কুড়ি

 সেদিন প্রাতঃকালটা হঠাৎ একটা ঘন কুয়াশায় সমস্ত অস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। রায়মশাই সেইমাত্র শয্যাত্যাগ করিয়া বাহিরে আসিয়াছিলেন; একজন ভদ্রব্যক্তিকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া কহিলেন, কে ও?

 আমি নির্মল, বলিয়া জামাতা কাছে আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল। এই আকস্মিক আগমনে তিনি কোনরূপ বিস্ময় বা হর্ষ প্রকাশ করিলেন না। চাকরদের ডাকিয়া বলিলেন, কে আছিস রে, নির্মলের জিনিসপত্রগুলো সব হৈমর ঘরে রেখে আয়। তা গাড়িতে কষ্ট হয়নি ত বাবা? খোকা, হৈম, এরা সব ভাল আছে ত?

 নির্মল ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, সকলে ভাল আছে।

 রায়মহাশয় কহিলেন, কিন্তু একা এলে কেন নির্মল, মেয়েটাকে সঙ্গে আনলে ত আর একবার দেখা হতো?

 নির্মল বলিল, দু'-চার দিনের জন্যে আবার―

 রায়মশাই ঈষৎ হাস্য করিলেন; বলিলেন, একি দু’-চার দিনের ব্যাপার বাবা, দু’-চার মাসের দরকার। যাও, ভেতরে যাও―মুখ-হাত ধোও গে।

 নির্মল ভিতরে আসিয়া দেখিল এখানেও সেই একই ভাব। যে প্রকারেই হোক তাহার আসার সম্ভাবনা কাহারও অবিদিত নয়, এবং সেজন্য কেহই প্রসন্ন নহেন। মুখ-হাত ধোয়া, কাপড় ছাড়া প্রভৃতি সমাধা হইলে গরম চা এবং কিছু জলখাবার শ্বশ্রুঠকুরানী স্বহস্তে আনিয়া জামাতাকে নিজে খাওয়াইতে বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হৈম কি আসতে চাইলে না।

 নির্মল কহিল, না।

 তারা জানে তুমি কেন আসছ?

 নির্মল মাথা নাড়িয়া বলিল, জানে বৈ কি, সমস্তই জানে।

 তবু মানা করলে না?

 তাঁহার প্রশ্ন ও কণ্ঠস্বরে নির্মল পীড়া অনুভব করিয়া বলিল, মানা কেন করবে মা? সে ত জানে আমি অন্যায় কাজে কোনদিনই হাত দিইনে।

 আর তার বাপই কেবল অন্যায় কাজে হাত দিয়ে বেড়ায়, এই কি সে জানে নির্মল? বলিয়া তিনি ক্ষণকাল নতমুখে স্থির থাকিয়া অকস্মাৎ আবেগের সহিত বলিয়া উঠিলেন, তা সে যাই কেন না জানুক বাছা, এ তুমি করতে পারবে না―এ কাজে তোমাকে আমি কোনমতেই নামতে দিতে পারব না। শ্বশুর-জামাইয়ে লড়াই করবে, গাঁয়ের লোক তামাসা দেখবে, তার আগে আমি জলে ডুব দিয়ে মরব, তোমাকে বলে রাখলাম বাবা।

 নির্মল আস্তে আস্তে বলিল, কিন্তু যে পীড়িত, যে অসহায়, তাকে রক্ষা করাই ত আমাদের ব্যবসা মা।

 শাশুড়ী কহিলেন, কিন্তু ব্যবসাই ত মানষের সমস্ত নয় বাছা। উকিল-ব্যারিস্টারের মা-বোন আছে, স্ত্রী আছে, শ্বশুর-শাশুড়ী আছে―গুরুজনের মান-মর্যাদা রাখার ব্যবস্থা সংসারে তাদের জন্যেও তৈরি হয়েছে।

