তের

 জমিদারের নিভৃত-নিবাস সাজাইতে গুছাইতে দিন-চারেক গিয়াছে। জনশ্রুতি এইরূপ যে, হুজুর এবার একাদিক্রমে মাস-দুই চণ্ডীগড়ে বিশ্রাম করিয়া যাইবেন। আজ সকালবেলাতেই উত্তরদিকের বড় হলটায় মজলিশ বসিয়াছিল। ঘরজোড়া কার্পেট পাতা, তাহার উপরে সাদা জাজিম বিছানো এবং মাঝে মাঝে দুই-চারিটা মোটা তাকিয়া ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত। গৃহের একধারে আজ গ্রামের মাতব্বরেরা সার দিয়া বসিয়াছিলেন―জমিদারের কাছে তাঁহাদের মস্ত নালিশ ছিল। রায়মহাশয় ছিলেন, শিরোমনি ছিলেন, ঘোষজা ছিলেন, বোসজা ছিলেন, এমন কি তারাদাস ঠাকুরও ইঁহাদের আড়ালে মুখ নীচু করিয়া ও কান খাড়া করিয়া সর্তক হইয়া বসিয়া ছিলেন। আরও যাঁহারা ছিলেন তাঁহাদের কেহই যদিচ অবহেলার বস্তু নহেন, তবুও ইঁহাদের নাম ধাম ও বিবরণ সবিস্তারে বিদিত না হইলেও পাঠকের জীবন দুর্ভর হইয়া উঠিবে না বিবেচনা করিয়া তাহাতে নিরস্ত হইলাম। যাই হোক, ইঁহাদের সমবেত চেষ্টায় অভিযোগের ভূমিকাটা একপ্রকার শেষ হইয়া গেলেও আসল কথাটি উঠি-উঠি করিয়াও থামিয়া যাইতেছিল―ঠিক যেন মুখে আসিয়াও কাহারও বাহির হইতে চাহিতেছিল না।

 জীবানন্দ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। সকলের সঙ্গে থাকিয়াও একটুখানি দূরে একটা তাকিয়ার উপর দুই কনুয়ের ভর দিয়া বসিয়া তিনি মন দিয়াই যেন সমস্ত শুনিতেছিলেন। মন প্রফুল্ল। একেবারে স্বাভাবিক না হইলেও সম্পূর্ণ কৃত্রিম বলিয়াও সন্দেহ হয় না। খুব সম্ভব মদের ফেনা তখনও তাঁহার মগজের সমস্ত অলিগলি দখল করিয়া বসে নাই। সুমুখের খোলা দরজা দিয়া বারুইয়ের শুকনা ঢালু ও ভিজা মাটির গন্ধ বাতাসে ভাসিয়া আসিতেছিল, এবং পাশের ঘরটাতেই বোধ করি রান্না হইতেছিল বলিয়া তাহারই রুদ্ধ দ্বারের কোন একটা ফাঁক দিয়া এক-জাতীয় শব্দ ও গন্ধ মাঝে মাঝে এই বাতাসেই ভর দিয়া লোকের কানে ও নাকে আসিয়া পৌঁছিতেছিল, তাহা ব্যক্তিবিশেষের কাছে উপাদেয় ও রুচিকর হইলেও শিরোমণিমহাশয় চঞ্চল হইয়া উঠিতেছিলেন। হঠাৎ তিনি বার-দুই কাশিয়াও উত্তরীয় প্রান্তে নাকের ডগাটা মার্জনা করিয়া, উঠিয়া গিয়া আর এক ধারে বসিতেই জীবানন্দ সহাস্যে কহিলেন, শিরোমণিমহাশয়ের কি অর্ধভোজন হয়ে গেল নাকি?

