ধুস্তুরী মায়া ইত্যাদি গল্প/লক্ষ্মীর বাহন
লক্ষ্মীর বাহন
সাত বৎসর পরে মুচুকুন্দ রায় আলিপুর জেল থেকে খালাস পেলেন। তাঁকে নিতে এলেন শুধু তাঁর শালা তারাপদবাবু; দুই ছেলের কেউ আসে নি। মুচুকুন্দ যদি বিপ্লবী বা কংগ্রেসী আসামী হতেন তবে ফটকের সামনে আজ অভিনন্দনকারীর ভিড় লেগে যেত, ফুলের মালা চন্দনের ফোঁটা জয়ধ্বনি—কিছুরই অভাব হত না। যদি তিনি জেলে যাবার আগে প্রচুর টাকা সরিয়ে রাখতে পারতেন, উকিল ব্যারিস্টার যদি তাঁকে চুষে না ফেলত, তা হলে অন্তত আত্মীয় বন্ধুরা অনেকে আসতেন। কিন্তু নিঃস্ব অরাজনীতিক জেল-ফেরত লোককে কেউ দেখতে চায় না। ভালই হল, মচুকুন্দবাবু মুখ দেখাবার লজ্জা থেকে বেচে গেলেন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি বাড়ি গেলেন না; কারণ বাড়িই নেই, বিক্রি হয়ে গেছে। তিনি তাঁর শালার সঙ্গে একটা ভাড়াটে গাড়িতে চড়ে সোজা হাওড়া স্টেশনে এলেন; সেখানে তাঁর স্ত্রী মাতঙ্গী দেবী অপেক্ষা করছিলেন। তার পর দুপরের ট্রেনে তাঁরা কাশী রওনা হলেন। অতঃপর স্বামী-স্ত্রী সেখানেই বাস করবেন; মাতঙ্গী দেবীর হাতে যে টাকা আছে, তাতেই কোনও রকমে চলে যাবে।
মুচুকুন্দবাবুর এই পরিণাম কেন হল? এ দেশের অসংখ্য কৃতকর্মা চতুর লোকের যে নীতি মুচুকুন্দরও তাই ছিল। যুধিষ্ঠির বোধ হয় একেই মহাজনের পন্থা বলেছেন। এদের একটি অলিখিত ধর্মশাস্ত্র আছে; তাতে বলে, বৃহৎ কাষ্ঠে যেমন সংসর্গদোষ হয় না তেমনি বৃহৎ বা বহুজনের ব্যাপারে অনাচার করলে অধর্ম হয় না। রাম শ্যাম যদুকে ঠকানো অন্যায় হতে পারে, কিন্তু গভর্নমেণ্ট মিউনিসিপ্যালিটি রেলওয়ে বা জনসাধারণকে ঠকালে সাধুতার হানি হয় না। যদিই বা কিঞ্চিৎ অপরাধ হয় তবে ধর্মকর্ম আর লোকহিতার্থে কিছু দান করলে সহজেই তা খণ্ডন করা যেতে পারে। বণিকের একটি নাম সাধু, পাকা ব্যবসাদার মাত্রেই পাকা সাধু। মুচুকুন্দর দুর্ভাগ্য এই যে তিনি শেষরক্ষা করতে পারেন নি, দৈব তাঁর পিছনে লেগেছিল।
দুর্দশাগ্রস্ত মুচুকুন্দবাবু আজকাল কি করছেন তা জানবার আগ্রহ কারও থাকতে পারে না। কিন্তু এককালে তাঁর খুঁটিনাটি সমস্ত খবরের জন্য লোকে উৎসুক হয়ে থাকত, তাঁর নাম-ডাকের সীমা ছিল না। প্রাতঃস্মরণীয় রাজর্ষি মুচুকুন্দ, ভারতজ্যোতি বঙ্গচন্দ্র কলিকাতাভূষণ মুচুকুন্দ— এইসব কথা ভক্তদের মুখে শোনা যেত। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতরা বলতেন, ধন্য শ্রীমুচুকুন্দ, যাঁর কীর্তিতে কুল পবিত্র হয়েছে, জননী কৃতার্থা হয়েছেন, বসুন্ধরা পুণ্যবতী হয়েছেন। বিজ্ঞ লোকেরা বলতেন, বাহাদুর বটে মুচুকুন্দ, কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা, মুসলিম লীগ আর গভর্নমেণ্ট সর্বত্র ওঁর খাতির; ভদ্রলোক বাঙালীর মুখ উজ্জ্বল করেছেন, উনি একাই সমস্ত মারোয়াড়ী গুজরাটী পারসী আর পঞ্জাবীর কান কাটতে পারেন, লাট মন্ত্রী পুলিস—সবই ওঁর মুঠোর মধ্যে। বকাট ছেলেরা বলত, মুচুর মতন মানুষ হয় না মাইরি, চাইবামাত্র আমাদের সর্বজনীনের জন্যে পাঁচ শ টাকা ঝড়াক্সে ঝেড়ে দিলে। সেই আট-দশ বৎসর আগেকার প্রখ্যাতনামা উদ্যোগী পুরুষসিংহের কথা এখন বলছি।
