তেইশ

 ব্যারিস্টার সাহেব চলিয়া গেছেন, ষোড়শী যাইতেছে―মন্দিরের চাবি-তালা সরঞ্জাম প্রভৃতি যাহা কিছু মূল্যবান সমস্ত আদায় হইয়া গেছে, ইত্যাদি সংবাদ রাষ্ট্র হইয়া পড়িতে কিছুমাত্র বিলম্ব ঘটিল না। শিরোমণি আনন্দের আবেগে মুক্তকচ্ছ আলুথালু বেশে রায়মহাশয়ের সদরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

 নির্মলের যাবার সময়ে বিদায়ের পালাটা বিশেষ প্রীতিকর হয় নাই। মনে মনে বোধ করি এই-সকল আলোচনাতেই জনার্দনের মখমণ্ডল গম্ভীর ভাব ধারণ করিয়াছিল। কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য করিবার অবস্থা শিরোমণির ছিল না, তিনি আশীর্বাদের ভঙ্গীতে ডান হাত তুলিয়া গদগদ-কণ্ঠে কহিলেন, দীর্ঘজীবী হও ভায়া, সংসারে এসে বুদ্ধি ধরেছিলে বটে!

 জনার্দন মুখ তুলিয়া কহিলেন, ব্যাপার কি?

 শিরোমণি বলিলেন, ব্যাপার কি! দশখানা গাঁয়ে রাষ্ট্র হতে বাকী আছে নাকি? বেটী চাবিপত্র যা-কিছ, সমস্ত দিয়ে চলে যাচ্ছে যে। বলি, শোননি নাকি?

 যে ভদ্রলোক সকাল হইতে বসিয়া এ মাসে সুদের কিছু টাকা মাপ করিতে অনুনয় বিনয় করিতেছিল, সে কহিল, বেশ! যজ্ঞেশ্বর জানলেন না, আর খবর পেলেন ঘেঁটুমনসা? এ-সব করলে কে শিরোমণি খুড়ো, সমস্তই ত রায়মশাই।

 শিরোমণি আসন গ্রহণ করিয়া বলিলেন, কিন্তু আসল চাবিটা শুনেচি নাকি গিয়ে পড়েচে জমিদারের হাতে? ব্যাটা পাঁড় মাতাল―দেখো ভায়া, শেষকালে মায়ের সিন্দুকের সোনারূপো না ঢুকে যায় শুঁড়ির সিন্দুকে। পাপের আর অবধি থাকবে না।

 ক্রমশঃ একে একে গ্রামের অনেকেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। স্থির হইল, জমিদারের হাত হইতে চাবিটা অবিলম্বে উদ্ধার করা চাই। বেলা তৃতীয় প্রহরে ঘুম ভাঙ্গিয়া হুজুর যখন মদ খাইতে আরম্ভ করিবেন, তাঁহার মাতাল হইয়া পড়িবার পূর্বেই সেটা হস্তগত করা প্রয়োজন। সেটা তাঁহার হাতে যাওয়ার সম্বন্ধে জনার্দন নিজের সামান্য একটু ত্রুটি ও অবিবেচনা স্বীকার করিয়া লইয়াই কহিলেন, সমস্ত স্থির করে রেখেছিলাম, হঠাৎ উনি যেন মাঝ থেকে চাবি হাত করবেন, সেটা আর খেয়াল করিনি। এখন সহজে দিলে হয়। দশ দিন পরে হয়ত বলে বসবে, কৈ কিছুই ত সিন্দুকে ছিল না। কিন্তু আমরা সবাই জানি, ভায়া, ষোড়শী আর যাই কেন না করুক, মায়ের সম্পত্তি অপহরণ করবে না―একটি পাই পয়সা না।