 অনেকেই হাসিয়া উঠিল, শিরোমণির নাকের ডগার মত মুখখানাও রাঙ্গা হইয়া উঠিল। জীবানন্দ তখন হাসিয়া বলিলেন, ভয় নেই ঠাকুর, জাত যাবে না; ওটা আপনাদের মা চণ্ডীরই মহাপ্রসাদ। তবে যিনি রাঁধচেন তাঁর গোত্রটি ঠিক জানিনে, হয়ত এক না হতেও পারে।

 শিরোমণি আপনাকে কতকটা সামলাইয়া লইয়া কহিলেন, তা হোক, তা হোক। ব্রাহ্মণ পাচক―দরিদ্র হলেও একটা গোত্র আছে বৈ কি।

 জীবানন্দ হাঃ হাঃ করিয়া উচ্চহাস্য করিয়া কহিলেন, জানিনে ঠাকুর, ও-সব বালাই ওর কিছু আছে কি না। কিন্তু হাতা, বেড়ির সঙ্গে মিলে সোনার চুড়ির আওয়াজটাও আমার বড় মিঠে লাগে। অব সেই হাতে পরিবেশন করলে―তা নিমন্ত্রণ করলে ত আর―বলিয়া তিনি পুনশ্চ প্রবল হাসির শব্দে ঘর ভরিয়া দিলেন।

 শিরোমণি অধোবদন হইলেন, এবং ভিতরের কদর্য ব্যাপার যদিও সকলেই জানিতেন; তথাপি এই অভাবনীয় প্রকাশ্য নির্লজ্জতায় উপস্থিত কেহই লোকটার মুখের প্রতি সহসা চাহিতে পর্যন্ত পারিল না।

 হাসি থামিলে তিনি কহিলেন, সদালাপ ত হলো। এবং দয়া করে মাঝে মাঝে এলে এমন আরও ঢের হতে পারবে, কিন্তু আপনাদের নালিশটা কি শুনি?

 কিন্তু উত্তরে কাহারও মুখে কথা ফুটিল না, সকলে যেমন নীরবে বসিয়া ছিল তেমনি নীরবে বসিয়া রহিল।

 জীবানন্দ কহিলেন, বলতে কি আপনাদের লজ্জাবোধ হচ্ছে?

 এবার রায়মহাশয় মুখ তুলিয়া চাহিলেন; বলিলেন, নন্দীমশাই ত সমস্ত জানেন, তিনি কি হুজুরের গোচর করেন নি?

 জীবানন্দ কহিলেন, হয়ত করেছেন, কিন্তু আমার মনে নেই। তা ছাড়া, তার গোচর করার প্রতি বেশি আস্থা না রেখে ব্যাপারটা আপনারাই বলুন। দ্বিরুক্তি দোষ ঘটতে পারে, কিন্তু কি আর করা যাবে। জমিদারের গোমস্তা―একটা মোকাবিলা হয়ে থাকা ভাল। ঠিক না?

 প্রভুর মুখে এককড়ির এই সুখ্যাতিটুকুকে রায়মহাশয় মনে মনে আনন্দ লাভ করিলেন। কিন্তু চাঞ্চল্য প্রকাশ না করিয়া পরম গাম্ভীর্যের সহিত বলিলেন, হুজুর সর্বজ্ঞ। ভৃত্যের সম্বন্ধে যথা ইচ্ছা আদেশ করতে পারেন, কিন্তু আমাদের অভিযোগ―

 কি অভিযোগ?

 জনার্দন রায় কহিলেন, আমরা গ্রামস্থ ষোল আনা ইতর-ভদ্র একত্র হয়ে―

 জীবানন্দ একটু হাসিয়া বলিলেন, তা দেখতে পাচ্চি। ওইটি কি সেই ভৈরবীর বাপ তারাদাস ঠাকুর নয়? এই বলিয়া তিনি তাহার প্রতি অঙ্গুলিসঙ্কেত করিলেন।

 তারাদাস সাড়া দিল না, জাজিমটার অংশবিশেষের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া নিঃশব্দে বসিয়া রহিল, এবং রায়মহাশয়ের আনত মুখের ’পরেও একটা ফ্যাকাশে ছায়া পড়িল। কিন্তু মুখরক্ষা করিলেন শিরোমণিঠাকুর। তিনি সবিনয়ে কহিলেন, রাজার কাছে প্রজা সন্তানতুল্য, তা দোষ করিলেও সন্তান, না করলেও সন্তান। আর কথাটা একরকম ওরই। ওর কন্যা ষোড়শী সম্বন্ধে আমরা নিশ্চয় স্থির করেছি, তাকে আর মহাদেবীর ভৈরবী রাখা যেতে পারে না। আমাদের নিবেদন, হুজুর তাকে সেবায়েতের কাজ থেকে অব্যাহতি দেবার আদেশ করুন।

 জমিদার চকিত হইয়া উঠিলেন, কহিলেন, কেন? তার অপরাধ?

