দেশের কাজ
দেশের কাজ
আমাদের শাস্ত্রে বলে ছ-টি রিপুর কথা—কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য্য। তাকেই রিপু বলে, যাতে আত্মবিস্মৃতি আনে। এমনি করে নিজেকে হারানই মানুষের সর্ব্বনাশ করে, এই রিপুই জাতির পতন ঘটায়। এই ছ-টি রিপুর মধ্যে চতুর্থ টির নাম মোহ। সে অন্ধতা আনে দেশের চিত্তে, অসাড়তা আনে তার প্রাণে, নিরুদ্যম করে দেয় তার আত্মকর্ত্তৃত্বকে। মানবস্বভাবের মূলে যে সহজাত শক্তি আছে তার প্রতি বিশ্বাস সে ভুলিয়ে দেয়। এই বিহ্বলতার নামই মোহ। আর এই মোহেরই উল্টো হচ্চে মদ—অহঙ্কারের মত্ততা। মোহ আমাদের আত্মশক্তিতে বিস্মৃতি অনে, আমরা যা তার চেয়ে নিজেকে হীন করে দেখি, আর গর্ব্ব, সে আপনাকে অসত্যভাবে বড় করে তোলে। এ জগতে অনেক অভ্যুদয়শালী মহাজাতির পতন হয়েচে অহঙ্কারে অন্ধ হয়ে। স্পর্দ্ধার বেগে তারা সত্যের সীমা লঙ্ঘন করেচে। আমাদের মরণ কিন্তু উল্টো পথে—আমাদের আচ্ছন্ন করেচে অবসাদের কুয়াশায়।
একটা অবসাদ এসে আমাদের শক্তিকে ভুলিয়ে দিয়েচে। এককালে আমরা অনেক কর্ম্ম করেচি, অনেক কীর্ত্তি রেখেচি, সে কথা ইতিহাস জানে। তারপর কখন অন্ধকার ঘনিয়ে এল ভারতবাসীর চিত্তে, আমাদের দেহে-মনে অসাড়তা এনে দিলে। মনুষ্যত্বের গৌরব যে আমাদের অন্তর্নিহিত, সেটাকে রক্ষা করবার জন্যে যে আমাদের প্রাণপণ করতে হবে, সে আমাদের মনে রইল না। একেই বলে মোহ। এই মোহে আমরা নিজের মরার পথ বাধামুক্ত করেছি, তার পর যাদের আত্মম্ভরিতা প্রবল, আমাদের মার আসচে তাদেরই হাত দিয়ে। আজ বলতে এসেচি, আত্মাকে অবমানিত করে রাখা আর চলবে না। আমরা বল্তে এসেচি যে, আজ আমরা নিজের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করলেম। একদিন সেই দায়িত্ব নিয়েছিলেম, আত্মশক্তিতে বিশ্বাস রক্ষা করেছিলেম। তখন জলাশয়ে জল ছিল, মাঠে শস্য ছিল, তখন পুরুষকার ছিল মনে। এখন সমস্ত দূর হয়েচে। আবার একবার নিজেকে নিজের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।
কোনো উপায় নেই, এত বড় মিথ্যা কথা যেন না বলি। বাহির থেকে দেখলে তো দেখা যায় কিছু পরিমাণেও বেঁচে আছি। কিছু আগুনও যদি ছাই-চাপা পড়ে থাকে তাকে জাগিয়ে তোলা যায়। এ কথা যদি নিশ্চেষ্ট হয়ে স্বীকার না করি তবে বুঝব এটাই মোহ। অর্থাৎ যা নয় তাই মনে করে বসা।
একটা ঘটনা শুনেচি—হাঁটুজলে মানুষ ডুবে মরেচে ভয়ে। আচমকা সে মনে করেছিল পায়ের তলায় মাটি নেই। আমাদেরও সেই রকম! মিথ্যে ভয় দূর করতে হবে, যেমনি হোক্ পায়ের তলায় খাড়া দাঁড়াবার জমি আছে এই বিশ্বাস দৃঢ় করব সেই আমাদের ব্রত। এখানে এসেচি সেই ব্রতের কথা ঘোষণা করতে। বাইরে থেকে উপকার করতে নয়, দয়া দেখিয়ে কিছু দান করবার জন্যে নয়। যে প্রাণস্রোত তার আপনার পুরাতন খাত ফেলে দূরে সরে গেছে বাধামুক্ত ক’রে তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এস, একত্রে কাজ করি।
