প্রথম পর্ব্ব

বাসন্তী, হে ভুবনমোহিনী,
দিক প্রান্তে, বনে বনান্তে
শ্যাম প্রান্তরে আম্রছায়ে,
সরোবর তীরে নদী নীরে,
নীল আকাশে মলয় বাতাসে,
ব্যাপিল অনন্ত তব মাধুরী;
নগরে গ্রামে কাননে
দিনে নিশীথে
পিক সঙ্গীতে নৃত্য গীত-কলনে
বিশ্ব আনন্দিত;
ভবনে ভবনে
বীণা তাম রণ-রণ ঝঙ্কৃত।
মধুমদমোদিত হৃদয়ে হৃদয়ের
নব প্রাণ উচ্ছ্বসিল আজি,
বিচলিত চিন উচ্ছ্বলি উন্মাদনা
ঝন ঝন ঝনিল মঞ্জীরে মঞ্জীরে॥

শুনেচো অলিমালা, ওরা বড়ো ধিক্কার দিচ্চে, ঐ ও-পাড়ার মল্লের দল, উৎসবে তোমাদের চাপল্য ওদের ভালো লাগ্চে না। শৈবালপুঞ্জিত গুহাদ্বারে কালো কালেৃো শিলাখণ্ডেল মতো তমিস্রগ্রহণ গাম্ভীর্য্যে ওরা নিশ্চল হয়ে ভ্রুকুটি করচে, নির্ঝরণী ওদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে প’ড়েচে এই আনন্দময় বিশ্বের আনন্দপ্রবাহ দিকে দিগন্তে বইয়ে দিতে, নাচে গানে কল্লোলে হিল্লোলে কলহাস্যে;— চূর্ণ চূর্ণ সূর্য্যের আলো উদ্বেল তরঙ্গভঙ্গের ছন্দে ছন্দে বিকীর্ণ ক’রে দিতে। এই আনন্দ-আবেগের অন্তরে অন্তরে যে-অক্ষয় শৌর্য্যের অনুপ্রেরণা আছে, সেটা ওদের শাস্ত্রবচনের বেড়ার বাইরে দিয়ে চ’লে-গেল। ভয় ক’রো না তোমরা; যে-রসরাজের নিমন্ত্রণে তোমরা এসেচো, তাঁর প্রসন্নতা যেমন নেমেচে আমাদের নিকুঞ্জ অন্তঃস্মিত গন্ধরাজ মুকুলের প্রচ্ছন্ন গন্ধরেণুতে তেমনি নামুক্ তোমাদের কণ্ঠে কণ্ঠে, তোমাদের দেহলতার নিরুদ্ধ নটনোৎসাদে। সেই যিনি সুরের গুরু, তাঁর চরণে নৃত্যের অর্ঘ্য নিবেদন ক’রে দাও।

সুরের গুরু, দাও গো সুরের দীক্ষা
মোরা সুরের কাঙাল এই আমাদের ভিক্ষা।
মন্দাকিনীর ধারা,
উষার শুকতারা,
কনকচাঁপা কানে কানে যে-সুর পেলো শিক্ষা।
তোমার সুরে ভরিয়ে নিয়ে চিত্ত
যাবো যেথায় বেসুর বাজে নিত্য।
কোলাহলের বেগে
ঘূর্ণি উঠে জেগে,
নিয়ো তুমি আমার বীণার সেইখানেই পরীক্ষা॥

তুমি সুন্দর যৌবন-ঘন
রসময় তব মূর্ত্তি,
দৈন্যভরণ বৈভব তব
অপচয় পরিপূর্ত্তি।
নৃত্য গীত কাব্য ছন্দ
কল গুঞ্জন বর্ণ গন্ধ,
মরণহীন চির নবীন
তব মহিমা স্ফূর্ত্তি॥

 একটা ফরমাস এসেচে বসন্ত উৎসবে নতুন কিছু চাই—কিন্তু যাদের রস-বেদনা আছে তা’রা ব’লচে আমরা নতুন চাইনে, আমরা চাই নবীনকে। তা’রা বলে মাধবূ বছরে বছরে সাজ বদ্লায় না, অশোক পলাশ পুরাতন রঙেই বারে বারে রঙীন। এই চিরপুরাতন ধরণী সেই চিরপুরাতন নবীনের দিকে তাকিয়ে বল’চে “লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখনু তবু হিয়া জুড়ন না গেল।​” সেই নবীনের উদ্দেশে তোমাদের গান সুরু ক’রে দাও।