 দুই-তিনজন প্রায় সমস্বরে জবাব দিয়া ফেলিল, অপরাধ নিরতিশয় গুরুতর।

 জীবানন্দ একে একে তাহাদের মুখের দিকে চাহিয়া অবশেষে জনার্দনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, তিনি হঠাৎ এমন কি ভয়ানক দোষ করেচেন রায়মহাশয়, যার জন্য তাঁকে তাড়ানো আবশ্যক?

 জনার্দন মুখ তুলিয়া শিরোমণিকে চোখের ইঙ্গিত করিতেই জীবানন্দ বাধা দিয়া কহিলেন, না, না, উনি অনেক পরিশ্রম করেচেন, বুড়োমানুষকে আর কষ্ট দিয়ে কাজ নেই, ব্যাপারটা আপনিই ব্যক্ত করুন।

 রায়মহাশয়ের চোখে ও মুখে দ্বিধা ও অত্যন্ত সঙ্কোচ প্রকাশ পাইল, মৃদুকণ্ঠে কহিলেন, ব্রাহ্মণকণ্যা―এ আদেশ আমাকে করবেন না।

 জীবানন্দ হাসিমুখে কহিলেন, দেব-দ্বিজে আপনার অচলা ভক্তির কথা এদিকে কারও অবিদিত নেই। কিন্তু এতগুলি ইতর-ভদ্রকে নিয়ে আপনি নিজে যখন উপস্থিত হয়েচেন তখন ব্যাপার যে অতিশয় গুরুতর তা আমার বিশ্বাস হয়েচে। কিন্তু সেটা আপনার মুখ থেকেই শুনতে চাই।

 কিন্তু জনার্দন রায় অত সহজে ভুল করবার লোক নহেন; প্রত্যুত্তরে তিনি শিরোমণির প্রতি একটা রুদ্ধদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন, হুজুর যখন নিজে শুনতে চাচ্ছেন তখন আর ভয় কি ঠাকুর? নির্ভয়ে জানিয়ে দিন না।

 খোঁচা খাইয়া বৃদ্ধ শিরোমণি হঠাৎ ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, সত্যি কথায় ভয় কিসের জনার্দন? তারাদাসের মেয়েকে আর আমরা কেউ ভৈরবী রাখব না হুজুর! তার স্বভাব-চরিত্র ভারী মন্দ হয়ে গেছে―এই আপনাকে আমরা জানিয়ে দিচ্চি।

 জীবানন্দের পরিহাস-দীপ্ত প্রফুল্ল মুখ অকস্মাৎ গম্ভীর ও কঠিন হইয়া উঠিল; একমুহূর্ত নিঃশব্দে থাকিয়া ধীরে ধীরে প্রশ্ন করিলেন, তাঁর স্বভাব-চরিত্র মন্দ হবার খবর আপনারা নিশ্চয় জেনেছেন?

 তৎক্ষণাৎ অনেকে একবাক্যে বলিয়া উঠিল যে, ইহাতে কাহারও কোন সংশয় নাই―এ গ্রামসুদ্ধ সবাই জানিয়াছে। জনার্দন মুখে কিছু না কহিলেও চুপ করিয়া মাথা নাড়িতে লাগিলেন। জীবানন্দ আবার ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া তাঁহারই মুখের প্রতি চাহিয়া কহিলেন, তাই সুবিচারের আশায় বেছে বেছে একেবারে ভীষ্মদেবের কাছে এসে পড়েছেন রায়মহাশয়? বিশেষ সুবিধে হবে বলে ভরসা হয় না।