সং বো মনাংসি সংব্রতা সমাকৃতীর্ণ মামসি।
অমী যে বিব্রতা স্থন তান্ বঃ সং নময়ামসি॥
এই ঐক্য যাতে স্থাপিত হয়, তারই জন্যে অক্লান্ত চেষ্টা চাই। ঘরে ঘরে কত বিরোধ। বিচ্ছিন্নতার রন্ধ্রে রন্ধে, আমাদের ঐশ্বর্য্যকে আমরা ধূলিস্খলিত করে দিয়েচি। সর্ব্বনেশে ছিদ্রগুলোকে রোধ করতে হবে আপনার সব কিছু দিয়ে।
আমরা পরবাসী। দেশে জন্মালেই দেশ আপন হয় না। যতক্ষণ দেশকে না জানি, যতক্ষণ তাকে নিজের শক্তিতে জয় না করি, ততক্ষণ সে দেশ আপনার নয়। আমরা এই দেশকে আপনি জয় করিনি। দেশে অনেক জড় পদার্থ আছে, আমরা তাদেরই প্রতিবেশী। দেশ যেমন এই-সব বস্তুপিণ্ডের নয়, দেশ তেমনি আমাদেরও নয়। এই জড়ত্ব—একেই বলে মোহ। মোহাভিভূত সেই তো চিরপ্রবাসী। সে জানে না সে কোথায় আছে। সে জানে না তার সত্যসম্বন্ধ কার সঙ্গে। বাইরের সহায়তার দ্বারা নিজের সত্য বস্তু কখনই পাওয়া যায় না। আমার দেশ আর কেউ আমাকে দিতে পারবে না। নিজের সমস্ত ধনমন প্রাণ দিয়ে দেশকে যখনি আপন ব’লে জানতে পারব তখনই দেশ আমার স্বদেশ হবে। পরবাসী স্বদেশে যে ফিরেচি তার লক্ষণ এই যে, দেশের প্রাণকে নিজের প্রাণ বলেই জানি। পাশেই প্রত্যক্ষ মরচে দেশের লোক রোগে উপবাসে, আর আমি পরের উপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে মঞ্চের উপর চড়ে দেশাত্মবোধের বাগ্বিস্তার করচি, এত বড় অবাস্তব অপদার্থতা আর কিছু হতেই পারে না।
রোগপীড়িত এই বৎসরে এই সভায় আজ আমরা বিশেষ করে এই ঘোষণা করচি যে, গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে হবে, অবিরোধে একব্রত সাধনার দ্বারা। রোগজীর্ণ শরীর কর্তব্য পালন করতে পারে না। এই ব্যাধি যেমন দারিদ্র্যের বাহন, তেমনি আবার দারিদ্র্যও ব্যাধিকে পালন করে। আজ নিকটবর্ত্তী বারোটি গ্রাম একত্র করে রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। এই কাজে গ্রামবাসীর সচেষ্ট মন চাই। তারা যেন সবলে বল্তে পারে, আমরা পারি, রোগ দূর আমাদের অসাধ্য নয়। যাদের মনের তেজ আছে তারা দুঃসাধ্য রোগকে নির্ম্মূল করতে পেরেচে, ইতিহাসে তা দেখা গেল।
আমাদের মনে রাখতে হবে, যারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে না, দেবতা তাদের সহায়তা করেন না।
দেবাঃ দুর্ব্বলঘাতকাঃ।
দুর্ব্বলতা অপরাধ। কেননা, তা বহুল পরিমাণে আত্মকৃত, সম্পুর্ণ আকস্মিক নয়। দেবতা এই অপরাধ ক্ষমা করেন না। অনেক মার খেয়েচি, দেবতার কাছে এই শিক্ষার অপেক্ষায়। চৈতন্যের দুটি পন্থা আছে। এক হচ্চে মহাপুরুষদের মহাবাণী। তাঁরা মানবপ্রকৃতির গভীরতলে চৈতন্যকে উদ্বোধিত করে দেন। তখন বহুধা শক্তি সকল দিক থেকেই জেগে ওঠে, তখন সকল কাজই সহজ হয়। আবার দুঃখের দিনও শুভদিন। তখন বাহিরের উপর নির্ভরের মোহ দূর হয়, তখন নিজের মধ্যে নিজের পরিত্রাণ খুঁজতে প্রাণপণে উদ্যত হয়ে উঠি। একান্ত চেষ্টায় নিজের কাছে কী করে আনুকূল্য দাবি করতে হয় অন্য দেশে তার দৃষ্টান্ত দেখতে পাচ্চি।
