বিবিকে এক তমসুখ লিখিয়া দিতে হয়।
জামাল খাঁ, নবাব সুজা বেগের দ্বিতীয় পত্রের উত্তরে লিখিয়াছিলেন—“তোমার মাতার মৃত্যুর পর, তুমি আর কোন চেষ্টা না করায় ও অরক্ষণীয়া কন্যা বেশী দিন রাখিতে অক্ষম হওয়ায়, আমি মীর লতিফের সহিত আনারের বিবাহ সম্বন্ধ একরূপ পাকা করিয়া ফেলিয়াছি, কিন্তু এজন্য আমি বড়ই দুঃখিত। আমার ও আমার কন্যার মহা দূর্ভাগ্য, যে তোমার সহিত কুটুম্বিতা করা, আমাদের সহিল না।”
কিন্তু পূর্ব্বেই বলিয়াছি, নবাব সুজা বেগ বড়ই নির্ব্বদ্ধবান। এই আনারকে পত্নীরূপে গ্রহণ করিতে পারিলে, বাহারবানুর কবল হইতে তিনি অতি সহজেই যুক্তিলাভ করিতে পারিতেন। কিন্তু কোথাকার কে এক পথের ভিক্ষুক মীর লতিফ আসিয়া, তাঁহার উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথে দাঁড়াইয়াছে, ইহা ভাবিয়া, তিনি মহাক্ষুব্ধ হইয়া জামাল খাঁকে লিখিলেন,—“কন্যাদানের স্বাধীনতা, সম্পূর্ণরূপে আপনার। যদি এ স্বাধীনতার অসদ্ব্যবহার করেন, জানিবেন, আমি এবং আমার মাতা এতদিন আপনার উপর যে সদয় ব্যবহার করিয়া আসিয়াছি, তাহা আর করিব না। আমাদের পাওনা টাকা আপনার ভিটা বেচিয়াও আদায় করিতে বাধ্য হইব।”
এই পত্র পাইয়াই জামাল খাঁ খুবই বিচলিত হইয়া পড়েন। এই ঐশ্বর্যশালী নবাব সুজা বেগ যে কতটা হীন প্রকৃতির লোক, তাহাও তিনি বুঝিলেন।
সুজা খাঁর নষ্ট চরিত্র সম্বন্ধীয় কথাগুলি যে জামাল খাঁর একেবারে অপরিজ্ঞাত ছিল, তাহা নয়। লোকের সহিত সুজা খাঁর বাহিরের ব্যবহারটা খুব লেফাকা দুরস্ত। তিনি মিষ্টভাষী, সদালাপী, আর তাঁর চেয়ে যাঁরা একটু অবস্থাহীন, তাঁহাদের প্রতি এমন একট। অমায়িকতার ভাব তিনি দেখাইতেন—যেন ঐশ্বর্য্যজনিত কোন দম্ভ বা অভিমান তাঁহার নাই।
জামাল খাঁর একমাত্র কন্যা এই আনার উন্নিসা। এই আনার উন্নিসাকে তিনি এক দুষ্কৃতাচারীর হস্তে সমর্পণ করিতে নিতান্তই নারাজ। সুজা খাঁর রূঢ় পত্রখানি পাইবার পূর্ব্ব পর্য্যন্ত, অন্ততঃ তাঁহার মনের এরূপ একটা দৃঢ়তা ছিল। পরলোকগত পত্নীর অন্তিম বাসনা পূর্ণ করিতে, তিনি খুবই উৎসুক ছিলেন।
কিন্তু এই পত্রখানি পাওয়ার পর হইতে তাহার মন ভাঙ্গিয়া গেল। তাঁহার দৃঢ় সংকল্প ভাসিয়া গেল। পত্নীর নিকট তাঁহার মৃত্যুশয্যা পার্শ্বের সেই পবিত্র প্রতিশ্রুতি, মীরলতিফের কুতোপ কাজের কৃতজ্ঞতা, সবই তিনি ভুলিয়া গেলেন। প্রচণ্ড স্রোততরঙ্গ মধ্যে সহসা নিমজ্জিত ব্যক্তি আত্মরক্ষার জন্য, যেমন তৃণখণ্ডকেও আশ্রয় মনে করিয়া বাঁচিতে চেষ্টা করে, জামাল খাঁ, তাঁহার ইজ্জত রক্ষার জন্য, সেইরূপ আনারকে সুজাখাঁর হস্তে সমর্পণ করিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইলেন।