আন্ গো তারা কা’র কী আছে.
দেবার হাওয়া বইলো দিকে দিগন্তরে
  এই সুসময় ফুরায় পাছে।
  কুঞ্জবনের অঞ্জলি-যে ছাপিয়ে পড়ে
  পলাশ কানন ধৈর্য্য হারায় রঙের পড়ে
  বেণুর শাখা তালে মাতান নাচে॥

প্রজাপতি রঙ ভাসালো নীলাম্বরে
মৌমাছিরা ধ্বনি উড়ায় বাতাস ’পরে
  দখিন হাওয়া হেঁকে বেড়ায় জাগো জাগো,
  দোয়েল কোয়েল গানের বিরাম জানে না গে,
  ক্ত রক্তের জাগ্লো প্রলাপ অশোক গাছে॥

অশোকবনের রংমহলে আজ লাল রঙের তানে তানে পঞ্চম-রাগে সানাই বাজিয়ে দিলে, কুঞ্জবনের বীথিকায় আজ সৌরভের অবারিত দানসত্র। আমরাও তো শূন্যহাতে আসিনি। দানের জোয়ার যখন লাগে অতল জলে তখন ঘাটে ঘাটে দানের বোঝাই-তরী রসি খুলে দিয়ে ভেসে পড়ে। আমাদের ভরা নৌকো দখিন হাওয়ায় পাল তুলে সাগর-মুখো হোলো, সেই কথাটা কণ্ঠ খুলে জানিয়ে দাও।

ফাগুন তোমার হাওয়ায় হাওয়ায়
ক’রেছি যে দান
আমার আপনহারা প্রাণ,
আমার বাঁধন-ছেঁড়া প্রাণ॥
তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রং লাগলো আমার অকারণের সুখে,
তোমার ঝাউএর দোলে
মর্ম্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান॥
পূর্ণিমা সন্ধ্যায়
তোমার রজনী-গন্ধায়
রূপ সাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়।

তোমার প্রজাপতির পাখা
আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধচোখের রঙীন স্বপন মাখা;
তোমার চাঁদের আলোয়
মিলায় আমার দুঃখ সুখের সকল অবসান॥

 ভ’রে দাও একেবারে ভ’রে দাও, কোথাও কিছু সঙ্কোচ না থাকে। পূর্ণের উৎসবে দেওয়া আর পাওয়া একই কথা। ঝরনার তা’র এক প্রান্তে পাওয়া রয়েছে অভ্রভেদী শিখরের দিক থেকে, আর এক প্রান্তে দেওয়া রয়েছে অতলস্পর্শ সাগরের দিকে, এর মাঝখানে তো কোনো বিচ্ছেদ নেই, অন্তহীন পাওয়া আর অন্তহীন দেওয়ার আবর্ত্তন নিয়ে এই বিশ্ব।

গানের ডালি ভ’রে দে গো ঊষার কোলে—
আয় গো তোরা, আয় গো তোরা, আয় গো চ’লে
চাঁপার কালি চাঁপার গাছে
সুরের আশায় চেয়ে আছে.
কান পেতেছে নতুন পাতা, গাইবি ব’লে
কমল বরণ গগন মাঝে
কমল চরণ ঐ বিরাজে।
ঐখানে তোর সুর ভেসে যাক্,
নবীন প্রাণের ঐ দেশে যাক্,
ঐ যেখানে সোনার আলোর দুয়ার খোলে॥

মধুরিমা দেখো, দেখো, চাঁদের তরণীতে আজ পূর্ণতা পরিপুঞ্জিত। কত দিন ধ’রে এক তিথি থেকে আরেক তিথিতে এগিয়ে আসচে। নন্দনবন থেকে আলোর পারিজাত ভ’রে নিয়ে আলো— কোন্ মাধুরীর মহাশ্বেতা সেই ডালি কোলে নিয়ে ব’সে আছে; ক্ষণে ক্ষণে রাজহংসের ডানার মতো তা’র শুভ্র মেঘের বসনপ্রান্ত আকাশে এলিয়ে পড়চে। আজ ঘুমভাঘা রাতের বাঁশিতে বেহাগের তান লাগ্লো।