 সকলে এ কথা স্বীকার করিল। অনেকের এমনও মনে হইল, ইহার চেয়ে বরঞ্চ সে-ই ছিল ভাল।

 এই দল যথাসময়ে এবং যথোচিত সমারোহে যখন জমিদারের শান্তিকুঞ্জে আসিয়া উপস্থিত হইল, জমিদার তখন বাহিরের ঘরে বসিয়া। মদের বোতল ও গ্লাসের পরিবর্তে—জমিদারির মোটা মোটা খাতাপত্র তাঁহার সম্মুখে। একধারে বসিয়া তাঁহার সহচর প্রফুল্লচন্দ্র খবরের কাগজ পড়িতেছিল, সে-ই সকলকে অভ্যর্থনা করিয়া বসাইল।

 শিরোমণি সকলের অগ্রে কথা কহেন, এবং সকলের শেষে অনুতাপ করেন; এ ক্ষেত্রেও তিনিই কথা কহিলেন, বলিলেন, হুজুরের পাছে নিদ্রার ব্যাঘাত হয়, তাই একটু বিলম্ব করেই আমরা সকলে―

 জীবানন্দ খাতাপত্র এক পাশে ঠেলিয়া রাখিয়া সহাস্যে কহিলেন, বিলম্ব না করে এলেও হুজুরের নিদ্রার ব্যাঘাত হতো না শিরোমণিমশায়, কারণ দিনের বেলা তিনি নিদ্রা দেন না।

 কিন্তু আমরা যে শুনি হুজুর―

 শোনেন? তা আপনারা অনেক কথা শোনেন যা সত্য নয়, এবং অনেক কথা বলেন যা মিথ্যে। এই যেমন আমার সম্বন্ধে ভৈরবীর কথাটা――, বলিয়া বক্তা হাস্য করিলেন, কিন্তু শ্রোতার দল থতমত খাইয়া একেবারে মুষড়িয়া গেল। জীবানন্দ কহিলেন, কিন্তু যে জন্যে ত্বরা করে আসতে চেয়েছিলেন তার হেতুটা শুনি?

 জনার্দন রায় নিজেকে কথঞ্চিৎ সামলাইয়া লইলেন, মনে মনে কহিলেন, এত ভয়ই বা কিসের? প্রকাশ্যে বলিলেন, মন্দির সংক্রান্ত গোলযোগ যে এত সহজে নিষ্পত্তি করতে পারা যাবে তা আশা ছিল না। নির্মল যে-রকম বেঁকে দাঁড়িয়েছিল―

 জীবানন্দ কহিলেন, তিনি সোজা হলেন কি করে?

 এই ব্যঙ্গ জনার্দন অনভব করিলেন, কিন্তু শিরোমণি তাহার ধার দিয়াও গেলেন না, খুশী হইয়া সদর্পে কহিলেন, সমস্তই মায়ের ইচ্ছা হুজুর, সোজা যে যেতেই হবে। পাপের ভার তিনি আর সইতে পারছিলেন না।

 জীবানন্দ ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, তাই হবে! তার পরে?

 শিরোমণি বলিলেন, কিন্তু পাপ ত দূর হলো, এখন―বল না জনার্দন, হুজুরকে সমস্ত বুঝিয়ে বল না? এই বলিয়া তিনি রায়মশায়কে হাত দিয়া ঠেলিলেন।

 জনার্দন চকিত হইয়া কহিলেন, মন্দিরের চাবি ত আমরা দাঁড়িয়ে থেকেই তারাদাস ঠাকুরকে দিইয়েছি। আজ তিনি সকালে মায়ের দোর খুলেচেন, কিন্তু সিন্দুকের চাবিটা শুনতে পেলাম ষোড়শী হুজুরের হাতে সমর্পণ করেছে!

 জীবানন্দ সায় দিয়া কহিলেন, তা করেচে। জমাখরচের খাতাও একখানা দিয়েচে।

 শিরোমণি বলিলেন, বেটী এখনও আছে, কিন্তু কখন যে কোথায় চলে যায় সে ত বলা যায় না।

 জীবানন্দ মহূর্তকাল বৃদ্ধের মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু সেজন্যে আপনাদের এত উদ্বেগ কেন?