মুচুকুন্দ রায়ের প্রকাণ্ড বাড়ি, প্রকাণ্ড মোটর, প্রকাণ্ড পত্নী। তিনি নিজে একট, বেঁটে আর পেট-মোটা, কিন্তু তার জন্য তাঁর আত্মসম্মানের হানি হয় নি; বন্ধুরা বলতেন, তাঁর চেহারার সঙ্গে নেপোলিয়নের খুব মিল আছে। ইংরেজ জার্মন মার্কিন প্রভৃতির কিন্তু খ্যাতি শোনা যায় যে তারা সব কাজ নিয়ম অনুসারে করে; মুচুকুন্দ তাদের হারিয়ে দিয়েছেন। সদ্য অয়েল করা দামী ঘড়ির মতন সুনিয়ন্ত্রিত মসৃণ গতিতে তাঁর জীবনযাত্রা নির্বাহ হয়। অন্তরঙ্গ বন্ধুরা পরিহাস করে বলেন, তাঁর কাছে দাঁড়ালে চিকচিক শব্দ শোনা যায়। আরও আশ্চর্য এই যে, ইহকাল আর পরকাল দু দিকেই তাঁর সমান নজর আছে, তবে ধর্মকর্ম সম্বন্ধে তিনি নিজে মাথা ঘামান না, তাঁর পত্নীর আজ্ঞাই পালন করেন।
প্রত্যহ ভোর পাঁচটার সময় মুচুকুন্দর ঘুম ভাঙে; সেই সময় একজন মাইনে করা বৈরাগী রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাঁকে পাঁচ মিনিট হরিনাম শোনায়। তার পর প্রাতঃকৃত্য সারা হলে একজন ডাক্তার তাঁর নাড়ীর গতি আর ব্লাডপ্রেশার দেখে বলে দেন আজ সমস্ত দিনে তিনি কতখানি ক্যালরি প্রোটিন ভাইটামিন প্রভৃতি উদরস্থ করবেন এবং কতটা পরিশ্রম করবেন। সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত পুরুত ঠাকুর চণ্ডীপাঠ করেন, মুচুকুন্দ কাগজ পড়তে পড়তে চা খেতে খেতে তা শোনেন। তার পর নানা লোক এসে তাঁর নানা রকম ছোটখাটো বেনামী কারবারের রিপোর্ট দেয়। যেমন—রিক্শ, ট্যাক্সি, লরি, হোটেল, দেশী মদের এবং আফিম গাঁজা ভাং চরসের দোকান ইত্যাদি। বেলা নটার সময় একজন মেদিনীপুরী নাপিত তাঁকে কামিয়ে দেয়, তার পর দুজন বেনারসী হাজাম তাঁকে তেল মাখিয়ে আপাদমস্তক চটকে দেয়, যাকে বলে দলাই-মলাই বা মাসাঝ। দশটার সময় একজন ছোকরা ডাক্তার তাঁর প্রস্রাব পরীক্ষা করে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দেয়। তার পর মুচুকুন্দ চর্ব্য-চূষ্য-লেহ্য-পেয় ভোজন করে বিশ্রাম করেন এবং ঠিক পৌনে বারোটায় প্রকাণ্ড মোটরে চড়ে তাঁর অফিসে হাজির হন।
বড় বড় ব্যবসায় সংক্রান্ত কাজ মুচুকুন্দ তাঁর অফিসেই নির্বাহ করেন। অনেক লিমিটেড কম্পানির ম্যানেজিং এজেন্সি তাঁর হাতে, কাপড়-কল, চট-কল, চা-বাগান, কয়লার খনি, ব্যাঙ্ক, ইনশিওরেন্স ইত্যাদি; তা ছাড়া তিনি কনট্রাকটারিও করেন। কাজ শেষ হলে তিনি মোটরে চড়ে একটু বেড়ান এবং ঠিক ছটার সময় বাড়িতে ফেরেন। তার পর কিঞ্চিৎ জলযোগ করে তাঁর ড্রইংরুমে ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়েন। তাঁর অনুগত বন্ধু আর হিতৈষীরাও একে একে উপস্থিত হন। এই সময় ভক্তিরত্ন মশাই আধ ঘণ্টা ভাগবত পাঠ করেন, মুচুকুন্দ গল্প করতে করতে তা শোনেন।
মুচুকুন্দর ধনভাগ্য যশোভাগ্য পত্নীভাগ্য সবই ভাল, কিন্তু ছেলে দুটো তাঁকে নিরাশ করেছে। বড় ছেলে লখা (ভাল নাম লক্ষ্মীনাথ) কুসঙ্গে পড়ে অধঃপাতে গেছে, দু বেলা বাড়িতে এসে তার মায়ের কাছে খেয়ে যায়, তার পর দিন রাত কোথায় থাকে কেউ জানে না। মুচুকুন্দ বলেন, ব্যাটা পয়লা নম্বর গর্ভস্রাব। ছোট ছেলে সরা (ভাল নাম সরস্বতীনাথ) লেখাপড়া শিখেছে, কিন্তু কলেজ ছেড়েই ঝাঁকড়া চুল আর জুলফি রেখে আল্ট্রা-আধুনিক সুপার-দুর্বোধ্য কবিতা লিখছে। অনেক চেষ্টা করেও মুচুকুন্দ তাকে অফিসের কাজ শেখাতে পারেন নি, অবশেষে হতাশ হ’য়ে বলেছেন, যা ব্যাটা দু নম্বর গর্ভস্রাব, কবিতা চুষেই তোকে পেট ভরাতে হবে। মুচুকুন্দর শালা তারাপদই তাঁর প্রধান সহায়, একটু বোকা, কিন্তু বিশ্বস্ত কাজের লোক।