নিবিড় অমা-তিমির হ’তে
বাহির হ’লো জোয়ার স্রোতে
 শুক্লরাতে চাঁদের তরণী।
ভরিল ভরা অরূপ ফুলে,
সাজালো ডালা অমরা-কূলে
 আলোর মালা চামেলি-বরণী।
 শুক্লরাতে চাঁদের তরণী॥
তিথির পরে তিথির ঘাটে
আসিছে তরী দোলের নাটে,
 নীরব হাসে স্বপনে ধরণী।
উৎসবের পসরা নিয়ে
পূর্ণিমার কূলেতে কি এ
 ভিড়িল শেষে তন্দ্রাহরণী
 শুক্লরাতে চাঁদের তরণী॥

দোল লেগেচে এবার। পাওয়া আর না-পাওয়ার মাঝখানে দোল। এক প্রান্তে বিরহ, আর প্রান্তে মিলন, স্পর্শ ক’রে ক’রে দুলচে বিশ্বের হৃদয়। পরিপূর্ণ আর অপূর্ণের মাঝখানে এই দোলন। আলোতে ছায়াতে ঠেকতে ঠেকতে রূপ জাগচে— জীবন থেকে মরণ, মরণ থেকে জীবনে, অন্তর থেকে বাহিরে আবার বাহির থেকে অন্তরে। এই দোলার তালে না মিলিয়ে চললেই রসভঙ্গ হয়। ও পাড়ার ওরা-যে দরজায় আগল এঁটে বসেই রইলো—হিসেবের খাতার উপর ঝুঁকে প’ড়েচে। একবার ওদের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দোলের ডাক দাও।

ওরে গৃহবাসী, তোরা খোল্ দ্বার খোলস
 লাগলো-যে দোল।
স্থলে জলে বন-তলে
 লাগলো-যে দোল।
  খোল্ দ্বার খোলি।
রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে,
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত আকাশে,
 নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।
  খোল্ দ্বার খোল্॥
বেণুবন মর্ম্মরে দখিন বাতাসে,
প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে—
 মউমাছি ফিরে যা’চি ফুলের দখিণা,
 পাখায় বাজায় তা’র ভিখারীর বীণা,
  মাধবী-বিতানে বায়ু গন্ধে বিভোল।
   খোল্ দ্বার খোল্॥

কিন্তু পূর্ণিমার চাঁদ-যে ধ্যানস্তিমিত লোচন পুরোহিতের মতো আকাশের বেদীতে ব’সে উৎসবের মন্ত্র জপ ক’রতে লাগলো। ওকে দেখাচ্চে যেন জ্যোৎস্না সমুদ্রের ঢেউয়ের চূড়ায় ফেনপুঞ্জের মতো—কিন্তু সে ঢেউ-যে চিত্রাপিতবৎ স্তব্ধ। এদিকে আজ বিশ্বের বিচলিত চিত্ত দক্ষিণের হাওয়ায় ভেসে প’ড়েচে, চঞ্চলের দল মেতেচে বনের শাখায়, পাখীর ডানায়, আর ঐ কি একা অবিচলিত হয়ে থাকবে, নিবাতনিষ্কম্পমিবপ্রদীপম্? নিজে মাতবে না আর বিশ্বকে মাতাবে, সে কেমন হোলো? এর একটা যা-হয় জবাব দিয়ে দাও।

কে দেবে চাঁদ তোমায় দোলা
আপন আলোর স্বপন মাঝে বিভোল ভোলা।
  কেবল তোমার চোখের চাওয়ায়
  দোলা দোলা হাওয়ায়া হাওয়ায়,
  বনে বনে দোল জাগালো
      ঐ চাহনি তুফান-তোলা।
আজ মানসের সরোবরে
কোন্ মাধুরীর কমল কানন
  দোলাও তুমি ঢেউয়ের ’পরে।
  তোমার হাসির আভাস লেগে
  বিশ্বদোলন দোলার বেগে
  উঠলো জেগে আমার গানের
      হিল্লোলিনী কলরোলা॥