অন্তরমধস্থ এক গুপ্তবাণী যেন তাঁহাকে বলিয়া দিল—“তোমার কন্যার ভাগ্যে যাহা আছে, তাহা লঙ্ঘন করাইবার তুমি কে? তাহার পরিবর্ত্তনের শক্তি তোমার কই? বিধাতা যার সঙ্গে যার মিলনের ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন—সে ব্যবস্থার রদ করিতে পার, এমন ক্ষমতাই বা কই তোমার? কত লোকে চেষ্টা চরিত্র করিয়া বড়লোকের বাটীতে কন্যার বিবাহ দিবার জন্য, কতই না প্রয়াস পায়। বিনা চেষ্টায় যদি এই প্রয়াসফল তোমার হস্তগত হয়, মুর্খের মত তাহা ছাড়িয়া দিতেছ কেন? নবাব সুজাখাঁর মত শক্তিশালী লোকের সহিত শত্রুতা ঘটিলে তোমার মান ইজ্জত সবই নষ্ট হইবে। সত্য বটে, সুজাখাঁর চরিত্র নিষ্কলঙ্ক নহে। কিন্তু পতিপরায়ণা সাধ্বী রমণীর শক্তি যে কত বেশী, তাহা ত তুমি ভাব নাই? হয়তঃ তুমিই একদিন দেখিবে,এই দুশ্চরিত্র নবাব—তোমার কন্যার একান্ত যত্নে চেষ্টায় ও শক্তিতে দেবচরিত্র হইয়া উঠিয়াছে।”
অন্তর্বাণীর এই সব কথায়, জামালখাঁর প্রাণের বোঝাটা খুবই কমিয়া গেল। একটু আগেই তিনি ভাবিতেছিলেন, কন্যার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি তাহাকে অপাত্রে সমর্পণ করিয়া বড়ই একটা অন্যায় কাজ করিতেছেন। কিন্তু এই ভাবের চিত্তায় বিবেকের সে তীক্ষ্ণ দংশন জ্বালাটা যেন খুবই কমিয়া গেল।
বলা বাহুল্য—হতভাগ্য মীর লতিফের সহিত প্রতিশ্রুতির কথাটা, তিনি তাঁহার চিত্ত হইতে একাবারে মুছিয়া ফেলিলেন। খালি তাই নয়, সেই দিনই তিনি—ছাউনীতে মীর লতিফের সহিত দেখা করিয়া, তাহাকে সমস্ত ঘটনা খুলিয়া বলিলেন। আর এটুকুও তাঁহাকে বুঝাইয়া দিলেন, যে আনারের সহিত যখন নবাব সুজা বেগের বিবাহ সম্বন্ধ স্থির হইয়া গিয়াছে, তখন তাহার সহিত এখন অত ঘন ঘন দেখা করাটা তার পক্ষে সুযুক্তিকর নহে।
মীর লতিকের বুকে, প্রচণ্ড শেলের মত এই সাংঘাতিক কথাগুলি আঘাত করিল। এই আঘাতে তাহার হৃদয় শতধা বিচ্ছিন্ন হইল। সে যে ভবিষ্যৎ সুখস্বপ্নের একটা উজ্জ্বল দীপ্তিতে মোহিত হইয়া, সংসারের বুকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল, সেই দীপ্তিটা যেন সহসা নিভিয়া গেল। সে দেখিল— তাঁহার অন্তরে, বাহিরে, সূচীভেদ্য প্রলয়ের অন্ধকার।
আর মীর লতিফের সহিত সাক্ষাত সময়ে তাহার সহিত যে যে কথাবার্ত্তা হইয়াছিল, আনারউন্নিসার পিতা, তাহার সকল গুলিই গৃহে ফিরিয়া আসিয়া, কন্যার নিকট ব্যক্ত করিলেন। আর এটুকুও তাঁহার কন্যাকে তিনি বুঝাইয়া দিলেন, যে এতবড় কথাটা শুনিয়াও মীর লতিফ, একটুও বিচলিত হয় নাই! বরঞ্চ সে এ সংবাদে যেন খুবই আহ্লাদিত হইয়াছে।