মুচুকুন্দ-গৃহিণী মাতঙ্গী দেবী লম্বা-চওড়া বিরাট মহিলা (হিংসুটে মেয়েরা বলে একখানা একগাড়ি মহিলা), যেমন কর্মিষ্ঠা তেমনি ধর্মিষ্ঠা। আধুনিক ফ্যাশন আর চাল-চলন তিনি দুচক্ষে দেখতে পারেন না। ধর্মকর্ম ছাড়া তাঁর অন্য কোনও শখ নেই, কেবল নিমন্ত্রণে যাবার সময় এক গা ভারী ভারী গহনা আর ন্যাফথালিনবাসিত বেনারসী পরেন। তিনি স্বামীর সব কাজের খবর রাখেন এবং ধনবদ্ধি আর পাপক্ষয় যাতে সমান তালে চলে সে বিষয়ে সতর্ক থাকেন। মুচুকুন্দ যদি অর্থের জন্য কোনও কুকর্ম করেন তবে মাতঙ্গী বাধা দেন না, কিন্তু পাপ খণ্ডনের জন্য স্বামীকে গঙ্গাস্নান করিয়ে আনেন, তেমন তেমন হলে স্বস্ত্যয়ন আর ব্রাহ্মণভোজনও করান। মুচুকুন্দর অট্টালিকায় বার মাসে তের পার্বণ হয়, পুরুত ঠাকুরের জিম্মায় গৃহদেবতা নারায়ণশিলাও আছেন। কিন্তু মাতঙ্গীর সব চেয়ে ভক্তি লক্ষ্মীদেবীর উপর। তাঁর পূজোর ঘরটি বেশ বড়, মারবেলের মেঝে, দেওয়ালে নকশা-কাটা মিনটন টালি, লক্ষ্মীর চৌকির উপর আলপনাটি একজন বিখ্যাত চিত্রকরের আঁকা। ঘরের চারিদিকের দেওয়ালে অনেক দেবদেবীর ছবি ঝুলছে এবং উঁচু বেদীর উপর একটি রূপোর তৈরী মাদ্রাজী লক্ষীমূর্তি আছে। মাতঙ্গী রোজ এই ঘরে পূজো করেন, বৃহস্পতিবারে একটু ঘটা করে করেন। সম্প্রতি তাঁর স্বামীর কারবার তেমন ভাল চলছে না সেজন্য মাতঙ্গী পূজোর আড়ম্বর বাড়িয়ে দিয়েছেন।
আজ কোজাগর পূর্ণিমা, মুচুকুন্দ সব কাজ ছেড়ে দিয়ে সহধর্মিণীর সঙ্গে ব্রতপালন করছেন। সমস্ত রাত দুজনে লক্ষ্মীর ঘরে থাকবেন, মাতঙ্গী মোটেই ঘুমুবেন না, স্বামীকেও কড়া কফি আর চুরুট খাইয়ে জাগিয়ে রাখবেন। শাস্ত্রমতে এই রাত্রে জুয়া খেলতে হয় সেজন্য মাতঙ্গী পাশা খেলার সরঞ্জাম আর বাজি রাখবার জন্য শ-খানিক টাকা নিয়ে বসেছেন। মুচুকুন্দ নিতান্ত অনিচ্ছায় পাশা খেলছেন, ঘন ঘন হাই তুলছেন আর মাঝে মাঝে কফি খাচ্ছেন।
রাত বারটার সময় পূর্ণিমার চাঁদ আকাশের মাথার উপর উঠল। ঘরে পাঁচটা ঘিএর প্রদীপ জ্বলছে এবং খোলা জানালা দিয়ে প্রচুর জ্যোৎস্না আসছে। মুচুকুন্দ আর মাতঙ্গী দেখলেন, জানালার বাইরে একটা বড় পাখি নিঃশব্দে ঘরে ঘরে উড়ে বেড়াচ্ছে, তার ডানায় চাঁদের আলো পড়ে ঝকমক করে উঠছে। মাতঙ্গী জিজ্ঞাসা করলেন, কি পাখি ওটা? মুচুকুন্দ বললেন, পেঁচা মনে হচ্ছে। পাখিটা হঠাৎ হুহু-হুম হুহু-হুম শব্দ করে ঘরে ঢুকে লক্ষ্মীর মূর্তির নীচে স্থির হয়ে বসল। মুচুকুন্দ তাড়াতে যাচ্ছিলেন, মাতঙ্গী তাঁকে থামিয়ে চুপি চুপি বললেন, খবরদার, অমন কাজ ক’রো না, দেখছ না মা-লক্ষ্মীর বাহন এসেছেন। এই বলে তিনি গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করলেন, তাঁর দেখাদেখি মুচুকুন্দও করলেন। পেঁচা মাথা নেড়ে মাঝে মাঝে হুহু হুম শব্দ করতে লাগল।
লক্ষ্মী পেঁচা তাতে সন্দেহ নেই, কারণ মুখটি সাদা, পিঠে সাদার উপর ঘোর খয়েরী রঙের ছিট। কাল পেঁচা নয়, কুটুরে পেঁচা নয়, হুতুমও নয়, যদিও আওয়াজ কতকটা সেই রকম। পেঁচার ডাক সম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মতভেদ আছে। সংস্কৃতে বলে ঘুৎকার, ইংরেজীতে বলে হূট। শেকস্পীয়ার লিখেছেন, টু টুইট টু হু। মদনমোহন তর্কালংকার তাঁর শিশুশিক্ষায় লিখেছেন, ছোট ছেলের কান্নার মতন। যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি মহাশয়ের মতে কাল পেঁচা কুক-কুক-কুক অথবা করুণ শব্দ করে, কুটুরে পেচা কেচা-কেচা-কেচা রব করে, হুতুম পেঁচা হুউম হুউম করে। লক্ষ্মী পেচার বুলি তিনি লেখেন নি। মুচুকুন্দর গৃহাগত পেঁচাটির ডাক শুনে মনে হয় যেন দেওয়ালের ফুটো দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বইছে।
