ধুস্তুরী মায়া ইত্যাদি গল্প/ধুস্তুরী মায়া (দুই বুড়োর রূপকথা)
ধুস্তুরী মায়া
(দুই বুড়োর রূপকথা)
উদ্ধব পাল আর তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু জগবন্ধু গাঙ্গুলীর বয়স প্রায় পয়ষট্টি। উদ্ধব বেঁটে মোটা শ্যামবর্ণ, মাথায় টাক, কাঁচাপাকা ছাঁটা গোঁফ। উডমণ্ট স্ট্রীটে এঁর একটি ইমারতী রঙের বড় দোকান আছে, এখন দুই ছেলে সেটি চালায়। জগবন্ধু লম্বা রোগা ফরসা, গোঁফ দাড়ি নেই। ইনি জামরুলতলা হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন, এখন অবসর নিয়েছেন। দুই বন্ধু দক্ষিণ কলকাতায় আবুহোসেন রোডে কাছাকাছি বাস করেন। ছেলেরা রোজগার করছে, মেয়েরা সুপাত্রে পড়েছে, সেজন্য সংসারের ভাবনা থেকে এঁরা নিষ্কৃতি পেয়েছেন। দুজনেরই স্বাস্থ্য ভাল, শখও নানারকম আছে, সুতরাং বুড়ো বয়সে এঁদের বেশ আনন্দেই থাকবার কথা।
রোজ বিকাল বেলা এঁরা ঢাকুরের লেকে হেঁটে যান এবং জলের ধারে একটি বড় শিমুল গাছের তলায় বসে সন্ধ্যা সাতটা আটটা পর্যন্ত গল্প করেন, তার পর বাড়ি ফেরেন। দুজনেই সেকেলে লোক, সিগারেট চুরুট পাইপ পছন্দ করেন না। ঝুলিতে হুঁকো আর তামাক-টিকে সাজানো দুটি কলকে নিয়ে যান এবং গল্প করতে করতে মুহুর্মুহু, ধূমপান করেন।
বৈশাখ মাস, সন্ধ্যা সাতটাতেও একটু আলো আছে। জগবন্ধু নিজের হুঁকো থেকে কলকেটি তুলে উদ্ধবের হাতে দিয়ে বললেন, আজ তোমার দাঁতের খবর কি?
উদ্ধব উত্তর দিলেন, তোমার সেই মাজনে কোনও উপকার হল না, পড়ে না গেলে কনকনানি যাবে না। তুমি খাসা আছ, দাপাটি বাঁধিয়ে মুড়ি কড়াইভাজা নারকেল গলদা চিংড়ি সবই চিবিয়ে খাচ্ছ। আমার তো পান সুদ্ধু, ছাড়তে হয়েছে।
—ছেঁচে খাও না কেন?
—আরে ছ্যা, তাতে সবাই ভাববে একেবারে থুত্থুড়ে বুড়ো হয়ে গেছি। তার চাইতে না খাওয়া ভাল। বুড়ো হওয়ার অশেষ দোষ।
—শুধু দোষ দেখছ কেন, ভালর দিকটাও দেখ। খাটতে হচ্ছে না, ছেলেরা সব করে দিচ্ছে। সবাই খাতির করে, কোথাও গেলে সব চাইতে আরামের চেয়ারটিতে বসতে দেয়, পাড়ায় সভা হলে তোমাকেই সভাপতি করে। গুরুজন নেই, ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করতে হয় না, অন্য লোকেই প্রণাম করে।
—থামলে কেন, বলে যাও না। মেয়েরা সব দাদু জেঠা মেসো বলে, বড়োদের দিকে আড় চোখে তাকায় না, আমরা যেন ইট পাথর গরু, ছাগল।
—তাতে তোমার ক্ষতিটা কি?
—ক্ষতি নয়? আমাদের পুরুষ মানুষে বলেই গণ্য করে না। দেখ জগু, জীবনটা বৃথাই কাটল।
—বৃথা কেন, তোমার কিসের অভাব? উপযুক্ত দুই ছেলে রয়েছে, গিন্নী রয়েছেন, ব্যাবসায় দেদার টাকা আসছে, শরীর ভালই আছে। তোমার ও দাঁত নড়া ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। বাত ডায়াবিটিস ব্লাডপ্রেশার কিছুই নেই, এই বয়সেও নিমন্ত্রণে গিয়ে দু দিস্তে লুচি আর দেদার মাছ মাংস দই মিষ্টান্ন খেতে পার। আমি অবশ্য তোমার মতন মজবুত নই, বড়লোকও নই, কিন্তু দুঃখ করবারও কিছু নেই। ক জন বুড়ো আমাদের মতন ভাগ্যবান?
উদ্ভব পাল হুঁকোর একটি দীর্ঘ টান দিয়ে কলকেটি বন্ধুর হাতে দিলেন। তার পর বললেন, দেখ জগু, যখন বয়স ছিল তখন কোনও ফূর্তিই করতে পাই নি। কর্তার হুকুমে ইস্কুলের পড়া শেষ না করেই দোকানে ঢুকেছি, ব্যাবসা আর রোজগার ছাড়া আর কিছুতে মন দেবার অবকাশ ছিল না।
জগবন্ধু গাঙ্গুলী বললেন, এখন তো দেদার অবকাশ, যত খুশি আনন্দ কর না।
—চেষ্টা করেছি, কিন্তু এই বয়সে তা হবার নয়। ছোঁড়াদের দেখে বাইসিকেল চড়ে সনসনিয়ে ছুটতে আর মোটর চালাতে ইচ্ছে করে, কিন্তু শক্তি নেই। আজকাল অ্যাং ব্যাং চ্যাং সবাই বিলেত ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে আসছে। আমারও ইচ্ছে হয়, কিন্তু ইংরিজী বলতে পারি না, হ্যাট-কোট পায়জামা-আচকান পরতে পারি না, কাঁটা-চামচ দিয়ে খেলে পেট ভরে না, কাজেই যাবার জো নেই। আবার সেকেলে ফুর্তিও সয় না। বছর চারেক আগে কাশীতে এক সাধুবাবার প্রসাদী বড়-তামাকের ছিলিমে একটি টান মেরেছিলুম, তার পর ঘণ্টা দই ত্রিভুবন অন্ধকার। সেদিন আমার বেয়াই জগন্নাথ দত্তর বাগানে গিয়ে উপরোধে পড়ে চার গেলাস খেয়েছিলুম-রম-পঞ্চ না কি বললে। খেয়ে যাই আর কি, কেবল হেঁচকি আর হেঁচকি, তার পর বমি।
—ফূর্তিরও সাধনা দরকার, জোয়ান বয়স থেকে অভ্যাস করতে হয়। এখন আর ওসব করতে যেয়ো না।
—তার পর এই সেদিন তোমার সঙ্গে স্বপনপুরী সিনেমার ‘লুটে নিল মন’ দেখেছিলুম। দেখা ইস্তক মনটা খিঁচড়ে আছে। জীবনের যা সব চাইতে বড় সুখ—প্রেম, তাই আমার ভোগ হল না।
—অবাক করলে তুমি। বাড়ীতে সতীলক্ষী গৃহিণী আছেন তব, বলছ প্রেম হয় নি! শাস্ত্রে বলে—জীর্ণমন্নং প্রশংসন্তি ভার্যাঞ্চ গতযৌবনাম্। অর্থাৎ ভাত হজম হলে আর স্ত্রী বৃদ্ধা হলেই লোকে প্রশংসা করে। এখন না হয় দুজনে বুড়ো হয়েছ, কিন্তু প্রথম বয়সে প্রেম হয় নি এ কি রকম কথা?
