নব্য জাপান ও রুষ জাপান যুদ্ধের ইতিহাস/রুষ ও জাপান যুদ্ধের ইতিহাস
রুষ ও জাপান যুদ্ধের ইতিহাস।
চীনের বক্সার বিদ্রোহ প্রশমিত হইলে, মার্কিন, জাপান ও ইয়ুরােপীয় শক্তিগণ সকলে সমবেত হইয়া অঙ্গীকার করেন যে; — আমরা বিবিধ ক্ষতিপূরণের জন্য চীন গভর্ণমেণ্টের নিকট হইতে এক শতকোটী টাকা গ্রহণ করিব; কিন্তু চীন-সাম্রাজ্য অক্ষুণ্ণ রাখিব। সম্মিলিত সৈন্যগণ চীনের যে সমস্ত দুর্গ ও নগরাদি অধিকার করিয়াছে, তথা হইতে ক্রমে ক্রমে সৈন্য সামন্ত উঠাইয়া লইব।
অন্যান্য শক্তিপুঞ্জ স্ব স্ব প্রতিজ্ঞানুসারে চীনরাজ্য পরিত্যাগপূর্ব্বক স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন, কিন্তু রুষ মাঞ্চুরিয়া পরিত্যাগ করিলেন না। শক্তিনিচয়ের পুনঃ পুনঃ অনুরােধ ও ভয় প্রদর্শন স্বত্তেও তিনি আজি নয় কালি, এমাসে নয় পরমাসে ইত্যাদি বিবিধ রাজনৈতিক ছল আরম্ভ করিয়া কালবিলম্ব করিতে আরম্ভ করিলেন। কিছুদিন পরে মাঞ্চুরিয়া পরিত্যাগ করা দূরে থাকুক, রুষ গভর্ণমেণ্ট কোরিয়া রাজ্যের উপরে স্বীয় লােলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। দেখিতে দেখিতে আলু নদীর তীরবর্ত্তী অরণ্যে কাষ্ঠছেদনের অধিকারপত্র সংগৃহীত হইল, কোরিয়ার উইজু বন্দর রুষ বন্দরে পরিণত হইল।
রুষের এই সকল দুরভিসন্ধি দর্শনে জাপান গভর্ণমেণ্ট স্বভাবতঃই উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। জাপান মনে করিলেন, রুষ ত মাঞ্চুরিয়া পরিত্যাগ করিবেই না; তাহার উপরে যদি কোরিয়া রাজ্য গ্রাস করিয়া বসে, তাহা হইলে কয়েক বৎসরের মধ্যে আমারও স্বাধীনতা-গৌরব বিলুপ্ত হইয়া যাইবে। অদ্য ১৮০০ শত বৎসর ধরিয়া যে কোরিয়ার উপরে আমার অখণ্ড আধিপত্য বিদ্যমান রহিয়াছে, যাহার উপরে জাপানবাসীর জীবন মরণ নির্ভর করিতেছে, সেই কোরিয়া রাজ্য কখনও রুষিয়ার করালগ্রাসে পতিত হইতে দিব না। তাঁহারা স্থির করিলেন, যদি দুরাকাঙ্খ রুষ, ন্যায়, ধর্ম্ম ও যুক্তির মস্তকে পদাঘাত পূর্ব্বক পররাজ্য গ্রাস করিতে প্রবৃত্ত হয়, তাহা হইলে আমরা “নিপনের” আজন্মস্বাধীনতাগৌরব রক্ষার জন্য ঈশ্বরের মহামহিমামণ্ডিত নাম স্মরণ করিয়া ধর্ম্মযুদ্ধে অগ্রসর হইব।
গত ১৯০৩ অব্দের ২৩শে জুন তারিখে টোকিওর মন্ত্রণামন্দিরে রুষদুত ব্যারণ রােসেনের সহিত জাপানের পররাষ্ট্র সচিব ব্যারণ কমুরা মহাশয়ের প্রবল বাক্যুদ্ধ উপস্থিত হয়। সপ্তমাস ব্যাপী তর্ক বিতর্কের পর খ্রীষ্টধর্ম্মপরায়ণ জার মহােদয় প্রকাশ করিলেন যে;—মানচুরিয়া সম্বন্ধে আমি জাপানের কোন কথা শুনিব না। কোরিয়ার ১/৩ অংশ নিরপেক্ষ থাকিবে, অবশিষ্টাংশে রুষাধিকার বিস্তৃত হইবে। ২২শে ডিসেম্বর তারিখে জাপান উত্তর দিলেন:— না, তাহা হইবে না। রুষকে কোন নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মানচুরিয়া পরিত্যাগ করিতে হইবে। কোরিয়ায় জাপানের ক্ষমতা অক্ষুন্ন থাকিবে। ৬ই জানুয়ারি তারিখে রুষ রাজনৈতিক ভাষায় মানচুরিয়ায় জাপানের স্বত্ব স্বীকার করিলেন, কিন্তু কোরিয়া সম্বন্ধে নিজাভিপ্রায় পূর্ব্বমত বলবৎ রাখিলেন। ১৩ই জানুয়ারি তারিখে জাপান আপনার শেষ অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া কহিলেন, মানচুরিয়ায় যাহাতে সমস্ত জাতিই স্বাধীনভাবে বাণিজ্য করিতে পারে তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে; কোরিয়ায় জাপানের প্রভুত্ব ও বাণিজ্যাধিকার অব্যাহত থাকিবে। ইহার পরে দ্বাবিংশতি দিবস অতিবাহিত হইল, তথাপিও রুষ গভর্ণমেণ্ট কোন উত্তর প্রদান করিলেন না। এই ঘটনায় জাপানের মনে রুষের দুরভিসন্ধি সম্বন্ধে গভীর সন্দেহের উদয় হইল। অতঃপর তাঁহারা আর কালবিলম্ব অনুচিত মনে করিয়া, ৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখে রুষিয়ার সহিত সমস্ত রাজনৈতিক সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিলেন।