 এ কথার ইঙ্গিত সকলে বুঝিল কিনা সন্দেহ, কিন্তু জনার্দন এবং শিরোমণি বুঝিলেন। জনার্দন মৌন হইয়া রহিলেন, কিন্তু শিরোমণি জবাব দিলেন। বলিলেন, আপনি দেশের রাজা―সুবিচার বলুন, অবিচার বলুন, আপনাকেই করতে হবে। আমাদের তাই মাথা পেতে নিতে হবে। সমস্ত চণ্ডীগড় ত আপনারই।

 কথা শুনিয়া জীবানন্দের মুখের ভাব একটু সহজ হইয়া আসিল; মুচকিয়া হাসিয়া কহিলেন, দেখুন শিরোমণিমশাই, অতি-বিনয়ে আপনাদের খুব হেঁট হয়ে কাজ নেই, অতি-গৌরবে আমাকেও আকাশে তোলবার আবশ্যক নেই। আমি শুধু জানতে চাই, এ অভিযোগ কি সত্য?

 সাগ্রহে রায়মহাশয়ের মুখ আশান্বিত হইয়া উঠিল। শিরোমণি ত একেবারে চঞ্চল হইয়া উঠিলেন; কহিলেন, অভিযোেগ? সত্য কি না! আচ্ছা, আমরা না হয়, কিন্তু তারাদাস, তুমিই বল ত! রাজদ্বার! যথাধর্ম বলো―

 তারাদাস একবার পাংশু, এবার রাঙ্গা হইয়া উঠিতে লাগিল, কিন্তু উপস্থিত সকলের একাগ্র দৃষ্টি খোঁচা দিয়া যেন তাহাকে উত্তেজিত করিতে লাগিল। সে একবার ঢোক গিলিয়া, একবার কণ্ঠের জড়তা সাফ করিয়া অবশেষে মরিয়ার মত বলিয়া উঠিল, হুজুর―

 জীবানন্দ চক্ষের নিমেষে হাত তুলিয়া তাহাকে থামাইয়া দিয়া কহিলেন, থাক। ওর মুখ থেকে ওর নিজের মেয়ের কাহিনী আমি যথাধর্ম বললেও শুনব না। বরঞ্চ আপনাদের কেউ পারেন ত যথাধর্ম বলুন।

 সভা পুনশ্চ নীরব হইল, কিন্তু এবার সে নীরবতার মধ্য হইতে অস্ফুট উদ্যম পরিস্ফুট হইবার লক্ষণ দেখা দিল। পাশের দরজা খুলিয়া বেহারা টম্‌ব্লার ভরিয়া হুইস্কি ও সোডা প্রভুর হাতে আনিয়া দিল; তিনি এক নিঃশ্বাসে তাহা নিঃশেষে পান করিয়া ভৃত্যের হাতে ফিরাইয়া দিয়া কহিলেন, আঃ―বাঁচলাম। একটু হাসিয়া কহিলেন, সকালবেলাতেই আপনাদের বাক্যসুধা পান করে তেষ্টায় বুক পর্যন্ত কাঠ হয়ে গিয়েছিল! কিন্তু চুপচাপ যে! কি হলো আপনাদের যথাধর্মের?

 শিরোমণি হতবুদ্ধি হইয়া বলিয়া উঠিলেন, এই যে বলি হুজুর, আমি যথাধর্ম বলব।

 জীবানন্দ ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, সম্ভব বটে। আপনি শাস্ত্রজ্ঞ প্রবীণ ব্রাহ্মণ, কিন্তু একজন স্ত্রীলোকের নষ্ট-চরিত্রের কাহিনী তার অসাক্ষাতে বলার মধ্যে আপনার যথাধর্মের যথাটা যদি বা থাকে, ধর্মটা থাকবে কি? আমার নিজের বিশেষ কোন আপত্তি নেই―ধর্মাধর্মের বালাই আমার বহুদিন ঘুচে গেছে, তবু আমি বলি ওতে কাজ নেই। বরঞ্চ আমি যা জিজ্ঞাসা করি তার জবাব দিন। বর্তমান ভৈরবীকে আপনারা তাড়াতে চান―এই না?