আজ সব ভীরুদের ভয় ভাঙানো চাই। ঐ মাধবীর দ্বিধা-যে ঘোচে না। এদিকে আকাশে আকাশে প্রগল্ভতা অথচ ওরা রইলো সসঙ্কোচে ছায়ার আড়ালে। ঐ অবগুষ্ঠিতাদের সাহস দাও। বেরিয়ে পড়বার হাওয়া বইলো যে, বকুলগুলো রাশি রাশি ঝরতে বল্চে, যা হয় তো হোক্ গে, আমের মুকুল নির্ভয়ে বলে উঠচে, দিয়ে ফেলবো একবারে শেষ পর্য্যন্ত। যে-পথিক আপনাকে বিলিয়ে দেবার জন্যেই পথে বেরিয়েচে তা’র কাছে আত্মনিবেদনের থালি উপুড় ক’রে দিয়ে তবে তাকে আনতে পারবে নিজের আঙিনায়। কৃপণতা ক’রে সময় বইয়ে দিলে তা চলবে না।

হে মাধবী, দ্বিধা কেন, আসিবে কি ফিরিবে কি,
আঙিনাতে বাহিরিতে মন কেন গেল ঠেকি’।
    বাতাসে লুকায়ে থেকে
    কে-যে তোরে গেছে ডেকে,
পাতায় পাতায় তোরে পত্র সে-যে গেছে লেখি’।
কখন দখিণ হ’তে কে দিল দুয়ার ঠেলি’
চমকি’ উঠিল জাগি’ চামেলি নয়ন মেলি’।
    বকুল পেয়েছে ছাড়া,
    করবী দিয়েছ সাড়া,
শিরীষ শিহরি’ উঠে দূর হ’তে কারে দেখি’।

দেখতে দেখতে ভরসা বেড়ে উঠ্চে, পাবো না তো কি? যখন দেখা দেয় না তখনো যে সাড়া দেয়। যে পথে চলে সেখানে-যে তা’র চলার রঙ লাগে। যে-আড়ালে থাকে তা’র ফাঁক দিয়ে আসে তা’র মালার গন্ধ। দুয়ারে অন্ধকার যদি-বা চুপচাপ থাকে, আঙিনায় হাওয়াতে চলে কানাকানি। পড়তে পারিনে সব অক্ষর কিন্তু চিঠিখান মনের ঠিকানায় এসে পৌছয়। লুকিয়েই ও ধরা দেবে এমনিতরাে ওর ভাবখানা।

সে কি ভাবে গােপন র’বে
লুকিয়ে হৃদয়-কাড়া?
তাহার আসা হাওয়ায় ঢাকা
সে-যে সৃষ্টিছাড়া।
হিয়ায় হিয়ায় জাগলাে বাণী,
পাতায় পাতায় কানাকানি,
“ঐ এলাে যে”, “ঐ এলাে যে”
পরাণ দিল সাড়া॥
এই তো আমার আপনারি এই
ফুল-ফোটানাের মাঝে
তা’রে দেখি নয়ন ভ’রে
নানা রঙের সাজে।
এই-যে পাখীর গানে গানে
চরণ ধ্বনি ব’য়ে আনে,
বিশ্ববীণার তারে তারে
এই তো দিল নাড়া॥

 এইবার বেড়া ভাঙলো, দুর্ব্বার বেগে। অন্ধকারের গুহায় অগােচরে জমে উঠেছিলো বন্যার উপক্রমণিকা, হঠাৎ ঝরনা ছুটে বেরােলাে, পাথর গেল ভেঙে, বাধা গেল ভেসে। চরম যখন আসেন তখন এক পা এক পা পথ গুণে গুণে আসেন না। একেবারে বজ্রে-শান-দেওয়া বিদ্যুতের মতো, পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘের বক্ষ এক আঘাতে বিদীর্ণ ক’রে আসেন।