এইরূপে রুষের চাতুর্য্য, স্বার্থপরতা, দুরাকাঙ্ক্ষা ও পররাজ্যগ্রাসস্পৃহার বিষময়ফলে সুদূর প্রাচ্য ভূখণ্ডে লোক-ভয়ঙ্কর ভীষণ সমরানল প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল।
জলযুদ্ধ।
গত ১৯০৪ অব্দের ৮ই ফেব্রুয়ারি তারিখে রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময়ে রুষ জাপানে প্রকৃত যুদ্ধারম্ভ হয়। তদবধি সন্ধিপত্র স্বাক্ষর পর্য্যন্ত সমুদ্রবক্ষে যতগুলি ভীষণ যুদ্ধ সংঘটিত হইয়াছে, তাহার প্রত্যেকটীতেই জয়লক্ষ্মী জাপানের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করিয়াছেন। এই কালসমরে রুষিয়ার জলবল সম্পূর্ণ নির্ম্মূল হইয়া গিয়াছে। রুষের কি সর্ব্বনাশ হইয়াছে, তাহা নিম্ন প্রদর্শিত তালিকা পাঠ করিলে সহজেই হৃদয়গম্য হইবে।
যুদ্ধের পূর্ব্ব দিবস পর্যন্ত সুদূর প্রশান্ত মহাসাগরে রুষিয়ার এই কয়েকখানি রণতরি বিদ্যমান ছিল,—
আর্থার বন্দরে (যুদ্ধজাহাজ) জারউইচ্ B, রেট্ভিসান C, সিবাষ্টপোল G, পোলটাবা G, পারচ্ভিট G, পোবিডা, G, পেট্র পেবলস্কি A।
(লৌহমণ্ডিত রণতরি) বেয়ান E।
(রক্ষিত রণতরি) আস্কল্ড C, নভিক E, ডিয়ানা D, পালাডা G, বেরিন E।
কোরিয়ার উপকূলে;—(রক্ষিত রণতরি) ভেরিয়াগ E, কোরিজ E।
ভ্যালাডিভােষ্টক বন্দরে (লৌহমণ্ডিত রণতরি) গ্রোমোবিয়া রসিয়া F, রুরিক E, বগাটির F।
উপরােক্ত প্রথমশ্রেণীর রণতরিসমষ্টির মধ্যে A চিহুিত জাহাজ খানি জাপানের আগ্নেয়যন্ত্রে পড়িয়া ৭০০ সৈন্য ও প্রচুর যুদ্ধোপকরণসহ সাগরগর্ভে প্রবিষ্ট হইয়াছে। এই জাহাজে সুপ্রসিদ্ধ নৌ-সেনাপতি ম্যাকারফ্ ও জগদ্বিখ্যাত চিত্রকর ভেরেটসাগীন অবস্থিত ছিলেন।
B চিহ্নিত জাহাজখানি চীনের কিয়াচিউ বন্দরের সন্নিকটে জলমগ্ন হয়। ইহাতে সেনাপতি উইটগার্ট, দুইশতাধিক সৈন্যসহ মৃত্যু মুখে পতিত হইয়াছিলেন।
C চিহ্নিত অস্কল্ড চীনের উসাং বন্দরে ভগ্নাবস্থায় বন্দী হয়।
D চিহ্নিতখানি ফরাসী অধিকৃত সৈগন বন্দরে বন্দী হয়।
E চিহ্নিত রণতরি ছয়খানি জাপানের গােলা ও টর্পেডোর আঘাতে প্রচুর সৈন্য ও যুদ্ধোপকরণ সহ সাগরসলিলে নিমগ্ন হয়।
F চিহ্নিত তরণীদ্বয় দ্রুত পলায়নকালে সমুদ্রমধ্যস্থ পর্ব্বত চুড়ায় আহত হইয়া জলমগ্ন হয়।
G চিহ্নিত প্রথম শ্রেণীর রণতরি ছয়খানি আর্থার বন্দরে জলমগ্ন হইয়া জাপানিদিগের হস্তে পতিত হয়।
এতদ্ভিন্ন এনিসি, ষ্টিরিগাছি, বুনি, রেষ্ট্রফনি প্রভৃতি অনেকগুলি কামানবাহী ও টর্পেডো ধবংসিণীতরণী বিনষ্ট ও নিরপেক্ষ বন্দরে বন্দী হয়। রেসিটেলনী, মঙ্গোলিয়া প্রভৃতি কয়েকখানি জাপানীরা কাড়িয়া লয়।
উপরােক্ত রণতরি সকলের মূল্য ত্রিংশতি কোটী টাকার ন্যূন হইবে না।
এই যুদ্ধে জাপানের হ্যাট্সুজ নাম্নী যুদ্ধজাহাজ, যশিনো নাম্নী রক্ষিত রণতরি ও কয়েকখানি টর্পেডো বােট জলমগ্ন হইয়াছিল।
স্থলযুদ্ধ।