মাতঙ্গী একটি রূপোর রেকাবিতে কিছু লক্ষ্মীপূজোর প্রসাদ রেখে পেঁচাকে নিবেদন করলেন। অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করে পেঁচা একটু ক্ষীর আর ছানা খেলে, বাদাম পেস্তা আঙুর ছুঁলে না। মুচুকুন্দ বললেন, মাংসাশী প্রাণী, যদি পুষতে চাও তো আমিষ খাওয়াতে হবে। মাতঙ্গী বললেন, কাল থেকে মাগুর মাছ আর কচি পাঁঠার ব্যবস্থা করব।
পেঁচা মহা সমাদরে বাড়িতেই রয়ে গেল। মুচুকুন্দ তাকে কাকাতুয়ার মতন দাঁড়ে বসাবেন স্থির করে পায়ে রূপোর শিকল বাঁধতে গেলেন, কিন্তু লক্ষ্মীর বাহন চিৎকার করে তাঁর হাতে ঠুকরে দিলে। তার পর থেকে সে যথেচ্ছাচারী মহামান্য কুটম্বের মতন বাস করতে লাগল। লক্ষ্মীপূজোর ঘরেই সে সাধারণত থাকে, তবে মাঝে মাঝে অন্য ঘরেও যায় এবং রাত্রে অনেকক্ষণ বাইরে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু পালাবার চেষ্টা মোটেই করে না। বাড়ির চাকররা খুশী নয়, কারণ পেঁচা সব ঘর নোংরা করছে। মাতঙ্গী সবাইকে শাসিয়ে দিয়েছেন—খবরদার, পেঁচাবাবাকে যে গাল দেবে তাকে ঝাঁটা মেরে বিদেয় করব।
পেঁচার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মুচুকুন্দবাবুর কারবারের উন্নতি দেখা গেল। বার-তের বৎসর আগে তিনি তাঁর দূর সম্পর্কের ভাই পঞ্চানন চৌধুরীর সঙ্গে কনট্রাকটারি আরম্ভ করেন। যুদ্ধ বাধলে এঁরা বিস্তর গরু, ভেড়া ছাগল শুওর এবং চাল ডাল ঘি তেল ইত্যাদি সরবরাহের অর্ডার পান, তাতে বহু লক্ষ টাকা লাভও করেন। তার পর দুজনের ঝগড়া হয়, এখন পঞ্চানন আলাদা হয়ে শেঠ কৃপারাম কচালুর সঙ্গে কাজ করছেন। গত বৎসর মুচুকুন্দ মিলিটারি ঠিকাদারিতে সুবিধা করতে পারেন নি, কৃপারাম আর পঞ্চাননই সমস্ত বড় বড় অর্ডার বাগিয়েছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, পেঁচা আসবার পরদিনই মুচুকুন্দ টেলিগ্রাম পেলেন যে তাঁর দশ হাজার মন ঘিএর টেণ্ডারটি মঞ্জুর হয়েছে।
এখন আর কোনও সন্দেহ রইল না যে মা-লক্ষী প্রসন্ন হয়ে স্বয়ং তাঁর বাহনটিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, যত দিন মুচুকুন্দ তার পক্ষপুটের আশ্রয়ে থাকবেন তত দিন কৃপারাম আর পঞ্চানন কোনও অনিষ্ট করতে পারবে না।
তিন দিন পরে কৃপারাম কচালু সকালবেলা মুচুকুন্দবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। মুচুকুন্দ বললেন, আসুন আসুন শেঠজী, আজ আমার কি সৌভাগ্য যে আপনার দর্শন পেলুম হুকুম করুন কি করতে হবে।
কাষ্ঠ হাসি হেসে কৃপারাম বললেন, আপনাকে হুকুম করবার আমি কে বাবু সাহেব, আপনি হচ্ছেন কলকত্তা শহরের মাথা। আমি এসেছি একটি খবর জানতে। আপনার এখানে একটি উল্লু আছে?
মুচুকুন্দ বললেন, উল্লুক? একটি কেন, দুটি আছে, আমার ছেলে দুটোর কথা বলছেন তো?
—আরে রাম কহ। উল্লুক নয়, উল্লু যাকে বলে পেঁচ।
—ইস্ক্রুপ? সে তো হার্ডওয়ারের দোকানে দেদার পাবেন।
—আঃ হা, সে পেঁচ নয় চিড়িয়া পেঁচ, তাকেই আমরা উল্লু বলি, রাত্রে চুপচাপ উড়ে বেড়ায়, চুহা কবুতর মেরে খায়।
—ও, পেঁচা! তাই বলুন। হাঁ, একটি পেঁঁচা কদিন থেকে এখানে দেখছি বটে।
কৃপারাম হাত জোড় করে বললেন, বাবুসাহেব, ওই পেঁচা আমার পোষা, শ্রীমতীজী—মানে আমার ঘরবালী—ওকে খুব পিয়ার করেন। আপনি রেখে কি করবেন, আমার চিড়িয়া আমাকে দিয়ে দিন।
মুচুকুন্দ চোখ কপালে তুলে বললেন, আপনার পোষা চিড়িয়া! তবে এখানে এল কি করে? পিঁজরায় রাখতেন না?
