নাগপাশ/প্রথম খণ্ড/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।

নবীনচন্দ্র কি করিলেন।

প্রভাত বিদ্যালয় হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া ছাত্রাবাসে আপনার কক্ষের দ্বারে চাবি খুলিতেছে, এমন সময় পার্শ্বের কক্ষ হইতে নবীনচন্দ্র ডাকিলেন, “কে ও? প্রভাত আসিলি?” পার্শ্বের কক্ষের অধিকারী ছাত্রদ্বয়ের এক জন অসুস্থতা প্রযুক্ত বিদ্যালয়ে যায় নাই। তাহার গৃহ ধূলগ্রামের পার্শ্ববর্ত্তী গ্রামে।

 প্রভাত দ্রুতপদে সেই কক্ষে প্রবেশ করিল; শয্যার উপর পুস্তকগুলি ফেলিয়া পিতৃব্যকে প্রণাম করিল; ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি? অসময়ে? বাড়ীর সব ভাল?”

 নবীনচন্দ্র দেখিলেন, সে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়াছে; বলিলেন, “সব ভাল। তুই যে বড় রোগা হইয়াছিস!”

 সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে নবীনচন্দ্র ভ্রাতুষ্পুত্ত্রকে বলিলেন, “আমি পল্লীগ্রামের লোক। চল, আমাকে তোদের সহর দেখাইয়া আনিবি ৷”

 উভয়ে ভ্রমণে বাহির হইলেন। নবীনচন্দ্র প্রভাতের নিকট জ্ঞাতব্য কথার অবতারণার অবসর সন্ধান করিতেছিলেন। অবসর পাইতে বিলম্ব হইল না। রাজপথে আসিয়া নবীনচন্দ্র লক্ষ্য করিলেন, সম্মুখে বৃহৎ হর্ম্মের দ্বারে দ্বারবান প্রভাতকে সেলাম করিল। নবীনচন্দ্র প্রভাতকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বাড়ী কাহার?”

 প্রভাত উত্তর করিল, “কৃষ্ণনাথ বসুর।”

 নবীনচন্দ্র মনে মনে হাসিলেন; প্রকাশ্যে বলিলেন,“ও বাড়ীতে কাহারও সহিত তোর পরিচয় আছে নাকি?”

 প্রভাত বলিল, “কৃষ্ণনাথ বাবুর মধ্যম পুত্র বিনোদবিহারী আমার সহপাঠী ছিল।”

  “খুব ত বড় বাড়ী! কৃষ্ণনাথ বাবু বড়লোক?”

 “হাঁ।”

 “কৃষ্ণনাথ বাবুর কন্যার সহিত তোর বিবাহের সম্বন্ধ আসিয়াছে।”

 প্রভাত কোনও কথা কহিল না; নতদৃষ্টি হইয়া চলিতে লাগিল। কিন্তু নবীনচন্দ্র লক্ষ্য করিলেন, তাহার কর্ণদ্বয় রক্তাভ হইয়া উঠিল। তিনি বুঝিলেন, লক্ষণ ভাল নহে,—সে এ কথা অবগত আছে। তিনি বলিলেন, “তোর মত জানিবার জন্যই আমি আসিয়াছি।”

 প্রভাত কোনও উত্তর দিল না; মুখ তুলিল না।

 নবীনচন্দ্র বলিলেন, “কি বলিস্? বল।”

 প্রভাত বলিল, “আমার আবার মত কি?”

 “তোর মতই আবশ্যক। তোর মতেই আমার মত। তোর যদি ইচ্ছা থাকে, তবে দাদার মত করাইব।”

 “তিনি অমত করিয়াছেন?”

 “অমত আর কি! তেমন আগ্রহ নাই।”

 “তবে আমি কিছুতেই এখানে বিবাহ করিব না।”

 নবীনচন্দ্র অন্য কথার অবতারণা করিলেন।

 রাত্রিকালে আহারের পর প্রভাত তক্তপোষের উপর হইতে আপনার শয্যা নামাইল। নবীনচন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “শয্যা নামাইতেছিস্ কেন?”