রুষজাপান সমরে যতগুলি উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ সংঘটিত হইয়াছে, তাহার সকলগুলিতেই জয়লক্ষ্মী রুযিয়ার প্রতি কার্পণ্য প্রকাশ করিয়াছেন। কি আলুতীরে, কি দুরারােহ ন্যান্সান পর্ব্বতে, কি ওয়েফ্যানকু প্রান্তরে, কি সুরক্ষিত কেইপিং নগরে, কি দুর্গম মটিয়েন গিরিপ্রদেশে, কি ট্যাসিচিও ক্ষেত্রে, সর্ব্বস্থানেই রুষ সৈন্য পরাজিত ও বিতাড়িত হইয়াছে। দ্রুত পলায়ন ব্যপদেশে রুষ সেনাপতিরা প্রতিযুদ্ধেই বহু সংখ্যক কামান, বহু সহস্র বন্দুক, প্রচুর যুদ্ধোপকরণ ও বহু পরিমাণ খাদ্যাদি পরিত্যাগ পূর্ব্বক ও সগৌরবে পলায়ন করিতে বাধ্য হইয়াছেন। রুষ সেনানী ও সৈনিকগণ প্রকৃত বীরের ন্যায় প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়াও এই ছয়টী যুদ্ধ ক্ষেত্রের কোন স্থলেই সফলকাম হইতে পারেন নাই। তাঁহারা প্রতি যুদ্ধেই জীবনে উপেক্ষা, অপূর্ব্ব বুদ্ধিমত্তা ও বীরত্বের পরকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াও নিষ্ঠুর অদৃষ্ট দেবীর চিত্ত বিনােদনে সমর্থ হয়েন নাই।
সপ্তম যুদ্ধ পৃথিবীর সমরেতিহাসে লেয়ং যুদ্ধ নামে অভিহিত হইয়াছে। ইহাই বিংশ শতাব্দীর সর্ব্বপ্রথম প্রধান যুদ্ধ। রুষ সেনাপতি কুরােপাট্কিন, সার্দ্ধ দ্বিলক্ষ প্রথম শ্রেণীর সৈন্য ও ষষ্ঠ শতাধিক কামান লইয়া লেয়ং নগরে অবস্থিতি করিতে ছিলেন। নদী, পর্ব্বত, প্রাচীর ও পরিখা প্রভৃতিতে এই নগরী স্বভাবতঃই দুর্ভেদ্য ও দুরাক্রম্য ছিল, তাহার উপরে রুষদিগের ষষ্ঠ মাসব্যাপী বিপুল অধ্যবসায় ও অসামান্য চেষ্টায় লেয়ং নগরী একটী অজেয় দুর্গে পরিণত হইয়াছিল। ফলতঃ মহাযুদ্ধ হইবার আশঙ্কায় কুরোপাট্কিন তাঁহার অবস্থান সুরক্ষিত করা সম্বন্ধে কোন অংশই অসম্পূর্ণ রাখেন নাই।
হায়! তথাপিও তাঁহাকে ভীষণ পরাজয় সহ্য করিতে হইয়াছিল; তথাপিও তাঁহাকে লজ্জারক্ত বদনে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিয়া আত্মরক্ষা করিতে হইয়াছিল। আমেরিকা, জাপান ও বিলাতী পত্র সম্পাদকেরা কুরােপাটকিনের এই অদ্ভুত পলায়ন বর্ণনায় সহস্রমুখ হইলেও, ফরাসী, জার্ম্মাণ ও রুষ পত্র-সম্পাদকেরা অণুমাত্র আনন্দ প্রকাশ করেন নাই। এই পৃষ্ঠপ্রদর্শন ব্যাপারে রুষ জনসাধারণ কোনরূপ আনন্দ করিবার অবসর পায় নাই; জার মহোদয় ও মন্ত্রিগণের পরাজয়মলিনবদনমণ্ডলে কোনরূপ আনন্দ চিহ্ন প্রকটিত হয় নাই। যে দাম্ভিক সেনাপতি তিনলক্ষ মাত্র সৈন্য লইয়া যুদ্ধারম্ভের ছয় মাস মধ্যেই টোকিওর নন্দন কাননে প্রবেশ করিতে বাসনা করিয়াছিলেন, তাঁহার অপূর্ব্ব বীরত্ব পুনঃ পুনঃ পলায়ন কৌশলে পর্য্যবসিত হইতে দেখিয়া আমরাও আনন্দ লাভ করিতে পারি নাই। এই যুদ্ধের ভয়াবহ ফলে বিচলিত হইয়া, কুরোপাট্কিনকে পরােক্ষে তিরস্কার করিবার ব্যপদেশে জার মহােদয় সেনাপতি গ্রিপেনবার্গকে স্বাধীন ক্ষমতা প্রদান করিয়া মাঞ্চুরিয়ার দ্বিতীয় সেনাপতি পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।
রুষ পক্ষের হিসাবে লেয়ং যুদ্ধে প্রায় ৩০ হাজার রুষ সৈন্য হতাহত হয়। জাপানের হতাহতের সংখ্যা চল্লিশ সহস্রের ন্যূন হইবে না। এই যুদ্ধে ১৩ জন রুষ সৈন্য ও ৩০ টী যুদ্ধাশ্ব জাপানের বন্দী হয়। এতদ্ব্যতীত ৪০০০ বন্দুক, ১৬ লক্ষ টোটা, ১০ হাজার শেলগােলা, ১২ শত শকট, ১৬ হাজার খনন যন্ত্র, ৫৬০ লাঙ্গল, ২৫০০ কুঠার, ৬৪০০ জামা, ১৯ হাজার টিন মাংস ও প্রচুর রেলসরঞ্জাম জাপানের হস্তগত হয়।