—আমার বয়স যখন বারো তখনই বাবা সাত বছরের পত্রবধু ঘরে আনলেন। খিদে না হতেই যদি খাবার জোটে তবে ভোজনের সুখ হবে কেমন করে? তা ছাড়া গিন্নীর মেজাজটি চিরকালই রুক্ষু, প্রেম করবার মানুষ তিনি নন। আর চেহারাটি তো তোমার দেখাই আছে। তবে হক কথা বলব, মাগী রাঁধে যেন অমৃত।
—কি রকম হলে তুমি খুশী হতে বল তো?
—যা হবার নয় তা বলে আর লাভ কি। তবু মনের কথা বলছি শোন। হুইল দেওয়া ছিপে যেমন করে রুই কাতলা ধরা হয় সেই রকম আর কি। ফাতনা নড়ে উঠল, টোপ গিলেই চোঁ করে সরে গেল, তার পর টান মেরে কাছে আনলুম, আবার তো ছাড়লুম, এই রকম খেলিয়ে খেলিয়ে বউ ঘরে তুলতে পারলেই জীবনটা সার্থক হত।
—ও, তুমি নটবর নাগর হয়ে প্রেমের মৃগয়া করতে চাও! এ বয়সে ওসব চিন্তা ভাল নয় ভাই। পত্নী যে ভাবেই ঘরে আসুন—কচি বেলায় বা ধেড়ে বয়সে, প্রেমের আগে বা পরে তিনি চিরকালই মার্গিতব্যা, অর্থাৎ খোঁজবার আর চাইবার জিনিস।
—কি বললে, মার্গিতব্যা? তা থেকেই বুঝি মাগী হয়েছে?
—তা জানি না, সুনীতি চাটুজ্যে মশাই বলতে পারেন।
উদ্ভব পাল একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভড়াক ভড়াক করে তামাক টানতে লাগলেন।
যে শিমুল গাছের তলায় এঁরা বসেছিলেন তার উপরে একটা পাখি হঠাৎ ডেকে উঠল—ওঠ ওঠ ওঠ ওঠ। আর একটা পাখি সাড়া দিলে—উঠি উঠি উঠি উঠি।
উদ্ধব বললেন, কি পাখি হে? বেশ মজার ডাক তো।
প্রথম পাখিটা মোটা সরে আবার ডাকল—ব্যাং ব্যাং গমী গমী গমী। অন্য পাখিটা মিহি সুরে উত্তর দিলে—ব্যাং ব্যাং গমা গমা গমা।
জগবন্ধু, রোমাঞ্চিত হয়ে চুপি চুপি বললেন, কি আশ্চর্য ব্যাপার!
উদ্ধব বললেন, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী নয় তো?
—চুপ চুপ। শুনে যাও কি বলছে।
ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর আলাপ শুরু হল। কলকাতার টেলিফোনের মতন অস্পষ্ট আওয়াজ, কিন্তু বোঝা যায়।
—নীচে কারা রয়েছে রে ব্যাঙ্গমী?
—দুটো বুড়ো।
—কি করছে ওরা?
—তামাক খাচ্ছে আর বক বক করছে।
—ও, তাই নাকে দুর্গন্ধ লাগছে আর কাশি আসছে। কি বলছে ওরা?
—একটা বুড়ো বলছে তার জীবনই বৃথা, প্রেম করবার সুবিধে পায় নি। আর একটা বুড়ো তাকে বোঝাচ্ছে।
—বুড়ো বয়স ধেড়ে রোগ ধরেছে। এই বলে ব্যাঙ্গমা তার দিয়ে সায়ংকালীন কোষ্ঠশুদ্ধি করলে। উদ্ধব আর জগবন্ধু রমাল মাথা মছে একটু সরে বসলেন।
ব্যাঙ্গমী বললে, তোমার তো নানারকম বিদ্যে আছে, একটা উপায় বাতলে দাও না। আহা, বুড়ো বেচারার মনে বড় দুঃখু যাতে তার শখ মেটে তার ব্যবস্থা কর।
ব্যাঙ্গমা বললে, জোয়ান হবার শখ থাকে তো তার প্রক্রিয়া বোধ হয় বাতলাতে পারি, কিন্তু ওদের সাহস হবে কি? বোধ হয় পেরে উঠবে না।
—পারুক না পারুক তুমি বল না।
উদ্ধব ফিস ফিস করে বললেন, নোট করে নাও হে, নোট করে নাও। জগবন্ধু তাঁর নোটবুকে লিখতে লাগলেন।
ব্যাঙ্গমা বললে, ধুস্তুরী ছোলা। এক-একটি ছোলা খেলে দশ-দশ বছর বয়স কমে যায়।
—সে আবার কি জিনিস? কোথায় পাওয়া যায়?
—তৈরি করতে হয়। ওই বেড়ার দক্ষিণ দিকে নীল ধুতরোর ঝোপ আছে, তাতে বড় বড় ফল ধরেছে। কৃষ্ণপক্ষ পঞ্চমীর সন্ধ্যায় ধুতেরো ফল চিরে তার ভেতরে ছোলা গুঁজে দিতে হবে, একটি ফলে একটি ছোলা। একাদশীর মধ্যে সেই ছোলা রস টেনে নিয়ে ফুলে উঠবে, তখন বার কবে নেবে। তার পর অমাবস্যা সন্ধ্যায় গঙ্গার ঘাটে গিয়ে ছোলা চিবিয়ে খেয়ে সংকল্প করবে। মনে থাকে যেন, একটি ছোলায় দশ বছর বয়স কমবে, পাঁচটিতে পঞ্চাশ বছর।
—যদি দশ-বিশটা খায়?
—তবে পূর্বজন্মে ফিরে যাবে। তার পর শোন। সংকল্পের পর এই মন্ত্রটি বলে গঙ্গায় একটি ডুব দেবে—
বম মহাদেব ধুস্তুরস্বামী,
দস্তুর মত প্রস্তুত আমি।
ডুব দেবা মাত্র বয়স কমে যাবে।
—আচ্ছা, যদি ফের আগের বয়সে ফিরে আসতে চায়?