 উত্তরের জন্য তিনি জনার্দনের প্রতি চাহিলেন। জনার্দন সাহস পাইয়া কহিলেন, দলিলপত্র, মূল্যবান তৈজসাদি, দেবীর অলঙ্কার প্রভৃতি যা কিছু আছে গ্রামের প্রাচীন ব্যক্তিরা সমস্তই জানেন। শিরোমণিমশায় বলছেন যে, ষোড়শী থাকতে থাকতেই সেগুলো সব মিলিয়ে দেখলে ভাল হয়। হয়ত―

 হয়ত নেই―এই না? কিন্তু না থাকলেই বা আপনারা আদায় করবেন কি করে?

 জনার্দন সহসা জবাব খুঁজিয়া পাইলেন না, শেষে বলিলেন, তবু ত জানা যাবে হুজুর।

 কিন্তু আজ আমার সময় নাই রায়মশাই।

 জনার্দন মনে মনে উল্লসিত হইয়া উঠিলেন, প্রায় এইপ্রকার ফন্দি করিয়াই তাঁহারা আসিয়া ছিলেন। শিরোমণি ব্যগ্র হইয়া কহিলেন, চাবিটা জনার্দন ভায়ার হাতে দিলে আজই সন্ধ্যার পূর্বে আমরা সমস্ত মিলিয়ে দেখতে পারি। হুজুরেরও আর কোন দায়িত্ব থাকে না,―কি আছে না আছে সে পালাবার আগেই সব জানা যায়। কি বল ভায়া? কি বল হে তোমরা? ঠিক না?

 সকলেই এ প্রস্তাবে সম্মতি দিল, দিল না কেবল যাহার হাতে চাবি। সে শুধু একটু ঈষৎ হাসিয়া কহিল, ব্যস্ত কি শিরোমণিমশায়, যদি কিছু নষ্ট হয়েই থাকে ত, ভিখিরীর কাছ থেকে আর আদায় হবে না। আপনারা আজ আসুন, আমার যেদিন অবসর হবে, মিলিয়ে দেখতে আপনাদের সকলকেই আমি সংবাদ দেব।

 ফন্দি খাটিল না দেখিয়া সবাই মনে মনে রাগ করিল। রায়মহাশয় উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, কিন্তু দায়িত্ব একটা―

 জীবানন্দ তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া কহিলেন, সে ত ঠিক কথা রায়মশায়। দায়িত্ব একটা আমার রইল বৈ কি।

 দ্বারের বাহির হইয়াই শিরোমণি জনার্দনের গা টিপিয়া কহিলেন, দেখলে ভায়া, ব্যাটা মাতালের ভাব বোঝাই ভার। গুয়োটা কথা কয় যেন হেঁয়ালি। মদে চুর হয়ে আছে। বাঁচবে না বেশী দিন।

 জনার্দন শুধু বলিলেন, হুঁ। যা ভয় করা গেল, তাই হ’লো দেখছি।

 শিরোমণি কহিলেন, এবারে গেল সব শুঁড়ির দোকানে? বেটী যাবার সময় আচ্ছা জব্দ করে গেল।

 একজন কহিল, হুজুর চাবি আর দিচ্ছেন না।

 শিরোমণি উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, আবার! এবার চাইতে গেলে গলা টিপে মদ খাইয়ে দিয়ে তবে ছাড়বে! কথাটা উচ্চারণ করিয়াই তাহার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল।

 ঘরের মধ্যে জীবানন্দ খোলা দ্বারের দিকে শূন্যদষ্টিতে চাহিয়া স্থির হইয়া বসিয়াছিল, প্রফুল্ল কহিল, দাদা, আবার একটা নতুন হাঙ্গামা জড়ালেন কেন, চাবিটা ওঁদের দিয়ে দিলেই ত হতো।

 জীবানন্দ তাহার মুখের প্রতি চক্ষু ফিরাইয়া কহিল, হতো না প্রফুল্ল, হলে দিতাম। পাছে এই দুঘটনা ঘটে বলেই সে কাল রাতে আমার হাতে চাবি দিয়েছে।

 প্রফুল্ল মনে মনে বোধ হয় ঠিক বিশ্বাস করিতে পারিল না, জিজ্ঞাসা করিল, সিন্দুকে আছে কি?