অষ্টম যুদ্ধ “সা” নদীর তীরদেশে সংঘটিত হওয়ায় সা-হো-যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছে। এই যুদ্ধে সেনাপতি কুরোপাট্কিন তিন লক্ষ সৈন্য লইয়া বিপুল বিক্রমে জাপানবাহিনীকে আক্রমণ করিয়া ভীষণ পরাজয় সহ্য করেন। ইতিপূর্ব্বে কোন যুদ্ধেও রুষের এরূপ পরাজয় হয় নাই। ইয়ুরােপের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সেনাপতি সাহো যুদ্ধের ভীষণ পরিণাম দৃষ্টি করিয়া পূর্ব্ব্যভ্যস্থ কৌশল অবলম্বন পূর্ব্বক নিজ গৌরব রক্ষা করেন। এই যুদ্ধে ৭০৯ জন রুষ সৈন্য জাপানের বন্দী হয়। সমরক্ষেত্রে জাপানী শববাহকেরা পঞ্চদশ সহস্র মৃত রুষসৈন্যের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করে। এতদ্ব্যতীত ৪৫টী কামান, ৫৪০০ বন্দুক, ৭৮ হাজার টোটা ও ৭ হাজার বড় গােলা বিজয়ী জাপানিগণের হস্তগত হয়। অনেকের অনুমান এই যুদ্ধে এক লক্ষ রুষ সৈন্য হতাহত হইয়াছিল।
সাহো যুদ্ধে জাপানী সৈন্যেরও সামান্য ক্ষতি হয় নাই। এই যুদ্ধে ৩০ হাজার জাপানী সৈন্য হতাহত ও ১২টী কামান রুষের অধিকৃত হইয়াছিল।
নবম যুদ্ধ ২য় সাহােযুদ্ধ বা হিকণ্টাইয়ের যুদ্ধ নামে অভিহিত হইয়াছে। গত পূর্ব্ব ২৫শে জানুয়ারি দ্বিতীয় রুষ সেনাপতি গ্রিপেনবার্গ বিপুল সৈন্য লইয়া অতর্কিতভাবে জাপানবাহিনীর বামভাগ আক্রমণ করেন। প্রথম চারি দিবসের যুদ্ধ দর্শনে অনেকেরই ধারণা হইয়াছিল যে, বুঝি এতদিনে জয়লক্ষ্মী রুষের প্রতি অনুকূলা হইলেন। কিন্তু তাহা হইল না, রুযিয়ার দগ্ধ অদৃষ্টে সে শুভ মুহূর্ত্ত আসিয়াও আসিল না। সেনাপতি ওয়ামার অপূর্ব্ব নেতৃত্ব কৌশলে চতুর্থ রজনীতে যুদ্ধের গতি সম্পূর্ণ নূতনাকার ধারণ করিল, তাহার ফলে প্রভাতের পূর্ব্বেই রুষের পূর্ণ পরাজয় হইল।
এইরূপ প্রকাশ, এই যুদ্ধে ৩৬ সহস্র রুষসৈন্য ও সাত সহস্র জাপানী সৈন্য হতাহত হইয়াছিল।
পরাজয়ের হেতু নির্দ্দেশ করিতে যাইয়া গ্রিপেনবার্গ বলিয়াছেন;—কুরোপাট্কিন যথা সময়ে সৈন্য সাহায্য করিলে, তাঁহাকে এরূপ পরাজয় সহ্য করিতে হইত না। কুরােপাট্কিন বলেন, গ্রিপেনবার্গ তাঁহার সহিত কোনরূপ পরামর্শ না করিয়া মহাযুদ্ধ সংঘটনপূর্ব্বক ভীষণ পরাজয় সহ্য করিয়াছিলেন।
আর্থার বন্দর অধিকার পৃথিবীর সমর ইতিহাসে এক অপূর্ব্ব কীর্ত্তি। জাপানীরা ২৩৩ দিনব্যাপী অবরোধ করিয়া, বহু সৈন্য উৎসর্গ করিয়া ১৯০৫ খৃঃ ১লা জানুয়ারি তারিখে অজেয় আর্থার দুর্গে মিকাভাের সূর্য্যাঙ্কিত বিজয় বৈজয়ন্তী উড্ডীন করিতে সমর্থ হয়। এই বন্দর অধিকার করিতে জাপানীরা যে অসাধারণ সহিষ্ণুতা, বিপুল অধ্যবসায় ও অদ্ভুত শৌর্য্য প্রদর্শন করিয়াছে, জগতের ইতিহাসে তাহার তুলনা নাই।
রুষ সেনাপতি মহাবীর ষ্টোসেল প্রতিজ্ঞাপূর্ব্বক বলিয়াছিলেন, একজন মাত্র রুষসৈন্য জীবিত থাকিতে, রুষের ধমনীতে বিন্দুমাত্র শােণিত থাকিতে আমি আত্মসমর্পণ করিব না।” অবশেষে সেই কঠোর কর্ম্মা সেনাপতি নিরুপায় হইয়া, দুঃখে, ক্ষোভে, অভিমানে জাপান সেনাপতিকে বলিয়াছিলেন,—"নগী! আর নয়, আমরা আত্মসমর্পণ করিতেছি।”
১৯০৫ খৃঃ ১লা জানুয়ারি তারিখে আর্থার বন্দরস্থিত কি সেনা, কি সামরিক কর্ম্মচারী সকলেই জাপানের নিকটে আত্মসমর্পণ করেন। ইহাতে বন্দরের সমস্ত দুর্গ, গােলাগুলি, বারুদ, বন্দুক, কামান, রণতরি ও বিবিধ বাণিজ্যজাহাজনিচয় জাপান গভর্ণমেণ্টের হস্তগত হয়। দশ বৎসর পূর্ব্বে রুষ যে সম্পত্তি অম্লানবদনে জাপানের নিকট হইতে কাড়িয়া লইয়াছিল, জাপান সেনাপতি নগী কেবলমাত্র জাপানী সেনার সাহায্যে সেই সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করিয়াছেন। কেন জাপানের যশােনিনাদে দিঙ্মণ্ডল প্রতিধ্বনিত হইবে না?