—খুব সোজা। পূর্ণিমার সন্ধ্যায় গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বেলপাতা চিবিয়ে খাবে, যটা ছোলা খেয়েছিল তটা বেলপাতা। তার পর এই মন্ত্রটি বলে একটি ডুব দেবে—
বম মহাদেব, সকল বস্তু
আগের মতন আবার অস্তু।
ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী নীরব হল। আরও কিছু, শোনবার আশায় খানিক ক্ষণ সবুর করে উদ্ধব বললেন, বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। যা শোনা গেল তাই যথেষ্ট। প্রক্রিয়াটি যা বললে তা মালবীয়জীর কায়কল্পের চাইতে ঢের সোজা, বিপদের ভয়ও দেখছি না।
জগবন্ধু বললেন, ধুতরোর রস হচ্ছে বিষ তা জান?
—আরে ছোলার মধ্যে কতই আর রস ঢুকবে। ব্যাঙ্গমার কথা যদি মিথ্যেই হয় তবে বড় জোর একটু নেশা হবে। আমরা তো আর মুটো খানিক ছোলা খাব না।
—তবে চল, দেখা যাক বেড়ার দক্ষিণে নীল ধতরোর গাছ আছে কি না।
দুজনে গিয়ে দেখলেন, ধুতরো গাছের জঙ্গল, বড় বড় ফল ধরেছে। জগবন্ধু বললেন, বোধ হয় পরশু কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী, বাড়ি গিয়ে পাঁজি দেখতে হবে। সেদিন ছোলা আর একটা ছুরি নিয়ে আসা যাবে।
পঞ্চমীর দিন উদ্ধব আর জগবন্ধু ধুতরোর বনে এসে দশ-বারোটা
ফল চিরে তার মধ্যে ছোলা পুরে দিলেন। তার পরেরকদিন তাঁরা নানারকম ভাবনায় আর উত্তেজনায় কাটালেন। জগবন্ধু অনেক বার বললেন, কাজটা ভাল হবে না। উদ্ধব বললেন, অত ভয় কিসের, এমন সুযোগ ছাড়তে আছে! আমাদের বরাত খুব ভাল তাই ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর কথা নিজের কানে শুনেছি। আমার মনে হয় হরপাবর্তী দয়া করে পাখির রূপ ধরে আমাদের হদিস বাতলে দিয়েছেন। এই বলে উদ্ধব হাত জোড় করে বার বার কপালে ঠেকাতে লাগলেন।
জগবন্ধু বললেন, আচ্ছা, জোয়ান না হয় হওয়া গেল, কিন্তু বাড়ির লোককে কি বলবে?
—বাড়িতে যাব কেন। খোঁজ না পেলে সবাই মনে করবে যে মরে গেছি। আমরা অন্য নাম নিয়ে অন্য জায়গায় থাকব। তুমি জগবন্ধুর বদলে জলধর হবে, আমি উদ্ভবের বদলে উমেশ হব। কেউ চিনতে পারবে না, নিশ্চিন্ত হয়ে ফুর্তি করা যাবে।
একাদশীর দিন তাঁরা ধুতরো ফল পেড়ে ভিতর থেকে ছোলা বার করে নিলেন। ছোলা ফুলে কুল আঁঠির মতন বড় হয়েছে। তার পর কদিন তাঁরা গোপনে নানা রকম ব্যবস্থা করে ফেললেন, যাতে ভবিষ্যতে নিজেদের আর পরিবারবর্গের কোনও অভাব না হয়। উদ্ধব উমেশ পালের নামে ব্যাঙ্কে একটা নতুন অ্যাকাউণ্ট খুলতে যাচ্ছিলেন। জগবন্ধু বললেন, যদি পরে ফিরে আসতে হয় তবে টাকাটা বার করতে পারবে না; উদ্ধব আর উমেশ পালের নামে জয়েণ্ট অ্যাকাউণ্ট কর। উদ্ধব তাই করলেন।
চতুর্দশীর দিন জগবন্ধু বললেন, দেখ, বয়স কমাতে হয় তুমি কমাও। আমার কোনও দরকার নেই।
উদ্ধব বললেন, তা কি হয়, এক যাত্রায় পৃথক ফল হতে পারে না। তুমি সঙ্গে না থাকলে আমি কিছুই করতে পারব না।
—বেশ, আমি কিন্তু দিন কতক পরেই ফিরে আসব।
—ফিরবে কেন, তোমারই তো সুবিধে বেশী। পরিবার বহুদিন গত হয়েছেন, নির্ঝঞ্চাটে আর একটি ঘরে আনবে।
—কটা ছোলা খেতে চাও হে?
— আমি বেশ করে ভেবে দেখলাম চারটে খাওয়াই ভাল। এখন আমাদের দুজনেরই বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি। চল্লিশ বাদ গিয়ে হবে পঁচিশ, একেবারে তাজা তরুণ।
—কিন্তু বুদ্ধিও তো খাজা তরুণের মতন হবে। এত দিন ব্যাবসা করে যে বুদ্ধিটি পাকিয়েছ তা একটা খেয়ালের বশে কাঁচিয়ে দিতে চাও? আমি বলি কি, দুটো ছোলা খাও, তাতে বয়স পঁয়তাল্লিশ বছর হবে। প্রায় জোয়ানেরই মতন, অথচ বুদ্ধি বেশী কেঁচে যাবে না।
উদ্ধব নাক সিটকে বললেন, রাম বল। পঁয়তাল্লিশে কারবার ফালাও করা যেতে পারে, দেদার খদ্দেরও যোগাড় করা যেতে পারে, কিন্তু মনের মানষ—ওই যাকে বলেছ মার্গিতব্যা-পাকড়াও করা যাবে না। আধবুড়োর কাছে কোনও মেয়ে ঘেঁষবে না। আচ্ছা, মাঝামাঝি করা যাক, তিনটে করে ছোলা খাওয়া যাবে, পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হলে মন্দ হবে না। আজকাল তো ধেড়ে আইবুড়ো মেয়ের অভাব নেই।
একটু ভেবে জগবন্ধ, বললেন, আচ্ছা উদ্ধব, তুমি তো নবকলেবর ধারণ করে উধাও হবার জন্য ব্যস্ত হয়েছ। তোমার তিরোধান হলে পরিবারের কি দশা হবে ভেবে দেখেছ? তোমার দুঃখ হবে না?