নবাব সুজা বেগের সহিত কন্যার বিবাহটা দিয়া ফেলিতে পারিলেই, তিনি একটা লজ্জাস্কর হীন ঋণদায় হইতে মুক্তি লাভ করিতে পারিবেন, এতজ্জনিত একটা আনন্দ উচ্ছ্বাসে অধীর হইয়া, পর দিনই তিনি নবাব সুজা বেগের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বিবাহের দিন স্থির করিয়া আসিলেন। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে এ কথাটাও স্থির হইয়া গেল, যে বিবাহের দিনই নবাব ঋণপত্রখানি তাঁহাকে ফেরৎ দিবেন।
আর এতটা আত্মসমর্পণ, এতটা আনুরক্তি, এতটা আত্মীয়তা, এতটা স্নেহ, যে দুনিয়ার ঘটনা স্রোতের ঘূর্ণাবর্ত্তে পড়িয়া, একাবারে তৃণখণ্ডের মত শতধা চূর্ণ হইয়া ভাসিয়া যাইতে পারে, হতভাগ্য মীর লতিফ, কেবল তাহাই ভাবিতে লাগিল।
ঋণঘটিত এই বাধ্য বাধকতার জন্যই যে এই বিবাহে জামালখাঁকে মত দিতে হইয়াছে, ইহাও সে বুঝিল। সে মনে মনে ভাবিল—“হায়! আজ আমার যদি এ অর্থ টা থাকিত?”
সহিষ্ণুতা, মীর লতিফের স্বভাবগত। বাল্যকাল হইতে দুঃখের ক্রোড়ে যারা লালিত পালিত হয়, সহিষ্ণুতাটা তাহারা খুবই আয়ত্ত্ব করিয়া রাখে।
এজন্য যখন সে জামালখাঁর নিকট এই সংবাদ প্রথমে শুনিল, তখন সে সাহসও সহিষ্ণুতা সঞ্চয়ে, মনটাকে তাহার শক্তির অধীন করিয়া ফেলিল। আর এই শক্তির প্রভাব এতটা বেশী, যে জামালখাঁ, অনেকক্ষণ ধরিয়া লক্ষ্য করিয়াও তাহার মুখভাবের কোনরূপ বৈলক্ষণ্য লক্ষ্য করিতে পারিলেন না। এই জন্যই জামাল খাঁর মনে একটা সংস্কার জন্মিল, যে এই বিবাহ ব্যাপারে সে একটুও বিস্মিত নহে। আর এই কারণেই জামাল খাঁ তাঁহার কন্যাকে বলিয়াছিলেন মীরলতিফ, এ ব্যাপারে একটুও দুঃখিত হয় নাই।
দূর্ভাগ্য মীরলতিফ মনে মনে নানাদিক দিয়া বিচার করিয়া সিদ্ধান্ত করিল—যখন আনারকে পাইবার সকল আশাই অতল কালস্রোতে ভাসিয়া গেল, তখন আগরা ত্যাগ করিয়া, এই প্রলোভনের মুখ হইতে দূরে থাকাই ভাল।
ইতিপূর্ব্বে সে আনারউন্নিসাকে যখন অ্ন্যস্থানে তাহার বদলী হইবার কথাটা বলে, তখন আনারউন্নিসা বড়ই বিষণ্ণ হইয়া পড়িয়াছিল। আর লতিফও আনারের মলিন মুখ দেখিয়া তাহাকে আশ্বাস দিয়াছিল, চেষ্টা করিলে এ স্থান পরিবর্ত্তনের আদেশ বন্ধ করান যাইতে পারে। কিন্তু ইহার দুই চারি দিন পরেই এই ব্যাপার ঘটায়, সে তাহা রদ্ করাইবার কোন চেষ্টাই করিল না। সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়াছে, যে প্রলোভনের পথ ত্যাগ করিবে।