—ও পিঁজরায় থাকে না বাবুজী। এক বছর আগে আমার বাড়ির ছাতে এসেছিল, সেখানে একটা কবুতরকে মার ডাললে। আমি তাড়া করলে আমার কোঠির মাথায় যে আমগাছ আছে তাতে চড়ে বসল। সেখানেই থাকত, শ্রীমতীজী তাকে খানা দিতেন। সেখান থেকে এখানে পালিয়ে এসেছে। এখন দয়া করে আমাকে দিয়ে দিন।
মুচুকুন্দবাবু সহাস্যে বললেন, শেঠজী, মহাত্মা গান্ধী স্বাধীনতার জন্য এত লড়ছেন তবু এখনও আমরা ইংরেজের গোলাম হয়ে আছি। কিন্তু জংলী পাখি কারও গোলাম নয়। ওই পেঁচা মর্জি মাফিক কিছুদিন আপনার আমগাছে ছিল, এখন আমার বাড়িতে এসেছে। ও কারও পোষা নয়, স্বাধীন পক্ষী, আজাদ চিড়িয়া। দু দিন পরে হয়তো তেলারাম পিছলচাঁদের গদিতে যাবে, আবার সেখান থেকে আলিভাই সালেজীর কোঠিতে হাজির হবে। ও পেঁচার ওপর মায়া করবেন না।
কৃপারাম রেগে গিয়ে বললেন, আপনি ফিরত দিবেন না?
মুচুকুন্দ মধুর স্বরে উত্তর দিলেন, আমি ফেরত দেবার কে শেঠজী? মালিক তো পরমাৎমা, তিনিই তামাম জানোয়ারকে চালাচ্ছেন।
—তবে তো আদালতে যেতে হবে।
—তা যেতে পারেন। আদালত যদি বলে যে ওই জংলী পেঁচা আপনার সম্পত্তি তবে বেলিফ পাঠিয়ে ধরে নিয়ে যাবেন।
মুচুকুন্দ রায়ের বাড়ি থেকে পঞ্চানন চৌধুরীর বাড়ি বেশী দূর নয়। কৃপারাম সেখানে উপস্থিত হলেন। পঞ্চানন বললেন, নমস্কার শেঠজী, অসময়ে কি মনে করে? খবর সব ভাল তো?
কৃপারাম বললেন, ভাল আর কোথা পঞ্চু ভাই, ঘিএর কনট্রাক্ট তো বিলকুল মুচুবাবু পেয়ে গেল। আমার বড় আশা ছিল যে কমসে-কম চার লাখ মুনাফা হবে, আমার তিন লাখ তোমার এক লাখ থাকবে, তা হল না। এখন শুন পঞ্চবাবু, তোমাকে একটি কাম করতে হবে। একটি উল্লু—তোমরা যাকে বল পেঁচা—আমার কোঠি থেকে পালিয়ে মুচুকুন্দবাবুর কোঠিতে গেছে। তিনি ফিরত দিতে চাচ্ছেন না। ছিনিয়ে আনতে হবে।
পঞ্চানন বললেন, পেঁচায় আপনার কি দরকার?
—বহুত ভাল পেঁচা, আমার ঘরবালীর খুব পিয়ারের পেঁচা। তাঁর এক বঙ্গালিন সহেলী আছেন, তিনি বলেছেন পেঁচাটি হচ্ছে লছমী মায়ীর সওয়ারি অসলী লক্ষ্মী পেঁচা। এই পেঁচার আশীর্বাদেই তো পরসাল আমাদের কনট্রাক্ট মিলেছিল। আবার যেমনি সে মুচুকুন্দবাবুর কাছে গেল অমনি তিনি ঘিএর অর্ডার পেয়ে গেলেন।
—বটে! তা হলে তো পেঁচাটিকে উদ্ধার করতেই হবে। আপনি মুচুকুন্দর নামে নালিশ ঠুকে দিন।
—নালিশে কিছু হবে না, পেঁচা তো পিঁজরায় ছিল না, আমার কোঠির হাথায় আমগাছে থাকত। তুমি দুসরা মতলব কর, যেমন করে পার পেঁচাটিকে আমার কাছে পৌঁছে দাও, খরচা যা লাগে আমি দিব।
পঞ্চানন একটু ভেবে বললেন, শক্ত কাজ, সময় লাগবে, হাজার দু-হাজার খরচও পড়তে পারে।
—খরচার জন্য ভেবো না, পেঁচা আমার চাই। কিন্তু দেরি করবে না, আবার তো এক মাসের মধ্যেই একটি বড় টেণ্ডার দিতে হবে।
পঞ্চানন বললেন, আচ্ছা, আপনি ভাববেন না, যত শীঘ্র পারি পেঁচাটিকে আমি উদ্ধার করব।
মুচুকুন্দর বড় ছেলে লখা ছেলেবেলায় পঞ্চুকাকার খুব অনুগত ছিল, এখনও তাঁকে একটু খাতির করে। পঞ্চানন তার গতিবিধির খবর রাখেন, রাত নটায় যখন সে খাওয়ার পর বাড়ি থেকে চুপি চুপি বেরচ্ছে তখন তাকে ধরলেন। লখাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে বললেন, বাবা লখু, তোমাকে একটি কাজ করতে হবে, তার জন্যে অনেক টাকা পাবে। এই নাও, আগাম পঞ্চাশ টাকা এখনই দিচ্ছি, কাজ হাসিল হলে আরও দেব।
টাকা পকেটে পরে লখা বললে, কি কাজ পঞ্চু কাকা?
পঞ্চানন লখার কাঁধে একটি আঙুল ঠেকিয়ে চোখ টিপে কণ্ঠস্বর নীচু করে বললেন, খুব লুকিয়ে কাজটি উদ্ধার করতে হবে বাবা, কেউ যেন টের না পায়।
—বাবার লোহার আলমারি ভাঙতে হবে?
—আরে না না। অমন অন্যায় কাজ আমি বলব কেন। তোমাদের বাড়িতে একটা পেঁচা আছে না? সেটা আমার চাই, চুপি চুপি ধরে আনতে হবে। যেন না চেঁচায়, তা হলে সবাই জেনে ফেলবে।
লখা বললে, মা বলে ওটা লক্ষী পেঁচা, খুব পয়মন্ত। যদি অন্য পেঁচা ধরে এনে দিই তাতে চলবে না?