 সবাই একযোগে মাথা নাড়িয়া জানাইল, ঠিক তাই।

 এঁকে নিয়ে আর সুবিধে হচ্ছে না?

 জনার্দন প্রতিবাদের ভঙ্গীতে মাথা তুলিয়া কহিলেন, সুবিধে অসুবিধে কি হুজুর, গ্রামের ভালোর জন্যেই প্রয়োজন।

 জীবানন্দ হঠাৎ হাসিয়া ফেলিয়া বলিলেন, অর্থাৎ গ্রামের ভালমন্দ আলোচনা না তুলেও এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, আপনার নিজের ভালমন্দ কিছু একটা আছেই। তাড়াবার আমার ক্ষমতা আছে কি না জানিনে, কিন্তু আপত্তি বিশেষ নেই। কিন্তু আর কোন একটা অজুহাত তৈরী করা যায় না? দেখুন না চেষ্টা করে। বরঞ্চ আমাদের এককড়িটিকেও না হয় সঙ্গে নিন, এ বিষয়ে তার বেশ একটু সুনাম আছে।

 কথা শুনিয়া সকলে অবাক হইয়া গেল। হুজুর একটু থামিয়া কহিলেন, এঁদের সতীপনার কাহিনী অত্যন্ত প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ, সুতরাং তাকে আর নাড়াচাড়া করে কাজ নেই। ভৈরবী থাকলেই ভৈরব এসে জোটে এবং ভৈরবীদেরও ভৈরব নইলে চলে না, এ অতি সনাতন প্রথা―সহজে টলানো যাবে না। দেশসুদ্ধ ভক্তের দল চটে যাবে, হয়ত দেবী নিজেও খুশী হবে না―একটা হাঙ্গামা বেধে যাবে। মাতঙ্গী ভৈরবীর গোটা-পাঁচেক ভৈরব ছিল, এবং তাঁর পূর্বে যিনি ছিলেন তার নাকি হাতে গোনা যেতো না। কি বলেন শিরোমণিমশাই, আপনি ত এ অঞ্চলের প্রাচীন ব্যক্তি, জানেন ত সব? এই বলিয়া তিনি শিরোমণি অপেক্ষা রায়মহাশয়ের প্রতি বিশেষ করিয়া কটাক্ষপাত করিলেন। এ প্রশ্নের কেহ উত্তর দিবে কি, সকলে যেন বুদ্ধিবিহ্বল হইয়া গেল। জমিদারের কণ্ঠস্বর সোজা না বাঁকা, বক্তব্য সত্য না মিথ্যা, তাৎপর্য বিদ্রূপ না পরিহাস, তামাশা না তিরস্কার, কেহ ঠাওর করিতেই পারিল না।

 সম্মুখের বারান্দা ধরিয়া একজন ভদ্রবেশধারী সৌখিন যুবক প্রবেশ করিল। হাতে তার ইংরেজী বাংলা কয়েকখানা সংবাদপত্র এবং কতকগুলো খোলা চিঠিপত্র। জীবানন্দ দেখিয়া কহিলেন, কি হে প্রফুল্ল, এখানেও ডাকঘর আছে নাকি? আঃ―কবে এইগুলো সব উঠে যাবে?

 প্রফুল্ল ঘাড় নাড়িয়া কহিল, সে ঠিক। গেলে আপনার সুবিধে হতো। কিন্তু সে যখন হয়নি তখন এগুলো দেখবার কি সময় হবে?

 জীবানন্দ কিছুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ না করিয়া কহিলেন, না, এখনও হয় না, অনা সময়েও হবে না। কিন্তু অনেকটা বাইরে থেকেই উপলব্ধি হচ্ছে। এই যে হীরালাল-মোহনলালের দোকানের ছাপ। পত্রখানি তাঁর উকিলের, না একেবারে অদালতের হে? ও খামখানা তো দেখছি সলোমন সায়েবের। বাবা, বিলিতী সুরার গন্ধ কাগজ ফুঁড়ে বার হচ্ছে। কি বলেন সাহেব, ডিক্রি জারি করবেন, না এই রাজবপুখানি নিয়ে টানাহেঁচড়া করবেন―জানাচ্ছেন? আঃ―সেকালের ব্রাহ্মণ্যতেজ যদি কিছু বাকী থাকতো ত এই বউদি-বেটাকে একেবারে ভস্ম করে দিতাম। মদের দেনা আর শুধতে হতো না।