 জীবানন্দ একটু হাসিয়া কহিল, কি আছে? আজ সকালে তাই আমি খাতাখানা পড়ে দেখছিলাম। আছে মোহর, টাকা, হীরে, পান্না, মক্তোর মালা, মকুট, নানারকম জড়োয়া গয়না, কত কি দলিলপত্র, তাছাড়া সোনারূপোর বাসনকোসনও কম নয়। কতকাল ধরে জমা হয়ে এই ছোট্ট চণ্ডীগড়ের ঠাকুরের যে এত সম্পত্তি সঞ্চিত আছে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। চুরি-ডাকাতির ভয়ে ভৈরবীরা বোধ করি কাউকে জানতেও দিত না।

 প্রফুল্ল সভয়ে কহিল, বলেন কি! তার চাবি আপনার কাছে? একমাত্র পুত্র সমপর্ণ ডাইনীর হাতে?

 জীবানন্দ রাগ করিল না, কহিল, নিতান্ত মিথ্যা বলনি ভায়া, এত টাকা দিয়ে আমি নিজেকেও বিশ্বাস করতে পারতাম না। ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, অথচ, এ আমি চাইনি প্রফুল্ল। আমি যতই তাকে পীড়াপীড়ি করলাম জনার্দন রায়কে দিতে, ততই সে অস্বীকার করে জামার হাতে গুঁজে দিলে।

 প্রফুল্ল নিজেও ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, এর কারণ?

 জীবানন্দ কহিল, বোধ হয় সে ভেবেছিল, এ দুর্নামের ওপর আবার চুরির কলঙ্ক চাপলে তার আর সইবে না। এদের সে চিনেছিল।

 প্রফুল্ল বলিল, কিন্তু সে আপনাকে চিনতে পারেনি।

 জীবানন্দ হাসিল, কিন্তু সে হাসিতে আনন্দ ছিল না; কহিল, সে দোষ তার, আমার নয়। তার সম্বন্ধে অপরাধ আমার আর যতদিকেই থাক, আমাকে চিনতে না পারার অপরাধ গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত আমি একটা দিনের তরেও করিনি। কিন্তু আশ্চর্য এই পৃথিবী, এবং তার চেয়েও আশ্চর্য এই মানুষের মন। এ যে কি থেকে কি ঠিক করে নেয়, কিছুই বলবার জো নেই। এর যুক্তিটা কি জানো ভায়া, সেই যে তার হাত থেকে মরফিয়া নিয়ে চোখ বুজে খাওয়ার গল্পটা তোমার কাছে করেছিলাম, সেই হলো তার সকল তর্কের শেষ তর্ক, সকল বিশ্বাসের বড় বিশ্বাস। কিন্তু সে রাত্রে আর কোন উপায় ছিল না, এদিকেও মরি, ওদিকেও মরি―সে ছাড়া আর কারও পানে চাইবার পথ ছিল না―এ-সমস্ত ষোড়শী একদম ভুলে বসে আছে, শুধু একটি কথা তার মনে জেগে রয়েছে, যে নিজের প্রাণটা নিঃসংশয়ে তার হাতে দিতে পেরেছিল, তাকে অবিশ্বাস করা যায় কি করে? ব্যাস, যা-কিছু ছিল সমস্ত দিলে চোখ বুজে আমার হাতে তুলে। প্রফুল্ল, দুনিয়ার ভয়ানক চালাক লোকও মাঝে মাঝে মারাত্মক ভুল করে বসে, নইলে সংসার একেবারে মরুভূমি হয়ে দাঁড়াতো, কোথাও রসের বাষ্পটুকু জমবার ঠাঁই পেত না।