—নাঃ। সম্পত্তি যখন রেখে যাচ্ছি তখন দুঃখ কিসের। তবে দিন কতক কান্নাকাটি করবে, তা না হলে যে ভাল দেখাবে না। গহনা খুলতে হবে, মাছ পেঁয়াজ পুঁই শাগ মসুর ডাল ছাড়তে হবে, তার জন্যও কিছু দিন একটু কষ্ট হবে। তার পর তোফা আলোচালের ভাত ঘি মটর ডাল পটোল ভাজা ঘন দুধ আম কলা সন্দেশ খেয়ে খেয়ে ইয়া লাশ হবে আর হরদম পান দোত্তা চিবুবে।
ঝাঁটা গোঁফের খোঁচা আর তামাকের গন্ধ সইতে হবে না, বেআক্কেলে মিনসের তোয়াক্কা রাখতে হবে না, মনের সুখে বউদের ওপর তম্বি করবে আর গুর-মহারাজের সঙ্গে কাশী হরিদ্বার হিল্লি দিল্লি মক্কা ঘরে বেড়াবে। ছেলে দুটো তো লাট হয়ে যাবে। বাপ পিতামহর বসত বাড়ি বেচে ফেলে ফরক হবে, মেট্রো প্যাটারেন ইমারত তুলবে, দামী দামী মোটর কিনবে। কারবারটা মাটি না করে এই যা চিন্তা। মরুকে গে, আমি, আর ওসব ভাবব না। আর তোমার তো কোনও ভাবনাই নেই। ছেলেটি অতি ভাল, তুমি সরে গেলে নিশ্চয় ঘটা করে শ্রাদ্ধ করবে।
—আমি কিন্তু তোমার একটা হিল্লে লেগে গেলেই ফিরে আসব। অবশ্য তোমার সঙ্গে রোজই দেখা করব।
—আগে কাঁচা বয়সের সোয়াদটা চেখে দেখ, তার পর যা ভাল বোধ হয় ক’রো।
উনিশে বৈশাখ বুধবার অমাবস্যা। সন্ধ্যার সময় দুই বন্ধু দক্ষিণেশ্বরের ঘাটে উপস্থিত হলেন। দুজনেই একটি করে ক্যাম্বিসের হালকা ব্যাগ নিয়েছেন, তাতে কিছু জামা কাপড় এবং অন্যান্য নিতান্ত দরকারী জিনিস আছে, আর যা দরকার পরে কিনে নেবেন। জগবন্ধু বললেন, উদ্ধব ভাই, আমার কথা শোন, আলেয়ার পিছনে ছুটো না, ঘরে ফিরে চল। বেশ আছ, সুখে থাকতে কেন ভূতের কিল খাবে।
উদ্ধব বললেন, সাহস না করলে কোনও কাজেই সিদ্ধি হয় না, ব্যাবসায় নয়, তুমি যাকে প্রেমের মৃগয়া বল তাতেও নয়। আর দেরি করবার দরকার কি, খাট থেকে লোকজন সব চলে গেছে, প্রক্রিয়াটি সেরে ফেলা যাক। বেশী রাত পর্যন্ত এখানে থাকলে মন্দিরের লোকে নানারকম প্রশ্ন করবে।
উদ্ভব একটি গামছা পরে ঘাটের চাতালে জামা কাপড় জুতো রাখলেন। জগবন্ধুও দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে জলে নামবার জন্য প্রস্তুত হলেন। বন্ধুর মুখে আর নিজের মুখে তিনটি করে ছোলা পরে দিয়ে উদ্ধব বললেন, নাও, বেশ করে চিবিয়ে গিলে ফেল। এইবার মনে মনে সংকল্প কর।......হয়েছে তো?
তার পর জগবন্ধুর হাত ধরে জলে নেমে উদ্ভব বললেন, এস, দুজনে এক সঙ্গে মন্ত্রটি বলে ডুব দেওয়া যাক।— বম মহাদেব ধুস্তুরস্বামী, দস্তুর মত প্রস্তুত আমি।
জল থেকে উঠে গা মুছতে মুছতে জগবন্ধু প্রশ্ন করলেন, কি রকম বোধ হচ্ছে? যে অন্ধকার, তোমার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। একটা টর্চ আনলে হত।
উদ্ধব কাপড় পরতে পরতে বললেন, বম ভোলানাথ, কেয়া বাত কেয়া বাত! মাথায় আবার চুল গজিয়েছে হে। শরীরটা খুব হালকা হয়ে গেছে, লাফাতে ইচ্ছে করছে। দাঁতের বেদনাও নেই। ধন্য ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী! যদি ধরা দিতে তবে সোনার খাঁচায় রেখে বাদাম পেস্তা আঙুর বেদানা খাওয়াতুম। তোমার কি রকম হল হে?
—বাঁধানো দাঁত খসে গেছে, দুপাটি নতুন দাঁত বেরিয়েছে, গায়েও জোর পেয়েছি। আলো জ্বেলে আরশিতে না দেখলে ঠিক বুঝতে পারা যাবে না।
—চল যাওয়া যাক, কলকাতার বাস এখনও পাওয়া যাবে। বউবাজারে তরুণধাম হোটেলে ঘর খালি আছে, আমি খবর নিয়েছি এখন সেখানেই উঠব। তার পর সুবিধে মতন একটা বাড়ি নেওয়া যাবে।
হোটেলে এসে আরশিতে মুখ দেখে উদ্ধব বললেন, এঃ, বয়স কমেছে বটে, কিন্তু চেহারাটা গুণ্ডা গুণ্ডা দেখাচ্ছে। তোমার তো দিব্বি রূপ হয়েছে জগু একবারে কার্তিক। দেখো ভাই, আমার শিকার তুমি যেন কেড়ে নিও না।
জগবন্ধু বললেন, আমি শিকার করতে চাই না।
—বেশ বেশ, তুমি শুকদেব গোসাঁই হয়ে তপস্যা ক’রো। এখন আমার মতলবটা শোন। প্রেমের মৃগয়া তো করবই, কিন্তু তাতে দিন কাটবে না। রসা রোডে একটা নতুন রঙের দোকান খুলব, পাল অ্যাণ্ড গাঙ্গুলী। তুমি বিনা মূলধনে অংশীদার হবে, লাভের বখরা পাবে। ব্যাঙ্কে দশ লাখ টাকা নতুন অ্যাকাউণ্টে জমা আছে। দেখবে ছ মাসের মধ্যে নতুন কারবারটি ফাঁপিয়ে তুলব। মনে থাকে যেন—তুমি হচ্ছ জলধর গাঙ্গুলী, আমি উমেশ পাল। রাত অনেক হয়েছে, এখন খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়া থাক।
পরদিন সকালে চা খেতে খেতে জগবন্ধু বললেন, এখন কি করতে চাও বল।
উদ্ধব বললেন, সমস্ত রাত ভেবেছি, ঘুমাতে পারি নি। শুনেছি বালিগঞ্জ আর নতুন দিল্লিই হচ্ছে প্রেমের জায়গা। দিল্লি তো বহু দূর, আমি বলি কি, বালিগঞ্জেই আস্তানা করা যাক।
—ওখানে তুমি সুবিধে করতে পারবে না। তোমার বয়স কমেছে বটে, পুরো তরুণ না হলেও হাফ তরুণ হয়েছ, কিন্তু তোমার চালচলন সাবেক কালের, ফ্যাশন জান না, লেখাপড়াও তেমন শেখ নি। কিছু মনে করো না ভাই, তোমার পালিশের অভাব আছে। ওদিককার মেয়েরা ইংরিজী ফ্রেঞ্চ বলে, বিলিতী কবিতা আওড়ায়। আবার শুনেছি পেণ্টুলুন পরে, ভুরু কামায়, রং মাখে, বল নাচে, সিগারেট খায়, মোটর হাঁকায়। আই সি এস, আই এ এস, বিলাত ফেরত ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার বা বড় চাকরে ছাড়া আর কারও দিকে ফিরেও তাকায় না।
—তাদের চাইতে আমার টাকা ঢের বেশী, রোজগারও বেশী করতে পারব। ভাল বাড়ি, আসবাব, মোটর, কিছুরই অভাব হবে না।
—তা মানলুম। কিন্তু তুমি টেবিলে বসে ছুরি-কাঁটা-চামচ চালাতে পারবে? হাপুস-হপুস শব্দ না করে তো খেতেই পার না। শুনেছি কড়াইশুঁটির দানা আর বড়ি ভাজা ছুরি দিয়ে তুলে মুখে তোলাই আধুনিক দস্তুর। তা তুমি পারবে?