 প্রফুল্ল ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিল, কি বলচেন দাদা? থাক থাক, আর একসময়ে আলোচনা করা যাবে। এই বলিয়া সে ফিরিতে উদ্যত হইতেই জীবানন্দ সহাস্যে কহিলেন, আরে লজ্জা কি ভায়া, এঁরা সব আপনার লোক, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, এমন কি, মণি-মাণিকোর এ-পিঠ ও-পিঠ বললেও অত্যুক্তি হয় না। তা ছাড়া তোমার দাদাটি যে কস্তুরী-মৃগ; সুগন্ধ আর কতকাল চেপে রাখবে ভাই। টাকা! টাকা! এর নালিশ তার তার নালিশ, অমুকের ডিক্রি আর তমুকের খিস্তিখেলাপ―ওহে, ও তারাদাস, সে-দিনটা নেহাত ফসকে গিয়েছিল, কিন্তু হতাশ হয়ো না ঠাকুর, যা করে তুলেচি, তাতে মনস্কামনা তোমার পূর্ণ হতে খুব বেশী বিলম্ব হবে বলে আশঙ্কা হয় না। প্রফুল্ল, রাগ করো না ভায়া, আপনার বলতে আর কাউকে বড় বাকী রাখিনী, কিন্তু এই চল্লিশটা বছরের অভ্যাস ছাড়তে পারবো বলেও ভরসা নেই, তার চেয়ে বরঞ্চ, নোট-টোট জাল করতে পারে এমন যদি কাউকে যোগাড় করে আনতে পারতে হে―

 প্রফুল্ল অত্যন্ত বিরক্ত হইয়াও হাসিয়া ফেলিল, কহিল, দেখুন, সবাই আপনার কথা বুঝবেন না, সত্য ভেবে যদি কেউ―

 জীবানন্দ গম্ভীর হইয়া কহিলেন, যদি কেউ সন্ধান করে আনেন? তা হলে ত বেঁচে যাই প্রফুল্ল। রায়মশায়, আপনি ত শুনি অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি, আপনার জানাশুনা কি এমন কেউ―

 রায়মহাশয় ম্লানমুখে অকস্মাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, বেলা হয়ে গেল, যদি অনুমতি করেন ত এখন আমরা আসি।

 জীবানন্দ ঈষৎ অপ্রতিভ হইয়া কহিলেন, বসুন, বসুন, নইলে প্রফুল্লর জাঁক বেড়ে যাবে। তা ছাড়া, ভৈরবীর কথাটাও শেষ হয়ে যাক। কিন্তু আমি যাও বললেই কি সে যাবে?

 রায়মহাশয় না বসিয়াই সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, সে ভার আমাদের।

 কিন্তু আর কাউকে ত বহাল করা চাই! ও ত খালি থাকতে পারে না।

 এবার অনেকেই জবাব দিল, সে ভারও আমাদের!

 জীবানন্দ নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, যাক বাঁচা গেল, এবার সে খাবেই। এতগুলো মানুষের নিঃশ্বাসের ভার একা ভৈরবী কেন, স্বয়ং মা-চণ্ডীও সামলাতে পারবেন না, তা বোঝা গেল। আপনাদের লাভ-লোকসান আপনারাই জানেন, কিন্তু আমার এমন অবস্থা যে, টাকা পেলে আমার কিছুতেই আপত্তি নেই। নতুন বন্দোবস্ত আমার কিছু পাওয়া চাই। ভাল কথা, কেউ দেখত রে, এককড়ি আছে না গেছে? কিন্তু গলাটা যে এদিকে শুকিয়ে একেবারে মরুভূমি হয়ে গেল।

 বেহারা আসিয়া প্রভুর ব্যগ্রব্যাকুল শ্রীহস্তে পূর্ণপাত্র দিয়া খবর দিল, সে সদরে বসিয়া খাতা লিখিতেছে। হুজুরের আহ্বানে ক্ষণেক পরে এককড়ি আসিয়া যখন সসম্ভ্রমে এক পাশে দাঁড়াইল, জীবানন্দ শুষ্ককণ্ঠ আর্দ্র করিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, সেদিন ভৈরবীকে যে কাছারিতে তলব করেছিলাম, কেউ তাঁকে খবর দিয়েছিলে?