 প্রভাত উত্তর করিল, “আপনার শয্যা রচনা করিব।”

 “আর তুই?”

 “আমি নিম্নে শয়ন করিব।”

 “কেন? আমি নিম্নে শয়ন করিলে কি ক্ষতি হইত?”

 তিনি প্রভাতকে নিম্নে শয়ন করিতে দিবেন না; প্রভাতও তাঁহাকে নিম্নে শয়ন করিতে দিবে না। শেষে টেবল ও চেয়ার তক্তপোষের উপর স্থানান্তরিত করিয়া হর্ম্ম্যতলেই উভয়ের শয্যা রচিত হইল।

 নবীনচন্দ্র বলিলেন, “এখন বল, এ বিবাহ সম্বন্ধে তোর মত কি?”

 প্রভাতকে নিরুত্তর দেখিয়া তিনি পুনরায় বলিলেন, “আমি বড় মুখ করিয়া আসিয়াছি, তোর মত জানিয়া যাইব। ভাবিয়াছি, তুই আমাকে কিছু গোপন করিবি না।”

 এবার প্রভাত বলিল, “বাবার যাহাতে অমত, আমি সে কায কখনই করিব না।”

 নবীনচন্দ্র সস্নেহে প্রভাতের গায়ে হাত বুলাইয়া বলিলেন, “পাগল ছেলে, বাপমা’র সবই ত ছেলের সুখের জন্য। তাঁহার মতের ভাব আমার রহিল। তুই তোর প্রকৃত মনোভাব আমাকে বলিবি না?”

 নবীনচন্দ্র পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুই অবশ্যই কোন দিন না কোন দিন মেয়েটিকে দেখিয়াছিস। মেয়েটি সুন্দরী?”

 প্রভাত মস্তকসঞ্চালনে জানাইল—হাঁ।

 নবীনচন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ বিবাহে তোর ইচ্ছা আছে। না?”

 প্রভাত নতমুখে রহিল।

 নবীনচন্দ্র বুঝিলেন, বলিলেন, “যাহাতে এ বিবাহ হয়, আমি তাহা করিব। তুই ভাবিস্ না।”

 প্রভাত ধীরে ধীরে বলিল, “বাবার অমতে আমি এ কায করিব না।”

 “তাঁহার নিকট কি তোর সুখের অপেক্ষা আর কিছু বড়? সে ভয় করিস্ না। সে ভাব আমার।”

 রাত্রিকালে নবীনচন্দ্রের যখনই নিদ্রাভঙ্গ হইল, তিনি তখনই দেখিলেন, প্রভাত জাগিয়া। তিনি বুঝিলেন,রোগ কঠিন।

 প্রত্যূষে উঠিয়া নবীনচন্দ্র জাগ্রত প্রভাতকে বলিলেন, “তোর সকালে উঠা অভ্যাস নাই; ঘুমা। আমি ভবানীপুরে যাইব। হরিহরের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া ফিরিব।”

 ভবানীপুরে যাইয়া নবীনচন্দ্র হরিহরের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাহার পত্র লিখিবার কারণ অবগত হইলেন, এবং তাহাকে মিষ্টালাপে আপ্যায়িত করিয়া ফিরিলেন।

 এ দিকে বিনোদবিহারী প্রভাতের নিকট আসিয়া নবীনচন্দ্রের আগমনবার্ত্তা অবগত হইয়া গিয়াছিল। হরিহর পূর্ব্বদিন শিবচন্দ্রের পত্রের বিষয় রমানাথকে জানাইয়াছিল; তাঁহার নিকট সংবাদ পাইয়া শ্যামাপ্রসন্ন বাবু কৃষ্ণনাথকে সে সংবাদ দিয়াছিলেন।

 নবীনচন্দ্র প্রত্যাবৃত্ত হইবার অল্পক্ষণ পরেই বিনোদবিহারী পুনরায় আসিয়া জানিয়া গেল, তিনি ফিরিয়াছেন। তাহার পরই কৃষ্ণনাথ স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কিছুক্ষণ আলাপের পর কৃষ্ণনাথ বলিলেন, “আমি কন্যাদায়গ্রস্থ, আপনার শরণাগত—আমাকে উদ্ধার করিতে হইবে।”