—চিমটে দিয়ে তুলে খেলে চলবে না?
—না। তা ছাড়া তুমি টেবিল ক্লথে ঝোল ফেলে নোংরা করবে, তা দেখলেই তোমার মার্গিতব্যা মারমুখো হবেন।
—বেশ, তুমিই বল কোথায় সুবিধে হবে।
—খবরের কাগজে গাদা গাদা পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন বার হয়। তা থেকেই বেছে নিতে হবে। এই তো আজকের কাগজ রয়েছে, পড় না।
উদ্ধব পড়তে লাগলেন। —বুলবুলি, লক্ষ্মী বোন আমার, ফিরে এস, বাবা মা শোকে শয্যাশায়ী। খঞ্জনকুমারের নাচের পার্টিতেই তুমি যোগ দিও। আরে গেল যা!...... বাবা নেংটু, বাড়ি ফিরে এস, ম্যাট্রিক দিতে হবে না, সিনেমাতেই তোমাকে ভর্তি করা হবে। আরে খেলে যা!
জগবন্ধু বললেন, ওসব কি পড়ছ, পাত্র-পাত্রীর কলম পড়।
— এম এ পাশ, স্বাস্থ্যবতী বাইশ বৎসরের গুহ পাত্রীর জন্য উচ্চপদস্থ পাত্র চাই। বরপণ যোগ্যতা অনুসারে। ......সুন্দরী নৃত্যগীতনিপুণা বিশ বৎসরের আই এ, নৈকষ্য কুলীন মুখোপাধ্যায় পাত্রীর জন্য আই সি এস পাত্র চাই।......দেখ জগু, এসব চলবে না, সেই মামুলী বর-কনের সম্বন্ধ স্থির করে বিয়ে, শুধু বয়সটাই বেড়ে গেছে আর তার সঙ্গে নৃত্য-গীত, এম এ, বি এ যোগ হয়েছে। অন্য উপায় দেখ।
— আচ্ছা, এই রকম একটা বিজ্ঞাপন কাগজে ছাপালে কেমন হয়।— পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়স্ক উদারপ্রকৃতি সদ্বংশীয় বাঙালী বহুলক্ষপতি ব্যবসায়ী, কোনও আত্মীয় নাই, বিবাহের উদ্দেশ্যে সুন্দরী মহিলার সহিত আলাপ করিতে চান। অসবর্ণে আপত্তি নাই। উভয় পক্ষের মনের মিল হইলে শীঘ্রই বিবাহ। বক্স নম্বর অমুক।
— খাসা হয়েছে, ছাপবার জন্য আজই পাঠিয়ে দাও।
বিজ্ঞাপন বার হবার তিন-চার দিন পর থেকেই রাশি রাশি উত্তর আসতে লাগল। একটি চিঠি এই রকম।— ৫নং ঘুঘুবাগান রোড, কলিকাতা। টেলিফোন নর্থ ২৩৪। মহাশয়, আপনার বিজ্ঞাপন দৃষ্টে জানাইতেছি যে কাতলামারি এস্টেটের একমাত্র স্বত্বাধিকারিণী রাজকুমারী শ্রীযুক্তেশ্বরী স্পন্দচ্ছন্দা চৌধুরানী আপনার সহিত আলাপ করতে ইচ্ছুক। ইনি পরমাসুন্দরী এবং অশেষ গুণবতী। ইণ্টারভিউএর সময় সন্ধ্যা সাতটা হইতে আটটা। ইতি। শ্রীরামশশী সরকার, সদর নায়েব।
উদ্ধব বললেন, ভালই মনে হচ্ছে, তবে পাত্রীর নামটা বিদকুটে। আর এস্টেটটি নিশ্চয় ফোঁপরা তাই রাজকুমারী ধনী বর খুঁজছেন। তা হক। হোটেলে তো টেলিফোন আছে, এখনই জানিয়ে দেওয়া যাক আজ সন্ধ্যায় আমরা দেখা করতে যাব।
জগবন্ধু বললেন, তোমার দেখছি তর সয় না। একটা চিঠি লিখে দাও না যে পরশু যাবে। তাড়াতাড়ি করলে ভাববে তোমার গরজ খুব বেশী।
—তুমি বোঝ না, কোনও কাজে গড়িমসি ভাল নয়।
উদ্ধব টেলিফোন ধরে ডাকলেন, নর্থ টু থ্রি ফোর।......ইয়েস। একটু পরে মেয়েলী গলায় সাড়া এল, কাকে চান?
—শ্রীযুক্তেশ্বরী আছেন কি? আমি হচ্ছি উমেশ পাল, আলাপের জন্য আমিই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলুম।
—ও, আপনি একজন ক্যাণ্ডিডেট?
উদ্ধব একট, গরম হয়ে বললেন, ক্যাণ্ডিডেট আপনাদের রাজকুমারী, তাঁর তরফ থেকেই তো বিজ্ঞাপনের উত্তরে দরখাস্ত পেয়েছি।
—দরখাস্ত বলছেন কেন। আমিই রাজকুমারী, আপনি দেখা করতে চান তো আজ সন্ধ্যায় আসতে পারেন।
উদ্ধব নীচু গলায় জগবন্ধুকে বললেন, জানিয়ে দিই যে আমরা দুজনে যাব, কি বল? জগবন্ধু বললেন, আরে না না, এসব ব্যাপারে সঙ্গী নেওয়া চলে না।
উত্তর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে রাজকুমারী বললেন, হেলো।
উদ্ধব জবাব দিলেন, কিলো।
—ও আবার কি রকম! ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা কইতে জানেন না?