 এককড়ি কহিল, আমি নিজে দিয়েছিলাম।

 তিনি এসেছিলেন?

 আজ্ঞে না।

 না কেন?

 এককড়ি অধোমুখে নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। জীবানন্দ উৎসুক হইয়া প্রশ্ন করিলেন, তিনি কখন আসবেন জানিয়েছিলেন?

 এককড়ি তেমনি অধোমুখে থাকিয়া অস্ফুটকণ্ঠে কহিল, এত লোকের সামনে আমি সে কথা হুজুরে পেশ করতে পারব না।

 জীবানন্দ হাতের শূন্য গ্লাসটা নামাইয়া রাখিয়া হঠাৎ কঠিন হইয়া বলিয়া উঠিলেন, এককড়ি, তোমার গোমস্তাগিরি কায়দাটা একটু ছাড়। তিনি আসবেন না, না?

 না!

 কেন?

 এবার প্রত্যুত্তরে যদিচ এককড়ি তাহার জমিদারি কায়দাটা সম্পর্ণ ছাড়িল না, কিন্তু সবাই শুনতে পায় এমনি সুস্পষ্ট করিয়াই কহিল, তিনি আসতে পারবেন না, এ কথা যত লোক দাঁড়িয়েছিল সবাই শুনেচে। বলেছিলেন, তোমার হুজুরকে বলো এককড়ি, তাঁর বিচার করবার মত বিদ্যেবদ্ধি থাকে ত নিজের প্রজাদের করুন গে। আমার বিচার করবার জন্যে আদালত খোলা আছে।

 সহসা মনে হইল জমিদারের এতক্ষণের এত রহস্য, এত সরল ঔদাস্য, হাস্যোজ্জ্বল মুখ ও তরল কণ্ঠস্বর চক্ষের পলকে নিবিয়া যেন অন্ধকার হইয়া গেল। ক্ষণকাল পরে শুধু আস্তে আস্তে কহিলেন, হুঁ। আচ্ছা তুমি যাও। প্রফুল্ল, সেই যে কি একটা চিনির কোম্পানি হাজার বিঘে জমি চেয়েছিল, তাঁদের কোন জবাব দিয়েছিলে?

 আজ্ঞে না।

 তা হলে লিখে দাও যে জমি তারা পাবে। দেরি করো না।

 না, দিচ্চি লিখে, এই বলিয়া সে এককড়িকে সঙ্গে লইয়া প্রস্থান করিল। আবার কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত গৃহটা নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। শিরোমণি উঠিয়া দাঁড়াইয়া আশীর্বাদ করিয়া কহিলেন, আমরা আজ তাহলে আসি?

 আসুন।

 রায়মহাশয় হেঁট হইয়া প্রণাম করিয়া কহিলেন, অনুমতি হয় ত আর একদিন চরণ দর্শন করতে আসব।

 বেশ, আসবেন।

 সকলেই ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন। বাহিরে আসিয়া তাঁহারা জমিদারের হাঁক শুনিতে পাইলেন, বেয়ারা―

 অনেকখানি পথ কেহই কাহারো সহিত বাক্যালাপ করিল না। অবশেষে শিরোমণি আর কৌতূহল দমন করিতে না পারিয়া রায়মহাশয়কে একপাশে একটু টানিয়া ফিসফিস করিয়া কহিলেন, জনার্দন, জমিদারকে তোমার কিরূপ মনে হয় ভায়া?