 নবীনচন্দ্র স্বাভাবিক বিনয়সহকারে বলিলেন, “আপনার সহিত কুটুম্বিতা ত আমাদের সৌভাগ্যের কথা। আমি যাইয়া দাদাকে সব বলিব।”

 কৃষ্ণনাথ পূর্ব্বেই বিনোদবিহারীকে দিয়া প্রভাতের নিকট সন্ধ্যায় নবীনচন্দ্রকে আহারের নিমন্ত্রণ করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন। প্রভাত বলিয়াছিল, এক দিনের পরিচয়ে নিমন্ত্রণে তিনি কোনও কারণ দেখাইয়া প্রত্যাখ্যান করিবেন। তাহা শুনিয়া কৃষ্ণনাথ আর এক কৌশল করিয়াছিলেন।

 সন্ধ্যাকালে কৃষ্ণনাথ পুনরায় নবীনচন্দ্রের নিকট উপস্থিত হইলেন; সঙ্গে শ্যামাপ্রসন্ন। কৃষ্ণনাথ বলিলেন, “আমার গৃহে আজ সঙ্গীতের আয়োজন হইয়াছে। আপনাকে পদধূলি দিতে হইবে।” নবীনচন্দ্র অনুরোধ এড়াইতে পারিলেন না। তিনি যৌবনে সঙ্গীতচর্চ্চা করিয়াছিলেন; সাধনায় সিদ্ধিলাভও হইয়াছিল। মৃদঙ্গবাদনে তিনি দেশে বিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু পত্নীর মৃত্যুর পর তিনি আর কোনও বাদ্যযন্ত্র স্পর্শ করেন নাই, যে যন্ত্র যে চাহিয়াছে, সে যন্ত্র তাহাকেই দিয়াছেন।

 কৃষ্ণনাথের বৃহ্ৎ বৈঠকখানা আজ বিশেষরূপ সুসজ্জিত; কুসুমে, আলোকে, আবরণযুক্ত চিত্রে— যে বৃহৎ কক্ষ মনোরম। আর সেই সুসজ্জিত, আলোকোজ্জ্ব্ল কক্ষে নিপূণ বাদকের হস্তে বাদ্যযন্ত্রের মধুর ধ্বনি, সুগায়কের কণ্ঠোদ্ভূত সুস্বরলহরী।

 কিছুক্ষণ সঙ্গীতের পর কৃষ্ণনাথ নবীনচন্দ্রকে বলিলেন, “বেহাই! অনুগ্রহ করিয়া একবার গাত্রোত্থান করিতে হইবে।”

 কৃষ্ণনাথ ও শ্যামাপ্রসন্ন একান্ত জিদ করিতে লাগিলেন,—মিষ্টমুখ করিতেই হইবে। অনন্যোপায় হইয়া নবীনচন্দ্র উঠিলেন।

 পার্শ্বের কক্ষে আসিয়া নবীনচন্দ্র দেখিলেন, বিপুল আয়োজন;—বিবিধ রৌপ্যপাত্রে বহুবিধ আহার্য্য ও পানীয় সজ্জিত। সে সকলের সদ্ব্যবহার করা একের সাধ্যাতীত। নবীনচন্দ্র ভাবিলেন, সহরে আহারের আয়োজন প্রধানতঃ দেখাইবার জন্য।

 আহারের সময় শ্যামাপ্রসন্ন আবার বিবাহের কথার উত্থাপন করিলেন। অন্য কথার মধ্যে কৃষ্ণনাথ বলিলেন, “আমি জামাতাকে দ্রব্যে বলুন বা নগদে বলুন, চারি সহস্র টাকা দিতে প্রস্তুত আছি।”