 নির্মল ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হয়েছে বৈ কি মা, নিশ্চয় হয়েছে। তাহার পরে সমস্ত ব্যাপারটা লঘু করিয়া দিবার অভিপ্রায়ে একটু হাসিয়া বলিল, আর শেষ পর্যন্ত হয়ত লড়াই-ঝগড়া কিছুই না হতে পারে।

 গৃহিণীর মুখ তাহাতে প্রসন্ন হইল না, কহিলেন, পারে, কিন্তু সে শুধু তোমার শ্বশুরের সর্বরকমে হার হলেই পারে। কিন্তু তার পরে আর তাঁর রায়মশাই হয়ে এ গ্রামে বাস করা চলবে না। তাছাড়া ষোড়শী দুর্বলও নয়, অসহায়ও নয়। তার ঠাঙাড়ে ডাকাতের দল আছে, তাকে জমিদার ভয় করে। তার একখানা চিঠির জোরে মানষে পাঁচ শ’ ক্রোশ দূর থেকে ঘরদোর ছেলেপুলে ফেলে চলে আসে, আমরা যা এক শ’ খানা চিঠিতে পারিনে। তারা হলো ভৈরবী, তুকতাক মন্ত্রতন্ত্র কত কি জানে। তা সে থাক ভাল, যাক ভাল, আমার ক্ষতি নেই―তার পাপের ভরা সে-ই বইবে, কিন্তু চোখের ওপর আমার নিজের মেয়ের সর্বনাশ আমি হতে দেব না নির্মল, তা লোকে যাই বলুক আর যাই করুক।

 নির্মল স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। যেভাবেই হোক, এদিকে জানাজানি হইতেও কিছু বাকী নাই এবং ষড়যন্ত্রেরও কোন ত্রুটি ঘটে নাই। তাহার শ্বশুর সকল আঁটঘাট বাঁধিয়া রাখিয়াছেন, ছিদ্র বাহির করিবার জো নাই। তাহার চুপচাপ প্রকৃতির শাশড়ীঠাকুরানী যে এমন মজবুত করিয়া কথা কহিতে জানেন, ইহা সে মনে করে নাই, এবং যাহা কিছু কহিলেন সে যে তাঁহার নিজের কথা তাহাও সে মনে করিল না, কিন্তু জবাব দিবারও কিছু খাঁজিয়া পাইল না। এই আর্জি যিনি মুসাবিদা করিয়া আর একজনের মুখে গুঁজিয়া দিয়াছেন, তিনি সকল দিক চিন্তা করিয়াই দিয়াছেন এবং ইহাও তাঁহার অবিদিত নাই, যে নিছক পরোপকার মানসেই সে যে পশ্চিমের একপ্রাপ্ত হইতে স্ত্রীপুত্র ফেলিয়া চলিয়া আসিয়াছে, এ উত্তর সে কোনমতেই মুখ দিয়া বাহির করিতে পারিবে না।

 ঘণ্টা-দুই বিশ্রাম করার পর নির্মল যখন বাটীর বাহির হইল, তখন কর্তা সদরে বসিয়া ছিলেন! কিন্তু কোথায়, কি বৃত্তান্ত ইত্যাদি নিরর্থক প্রশ্নে সময় নষ্ট করিলেন না, শুধু একটু সকাল সকাল ফিরিবার অনুরোধ করিয়া বলিয়া দিলেন যে, এই শ্রান্ত দেহে অধিক বেলায় স্নানাহার করিলে অসুখ করিতে পারে।

 শিরোমণিমহাশয় পাশে বসিয়া কি বলিতেছিলেন, উঁকি মারিয়া দেখিয়া সবিস্ময়ে কহিলেন, বাবাজী―না?