রুষ কর্ম্মচারিগণ দুর্গরক্ষায় বিশেষ বীরত্ব প্রকাশ করায়, জাপান সেনাপতি প্রস্তাব করেন, যে সমস্ত রুষ কর্ম্মচারী শপথ করিয়া বলিবেন, “আর কখনও জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিব না” তাঁহারা রুষিয়ায় প্রত্যাবর্ত্তন করিতে অধিকার পাইবেন। এই রূপ শপথ করিয়া মহাবীর ষ্টোশেল, ৪৪১ জন কর্ম্মচারী ও ২২৯ আরদালীসহ মুক্তিলাভ করিয়াছিলেন। অবশিষ্ট ৪৩ জন কর্ম্মচারী ও ২৩৪৯১ জন সৈনিক বন্দী হইয়া জাপানে প্রেরিত হয়।
সৈন্য ও কর্ম্মচারী ব্যতীত, বিজয়ী জাপান সেনাপতি আর্থার বন্দরে ৫৯টী স্থায়ী দুর্গ, ৫৪৬টী কামান, ৩৫ হাজার বন্দুক, ৮২ হাজার শেলগােলা, ১৯ লক্ষ মণ কয়লা, ৪ খানি যুদ্ধ জাহাজ, ২খানি লৌহমণ্ডিত রণতরি, ১৪ খানি টর্পেডো তরণী, ১০ খানি বাণিজ্য জাহাজ, ৩৫ খানি কলের জাহাজ ও প্রচুর রেল সরঞ্জাম প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।
দশম যুদ্ধ মুকদেন যুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছে। এই মহাযুদ্ধে জাপানের সুসন্তান মার্শাল ওয়ামা যে অপূর্ব্ব কৃতিত্ব ও অসাধারণ রণচাতুর্য্যের পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন, পৃথিবীর সমরেতিহাসে তাহার তুলনা নাই। আজি জাপান সৈনিকের অনন্যসাধারণ শৌর্য-বীর্য্য দর্শন করিয়া, আমেরিকা স্তম্ভিত, ইউরােপ ভীত, এসিয়া পরমানন্দে বিমােহিত। প্রশান্ত মহাসাগরে রুষের জলবল পূর্ব্বেই নির্ম্মূল হইয়া যায়, তাহার পরে মানচুরিয়ার বিস্তৃত সমরপ্রাঙ্গনে স্থলবলও এক রূপ ধ্বংশ হইয়া গেল। বহুবর্ষ ধরিয়া, বহু কোটী মুদ্রা ব্যয় করিয়া, রুষ সমগ্র এসিয়ায় একাধিপত্য বিস্তারের যে কল্পনা করিতেছিলেন, আজি জাপানের প্রচণ্ড বিক্রমে সে কল্পনাজাল সহসা ছিন্ন হইয়া গিয়াছে। হায়! অদৃষ্টের কি কঠোর উপহাস!
আর ইউরােপের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সেনাপতি মহাবীর কুরােপাট্কিন! যিনি একদা টোকিওর নন্দন কাননে দৈত্যপতির ন্যায় বিচরণ করিতে বাসনা করিয়াছিলেন, মুকদেন যুদ্ধে তাঁহার সমস্ত আশাভরসা, তেজ, গর্ব্ব বিনষ্ট হইয়া গেল। এই মহাযুদ্ধের ভয়াবহ ফলে বিচলিত হইয়া, জার মহােদয়, সেনাপতি লিনিভিচকে মানচুরিয়ার প্রধান সেনাপতিপদে নিযুক্ত করেন। হায়! নিষ্ঠুর অদৃষ্ট।
রুষপক্ষ হইতে প্রকাশ, সাহাে মুকদেন যুদ্ধে প্রায় দুই লক্ষ রুষ সৈন্য হত, আহত ও বন্দী হইয়াছে এবং প্রায় ৫০০ শত কামান জাপানের হস্তগত হইয়াছে।
এইরূপ প্রকাশ, এই যুদ্ধে যে সমস্ত সমরোপকরণ ও রসদাদি জাপানের হস্তগত হইয়াছে, তাহার কিয়দ্দংশ শকটপূর্ণ হইয়া স্থানান্তরে প্রেরণ কালে ১২ মাইল পথ আচ্ছন্ন হইয়াছিল।
মার্শাল ওয়ামার রিপোর্টে প্রকাশ, এই মহাসমরে জাপানের হতাহতের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার হইয়াছিল।
মুকদেন যুদ্ধের পরে, টিলিং, সিংহিং প্রভৃতি স্থানে যে সকল যুদ্ধ হইয়াছিল তাহার সকল গুলিতেই রুষিয়ার শােচনীয় পরাজয় হয়। পৃথিবীর সমরেতিহাসে এরূপ ধারাবাহিক পরাজয়ের কথা শ্রুত হওয়া যায় নাই।
বাল্টিক নৌ-বাহিনীর পরিণাম।
জাপানিদিগকে উপর্য্যুপরি জয়লাভ করিতে দেখিয়া রুষ সম্রাট এডমিরাল রোজ্ডেজ্ভেনস্কির অধীনে বাল্টিক সাগরস্থিত নৌ-বাহিনীকে সুসজ্জিত করিয়া জাপানযুদ্ধে প্রেরণ করেন। এই বিপুল-বাহিনী যখন ইংরেজের কয়েকখানি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্ণবপােত বিনষ্ট করিয়া আটলাণ্টিকবক্ষঃ আলােড়িত করিতে করিতে প্রাচ্য সমুদ্রাভিমুখে ধাবিত হইল,তখন অনেকেই জাপানের পরিণাম ভাবিয়া আকুল হইয়াছিলেন। এই সময়ে জার্ম্মানি, ফরাসী প্রভৃতি নিরপেক্ষ শক্তিপুঞ্জেরা বিবিধ উপায়ে রুষিয়ার সাহায্য করিয়াছিলেন। অধিক কি, ইংরেজ বণিকেরা পর্য্যন্ত প্রকারান্তরে এই বিরাটবাহিনীর আবশ্যকীয় ইন্ধনাদি সংগ্রহে সহায়তা করিয়াছিলেন। এই সমস্ত ঘটনায়, বিশেষতঃ যখন রুষবাহিনী চীনসাগর অতিক্রম করিয়া জাপানের নিকট দিয়া উত্তরাভিমুখে অগ্রসর হইল, অথচ জাপানী নৌ-সেনাপতি টেগো শত্রুর গতিরোধ জন্য কোনপ্রকার চেষ্টা করিলেন না, তখন জাপানের জয় সম্বন্ধে সকলেরই অন্তঃকরণে দারুণ সন্দেহ উপস্থিত হইল। কিন্তু হায়! এত চেষ্টা ও আড়ম্বর স্বত্ত্বেও রুষিয়ার দগ্ধাদৃষ্টে পুনরায় দারুণ পরাজয় ঘটিল, জগতে পুনরায় অধর্ম্মের পরাজয় ও ধর্ম্মের জয় বিঘােষিত হইল।