 প্রফুল্ল ঘাড় নাড়িয়া কহিল, অতিশয় খাঁটি কথা দাদা। অতএব অবিলম্বে খাতাখানা পড়িয়ে ফেলুন, তারাদাস ঠাকুরকে ডেকে ধমক দিন―জমানো মোহরগুলোয় যদি সলোমন সাহেবের দেনাটা শোধা যায় ত, শব্দ রসের বাষ্প কেন, মুষলধারে বর্ষণ শুরু হতে পারবে।

 জীবানন্দ কহিল, প্রফল্ল এই জন্যেই তোমাকে এত পছন্দ করি।

 প্রফুল্ল হাত জোড় করিয়া বলিল, এই পছন্দটা এইবার একটু খাটো করতে হবে দাদা। রসের উৎস আপনার অফুরন্ত হোক, কিন্তু মোসাহেবি করে এ অধীনের গলার চুঙ্গি পর্যন্ত কাঠ হয়ে গেল, এইবার একবার বাইরে গিয়ে দুটো ডালভাতের জোগাড় করতে হবে। কাল-পরশু আমি বিদায় নিলাম।

 জীবানন্দ হাসিয়া কহিল, একেবারে নিলে? কিন্তু এইবার নিয়ে ক’বার নেওয়া হ’লো প্রফুল্ল?

 বার-চারেক। এই বলিয়া সে নিজেও হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, ভগবান মুখটা দিয়েছিলেন, তা বড়লোকের প্রসাদ খেয়েই দিন গেল; দুটো বড় কথাও যদি না মাঝে মাঝে বার করতে পারি নিতান্তই এর জাত যায়। নেহাত অপরাধও নেই দাদা। বহুকাল ধরে আপনাদের জলকে কখনো উঁচু কখনো নিচু বলে এ দেহটায় মেদ মাংসই কেবল শ্রীবৃদ্ধিলাভ করেচে, সত্যিকারের রক্ত বলতে বোধ করি ছিটেফোঁটাও আর বাকী নেই। আজ ভাবছি এক কাজ করব। সন্ধ্যার আবছায়ায় গা-ঢাকা দিয়ে খপ্ করে ভৈরবী ঠাকরুনের এক খামচা পায়ের ধূলো নিয়ে গিলে ফেলব। আপনার অনেক ভালমন্দ দ্রব্যই ত আজ পর্যন্ত উদরস্ত করেচি, এ নইলে সেগুলা আর হজম হবে না, পেটে লোহার মত ফুটবে।

 জীবানন্দ হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, আজ উচ্ছ্বাসের কিছু বাড়াবাড়ি হচ্ছে প্রফুল্ল।

 প্রফুল্ল পুনশ্চ হাত জোড় করিয়া কহিল, তাহলে বসুন দাদা, এটা শেষ করি। মোসাহেব-পেন্সন বলে সেদিন যে উইলখানায় হাজার-পাঁচেক টাকা লিখে রেখেচেন, সেটার ওপরে দয়া করে একটা কলমের আঁচড় দিয়ে রাখবেন―চণ্ডীর টাকাটা হাতে এলে মোসাহেবের অভাব হবে না, কিন্তু আমাকে দান করে অতগলো টাকার আর দুর্গতি করবেন না।

 জীবানন্দ কহিল, তাহলে এবার আমাকে তুমি সত্যি সত্যিই ছাড়লে?

 প্রফুল্ল তেমনি করজোড়ে কহিল, আশীর্বাদ করুন, এই সুমতিটুকু শেষ পর্যন্ত যেন বজায় থাকে।

 জীবানন্দ মৌন হইয়া রহিল!

 প্রফুল্ল জিজ্ঞাসা করিল, কবে যাচ্ছেন তিনি?

 জানিনে!

 কোথায় যাচ্ছেন তিনি?