 রায়মহাশয় বলিলেন, হাঁ।

 শিরোমণি ডাকিয়া আলাপ করিবার উদ্যম করিতেই জনার্দন বাধা দিয়া বলিলেন, নির্মল পালাচ্চে না, তোমার কথাটা শেষ কর, আমাকে উঠতে হবে।

 নির্মল নিঃশব্দে বাহির হইয়া আসিল। তাহার শ্বশুর যে তাহাকে অতি-কৌতূহলী প্রতিবেশীর অপ্রিয় জেরার দায় হইতে দয়া করিয়া অব্যাহতি দিলেন, ইহা অনুভব করিয়া তাহার মুখ রাঙ্গা হইয়া উঠিল।

 ষোড়শীর সহিত সে দেখা করিতে চলিয়াছিল! দিন-দুই পূর্বে যে উৎসাহ লইয়া, মনের ভিত্তিগাত্রে যে ছবি আঁকিয়া লইয়া সে তাহার প্রবাস-গৃহ ত্যাগ করিয়াছিল, সে আর ছিল না। যে স্বপ্ন সুদীর্ঘ যাত্রাপথের সকল দুঃখ তাহার হরণ করিয়াছিল, শ্বশুর ও শাশুড়ীর অব্যক্ত ও ব্যক্ত অভিযোগের আক্রমণে এইমাত্র তাহা লণ্ডভণ্ড হইয়া গিয়াছিল। সমবেত ও প্রবল শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া তাহার একক পৌরুষে নিরাশ্রয়ের অবলম্বন, দুর্বল, পরিত্যক্ত, নির্জিত নারীর নিঃস্বার্থ বন্ধুরূপে এই গ্রামে পদার্পণ করিতে চাহিয়াছিল। তাহার কত না বল, কত না শোভা, কিন্তু আসিয়া দেখিল তাহার নকল কার্যেরই ইতিমধ্যে একটা কারণ প্রকাশ হইয়া গেছে। তাহা যেমন কদর্য, তেমনি কালো। কালিতে লেপিয়া একাকার হইতে আর বাকী কিছু নাই। শ্বশুরকে কোনদিন আদর্শ পুরুষ মনে করে নাই; তিনি পল্লীগ্রামের বিষয়ী লোক, সামান্য অবস্থা হইতে যথেষ্ট সঞ্চয় করিয়াছেন, অতএব পরলোকের খরচের পাতাটিও সাদা পড়িয়া থাকিবার কথা নয়, ইহা সে বেশ জানিত এবং মনে মনে ক্ষমাও করিত; কিন্তু আজ যখন সে মন্দিরের প্রাচীর ঘুরিয়া পায়ে-হাঁটা সেই সরু পথ ধরিয়া ষোড়শীর কুটির অভিমুখে পা বাড়াইল, তখন সংক্ষুব্ধ চিত্ততরে তাহার একদিকে শ্বশুরের বিরুদ্ধে যেমন বিদ্বেষ ও ঘৃণা নিবিড় হইয়া দেখা দিল, তেমনি অন্যদিকে বিশেষ কিছু না জানিয়াও ষোড়শীর প্রতি অভিমান বিরক্তিতে মন তিক্ত হইয়া উঠিল। মনে মনে বার বার করিয়া বলিতে লাগিল, যে স্ত্রী অনাত্মীয় অপরিচিতপ্রায় পুরুষের কৃপাভিক্ষা করিয়া পত্রদ্বারা আহ্বান করিবার সঙ্কোচ অনুভব করে না, এবং সেকথা নির্লজ্জ দাম্ভিকার ন্যায় পথে-ঘাটে প্রচার করিয়া বেড়ায়, তাহাকে আর যাহাই হোক সম্মানের উচ্চ আসনে বসানো চলে না। কিন্তু অকস্মাৎ কিন্তু তাহার এইখানে বাধা পাইয়া থামিল। পত্রবহুল মনসাগাছের বাঁক ফিরিতেই তাহার উৎসুক দৃষ্টি সন্নিকটবর্তিনী ষোড়শীর আনত মুখের উপর গিয়া পড়িল। সে প্রাঙ্গণের বাহিরে দাঁড়াইয়া একমনে বেড়ার দড়ি বাঁধিতেছিল, আগন্তুকের পদশব্দ শুনিতে পাইল না, এবং ক্ষণকালের জন্য নির্মল না পারিল নড়িতে, না পারিল চোখ ফিরাইতে। এই ত সেদিন, তবুও তাহার মনে হইল এ সে ভৈরবী নয়। অথচ পরিবর্তন যে কোন্‌খানে তাহাও ধরিতে পারিল না! সেই রাঙাপাড়ের গৈরিক শাড়ি-পরা, তেমনি রুক্ষ এলোচুল, গলায় তেমনি রুদ্রাক্ষের মালা, তেমনি মুখের উপরে উপবাসের একটি শীর্ণ ছায়া―সিঁদুর মাখানো ত্রিশূলটি পর্যন্ত তেমনি হাতের কাছে ঠেস দিয়ে রাখা―কিছু বদলায় নাই, তবুও অপরিচিত, অজানা মোহে তাহাকে মুহূর্ত কয়েকের নিমিত্ত স্তম্ভিত করিয়া দিল। দড়ির গ্রন্থি টানিয়া দিয়া ষোড়শী মুখ তুলিয়াই একটু চমকিত হইল, কিন্তু পরক্ষণেই দড়ি ছাড়িয়া দিয়া স্নিগ্ধমধুর হাসিয়া সুমুখে আসিয়া কহিল, আসুন, আমার ঘরে আসুন।