—খুব জানি। আলাপ তো হবেই, এখনই শুরু করলে দোষ কি। আজই সন্ধ্যায় আপনার কাছে যাব।
—আপনাকে বকাটে ছোকরা বলে মনে হচ্ছে।
—ঠিক ধরেছেন। বয়স যদিচ পঁয়ত্রিশ, কিন্তু স্বভাব কুড়িপঁচিশের মতন। দেখুন, আপনার গলার সুরটি খাসা। চেহারাটিও ওই রকম হবে তো?
—দেখতেই পাবেন। মশাই নিজে কেমন?
—চমৎকার। দেখলেই মোহিত হয়ে যাবেন।
টেলিফোনের আলাপ শেষ হলে জগবন্ধু বললেন, হাঁ হে উদ্ধব, ভুলে তিনটের জায়গায় চার-পাঁচটা ছোলা খেয়ে ফেল নি তো? ফাজিল ছোকরার মতন কথা বলছিলে।
—তিনটেই খেয়েছিলাম। কি জান, ছেলেবেলায় বাবার শাসনে কোনও রকম আড্ডা দেওয়া বা বকামি করবার সুবিধে ছিল না। এখন আবার কাঁচা বয়সে এসে ফুর্তি চাগিয়ে উঠেছে। তুমি কিছু ভেবো না, আমার বুদ্ধি ঠিক আছে, বেচাল হবে না।
জগবন্ধু কিছুতেই সঙ্গে যেতে রাজী হলেন না, অগত্যা উদ্ধব একলাই রাজকুমারী স্পন্দচ্ছন্দা চৌধুরানীর কাছে গেলেন। বাড়িটা জীর্ণ, অনেক কাল মেরামত হয় নি, সামনের বাগানেও জঙ্গল হয়েছে। বৃদ্ধ নায়েব রামশশী সরকার উদ্ধবকে একটি বড় ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। একটু পরে পাশের পর্দা ঠেলে স্পন্দচ্ছন্দা এলেন।
উদ্ভব স্থির করে এসেছেন যে হ্যাংলামি দেখাবেন না। রসিকতা করবেন বটে, কিন্তু মরুব্বীর চালে। হলেনই বা রাজকুমারী, উদ্ধব নিজেও তো কেও-কেটা নন।
ঘরের ল্যাম্প শেড দিয়ে ঢাকা সেজন্য আলো কম। উদ্ধব দেখলেন, স্পন্দচ্ছন্দা লম্বা, দোহারা, কিন্তু মাংসের চেয়ে হাড় বেশী। মেমের চাইতেও ফরসা, গোলাপী গাল, লাল ঠোঁট, লাল নখ, চাঁচা ভুরু, কাঁধ পর্যন্ত ঝোলা কোঁকড়ানো চুল, নীল শাড়ি। জগবন্ধুর শিক্ষা অনুসারে উদ্ভব দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, নমস্কার।
—নমস্কার। আপনি বসুন।
—ইয়ে, দেখুন শ্রীযূক্তেশ্বরী রাজকুমারী পণ্ডচণ্ডা দেবী—
—স্পন্দচ্ছন্দা।
— হাঁ হাঁ, স্পন্দচ্ছন্দা। দেখুন, একটি কথা গোড়াতেই নিবেদন করি। আপনার নামটা উচ্চারণ করা বড় শক্ত, আমি হেন জোয়ান মরদ হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। যদি আপনাকে পদীরানী বলি তো কেমন হয়?
—স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন। আমিও আপনাকে উম্শে বলব।
—সেটা কি ভাল দেখাবে? প্রজাপতির নির্বন্ধে আমি তো আপনার স্বামী হতে পারি। হবু স্বামীকে নাম ধরে ডাকা আমাদের হিন্দু, ঘরের দস্তুর নয়।
স্পন্দচ্ছন্দা হি হি করে হেসে বললেন, আপনি দেখছি অজ পাড়াগেঁয়ে।
—আমি আসল শহুরে, চার পুরুষ কলকাতায় বাস। আপনিই তো পাড়াগাঁ থেকে এসেছেন। বেশ, নাম ধরেই ডাকবেন, তাতে আমার ক্ষতিটা কি। এখন কাজের কথা শুরু হক। আমার চেহারাটা কেমন দেখছেন?
—মন্দ কি। একটু বেঁটে আর কালো, তা সেটুকু ক্রমে সয়ে যাবে। আমাকে কেমন দেখছেন?
—খাসা, যেন পটের বিবিটি। অত ফরসা কি করে হলেন?
—আমার গায়ের রংই এই রকম।
উদ্ধব সশব্দে হেসে বললেন, ওগো চণ্ডপণ্ডা পদীরানী, রঙের ব্যাপারে আমাকে ঠকাতে পারবে না, ওই হল আমার ব্যাবসা। তুমি এক কোট অস্তরের ওপর তিন পোঁচ পেণ্ট চড়িয়েছ—হবক্স জিঙ্ক, একটু পিউড়ি, আর একটু মেটে সিঁন্দুরে। তা লাগিয়েছ বেশ করেছ, কিন্তু জমির আদত রংটি কেমন?
—আপনি অতি অসভ্য।
—আচ্ছা, আচ্ছা, তোমার গায়ের রং তোমারই থাক, আমার তা জানবার দরকার কি। তবে একটা কথা বলি—মূর্তিটা কুমোরটুলি ঢঙের করতে পার নি। যদি আরও বেশী পিউড়ী কি এলামাটি দিতে আর চোখের কাজলটা কান পর্যন্ত টেনে দিতে তবেই খোলতাই হত।
—আপনি নিজে কি মাখেন? আলকাতরা?
উদ্ধব সহাস্যে বললেন, সরষের তেল ছাড়া কিছুই মাখি না। আমার হচ্ছে খোদ রং, নারকেল ছোবড়া দিয়ে ঘষলেও উঠবে না, একেবারে পাকা। আমার কাছে তঞ্চকতা পাবে না। বয়সও ভাঁড়াতে চাই না, ঠিক পঁয়ত্রিশ। তোমার কত?
বাইশ।
—উঁহু বেয়াল্লিশ।
স্পন্দচ্ছন্দা চেচিয়ে বললেন, বাইশ!
আরও চেঁচিয়ে টেবিলে কিল মেরে উদ্ভব বলেন, বেয়াল্লিশ!
— আপনি আমার অপমান করছেন?
—আরে না না, একটু দরদস্তুর করছি। আচ্ছা, তোমার কথা থাকুক, আমার কথাও থাকুক, একটা মাঝামাঝি রফা করা যাক। তোমার বয়স বত্রিশ।
স্পন্দচ্ছন্দা মুখ ভার করে বলেন, বেশ, তাই না হয় হল।
—লেখাপড়া কদ্দূর? মাছ-তরকারি ধোবার হিসেব এসব লিখতে পারবে?
নাকটি ওপর দিকে তুলে স্পন্দচ্ছন্দা বললেন, মেমের কাছে এম এ ক্লাসের চাইতে বেশী পড়েছি। মশায়ের বিদ্যে কতদূর?