 তাও জানিনে।

 প্রফুল্ল কহিল, জেনেও ত কোন লাভ নেই দাদা। সহসা তাহার মুখের চেহারা বদলাইয়া গেল, কহিল বাপ রে! মেয়েমানুষ ত নয়, যেন পুরুষের বাবা। মন্দিরে দাঁড়িয়ে সেদিন অনেকক্ষণ চেয়েছিলাম, মনে হল, যেন পা থেকে মাথা পর্যন্ত একেবারে পাথরে গড়া। ঘা মেরে গুঁড়ো করা যাবে, কিন্তু আগুনে গলিয়ে যে ইচ্ছেমত ছাঁচে ঢেলে গড়বেন, সে বস্তুই নয়। পারেন ত মতলবটা পরিত্যাগ করবেন।

 জীবানন্দ কতকটা বিদ্রূপের ভঙ্গীতে প্রশ্ন করিল, তা হলে প্রফুল্ল এবার নিতান্তই যাচ্চে?

 প্রফুল্ল সবিনয়ে জবাব দিল, গুরুজনের আশীর্বাদের জোর থাকে ত মনস্কামনা সিদ্ধ হবে বৈ কি।

 জীবানন্দ কহিল, তা হতে পারে। কিন্তু কি করবে স্থির করেচ?

 প্রফুল্ল বলিল, অভিলাষ ত আপনার কাছে ব্যক্ত করেছি। প্রথমে চারটি ডালভাতের যোগাড়ের চেষ্টা করব।

 জীবানন্দ কয়েক মুহূর্ত নীরবে থাকিয়া প্রশ্ন করিল, ষোড়শী সত্যই চলে যাবে তোমার মনে হয়?

 প্রফুল্ল কহিল, হয়। তার কারণ, সংসারে সবাই প্রফুল্ল নয়। ভাল কথা দাদা, একটা খবর আপনাকে দিতে ভুলেছিলাম। কাল রাত্রে নদীর ধারে বেড়াচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি সেই ফকিরসাহেব। আপনাকে যিনি একদিন তার বটগাছে ঘুঘু শিকার করতে দেননি―বন্দুক কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। কুর্নিশ করে কুশলপ্রশ্ন করলাম, ইচ্ছে ছিল মুখরোচক দুটো খোশামোদ-টোশামোদ করে যদি একটা কোন ভালরকমের ওষুধ-টষুধ বার করে নিতে পারি ত আপনাকে ধরে পেটেণ্ট নিয়ে বেচে দু’পয়সা রোজগার করব। কিন্তু ব্যাটা ভারী চালাক, সেদিক দিয়েই গেল না। কথায় কথায় শুনলাম তাঁর ভৈরবী মাকে দেখতে এসেছিলেন, এখন চলে যাচ্ছেন। ভৈরবী যে সমস্ত ছেড়ে যাচ্চেন, তাঁর কাছেই শুনতে পেলাম।

 জীবানন্দ কৌতূহলী হইয়া উঠিল, কহিল, এর সদুপদেশেই বোধ করি তিনি চলে যাচ্ছেন?

 প্রফুল্ল ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না। বরঞ্চ এঁর উপদেশের বিরুদ্ধেই তিনি চলে যাচ্ছেন।

 জীবানন্দ উপহাস করিয়া কহিল, বল কি প্রফুল্ল, ফকিরসাহেব শুনি যে তার গুরু। গুরু-আজ্ঞা লঙ্ঘন?

 প্রফুল্ল কহিল, এ ক্ষেত্রে তাই বটে!

 কিন্তু এতবড় বিরাগের হেতু?

 প্রফুল্ল কহিল, বিরাগের হেতু আপনি। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, কি জানি এ কথা আপনাকে শোনানো ভাল হবে কি না, কিন্তু ফকিরের বিশ্বাস আপনাকে তিনি মনে মনে অত্যন্ত ভয় করেন―পাছে কলহ-বিবাদের মধ্য দিয়েও আপনার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যায়, এই তাঁর সকলের চেয়ে বড় ভয়। নইলে দেশের লোককে তিনি ভয় করেন নি।

 জীবানন্দ বিস্ফারিত চক্ষে তাহার প্রতি নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।

 প্রফুল্ল একটুখানি হাসিয়া কহিল, দাদা, ভগবান আপনাকেও বুদ্ধি বড় কম দেননি, কিন্তু সর্বস্ব সমর্পণ করে কাল তিনিই মারাত্মক ভুল করলেন, কি হাত পেতে নিয়ে আপনি মারাত্মক ভুল করলেন, সে মীমাংসা আজ বাকী রয়ে গেল, যদি বেঁচে থাকি ত একদিন দেখতে পাবো আশা হয়!