 নির্মল অপ্রস্তুত হইয়া বলিল, কিন্তু আপনার কাজে যে বাধা দিলাম।

 ষোড়শী সকৌতুকে মুচকিয়া হাসিয়া কহিল, বেড়া-বাঁধা বুঝি আমার কাজ? আর হলোই বা কাজ, কুটুম্বকে খাতির করাটা বুঝি কাজ নয়? শ্বশুরবাড়িতে জামাইয়ের আদর হয়নি, কিন্তু শালীর কুঁড়েঘর থেকে ভগিনীপতিকে অনাদরে ফিরতে দেব না। আসুন, ঘরে গিয়ে বসবেন চলুন। খোকা, হৈম, চাকর-বাকর সব ভাল আছে? আপনি নিজে ভাল আছেন?

 নির্মল কেমন যেন সংকুচিত হইয়া পড়িল। ঘাড় নাড়িয়া কহিল, সবাই ভাল আছে, কিন্তু আজ আর বসব না।

 ষোড়শী কহিল, কেন শুনি? তারপরে কণ্ঠস্বর নত করিয়া আরও একটু কাছে আসিয়া বলিল, একদিন হাত ধরে অন্ধকারে পার করে এনেছিলাম মনে পড়ে? দিনেরবেলায় ওতে আর কাজ নেই, কিন্তু চলুন বলচি। যে এতদূর থেকে টেনে আনতে পারে, সে এটুকুও টেনে নিয়ে যেতে পারবে।

 নির্মল লজ্জাবোধ করিল, আঘাত পাইল। এই আচরণ, এই কথা ষোড়শীর মুখে কেবল অপ্রত্যাশিত নয়, অচিন্ত্যনীয়। বিদুষী সন্ন্যাসিনী ভৈরবীকে সে শান্তসমাহিত দৃঢ়, এমনকি কঠোর বলিয়া জানিত। সংসারে রমণীর পর্যায়ভুক্ত করিয়া কল্পনা করিতে যেন তাহার বাধিত। তাহাকে অনেক ভাবিয়াছে―কর্মের মধ্যে বিশ্রামের মধ্যে এই ষোড়শীকে সে চিন্তা করিয়াছে―সমস্ত অন্তর রসে ভরিয়া উঠিয়াছে, কিন্তু কখনও চিন্তাকে সে পদ্ধতি দিবার, শঙ্খলিত করিবার সাহস পর্যন্ত করে নাই। কিন্তু সেই ষোড়শী আজ যখন অপ্রত্যাশিত আত্মীয়তার অতি-ঘনিষ্ঠতায় অকস্মাৎ নিজেকে ছোট করিয়া, মানবী করিয়া, সাধারণ মানবের কামনার আয়ত্তাধীন করিয়া দিল, নির্মল অন্তরের একপ্রান্তে যেমন বেদনা বোধ করিল, তেমনি আর একপ্রান্ত তাহার কি একপ্রকার কলুসিত আনন্দে একনিমেষে পরিপ্লুত হইয়া গেল।