হৃদয় আমার ঐ বুঝি তোর
ফাল্গুনী ঢেউ আসে,
বেড়া-ভাঙার মাতন নামে
উদ্দাম উল্লাসে॥
তোমার মোহন এলো সোহন বেশে।
কুয়াসা-ভার গেল ভেসে,
এলো তোমার সাধন ধন
উদার আশ্বাসে॥
অরণ্যে তোর সুর ছিল না
বাতাস হিমে ভরা।
জীর্ণ পাতায় কীর্ণ কানন
পুষ্পবিহীন ধরা।
এবার জাগরে হতাশ আয়রে ছুটে
অবসাদের বাঁধন টুটে,
বুঝি এলো তোমার পথের সাথী
উতল উচ্ছাসে॥

 উৎসবের সোনার কাঠি তোমাকে ছুঁয়েচে, চোখ খুলেচে। এইবার সময় হোলো চারদিক দেখে নেবার। আজ দেখতে পাবে, ঐ শিশু হয়ে এসেচে চির নবীন, কিশলয়ে তা’র ছেলেখেলা জমাবার জন্যে। তার দোসর হয়ে তার সঙ্গে যোগ দিল ঐ সূর্য্যের আলো, সে-ও সাজলো শিশু, সারাবেলা সে কেবল ঝিকিমিকি কর’চে। ঐ তা’র কলপ্রলাপ। ওদের নাচে নাচে মর্মরিত হয়ে উঠলো প্রাণগীতিকার প্রথম ধুয়েটি।

ওরা অকারণে চঞ্চল।
ডালে ডালে দোলে, বায়ুহিল্লোলে
নব পল্লবদল।
ছড়ায়ে ছড়ায়ে ঝিকিমিকি আলো,
দিকে দিকে ওরা কী খেলা খেলালো,
মর্ম্মর তানে প্রাণে ওরা আনে
কৈশাের কোলাহল।
ওরা কান পেতে শােনে গগনে গগনে
নীরবের কানাকানি,
নীলিমার কোন্ বাণী
ওরা প্রাণঝরনাব উচ্ছল ধার,
ঝরিয়া ঝরিয়া বহে অনিবার,
চির-তাপসিনী ধরণীর ওরা
শ্যামশিখা হােমানল॥

 আবার একবার চেয়ে দেখো—অবজ্ঞায় চোখ ঝাপসা হয়ে থাকে, আজ সেই কুয়াশা যদি কেটে যায় তবে যাকে তুচ্ছ বলে দিনে দিনে এড়িয়ে গেছে। তাকে দেখে নাও তা’র আপন মহিমায়। ঐ দেখাে ঐ বনফুল, মহাপথিকের পথের ধারে ও ফোটে, তাঁর পায়ের করুণ স্পর্শে সুন্দর হয়ে ওঠে ওর প্রণতি। সূর্য্যের আলো ওকে আপন ব’লে চেনে, দখিন হাওয়া ওকে শুধিয়ে যায় কেমন আছ। তােমার গানে আজ ওকে গৌরব দিক্‌। এরা যেন কুরুরাজের সভায় শূদ্রার সন্তান বিদুরের মতো, আসন বটে নীচে, কিন্তু সম্মান স্বয়ং ভীষ্মের চেয়ে কম নয়।

আজ দখিন বাতাসে
নাম-না-জানা কোন্ বনফুল
ফুটলো বনের ঘাসে।
ও মাের পথের সাথী পথে পথে
গোপনে যায় আসে॥
কৃষ্ণচূড়া চূড়ায় সাজে,
বকুল তােমার মালার মাঝে,
শিরীষ তোমার ভ’রবে সাজি
ফুটেছে সেই আশে।
এ মাের পথের বাঁশির সুরে সুরে
লুকিয়ে কাঁদে হাসে॥
ওরে দেখাে বা নাই দেখাে, ওরে
যাও বা না যাও ভুলে।
ওরে নাই বা দিলে দেলা, ওরে
নাই বা নিলে তুলে।
সভায় তােমার ও কেই নয়,
ওর সাথে নেই ঘরের প্রণয়,

যাওয়া-আসার আভাস নিয়ে
রয়েছে এক পাশে॥
ওগাে ওর সাথে মাের প্রাণের কথা
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে॥