জাপান ও কোরিয়া প্রায়দ্বীপের মধ্যে কোরিয়া প্রণালী অবস্থিত। গত ১৯০৫ অব্দের ২৭ মে শনিবার তারিখে রুষ নৌ-বাহিনী চারিভাগে বিভক্ত হইয়া এই প্রণালীতে প্রবিষ্ট হইবামাত্র জাপানী নৌ-বাহিনী কর্ত্তৃক আক্রান্ত হয়। শনিবার প্রাতঃকাল হইতে আরম্ভ হইয়া সােমবার প্রাতঃকাল পর্যন্ত যুদ্ধ হইয়াছিল। প্রথম দ্বাদশ ঘণ্টার মধ্যেই রুষবাহিনী বিধ্বস্ত হইয়া ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে আরম্ভ করে। পরে নৈশযুদ্ধে জাপানের টর্পেডাের আঘাতে তাহাদের শােচনীয় সর্ব্বনাশ সাধিত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত শত্রুপক্ষ সম্পূর্ণ পরাস্থ না হইয়াছিল, ততক্ষণ জাপানী সৈন্যেরা বিন্দুমাত্র শৈথিল্য প্রকাশ করে নাই।
এই কালসমরে রূষপক্ষের রিয়াজসুভায়ফ, আলেকজেণ্ডার, বেরিডিনো, ডিমিট্রি, নাচিমহফ্, ভ্যালাডিমির, মনােমাক, জামযুগ, উষাহফ্,অসলিয়া, নাভারিণ, আলমাজ প্রভৃতি রণপােতগুলি কোরিয়া প্রণালীস্থিত সুসীমা দ্বীপের নিকটে জলমগ্ন হয়। নিকোলাস, ওরেল, আপ্রাকসিন, সেনিয়াভিন ও চিভােডি এই পাঁচখানি রণতরি বিজয়ী জাপানিদিগের হস্তগত হয়।
এই সমস্ত রণতরিগুলির মূল্য বিংশতি কোটী টাকার ন্যূন হইবে না।
এই মহাযুদ্ধে জাপানীপক্ষের তিনখানি টর্পেডো তরণী বিনষ্ট ও ৪০০ লােক হতাহত হয়। এইরূপ প্রকাশ যে যুদ্ধ পরিচালন কালে সেনাপতি টেগো ও এডমিরাল যিশু সামান্য আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।
এই যুদ্ধে ৫৫০০ শত রুষসেনার সহিত প্রধান সেনাপতি রােজডেজভেনস্কি, নেবােগেটফ্, ফোকর্সাম ও বোট্রোভােস্কি জাপানের বন্দী হন।
অতিদর্পে লঙ্কেশ্বর রাবণ বিনষ্ট হইয়াছিলেন, অতিশয় অভিমানে কুরুপতি দুর্য্যোধনের সর্ব্বনাশ হইয়াছিল, আর অতিলােভে রুষ সম্রাট নিকোলাস হতমান, নষ্টগৌরব ও ভগ্নমনোরথ হইলেন। অর্দ্ধ ইউরােপ ও অর্দ্ধ এসিয়া যাঁহার পদানত এই যুদ্ধ ফলে সেই রুষসম্রাটকে জাপানের ইচ্ছানুসারে সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিতে হইল। ধনবল, বাহুবল, লােকবলের অপেক্ষা যে ধর্ম্মবল কত শ্রেষ্ঠ তাহা তিনি জানিতেন না। অর্দ্ধ পৃথিবীর অপ্রিয় অধীশ্বরের অপেক্ষা ক্ষুদ্রদ্বীপের প্রিয় সম্রাট যে কত শক্তিশালী, জার মহােদয় এই যুদ্ধে তাহা সম্যক্ হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইয়াছেন।
জাপানের এই অশ্রুতপূর্ব্ব জয়লাভে আজ আমরা আনন্দিত; কোন্ প্রাচ্যজাতি প্রাচ্যজাতির জয়লাভে আনন্দ ও গর্ব্ব অনুভব না করিবে? জাপান গত মহাযুদ্ধে পাশ্চাত্য মােহ-জাল ছিন্ন করিয়া প্রাচ্যজগতের মুখােজ্জ্বল করিয়াছে। সেই জন্যই আমাদের আনন্দ। কিন্তু প্রবল প্রতাপ রুষ সম্রাটের অবস্থা স্মৃতিপথে উদিত হইলে আমরা দুঃখে ম্রিয়মাণ হই। ভারতবর্ষের ভীষণ দুর্ভিক্ষের সময়ে রুষিয়া নানাপ্রকারে আমাদিগকে সাহায্য করিয়াছিল, সুতরাং আমরা রুষিয়ার নিকটও কৃতজ্ঞতাপাশে বদ্ধ। রুষ সম্রাট নিকোলাস আমাদের ভারত সম্রাট সপ্তম এডোয়ার্ডের নিকট আত্মীয়, সেজন্যও আমরা তাঁহার বিপদে দুঃখিত। কিন্তু তিনি যদি আমাদিগকে বিপদকালে সাহায্য না করিতেন, অথবা তিনি আমাদের রাজরাজেশ্বরের আত্মীয় না হইতেন, তথাপি আমরা তাঁহার এই দুর্দ্দশায় দুঃখিত হইতাম। প্রবল পরাক্রান্ত সম্রাটকে, ধুল্যবলুণ্ঠিত দেখিলে কাহার হৃদয়ে বিষাদের ছায়া পতিত না হয়? প্রবল ভূমিকম্পে গগণস্পর্শী অট্টালিকা ভূমিশায়ী হইলে কে তাহা অবিচলিত চিত্তে দর্শন করিতে পারে?