 নির্মলকে ঘরে আনিয়া ষোড়শী কম্বল পাতিয়া বসিতে দিল, জিজ্ঞাসা করিল, পথে কষ্ট হয়নি?

 নির্মল বলিল, না। কিন্তু মন্দিরে আজ আপনার কাজ নেই?

 ষোড়শী কহিল, অর্থাৎ আজ মন্দিরের রবিবার কিনা! তাহার পরে বলিল, কাজ আছে, সকালে একদফা করেও এসেচি। যেটুকু বাকী আছে সেটুকু বেলাতে করলেও হবে। হাসিয়া কহিল, জামাইবাবু, এ আপনাদের কোর্ট-কাছারি নয়, মন্দির। ঠাকুর-দেবতারা তাদের দাসদাসীদের কখনো মুহূর্তের ছুটি দেন না, কানে ধরে চব্বিশ ঘণ্টা সেবা করিয়ে নিয়ে তবে ছাড়েন।

 কিন্তু এ চাকরি ত আপনি ইচ্ছে করেই নিয়েচেন।

 ইচ্ছে করে? তা হবে। বলিয়া ষোড়শী সহসা একটুখানি হাসিয়া কহিল, আচ্ছা, আসার একটু খবর দিলেন না কেন?

 নির্মল কহিল, সময় ছিল না। কিন্তু তার শাস্তিস্বরূপ শ্বশুরবাড়িতে যে খাতির পাইনি, অন্ততঃ তাঁরা যে আমাকে দেখে খুশী হননি, এ কথা আপনি জানলেন কি করে? এবং আমার আসার সংবাদ আসার পূর্বেই কে প্রচার করে দিল বলতে পারেন?

 ষোড়শী কহিল, বলতে পারিনে, কিন্তু আন্দাজ করতে পারি।

 নির্মল বলিল, আন্দাজ করতে ত আমিও পারি, কিন্তু সত্যি কে করেচে এবং কোথায় সে খবর পেলে, জানেন ত আমাকে বলুন। আশা করি আপনার দ্বারা একথা প্রকাশ হয়নি।

 ষোড়শী কহিল, হাসিল, কোন আশা করতেই আমি কাউকে নিষেধ করিনে। কিন্তু জেনে আপনার লাভ কি? আপনি এসেচেন এ খবরও সত্যি, আমারই জন্যে এসেচেন একথাও ঠিক। তার চেয়ে বরঞ্চ বলুন, আসা সার্থক হবে কিনা? আমাকে উদ্ধার করতে পারবেন কিনা?

 নির্মল কহিল, প্রাণপণে চেষ্টা করব বটে।

 যদি কষ্ট হয় তবুও?

 নির্মল ঘাড় নাড়িয়া বলিল, যদি কষ্ট হয় তবুও!

 ষোড়শী হাসিয়া ফেলিল। নির্মল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া নিজেও একটু হাসিয়া বলিল, হাসলেন যে?