—উঁহু, ওই পেঁচাটিই দরকার। আমার গুরুদেব অঘোরী বাবা চেয়েছেন, কি এক তান্ত্রিক সাধনা করবেন। যে-সে পেঁচায় চলবে না, তোমাদের বাড়ির পেঁচাটিরই শাস্ত্রোক্ত সব লক্ষণ আছে। পারবে না লখু?
কিছুক্ষণ ভেবে লখা বললে, তা আমি পারব, কিন্তু দিন দশবার দেরি হবে, পেঁচাটাকে আগে বশ করতে হবে। এখন তো ব্যাটা আমাকে দেখলেই ঠোকরাতে আসে। কত টাকা দেবেন?
—পঞ্চাশ দিয়েছি, পেঁচা আনলে আরও পঞ্চাশ দেব।
—তাতে কিছুই হবে না, অন্তত আরও পাঁচ শ চাই। তা ছাড়া কোকেনের জন্য শ-খানিক। দারোয়ানটাকেও ঘুষ দিতে হবে, নইলে বাবাকে বলে দেবে।
—কোকেন কি হবে, তুমি খাও নাকি?
—রাম বল, ভদ্রলোকে কোকেন খায় না। আমার জন্যে নয়, ওই পেঁচাটাকে কোকেন ধরিয়ে বশ করতে হবে, তবে তাকে আনতে পারব।
অনেক দর কষাকষির পর রফা হল যে পেঁচা পঞ্চাননের হস্তগত হলে লখা আরও আড়াই শ টাকা পাবে।
কৃপারাম নিজে এসে বা টেলিফোন করে রোজ খবর নিতে লাগলেন পেঁচা এল কিনা। পঞ্চানন তাঁকে বললেন, অত ব্যস্ত হবেন না, জানাজানি হয়ে যাবে। এলেই আপনাকে খবর দেব, আপনি নিজে এসে নিয়ে যাবেন।
দশ দিন পরে রাত এগারটার সময় লখা একটা রিক্শয় চড়ে পঞ্চাননের বাড়িতে এল। তার সঙ্গে একটি ঝুড়ি, কাপড় দিয়ে মোড়া। পঞ্চানন অত্যন্ত খুশী হয়ে মাল সমেত লখাকে নিজের অফিস-ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজায় খিল দিলেন। কাপড় সরিয়ে নিলে দেখা গেল পেঁচা বুঁদ হয়ে চুপ করে বসে আছে।
লখা বললে, শুনুন পঞ্চুকাকা, এটাকে দিনের বেলায় ঘরে বন্ধ করে রাখবেন, কিন্তু রাত্রে ছেড়ে দেবেন, ও ইঁদুর পাখির ছানা এইসব ধরে খাবে, নইলে বাঁচবে না। আর এই শিশিটা রাখুন, এতে পাঁচ শ ভাগ চিনির সঙ্গে এক ভাগ কোকেন মিশনো আছে। রোজ বিকেলে চারটের সময় পেঁচাকে অল্প এক চিমটি খেতে দেবেন। একটা ছোট রেকাবিতে রেখে নিজের হাতে ওর সামনে ধরবেন, তা হলেই খুঁটে খুঁটে খাবে। যেখানেই থাকুক রোজ মৌতাতের সময় ঠিক আপনার কাছে হাজির হবে।
পঞ্চানন মুগ্ধ হয়ে বললেন, উঃ, লখু তোমার কি বুদ্ধি বাবা! কোকেন ধরালে পেঁচা আর কারও বাড়ি যাবে না, কি বল?
লখা বললে, যাবার সাধ্য কি, ও চিরকাল আপনার গোলাম হয়ে থাকবে।
বার দিন হয়ে গেল তবু পেঁচার কোনও খবর আসছে না দেখে কৃপারাম উদ্বিগ্ন হয়ে পঞ্চাননের বড়ি এলেন। পঞ্চানন জানালেন, অনেক হাঙ্গামা আর খরচ করে তিনি পেঁচাটিকে হস্তগত করতে পেরেছেন।
কৃপারাম উৎফুল্ল হয়ে বললেন, বাহবা পঞ্চু ভাই! এনে দাও, এনে দাও, আমি এখনই মোটরে করে নিয়ে যাব। খরচ কত পড়েছে বল, আমি চেক লিখে দিচ্ছি।
পঞ্চানন একটু চুপ করে থেকে বললেন, খরচ বিস্তর লাগবে।
—কত? পাঁচ শ? হাজার?