 জনার্দন সংক্ষেপে বলিলেন, মনে ত অনেক রকমই হলো।

 মহাপাপিষ্ঠ―লজ্জাশরম আদৌ নেই।

 না।

 কিন্তু দিব্যি সরল। মাতাল কিনা! দেখলে, দেনার দায়ে চুল পর্যন্ত বাঁধা, তাও বলে ফেললে।

 জনার্দন বলিলেন, হুঁ।

 শিরোমণি বলিলেন, কিছুই থাকবে না, সব ছারখার হয়ে যাবে, তুমি দেখে নিয়ো।

 জনার্দন বলিলেন, খুব সম্ভব।

 হয়ত বেশীদিন বাঁচবেও না।

 হতেও পারে।

 কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলিয়া শিরোমণি পুনশ্চ বলিলেন, যা ভাবা গিয়েছিল, বোধ হয় ঠিক তা নয়―নেহাত হাবাবোকা বলে মনে হয় না। কি বল?

 জনার্দন শুধু জবাব দিলেন, না।

 কিন্তু বড় দুর্মুখ। মানীর মান-মর্যাদার জ্ঞান নেই।

 জনার্দন চুপ করিয়া রহিলেন। উত্তর না পাইয়াও শিরোমণি কহিলেন, কিন্তু দেখেচ ভায়া কথার ভঙ্গী―অর্ধেক মানে বোঝাই যায় না। সত্য বলচে, না আমাদের বাঁদর নাচাচ্চে ঠাওর করাই শক্ত। জানে সব, কি বল?

 রায়মহাশয় তথাপি কোন মন্তব্য প্রকাশ করিলেন না, তেমনি নীরবে পথ চলিতে লাগিলেন। কিন্তু বাটীর কাছাকাছি আসিয়া শিরোমণি আর কৌতূহল সংবরণ করিতে পারিলেন না, আস্তে আস্তে বলিলেন, ভায়াকে বড় বিমর্ষ দেখাচ্চে―বিশেষ সুবিধে হবে না বলেই যেন ভয় হচ্চে, না?

 রায়মহাশয় যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু দাঁড়াইয়া কহিলেন, মায়ের অভিরুচি।

 শিরোমণি ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, তার আর কথা কি! কিন্তু ব্যাপারটা যেন খিচুড়ি পাকিয়া গেল—না গেল একে ধরা, না গেল তাকে মারা। তোমার কি ভায়া―পয়সার জোর আছে―কিন্তু বাঘের গর্তের মুখে ফাঁদ পাততে গিয়ে না শেষে আমি মারা পড়ি।

 জনার্দন একটু রুক্ষকণ্ঠে কহিলেন, আপনি কি ভয় পেয়ে এলেন নাকি?

 শিরোমণি বলিলেন, না না ভয় নয়, কিন্তু তুমিও যে খুব ভরসা পেয়ে এলে, তা ত তোমার মুখ দেখেও অনুভব হচ্ছে না। হুজুরটি ত কানকাটা সেপাই―কথাও যেমন হেঁয়ালি, কাজও তেমনি অদ্ভুত! ও যে ধরে গলা টিপে মদ খাইয়ে দেয়নি এই আশ্চর্য। এককড়ির মুখে ঠাকরুনটির হুমকিও ত শুনলে? আমিও মেলা কথা কয়ে এসেচি―ভাল করিনি। কি জানি, এককোড়ে ব্যাটা ভেতরে ভেতরে সব বলে দেয় নাকি। দুয়ের মাঝে পড়ে শেষকালে না বেড়াজালে ধরা পড়ি।

 জনার্দন উদাসকণ্ঠে কহিলেন, সকলই চণ্ডীর ইচ্ছা। বেলা হয়ে গেল―ও বেলায় একবার আসবেন।

 তা আসবো।

 গলির মোড় ফিরিতে বাঁ দিকে গাছের ফাঁকে মন্দিরের অগ্রভাগ দেখা দিতেই বৃদ্ধ শিরোমণি হাত তুলিয়া যুক্তকরে প্রণাম করিলেন, কানে এবং নাকে হাত দিলেন, কিন্তু অস্ফুটে কি প্রার্থনা যে করিলেন তাহা শোনা গেল না। তার পরে ধীরে ধীরে বাড়ি চলিয়া গেলেন।