 ষোড়শী কহিল, হাসচি―আগেকার দিনে ভৈরবীরা বিদেশী মানুষদের ভেড়া বানিয়ে রাখত। আচ্ছা, ভেড়া নিয়ে তারা কি করত? চরিয়ে বেড়াত, না লড়াই বাধিয়ে দিয়ে তামাশা দেখত। বলিতে বলিতেই সে একেবারে ছেলেমানুষের মত উচ্ছ্বসিত হইয়া হাসিতে লাগিল।

 নির্মলের দেহ-মন পুলকে নৃত্য করিয়া উঠিল। এই কঠিন আবরণের নীচে যে রহস্যপ্রিয় কৌতুকময়ী চঞ্চল নারীপ্রকৃতি চাপা দেওয়া আছে, তাহার অপর্যাপ্ত হাসির প্রস্রবণ যে ব্রতোপবাসের সহস্রবিধ কৃচ্ছ্রসাধনায় আজও শুকায় নাই―ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নির ন্যায় সে তেমনি জীবন্ত―এই কথা স্মরণ করিয়া সর্বশরীরে তাহার কাঁটা দিল। পরিহাসে নিজেও যোগ দিয়া হাসিয়া কহিল, হয়ত বা মাঝে মাঝে মায়ের স্থানে বলি দিয়ে খেতো। অর্থাৎ আমার শ্বশুর কিংবা শাশুড়ীঠাকরুন ইতিমধ্যে আপনার কাছে এসেছিলেন, এবং অনেক অপ্রিয় অসত্য শুনিয়ে গেছেন।

 ষোড়শী কহিল, না, তাঁরা কেউ আসেন নি। আমি যে মন্ত্রেতন্ত্রে সিদ্ধিলাভ করেচি এটা অসত্য হতে পারে, কিন্তু অপ্রিয় হবে কেন নির্মলবাবু? তা ছাড়া আপনার আসার ধরন দেখে নিজেরই সন্দেহ হচ্ছে হয়ত বা নিতান্ত মিথ্যা না হতেও পারে। তাহার মুখে হাসির আভাস লাগিয়াই রইল, কিন্তু গলার শব্দ বদলাইয়া গেল। ওষ্ঠপ্রান্তে ও কণ্ঠস্বরে সহসা যেন আর সঙ্গতি রহিল না।

 নির্মল আশ্চর্য, অবাক হইয়া রহিল। ইহার কতটুকু পরিহাস এবং কতখানি তিরস্কার, এবং কিসের জনা তাহা সে কিছুতে ভাবিয়া পাইল না।

 ষোড়শী নিজেও আর কিছু কহিল না, কিন্তু তাহার আনত মুখের পরে যে অপ্রত্যাশিত লজ্জার আরক্ত আভা পলকের নিমিত্ত ছায়া ফেলিয়া গেল, ইহা তাহার চোখে পড়িল। কিন্তু সে ঐ পলকের জন্যই। ষোড়শী আপনাকে সামলাইয়া লইয়া মুখ তুলিয়া হাসিমুখে কহিল, কুটুমের অভ্যর্থনা ত হলো। অবশ্য হাসি-খুশি দিয়ে যতটুকুই পারি ততটুকুই―তার বেশী ত সম্বল নেই ভাই―এখন আসুন, বরঞ্চ কাজের কথা কওয়া থাক।

 তাহার ঘনিষ্ঠ সম্ভাষণকে এবার সে সংশয়ের সহিত গ্রহণ করিতে চাইল, তবুও তাহার মন ভিতরে ভিতরে উল্লসিত হইয়া উঠিল। কহিল, বলুন।

 ষোড়শী কহিল, দুটি লোক দেবতাকে বঞ্চিত করতে চায়। একটি রায়মহাশয়, আর একটি জমিদার―

 নির্মল বলিল, আর একটি আপনার বাবা। এঁরাই ত আপনাকেও বঞ্চিত করতে চান।

 বাবা? হ্যাঁ, তিনিও বটে। এই বলিয়া ষোড়শী চুপ করিয়া রহিল।

 নির্মল বলিল, আমার শ্বশুরের কথা বুঝি, আপনার বাবার কথাও কতক বুঝতে পারি, কিন্তু পারিনে এই জমিদার প্রভুটিকে বুঝতে। তিনি কিসের জন্য আপনার এত শত্রুতা করেন?