—উঁহু, ঢের বেশী।
—বল না কত।
পঞ্চানন আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, শুনুন শেঠজী—লাখ পেঁচার মধ্যে একটি লক্ষ্মী পেঁচা মেলে, আবার দশ লাখ লক্ষ্মী পেঁচার মধ্যে একটি রাজলক্ষ্মী পেঁচা পাওয়া যায়। ইনি হলেন সেই আদত রাজলক্ষ্মী পেঁচা, সাত রাজার ধন এক মানিক। পঞ্চাশটি গণেশজীর চাইতে এঁর কুদরত বেশী। এমন ইনভেস্টমেণ্ট আর কোথাও পাবেন না, আপনার বাড়িতে থাকলে বহু লক্ষ টাকা আপনি কামাতে পারবেন, আমি তার ভাগ চাই না। আমাকে দশ লাখ নগদ দিন, আমি পেঁচা ডেলিভারি দেব।
কৃপারাম অত্যন্ত চটে গিয়ে বললেন, পঞ্চুবাবু তুমি এত বড় বেইমান নিমকহারাম ঠক জুয়াচোর তা আমার মালুম ছিল না। দু হাজার টাকা নিয়ে পেঁচা দেবে কিনা বল, না দাও তো মুশকিলে পড়বে।
—আমার এক কথা, নগদ দশ লাখ চাই, ডেলিভারি এগেন্স্ট ক্যাশ। আপনি না দেন তো অন্য লোক দেবে, এই লড়াইএর বাজারে রাজলক্ষ্মী পেঁচার খদ্দের অনেক আছে।
কৃপারাম বললেন, আচ্ছা, তোমাকে আমি দেখে লিব। এই বলে গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কৃপারাম তুখড় লোক। তিনি ভেবে দেখলেন, পঞ্চাননের কাছ থেকে পেঁচা চুরি করে আনলে ঝঞ্ঝাট মিটবে না, তাঁর বাড়ি থেকে আবার চুরি যেতে পারে। অতএব এক শত্রুর সঙ্গে রফা করে আর এক শত্রুকে শায়েস্তা করতে হবে। তিনি সেই দিনই সন্ধ্যার সময় মুচুকুন্দবাবুর সঙ্গে দেখা করলেন। মুচুকুন্দর মন ভাল নেই, তাঁর গৃহিণীও পেঁচার শোকে আহার নিদ্রা ত্যাগ করেছেন।
কৃপারাম বললেন, নমস্তে মুচুবাবু। আমার চিড়িয়া আপনি দিলেন না, জবরদস্তি ধরে রাখলেন, এখন দেখছেন তো, সে দুসরা জায়গায় গেছে।
মুচুকুন্দ ব্যগ্র হয়ে বললেন, আপনি জানেন নাকি কোথায় আছে?
—হাঁ, জানি। আপনার ভাই সেই পঞ্চু শালা চোরি করে নিয়ে গেছে, দশ লাখ টাকা না পেলে ছাড়বে না। মুচুবাব, আমার কথা শুনুন, আমার সাথ দোস্তি করুন। ব্যাঙ্ক কটন-মিল ওগয়রহ আপনার থাকুক, আমি তার ভাগ চাই না, কেবল মিলিটারি ঠিকার কাজ আপনি আর আমি এক সাথ করব, মুনাফার বখরা আধাআধি। পঞ্চুর সঙ্গে আমার ফরাগত হয়ে গেছে। লক্ষ্মী পেঁচা পালা করে এক মাস আপনার কাছে এক মাস আমার কাছে থাকবে, তাহলে আর আমাদের মধ্যে ঝগড়া হবে না। বলুন, এতে রাজী আছেন?
মুচুকুন্দ বললেন, আগে পেঁচা উদ্ধার করুন।
—সে আপনি ভাববেন না, দু দিনের মধ্যে পেঁচা আপনার বাড়ি হাজির হবে। আমার মতলব শুনুন। ফজলু আর মিসরিলাল গুণ্ডাকে আমি লাগাব। তারা তাদের দলের লোক নিয়ে গিয়ে কাল দুপহর রাতে পঞ্চুর বাড়িতে ডাকাতি করবে, যত পারে লুঠ করবে, পঞ্চুকে ঐসা মার লাগাবে যে আর কখনও সে খাড়া হতে পারবে না।
—পেঁচার কি হবে?
—সে আপনি ভাববেন না। আমি কাছেই ছিপিয়ে থাকব, ফজলু আর মিসরিলাল আমার হাতেই পেঁচা দেবে।
মুচুকুন্দ বললেন, বেশ, আমি রাজী আছি। পেঁচা নিয়ে আসুন, আপনার সঙ্গে পাকা এগ্রিমেণ্ট করব।
পুলিস সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট খাঁ সাহেব করিমুল্লা মুচুকুন্দবাবুর বিশিষ্ট বন্ধু। রাত আটটার সময় তাঁর কাছে গিয়ে মুচুকুন্দ বললেন, খাঁ সাহেব, সুখবর আছে। কি খাওয়াবেন বলুন।
তেঁতুল-বিচির মতন দাঁত বার করে করিমুল্লা বললেন—তওবা! আপনি যে উলটো কথা বলছেন সার। পুলিস খাওয়ায় না, খায়।
মুচুকুন্দ বললেন, বেশ, আপনি আমার কাজ উদ্ধার করে দিন, আমিই আপনাকে খাওয়াব। এখন শুনুন—আমি খবর পেয়েছি, কাল দুপুর রাতে পঞ্চানন চৌধুরীর বাড়িতে ডাকাতি হবে। পঞ্চুকে আপনি জানেন তো? দূর সম্পর্কে আমার ভাই হয়। ডাকাতের সর্দার হচ্ছেন স্বয়ং শেঠ কৃপারাম।
—বলেন কি, কৃপারাম কচালু?
—হাঁ, তিনিই। তাঁর সঙ্গে ফজলু আর মিসরিলালের দলও থাকবে। আপনি পঞ্চুর বাড়ির কাছাকাছি পুলিস মোতায়েন রাখবেন। ডাকাতির পরেই সবাইকে গ্রেপতার করে চালান দেবেন, মায় কৃপারাম। তাকে কিছুতেই ছাড়বেন না, বরং ফজলু আর মিসরিকে ছাড়তে পারেন।
—ডাকাতির পরে গ্রেপতার কেন? আগে করাই তো ভাল।
—না না, তা হলে সব ভেস্তে যাবে। আর শুনুন—আমার একটি পেঁচা ছিল, পঞ্চু সেটাকে চুরি করেছে। আবার কৃপারাম পঞ্চুর ওপর বাটপাড়ি করতে যাচ্ছে। সেই পেঁচাটি আপনি আমাকে এনে দেবেন, কিন্তু যেন জখম না হয়।
—ও, তাই বলুন, পেঁচাই হচ্ছে বখেড়ার মূল! মেয়েমানুষ হলে বুঝতুম, পেঁচার ওপর আপনাদের এত খাহিশ কেন? কাবাব বানাবেন নাকি?