 কাব্যলােকের আদরিণী সহকাবমঞ্জরীকে আর চিনিয়ে দিতে হবে না। সে আপনাকে তাে লুকোতে জানে না। আকাশের হৃদয় সে অধিকার করেছে, মৌমাছির দল বন্দনা ক’রে তা’র কাছ থেকে অজস্র দক্ষিণ নিয়ে যাচ্চে। সকলের আগেই উৎসবের সদাব্রত ও সুরু ক’রে দিয়েছিলো, সকলের শেষ পর্যন্ত ওর আমন্ত্রণ রইলো খােলা। কোকিল ওর গুণগান দিনে রাতে আর শেষ করতে পারছে না—তােমরাও তান লাগাও।

ও মঞ্জরী, ও মঞ্জরী, আমের মঞ্জরী,
আজ হৃদয় তােমার উদাস হ’য়ে
প’ড়ছে কি ঝরি’ ?
আমার গান-যে তােমার গন্ধে মিশে
দিশে দিশে
ফিরে ফিরে ফেরে গুঞ্জরি’॥
পূর্ণিমা চাঁদ তােমার শাখায় শাখায়
তােমার গন্ধ সাথে আপন আলো মাখায়,
 দখিন বাতাস গন্ধে পাগল
ভাঙ্লো আগল
ঘিরে ঘিরে ফিরে সঞ্চরি’॥

 দীর্ঘ শুন্য পথটাকে এতদিন ঠেকেছিলাে বড় কঠিন, বড়ো নিষ্ঠুর। আজ তাকে প্রণাম। পথিককে সে তাে অবশেষে এনে পৌছিয়ে দিলে। তারি সঙ্গে এনে দিলে অসীম সাগরের বাণী। দুর্গম উঠলো সেই পথিকের মধ্যে গান গেয়ে। কিন্তু আনন্দ ক’রতে ক’রতেই চোখে জল আসে যে। ভুলবো কেমন ক’রে যে, যে-পথ কাছে নিয়ে আসে, সেই পথই দূরে নিয়ে যায়। পথিককে ঘরে আটক করে না। বাঁধন ছিড়ে নিজেও বেরিয়ে না প’ড়লে ওর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঠেকাবে কী ক’রে? আমার ঘর-যে ওর যাওয়া-আসার পথেব মাঝখানে, দেখা দেয় যদি-বা, তা’র পরেই সে-দেখা আবাব কেড়ে নিয়ে চলে যায়।

মাের পথিকেরে বুঝি এনেছাে এবারে
করুণ রঙীন পথ।
এসেছে এসেছে অঙ্গনে, মাের
দুয়ারে লেগেছে রথ।
সে-যে সাগর পারের বাণী
মোর পরাণে দিয়েছে আনি’,
তা’র আঁখির তারায় যেন গান গায়
অরণ্য পর্ব্বত॥
দুঃখসুখের এপারে ওপারে
দোলায় আমার মন,
কেন অকারণ অশ্রু-সলিলে
ভ’রে যায় দু-নয়ন।

ওগো নিদারুণ পথ, জানি,
জানি পুন নিয়ে যাবে টানি’
তা’রে,  চিরদিন মোর যে-দিল ভরিয়া
যাবে সে স্বপনবৎ॥

 তবু ওকে ক্ষণকালের বাঁধন পরিয়ে দিতে হবে। টুকরো টুকরো সুখের গাথবো—পরাবো ওকে মাধুয্যের মুক্তোগুলি। ফাগুনের ভরা সাজি থেকে যা কিছু ঝ’রে ঝ’রে প’ড়্চে কুড়িয়ে নেবো, বনের মর্ম্মর, বকুলের গন্ধ, পলাশের রক্তিমা—আমার বাণীর সুত্রে সব গেঁথে বেঁধে দেবো ভা’রমণিবন্ধে। হয়তো আবার আর-বসন্তেও সেই আমার-দেওয়া ভূষণ প’রেই সে আসবে। আমি থাকবো না, কিন্তু কি জানি, আমার দানের ভূষণ হয়তো থাকবে ওর দক্ষিণ হাতে।

ফাগুনের নবীন আনন্দে
গানখানি গাঁথিলাম ছন্দে।
দিল তা’রে বনবীথি
কোকিলের কলগীতি
ভরি’ দিল বকুলের গন্ধে॥
  মাধবীর মধুময় মন্ত্র
  রঙে রঙে রাঙালো দিগন্ত।
বাণী মম নিল তুলি’
পলাশের কলিগুলি,
  বেঁধে দিল তব মণিবন্ধে॥