—ফোর্থ কেলাস পর্যন্ত। তবে রবিঠাকুর জানি—ওরে দুরাচার হিন্দু কুলাঙ্গার, এই কি তোদের—
কানে আঙ্গুল দিয়ে স্পন্দচ্ছন্দা বললেন, থাক থাক, খুবে হয়েছে। আয় কত?
—তোমার কোনও চিন্তা নেই। ব্যাঙ্কে খোঁজ নিলেই জানতে পারবে যে আমার দেদার টাকা আছে। বাড়ি, গাড়ি, আসবাব, গহনা, সব তোমার মনের মতন হবে। তোমার এস্টেটের আয় কত?
—পাকিস্থানে পড়েছে অনেক কাল আদায় হয় নি। তবে ভাবনার কিছু নেই। খা ঁসায়েব বদরুদ্দিন আমার বাবার বন্ধু তিনি বলেছেন সব আদায় করে দেবেন।
—তবেই হয়েছে। বেচে ফেল, বেচে ফেল।
——বেশ তো। আপনিই তার ব্যবস্থা করবেন।
—আচ্ছা। বৈষয়িক আলাপ তো এক রকম হল, এখন একট প্রেমালাপ করা যাক। দেখ পদীরানী, আমার সঙ্গে দু দিন ঘর করলেই টের পাবে আমি কি রকম দিলদরিয়া চমৎকার লোক। পষ্ট করে বল দিকি—আমাকে মনে ধরেছে?
—তা ধরেছে।
একজন প্যাণ্ট-শার্ট পরা আধাবয়সী ভদ্রলোক পাইপ টানতে টানতে ঘরে ঢুকলেন। স্পন্দচ্ছন্দা দু পক্ষের পরিচয় করিয়ে দিলেন —ইনি হচ্ছেন মিস্টার মকর রায়, বার-অ্যাট-ল, সম্পর্কে আমার দাদা হন। আর ইনি উমেশ পাল, খুব ধনী পেণ্ট মার্চেণ্ট, আমার ভাবী বর।
মকর রায় বললেন, আরে তাই নাকি! এরই না আজ আসবার কথা ছিল? বাহাদুর লোক, এসেই হৃদয় জয় করেছেন, একেবারে ব্লিৎস ক্লিগ। কংগ্রাচুলেশন মিস্টার পাল, লাকি ডগ, ভাগ্যবান কুত্তা! এই বলে উদ্ভবের হাত সজোরে নেড়ে দিলেন। তার পর বললেন, স্পন্দার মতন মেয়ে লাখে একটি মেলে না মশাই, নাচ গান অ্যাকটিং সব তাতে চৌকস। সিনেমার লোকে সাধাসাধি করছে। এর কাঁচপোকা-নৃত্য যদি দেখেন তো অবাক হয়ে যাবেন।
—কাঁচপোকা নাচে নাকি?
—যখন তখন নাচে না, আরসোলা ধরবার সময় নাচে।
স্পন্দচ্ছন্দা বললেন, জান মকর-দা, মিস্টার পাল হচ্ছেন একজন আদিম হি-ম্যান।
উদ্ভব প্রশ্ন করলেন, সে আবার কাকে বলে? হি-গোটই তো জানি।
মকর রায় বললেন, হি-ম্যান জানেন না? মদ্দা পুরুষ। আমাদের ঋষিরা যাকে বলতেন নরপুংগ্রব বা পুরুষর্ষভ, অর্থাৎ যিনি ষাঁড়ের মতন শিং বাগিয়ে সোজা ছুটে গিয়ে লক্ষ্যস্থানে পৌঁছে যান। দেখন মিস্টার পাল, যদি রঙের কারবার বাড়াতে চান তো আমাকে বলবেন। হুণ্ডাগড় স্টেটের সমস্ত খনি আমার হাতে, অজস্র গের মাটি আর এলা মাটি আছে। দু লাখ যদি ঢালেন তবে এক বছরেই তিন লাখ ফিরে পাবেন। আচ্ছা, সে কথা পরে হবে, আপনারা এখন আলাপ করুন, আমি ওপরে গিয়ে বসছি।
উদ্ধব বললেন, আরে না না, এইখানেই বসুন। আমার ঢাকঢাক গুড়-গুড় নেই মশাই, বিশেষত আপনি যখন সম্পর্কে শালা। দেখুন মকরবাবু, আপনার এই বোনটি হচ্ছেন আমার মার্গিতব্যা।
—সে আবার কি চিজ?
—জানেন না? চিরকাল খোঁজবার আর চাইবার জিনিস। একজন হেডমাস্টার কথাটির মানে বলে দিয়েছেন। আচ্ছা, আজকের মতন উঠি, তামাক খেতে হবে, আপনাদের এখানে তো সে পাট নেই। না না, সিগারেট ফিগারেট চলবে না, গুড়ুক চাই। কাল বিকেলে আবার আসব, গড়গড়া আর তামাকের সরঞ্জামও সব নিয়ে আসব। হাঁ, ভাল কথা—আমার আর একটু জানবার আছে। হ্যাঁগা পদীরানী, শুক্ত, মোচার ঘণ্ট, ছোলার ডালের ধোঁকা—এসব রাঁধতে জান?
স্পন্দচ্ছন্দা ঠোঁট বেকিয়ে বললেন, ওসব আমি খাই না।
—আমি খেতে ভালবাসি। আচ্ছা, মাগুর মাছের কালিয়া, ইলিশের পাতুড়ি, ভাপা দই—এসব করতে জান?
—ও তো বাবুর্চীর কাজ।
—তবে কি ছাই জান! এসব রান্না বাবুর্চীর কাজ নয়, গিন্নীরই করা উচিত। তোমার নাচ দেখে তো আমার পেট ভরবে না।
—ও, আপনি রাঁধুনী গিন্নী চান! একটা কেষ্টদাসী কি কালিদাসী ঘরে আনলেই পারতেন।
হঠাৎ রেগে গিয়ে উদ্ধব বললেন, কি বললে! কালিদাসীর সামনে তুমি দাঁড়াতে পার নাকি?
—অত রাগ কেন মশাই, তিনি বঝি আপনার আগেকার গিন্নী?
উদ্ভব গর্জন করে বললেন, আগেকার কি, দস্তুর মত জলজ্যান্ত এখনকার! তার কাছে তুমি? তরমুজের কাছে তেলাকুচো, কামধেনর কাছে মেনী বেরাল!
স্পন্দচ্ছন্দা চিৎকার করে বললেন, অ্যাঁ, এক স্ত্রী থাকতে আবার বিয়ে করতে এসেছ? ঠক জোচ্চোর, বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও!