গত রুষজাপান যুদ্ধে যে সমস্ত খ্যাতনামা রুষ সেনাপতিগণের দারুণ ভাগ্যবিপর্যয় ঘটিয়াছিল, নিম্নে তাঁহাদের একটী তালিকা প্রদান করা হইল।
স্থল সেনাপতি।
(জেনারল উপাধিধারী যে ২৮ জন যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন)
১। ষ্টোশেল ... বন্দী[১] | ১০। রটকোভােস্কি নিহত |
২। গ্রিপেনবার্গ অপমানিত | ১১। স্মারনফ্ বন্দী |
হইয়া প্রত্যাবর্ত্তন। | ১২। রেচ টালিনিষ্কি ঐ |
৩। অরলফ্ ঐ | ১৩। প্লাগ ঐ |
৪। ট্রুসক্ ঐ | ১৪। বিলি ঐ |
৫। কেলার যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত। | ১৫। গােরবাটকোভােস্কি ঐ |
৬। কোণ্ড্রাচেনকো ঐ | ১৬। নিকিটিন ঐ |
৭। জারপিটসি ঐ | ১৭। ফক বন্দী |
৮। রিয়ালিনকিন ঐ | ১৮। কোণ্ড্রাভিচ সাংঘাতিক |
৯। স্নোলেনস্কি ঐ | আহত। |
১৯। কাসাটালিনিস্কী আহত। | ২৬। লিনিভিচ্ উন্নতিলাভ |
২০। সাসুলিচ পদানত। | করিয়া যুদ্ধ শেষ পর্য্যন্ত |
২১। ষ্টাকেলবার্গ আহত। | ছিলেন। |
২২। রেনেনক্যাম্প ঐ | ২৭। কবলারস্ যুদ্ধ শেষ পর্য্যন্ত |
২৩। মিচচেন্কো ঐ | স্বপদে ছিলেন। |
২৪। কুরোপাটকিন্ পদাবনত। | ২৮। সাকারফ্ ঐ |
২৫। বিলডারিং ঐ |
জল সেনাপতি।
(এডমিরাল উপাধিধারী যে ১৬ জন যুদ্ধে নিযুক্ত হন)
১। এলেকসিফ অপমানিত | ৯। রোজডেজভেনস্কি বন্দী |
হইয়া প্রত্যাবর্ত্তন। | ১০। ফোকেরশাম ঐ |
২। ষ্টার্ক ঐ | ১১। বোট্রোভােস্কি ঐ |
৩। স্ক্রাইডলফ্ ঐ | ১২। ম্যাকারফ্ নিহত। |
৪। বেজোব্রাজফ ঐ | ১৩। নেবােগেটফ্ ঐ |
৫। উখ্টোমস্কি বন্দী | ১৪। মােলাস্ ঐ |
৬। উইরেন ঐ | ১৫। উইটগেট্ ঐ |
৭। লচচিনিস্কি ঐ | ১৬। জেসুরু যুদ্ধ শেষ পর্য্যন্ত |
৮। গ্রিগােরিভিচ ঐ | ভ্যালিডিভােষ্টকে ছিলেন। |
রুষ জাপান সন্ধি।
বাল্টিক নৌ-বাহিনীর শােচনীয় পরিণাম সন্দর্শন করিয়া আমেরিকার যুক্তরাজ্যের প্রেসিডেণ্ট রুজভেল্ট মহােদয় ১৯০৫ অব্দের ৯ই জুন তারিখে যুযুৎসু জাতিদ্বয়ের নিকটে সন্ধির প্রস্তাব করেন। তদনুসারে রুষপক্ষে কাউণ্ট ডি-উইটী ও জাপান পক্ষে ব্যারণ কমুরা সন্ধিদূত নিযুক্ত হইয়া, আমেরিকার পাের্টসমাউথ নগরে গমন করেন। ১০ই আগষ্ট তারিখে সন্ধির প্রথম অধিবেশন হয়। প্রায় এক মাসকালব্যাপী প্রবল তর্ক বিতর্কের পরে ৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে উভয় পক্ষ সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিয়া, বিংশশতাব্দীর প্রথম যুদ্ধের অবসান করেন।
নিম্নে সন্ধির যাবতীয় স্বত্ত্বগুলি ধারাবাহিকরূপে সঙ্কলিত হইল।
১। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণজন্য জাপান গভর্ণমেণ্ট রুষিয়ার নিকটে অর্থরূপে কিছু গ্রহণ করিবেন না। যে সমস্ত রুষ সৈন্য বন্দী হইয়া জাপানে অবস্থিতি করিতেছে, তাহাদের জন্য যে টাকা ব্যয় হইয়াছে, জাপান তাহা প্রাপ্ত হইবেন।
২। রুষাধিকৃত সাগেলিয়ন দ্বীপ সমান দুই অংশে বিভক্ত করিয়া, তাহার দক্ষিণার্দ্ধ জাপান গ্রহণ করিবেন। এই অর্দ্ধাংশে জাপান গভর্ণমেণ্ট স্থায়ীভাবে কোন দুর্গাদি নির্ম্মাণ করিবেন না। যেশাে ও সাগেলিয়ান দ্বীপের মধ্যবর্তী লাপিরুজ প্রণালী জাপানের অধিকার ভুক্ত হইবে।
৩। লিয়াওটাং উপদ্বীপ, দুর্গাদিসহ আর্থার বন্দর ও ইলিয়ট দ্বীপপুঞ্জ জাপান গভর্ণমেণ্ট প্রাপ্ত হইবেন।