 স্বভাবতঃ বিনয়ী নবীনচন্দ্রের হৃদয়ে একটা কি ছিল, যাহা অন্যায় সহ্য করিতে পারিত না, আত্মসম্মানে আঘাত সহ্য করিত না। তিনি বলিলেন, “আমরা বড়মানুষ নহি; কিন্তু পুত্ত্রের বিবাহ দিয়া টাকা লইতে পারিব না। শুনিয়াছি, পুত্ত্রবিক্রয়প্রথা সহরে প্রচলিত হইয়াছে; কিন্তু আমাদের পল্লীগ্রামে যে কয় দিন, না যায়, সেই কয় দিনই ভাল। আমরাও কন্যার বিবাহ দিয়াছি; কিন্তু বরপক্ষীয়গণ দরের কোনও কথা বলেন নাই।”

 বুদ্ধিমান শ্যামাপ্রসন্ন বুঝিলেন, টাকার কথাটা প্রলোভনীয় না হইয়া বিপরীতফলপ্রসূ হইয়া দাঁড়াইতেছে! তিনি বলিলেন, “সে কথা নহে। আপনারা মহৎ ব্যক্তি, আপনাদিগকে কি আমরা সে কথা বলিতে পারি? কৃষ্ণনাথের এক মেয়ে, জামাতাকে কিছু যৌতুক দিতে ইচ্ছা করে, তাই আপনার অনুমতি চাহিতেছে।”

 নবীনচন্দ্র বলিলেন, “তাহাতে আমাদের মতামত কি?”

 শ্যামাপ্রসন্ন অন্য কথার উত্থাপন করিলেন।

 কৃষ্ণনাথের কনিষ্ঠ পুত্র নলিনবিহারী শ্যামাপ্রসন্নকে কি বলিয়া গেল। শ্যামাপ্রসন্ন কৃষ্ণনাথকে বলিলেন, “যাও; শোভাকে লইয়া আইস। শ্বশুরকে প্রণাম করিয়া যাউক।”

 কৃষ্ণনাথ কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন, এবং অল্পক্ষণ পরেই সুবেশসজ্জিতা, বহুমূল্য অলঙ্কারে ভূষিতা, অমলস্রগ্দামশোভিতা কন্যাকে লইয়া প্রত্যাগত হইলেন। শোভা নবীনচন্দ্রকে প্রণাম করিল। নবীনচন্দ্র যথোপযুক্ত আশীর্ব্বাদ করিলেন। তিনি দেখিলেন, কৃষ্ণনাথের কন্যা সত্যই সুন্দরী।

 প্রত্যাবর্ত্তনকালে নবীনচন্দ্র কৃষ্ণনাথের কুল শীল পরিচয় জিজ্ঞাসা করিয়া আসিলেন।

 নবীনচন্দ্র পরদিন গৃহে যাইতে পারিলেন না; ঘটকের নিকট কৃষ্ণনাথের কুলপরিচয় লইয়া আসিলেন। তিনি জানিলেন, কৃষ্ণনাথের সঙ্গে সম্বন্ধ সে হিসাবে স্পৃহনীয়।

 সে দিন কৃষ্ণনাথ পুনরায় নবীনচন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন।

 নবীনচন্দ্র সেইদিন রাত্রিতে গৃহে যাইবার জন্য যাত্রা করিবেন, স্থির করিয়াছিলেন; কিন্তু তাহা হইল না। তিনি শিবচন্দ্রের এক পত্র পাইলেন।—নবীনচন্দ্রের শ্বশুর মহাশয় তাঁহার একমাত্র সন্তান—নবীনচন্দ্রের পত্নীর মৃত্যুর পর সস্ত্রীক কাশীবাসী হইয়াছিলেন। তথায় তাঁহার পত্নীর মৃত্যু ঘটে। এক্ষণে তিনি পীড়িত হইয়া নবীনচন্দ্রকে যাইতে লিখিয়াছেন। শিবচন্দ্র সেই পত্র পাঠাইয়াছেন, এবং স্বয়ং লিখিয়াছেন, নবীনচন্দ্রের পক্ষে কলিকাতা হইতে কাশী যাত্রা করাই কর্তব্য।

 সেই পত্র পাইয়া নবীনচন্দ্র কাশীযাত্রা করিলেন।