—এসব হিন্দুশাস্ত্রের কথা, আপনি বুঝবেন না। আমার কাজটি উদ্ধার করে দিন, সরকারের কাছে আপনার সুনাম হবে, খাঁ বাহাদুর খেতাব পেয়ে যাবেন, আমিও আপনার মান রাখব।
করিমুল্লার কাছে প্রতিশ্রুতি পেয়ে মুচুকুন্দবাবু বাড়ি ফিরে গেলেন।
পরদিন রাত বারটার সময় পঞ্চানন চৌধুরীর বাড়িতে ভীষণ ডাকাতি হল। নগদ টাকা আর গহনা সব লুট হয়ে গেল। পঞ্চাননের মাথায় আর পায়ে এমন চোট লাগল যে তিনি পনের দিন হাসপাতালে বেহুঁশ হয়ে রইলেন। তিনটে ডাকাত ধরা পড়ল, কিন্তু ফজলু আর মিসরিলাল পালিয়ে গেল। কৃপারাম পেঁচার খাঁচা নিয়ে একটা গলি দিয়ে সরে পড়বার চেষ্টা করছিলেন, তিনিও গ্রেপ্তার হলেন। সকালবেলা স্বয়ং খাঁ সাহেব করিমুল্লা মুচুকুন্দর হাতে পেঁচা সমর্পণ করলেন। মাতঙ্গী দেবী শাঁক বাজিয়ে লক্ষীর বাহনকে ঘরে তুললেন।
পেঁচা অক্ষত শরীরে ফিরে এসেছে, কিন্তু তার ফুর্তি নেই। সমস্ত দিন সে মুখ হাঁড়ি করে বসে রইল। নিশ্চিন্ত হবার জন্য পঞ্চানন তাকে ডবল মাত্রা খাওয়াচ্ছিলেন, তাই বেচারা ঝিমিয়ে আছে। বিকালবেলা মৌতাতের সময় সে ছটফট করতে লাগল, মুচুকুন্দ কাছে এলে তাঁর হাতে ঠুকরে দিলে। মাতঙ্গী আদর করে বললেন, কি হয়েছে কি হয়েছে আমার পেঁচু বাপধনের! পেঁচা তাঁর হাতে ঠোকর মেরে গালে নখ দিয়ে আঁচড়ে রক্তপাত করে দিলে। মাতঙ্গী রাগ সামলাতে পারলেন না, দূর হ লক্ষ্মীছাড়া বলে তাকে হাত-পাখা দিয়ে মারলেন। পেঁচা বিকট চ্যাঁ চ্যাঁ রব করে ঘর থেকে উড়ে কোথায় চলে গেল। মাতঙ্গী ব্যাকুল হয়ে চারিদিকে লোক পাঠালেন, কিন্তু পেঁচার কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না।
এর পরের ঘটনাবলী খুব দ্রুত। মুচুকুন্দর উত্থান গত পনের বৎসর ধরে ধীরে ধীরে হয়েছিল, কিন্তু এখন ঝুপ করে তাঁর পতন হল। কিছুকাল থেকে ফটকাবাজিতে তাঁর খুব লোকসান হচ্ছিল। সম্প্রতি তিনি যে দশ হাজার মন ঘি পাঠিয়েছিলেন, ভেজাল প্রমাণ হওয়ায় তার জন্য বিস্তর টাকা গচ্চা দিতে হল। তাঁর মুরুব্বী মেজর রবসন হঠাৎ বদলী হওয়াতেই এই বিপদ হল, তিনি থাকলে অতি রাবিশ মালও পাস করে দিতেন। মুচুকুন্দবাবুর কম্পানিগুলোরও গতিক ভাল নয়। এমন অবস্থায় ধুরন্ধর ব্যবসায়ীরা যা করে থাকেন তিনিও তাই করলেন, অর্থাৎ এক কারবারের তহবিল থেকে টাকা সরিয়ে অন্য কারবার ঠেকিয়ে রাখতে গেলেন। কিন্তু শত্রুরা তাঁর পিছনে লাগল। তার পর একদিন তাঁর ব্যাঙ্কের দরজায় তালা পড়ল, যথারীতি পুলিসের তদন্ত এবং খাতাপত্র পরীক্ষা হল, এক বৎসর ধরে মকদ্দমা চলল, পরিশেষে মুচুকুন্দ তহবিল তছরুপ জালিয়াতি ফেরেববাজি প্রভৃতির দায়ে জেলে গেলেন।
মাতঙ্গী দেবী তাঁর ভাই তারাপদর কাছে আশ্রয় নিলেন। লখা আর সরা কোথায় থাকে কি করে তার স্থিরতা নেই। তারাপদবাবু বলেন, দিদি আর জামাইবাবু মস্ত ভুল করেছিলেন। পেঁচাটা লক্ষ্মীপেঁচাই নয়, নিশ্চয় হতুমপেঁচা, ভোল ফিরিয়ে এসেছিল। সেই অলক্ষ্মীর বাহনই সর্বনাশ করে গেল। তারাপদ দিল্লি থেকে খবর পেয়েছেন যে সেই পেঁচা এখন কিং এডোআর্ড রোডের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার সঙ্গে একটা পেঁচীও জুটেছে, কোথায় আস্তানা গাড়বে বলা যায় না।