মকর রায় বললেন, যাবে কোথায়! রীতিমত ক্রিমিনাল কাণ্ড, ধাপ্পা দিয়ে রাজকন্যা আর রাজ্য আদায় করতে এসেছে। থাম, মজা টের পাইয়ে দেব।
উদ্ধব দাঁত খিচিয়ে কিল দেখিয়ে গট গট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সমস্ত শানে জগবন্ধু বললেন, ব্যাপারটা ভাল হল না। ওরা অমনি ছাড়বে না, তোমাকে জব্দ করবার চেষ্টা করবে।
উদ্ধব বললেন, গিন্নীর নামটা শুনে হঠাৎ কেমন মন খারাপ হয়ে গেল, সামলাতে পারলাম না। তা যাক গে, কি আর করবে।
দু দিন পরে সলিসিটার গুঁই অ্যাণ্ড হুঁই-এর চিঠি এল। রাজকুমারী শ্রীযুক্তেশ্বরী স্পন্দচ্ছন্দা চৌধুরানীকে যে মানসিক আঘাত দেওয়া হয়েছে এবং তজ্জনিত তাঁর যে স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে তার খেসারত স্বরূপ এক লক্ষ টাকা তিন দিনের মধ্যে পাঠানো চাই, অন্যথায় উমেশ পালের বিরুদ্ধে মকদ্দমা রুজু করা হবে।
জগবন্ধু বললেন, মশকিলে ফেললে দেখছি। মকদ্দমার ফল যাই হক, হয়রানি আর কেলেঙ্কারি হবে। ভাবিয়ে তুললে হে!
উদ্ধব বললেন, ভাবনা কিসের। মোক্ষম উপায় আমাদের হাতে রয়েছে। ব্যাঙ্গমার কথা মনে নেই?
জগবন্ধু সোৎসাহে বললেন, রাজী আছ তুমি?
—খূব রাজী। শখ মিটে গেছে, হোটেলের জঘন্য রান্না আর খেতে পারি না। দেখ তো পূর্ণিমা কবে।
পাঁজি দেখে জগবন্ধু বললেন, আজই তো!
সন্ধ্যার সময় দুজনে দক্ষিণেশ্বরের ঘাটে এলেন এবং তিনটি বেলপাতা চিবিয়ে মন্ত্র পাঠ করলেন—বম মহাদেব সকল বস্তু আগের মতন আবার অস্তু। বলেই একটি ডুব দিলেন।
ঘাটে উঠে মাথা মুছতে মুছতে উদ্ধব বললেন, ওহে জগু, আবার দিব্যি একমাথা টাক হয়েছে, শরীরটাও আড়াইমনী হয়ে গেছে। তোমার কেমন হল?
জগবন্ধু বললেন, আমারও মুখে দুপোটি নকল দাঁত এসে গেছে। সব তো হল, এখন বাড়ি গিয়ে বলবে কি? দু হপ্তা আমরা গায়েব হয়ে আছি, তার একটা ভাল রকম কৈফিয়ত দেওয়া চাই।
—সে তুমি ভেবো না। তুমি তা পারবেও না, চিরকাল মাস্টারি করে ছেলেদের শিখিয়েছ—সদা সত্য কথা কহিবে। যা বলবার আমিই বলব। আজ রাতে আর বাড়ি গিয়ে কাজ নেই, হোটেলে ফিরে চল।
হোটেলে এসে দেখলেন, তাঁদের ঘরে চার জন বিছানা পেতে শুয়ে আছে। উদ্ধব ম্যানেজারকে বললেন, আচ্ছা লোক তো আপনি, কিছু না জানিয়ে আমাদের রিজার্ভ করা ঘরে অন্য লোক ঢুকিয়েছেন! এর মানে কি?
ম্যানেজার আশ্চর্য হয়ে বললেন, কে আপনারা?
—ন্যাকা, চিনতে পারছেন না! উমেশ পাল আর জলধর গাঙ্গুলী। উনিশে বোশেখ, মানে দোসরা মে বুধবার থেকে দু হপ্তা এই ঘর আমাদের দখলে আছে।
—দু হপ্তা বলছেন কি মশাই, নেশা করেছেন নাকি? আজই তো বুধবার দোসরা মে উনিশে বোশেখ।
উদ্ভবকে টেনে নিয়ে রাস্তায় এসে জগবন্ধু বললেন, সবই ধুস্তুরী মায়া। গত দু হপ্তা জগতের ইতিহাস থেকে একবারে লোপ পেয়ে গেছে। এখন বাড়ি চল।
রাত প্রায় বারোটার সময় জগবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে উদ্ধব নিজের
বাড়িতে পৌঁছালেন। উদ্ভব-গৃহিণী কালিদাসী বললেন, বলি দুপুর রাত পর্যন্ত দুই ইয়ারে ছিলে কোন্ চুলোয়? ওঁর লক্ষী না হয় ছেড়ে গেছে, তোমার তো ঘরে একটা আপদ-বালাই আছে। দেরি দেখে মানুষটা ভেবে মরছে সে হুঁশ হয় নি বুঝি?
উদ্ধব হাঁপাতে হাঁপাতে কান্নার সুরে বললেন, ওঃ গিন্নী, তোমার শাঁখা-সিঁদুরের জোরে আর এই জগু ভাইএর হিম্মতে আজ প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছি। সন্ধ্যার সময় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ঘাটে গঙ্গার ধারে বসেছিলুম। ভাবলুম মূখে হাত পা ধুয়ে নিই, তার পর মায়ের আরতি দেখব। যেমন জলে নাবা অমনি এক মস্ত কুমির পা কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে চলল—
উদ্ধবের দু পায়ে হাত বুলিয়ে কালিদাসী বললেন, কই দাঁত বসায় নি তো!
—ফোকলা কুমির গিন্নী, একদম ফোকলা। ভাগ্যিস কুমিরটা বুড়ো ছিল তাই পা বেঁচে গেছে। আমার বিপদ দেখে জগু লাঠি নিয়ে লাফিয়ে জলে পড়ল। এক হাতে সাঁতার দেয়, আর এক হাতে ধপাধপ লাঠি চালায়। শেষে চাঁদপাল ঘাটে এসে কুমিরটা মারের চোটে কাবু হয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। তার পর এক ময়রার দোকানে উনুন-পাড়ে বসে জামাকাপড় শুকিয়ে ঘরে ফিরেছি।
কালিদাসী বললেন, মা দক্ষিণেশ্বরী রক্ষা করেছেন, কালই পূজো পাঠাব। রান্না সব জুড়িয়ে জল হয়ে গেছে, গরম করে দিচ্ছি, লুচিও এখনি ভেজে দিচ্ছি। ততক্ষণ তোমরা মুখ হাত পা ধুয়ে একটু জিরিয়ে নাও। গাঙ্গুলী মশায়ের বাড়ি খবর পাঠাচ্ছি, উনি এখানেই খেয়ে দেয়ে যাবেন এখন।
উদ্ধব বললেন, নিশ্চয় নিশ্চয়, এখানেই খাবে হে জগু, এখানেই খাবে। গিন্নীর রান্না তো নয়, অমৃত।
১৩৫৭