ইংলণ্ড আজ যখন দৈন্যের দ্বারা আক্রান্ত তখন সে ঘোষণ! করেচে, দেশের লোকে যথাসাধ্য নিজের উৎপন্ন দ্রব্যই নিজেরা ব্যবহার করবে। পথে পথে ঘরে ঘরে এই ঘোষণা যে, দেশজাত পণ্যদ্রব্যই আমাদের মুখ্য অবলম্বন। বহুদিনের বহু অন্নপুষ্ট জাতের মধ্যে যখনই বেকার সমস্য। উপস্থিত হল তখনই দেশের ধন নিরন্নদের বাঁচাতে লেগেচে। এর থেকে দেখা যায় সেখানে দেশের লোকের সকলের চেয়ে বড় সম্পদ দেশব্যাপী আত্মীয়তা। তাদের উপরে আনুকূল্য রয়েছে সদাজাগ্রত। তাতে মনের মধ্যে ভরসা হয়। আমরা বেকার হয়ে মরচি অথচ কেউ আমাদের খবর নেবে না, এ কোনোমতেই হতে পারে না, —এই তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এই বিশ্বাসে তাদের এত ভরসা। আমাদের ভরসা নেই। মারী, রোগ, দুর্ভিক্ষ, জাতিকে অবসন্ন করে দিয়েচে। কিন্তু প্রেমের সাধনা কই, সেবার উদ্যোগ কোথায়? যে বৃহৎ স্বার্থবুদ্ধিতে বড় রকম করে আত্মরক্ষা করতে হয় সে আমাদের কোথায়?
চোখ বুজে অনেক তুচ্ছ বিষয়ে আমরা বিদেশীর অনেক নকল করেচি, আজ দেশের প্রাণান্তিক দৈন্যের দিনে একটা বড় বিষয়ে ওদের অনুবর্ত্তন করতে হবে,—কোমর বেঁধে বল্তে চাই কিছু সুবিধার ক্ষতি, কিছু আরামের ব্যাঘাত হলেও নিজের দ্রব্য নিজে ব্যবহার করব। আমাদের অতি ক্ষুদ্র সম্বল যথাসাধ্য রক্ষা করতে হবেই। বিদেশে প্রভূত পরিমাণ অর্থ চলে যাচ্ছে, সব তার ঠেকাবার শক্তি আমাদের হাতে এখন নেই, কিন্তু একান্ত চেষ্টায় যতটা রক্ষা করা সম্ভব তাতে যদি শৈথিল্য করি তবে সে অপরাধের ক্ষমা নেই।
দেশের উৎপাদিত পদার্থ আমরা নিজে ব্যবহার করব। এই ব্রত সকলকে গ্রহণ করতে হবে। দেশকে আপন করে উপলব্ধি করবার এ একটি প্রকৃষ্ট সাধনা। যথেষ্ট উদ্বৃত্ত অন্ন যদি আমাদের থাকত, অন্তত এতটুকুও যদি থাকত যাতে দেশের অজ্ঞান দূর হয়, রোগ দূব, দেশের জলকষ্ট পথকষ্ট বাসকষ্ট দূর হয়, দেশের স্ত্রীমারী, শিশুমারী দূর হতে পারত তাহলে দেশের অভাবের দিকেই দেশকে এমন একান্তভাবে নিবিষ্ট হতে বলতুম না। কিন্তু আত্মঘাত এবং আত্মগ্লানি থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে সমস্ত চেষ্টাকে যদি উদ্যত না করি, অদ্যকার বহু দুঃখ বহু অবমাননার শিক্ষা যদি ব্যর্থ হয় তবে মানুষের কাছ থেকে ঘৃণা ও দেবতার কাছ থেকে অভিশাপ আমাদের জন্যে নিত্য নিদ্দিষ্ট হয়ে থাকবে যে পর্য্যন্ত আমাদের জীর্ণ হাড় ক-খানা ধূলার মধ্যে মিশিয়ে না যায়।[১]
- ↑ শ্রীনিকেতনে বাৎসরিক উৎসবে রবীন্দ্রনাথের অভিভাষণ। ৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৩২।
শান্তিনিকেতন প্রেসে
রায় সাহেব শ্রীজগদানন্দ রায় কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত
শান্তিনিকেতন, বীরভূম।