৪। যুযুৎসু জাতিদ্বয় নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মানচুরিয়া পরিত্যাগ করিবেন।
৫। স্বরাজ্যে চীন গভর্ণমেণ্টের একাধিপত্য স্থাপিত হইবে।
৬। চীনরাজ্যে সমস্ত বৈদেশিক শক্তির সমান বাণিজ্যাধিকার থাকিবে।
৭। হার্ব্বিন হইতে আর্থার বন্দর পর্যন্ত রুষিয়ার রেলপথ জাপান গভর্ণমেণ্ট প্রাপ্ত হইবেন। ভ্যালাডিভােষ্টক রেলপথ রুষিয়ার অধিকারে থাকিবে।
৮। কোরিয়া রাজ্যের সমস্ত বিভাগে জাপানের অক্ষুণ্ণ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হইবে।
৯। রুষাধিকৃত ভ্যালাডিভােষ্টক হইতে বেরিং প্রণালী পর্য্যন্ত সাইবেরিয়া প্রদেশের উপকূলে জাপানীরা মৎস্য ধরিবার অধিকার প্রাপ্ত হইবে।
১০। রুষিয়ার যে সমস্ত যুদ্ধ ও বাণিজ্য জাহাজ জাপান গভর্ণমেণ্ট ধৃত করিয়াছেন এবং যাহা সমুদ্রে নিমগ্ন রহিয়াছে, সে সমস্ত জাপান প্রাপ্ত হইবেন।
১১। রুষিয়ার যে সমস্ত যুদ্ধ ও বাণিজ্য জাহাজ নিরপেক্ষ বন্দরে আত্মসমর্পণ করিয়াছে, সে সমস্ত রুষ গভর্ণমেণ্ট প্রাপ্ত হইবেন।
উপরােক্ত সন্ধিপত্রের স্থূলমর্ম্ম প্রকাশ হইবার অব্যবহিত পরেই সমগ্র সভ্যজগৎব্যাপিয়া মহা হুলস্থূল পড়িয়া গিয়াছিল। “টাইমস” বলিয়াছিলেন, “জাপানীরা এই সন্ধিতে স্বীকৃত হইয়া যে ঔদার্য্য, মহানুভবতা ও আত্মসংযমতার পরিচয় প্রদান করিয়াছে, তাহা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখন পরিদৃষ্ট হয় নাই।” “মণিং পােষ্টের” মতে “এই মহা ত্যাগস্বীকারে জাপানের বিজয়গৌরব শতগুণে বর্দ্ধিত হইয়াছে।” “গ্রাফিক” বলিয়াছিলেন, “খৃষ্টীয় রাজন্যবর্গের কেহই এরূপ মহত্ব ও উদারতা দেখাইতে পারেন না।” “ডেলীমেল” লিখিয়াছিলেন, “যুদ্ধকৌশলে জাপানীরা শ্রেষ্ঠ হইলেও কুটরাজনীতিতে রুষিয়ার সমকক্ষ নহে।” “ষ্টাণ্ডার্ডে” প্রকাশ, রুষ গভর্ণমেণ্ট গােপনে জাপানের ক্ষতিপুরণ করিয়াছেন, কেবল জারের বিশেষ অনুরােধে সন্ধিপত্রে ইহা পরিত্যক্ত হইয়াছে।
জাপানী পত্র সম্পাদকেরা বলিয়াছিলেন, জাপানের জয়ের তুলনায় বর্ত্তমান সন্ধি কিছুই নহে।
আমেরিকা, জারমানি ও প্যারিসের পত্র সম্পাদকেরা একবাক্যে জাপানের মহানুভবতা ও রুষ মন্ত্রিগণের কূটরাজনীতিজ্ঞতার ভূয়সী প্রশংসা করিয়াছিলেন।
রুষপত্র “নভােভ্রিমিয়া” বলিয়াছিলেন, “বর্ত্তমান সন্ধি রুষিয়ার অদৃষ্টে দারুণ বিপদ আনয়ন করিবে।” রুষিয়ার “সুয়েট” লিখিয়াছিলেন, “সাগেলিয়ান দ্বীপের অর্দ্ধাংশ পরিত্যাগের তুলনায় জাপানের ত্যাগস্বীকার কোনক্রমেই গণনীয় হইতে পারে না।” “রাস্” পত্রে প্রকাশ “বর্ত্তমান সন্ধিতে শত্রুপক্ষেরই স্বার্থ অধিক পরিমাণে সংরক্ষিত হইয়াছে।” “নভােস্তীতে” প্রকাশ “এই সন্ধিতে রুষিয়ার পূর্ব্বগৌরব সম্পূর্ণ বিনষ্ট হইয়াছে।”
রুষ জাপান যুদ্ধের সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হইবার অল্পদিবস পূর্ব্বে (১৯০৫, ১২ই আগষ্ট) ইংরেজ ও জাপানের সহিত একটী চুক্তি হইয়া গিয়াছে। তাহাতে উভয়শক্তি উভয়েরই বিপদে সাহায্য করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছেন। চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হইবার তারিখ হইতে দশ বৎসরের জন্য এই চুক্তি বলবৎ থাকিবে।
সম্পূর্ণ।
- ↑ রুষ কারাগারে বন্দীরূপে বাস করিতেছেন।