 ষোড়শী বলিল, দেবীর অনেকখানি জমি তিনি নিজের বলে বিক্রি করে ফেলতে চান, কিন্তু আমি থাকতে সে কোনমতেই হবার জো নাই।

 নির্মল সহাস্যে কহিল, সে আমি সামলাতে পারব। বলিয়া সে কটাক্ষে ভৈরবীর মুখের প্রতি লক্ষ্য করিয়া দেখিল, ষোড়শী নীরব হইয়া আছে, কিন্তু তাহার মুখের কোন পরিবর্তন ঘটে নাই। খানিক পরে মুখ তুলিয়া ধীরে ধীরে কহিল, কিন্তু আরও অনেক জিনিস আছে, যা আপনিও হয়ত সামলাতে পারবেন না।

 কি সে-সব? একটা ত আপনার মিথ্যে দুর্নাম?

 ষোড়শী কোনরূপ উত্তেজনা প্রকাশ করিল না; শান্তস্বরে বলিল, সে আমি ভাবিনে। দুর্নাম সত্যি হোক, মিথ্যে হোক, তাই নিয়েই ত ভৈরবীর জীবন নির্মলবাবু! আমি এই কথাটাই তাঁদের বলতে চাই।

 নির্মল বিস্মিত হইয়া কহিল, এই কথা নিজের মুখে বলতে চান? সে যে স্বীকার করার সমান হবে।

 ষোড়শী চুপ করিয়া রহিল।

 নির্মল সসঙ্কোচে কহিল, ওরা যে বলে―

 কারা বলে?

 অনেকেই বলে সে সময়ে আপনি―

 কোন্‌ সময়ে?

 নির্মল ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া অভ্যস্ত সঙ্কোচ সবলে দমন করিয়া বলিল, সেই ম্যাজিস্ট্রেট আসার দিনে। তখন আপনার কোলের উপরেই নাকি―

 ষোড়শী একটু আশ্চর্য হইয়া কহিল, তারা কি দেখেছিল নাকি? তা হবে, আমার ঠিক মনে নাই―যদি দেখে থাকে, তা সত্যি, জমিদারের মাথা আমিই কোলে করে বসেছিলাম।

 নির্মল স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। অনেকক্ষণ পরে আস্তে আস্তে কহিল, তার পরে?

 ষোড়শী শান্ত মুখখানি হাসির আভাসে একটু উজ্জ্বল করিয়া বলিল, তার পরে? দিন কেটে যাচ্চে! কিন্তু কিছুতেই আর মন বসাতে পারিনে! সবই যেন মিথ্যা বলে ঠেকে।

 কি মিথ্যে?

 সব। ধর্ম, কর্ম, ব্রত, উপবাস, দেবসেবা, এতদিনের যা-কিছু সমস্তই―

 তবু ভৈরবীর আসন চাই?

 চাই বৈ কি। আর আপনি যদি বলেন, চাই না―

 না, না, আমি কিছুই বলিনে। এই বলিয়া নির্মল তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, বেলা হয়ে যাচ্চে―এখন আমি চললাম।

 ষোড়শী সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইল, কহিল, আমারও মন্দিরের কাজ আছে। কিন্তু আবার কখন দেখা হবে?

 নির্মল অনিশ্চিত অস্ফুটকণ্ঠে কি একটা কহিল, ভাল শোনা গেল না। ষোড়শী হঠাৎ বলিয়া উঠিল, ভাল কথা, সন্ধ্যার পর আজই ত আমাকে নিয়ে মন্দিরে একটা হাঙ্গামা আছে, আসবেন?

 নির্মল ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইয়া বাহির হইয়া গেল। ষোড়শী মুচকিয়া একটু হাসিল, তার পরে কুটীরের দ্বারে শিকল তুলিয়া দিয়া মন্দিরের অভিমুখে বহির্গত হইল।