 জীবানন্দ এ কথারও কোনও উত্তর দিল না, তেমনি নীরবে বসিয়া রহিল।

 সন্ধ্যা হয়-হয়, বেহারা পাত্র ভরিয়া মদ আনিয়া উপস্থিত করিল; জীবানন্দ হাত নাড়িয়া কহিল, নিয়ে যা―দরকার নেই।

 ভৃত্য বঝিতে না পারিয়া দাঁড়াইয়া থাকিলে প্রফুল্ল কহিল, কখন দরকার সেইটে বলে দিন না।

 জীবানন্দ সহসা কখন যেন অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল, প্রফুল্লর প্রশ্নে চোখ তুলিয়া কহিল, এখন ত নিয়ে যা―দরকার হলে ডেকে পাঠাবো। সে চলিয়া যাইতেছিল, জীবানন্দ ডাকিয়া কহিল, হাঁ রে, তোদের চা আছে?

 প্রফুল্ল কহিল, শোন কথা! চা নেই ত আমি বেঁচে আছি কি করে?

 তবে, তাই একবাটি নিয়ে আয়।

 বেহারা প্রস্থান করিলে প্রফুল্ল প্রশ্ন করিল, অকস্মাৎ অমৃতে অরুচি যে?

 জীবানন্দ বলিল, অরুচি নয়―কিন্তু আর খাবো না।

 প্রফুল্ল হাসিল, এবং ক্ষণেক পূর্বে তাহারই প্রতি প্রযুক্ত বিদ্রূপ ফিরাইয়া দিয়া কহিল, এই নিয়ে ক’বার হ’লো দাদা?

 জীবানন্দ রাগ করিল না, সেও হাসিয়া তাহারই অনুকরণ করিয়া কহিল, এ মীমাংসাটাও আজ না হয় বাকী থাক প্রফুল্ল, যদি বেঁচে থাকো ত একদিন দেখতে পাবে আশা করি।

 প্রফুল্ল মুখ টিপিয়া শুধু একটু হাসিল, প্রত্যুত্তর করিল না।

 চাকর আলো দিয়ে গেল। ক্রমশঃ সন্ধ্যার অন্ধকার যখন বাহিরে গাঢ় হইয়া আসিতেছিল, জীবানন্দ হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, যাই একটু ঘরে আসি―

 প্রফুল্ল আশ্চর্য হইয়া কহিল, কৈ, কাপড় ছাড়লেন না?

 থাক গে!

 আপনার সহচর?

 সেও থাক। আজ একলাই ঘুরতে চললাম।

 প্রফুল্ল ভয়ানক আপত্তি করিয়া বলিল, না না, সে হয় না দাদা! অন্ধকার রাত, পথে ঘাটে আপনার অনেক শত্রু। এই বলিয়া সে তাড়াতাড়ি দেরাজ হইতে পিস্তল বাহির করিয়া হাতে গুঁজিয়া দিতে গেল।

 জীবানন্দ দুই-পা পিছাইয়া গিয়া কহিল, ওকে আর আমি ছুঁচ্চিনে প্রফুল্ল―

 প্রফুল্ল বিস্ময়ে অবাক হইয়া কহিল, হঠাৎ হলো কি দাদা? না হয় পাইকদের ডেকে দিই, তাদের কেউ সঙ্গে যাক।

 জীবানন্দ মাথা নাড়িয়া কহিল, না, তাও না। আজ থেকে আমি এমনি একলা বার হব, যেন কোথাও কোন শত্রু নেই আমার, আর আমার থেকে কারও কোন ভয় না হোক; তার পরে যা হয় তা আমার ঘটুক―আমি কারও কাছে নালিশ করব না। এই বলিয়া সে অন্ধকারে ধীরে ধীরে একাকী বাহির হইয়া গেল।