নাগপাশ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ)/প্রথম খণ্ড/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ।
বিপদ ও সম্পদ।
নবীনচন্দ্র কাশীতে আসিয়া দেখিলেন, তাঁহার শ্বশুর মৃত। নবীনচন্দ্র দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ না করায় বৃদ্ধ তাঁহাকে বিশেষ স্নেহ ও শ্রদ্ধা করিতেন। কিন্তু কন্যার মৃত্যুজনিত শোকে তিনি সংসারে নির্লিপ্ত হইয়া ধর্ম্মালোচনায় মন দিয়াছিলেন। তাঁহার পত্নী জীবিতা থাকিতে কয়বার দৌহিত্রীকে আনাইয়াছিলেন। বৃদ্ধ তাঁহাকে পুনঃপুনঃ বলিতেন, “আর সংসারের মায়া জড়াইও না।” পত্নীর মৃত্যুর পর তিনি দৌহিত্রাকে আর নিকটে আনেন নাই; কিন্তু নবীনচন্দ্রের ও তাহার সংবাদ সর্ব্বদাই লইতেন।
তিনি সঙ্গতিপন্ন ব্যক্তি ছিলেন; কিন্তু তাঁহার সংস্থানের পরিমাণ নবীনচন্দ্র জানিতেন না—এইবার জানিলেন। তাঁহার উইল রেজেষ্ট্রী আফিসে ছিল, নকল তাঁহার হাতবাক্সে ছিল। তাহার নির্দ্দেশ,—তাঁহার পঁয়ষট্টি হাজার টাকার কোম্পানীর কাগজের পাঁচ হাজার টাকার কাগজ তাঁহার দৌহিত্রী শ্রীমতী কমলকুমারীর; এক হাজার টাকার কাগজ বিক্রয় করিয়া অর্থ তাঁহার ভৃত্যদিগকে দান করা হইবে; তিনি যে সকল দরিদ্রকে মাসিক সাহায্য করিতেন, চারি হাজার টাকার কাগজের বিক্রয়লব্ধ অর্থ নির্দ্দেশমত তাহাদিগকে এককালীন দান করিতে হইবে; অবশিষ্ট সমস্ত কাগজ, দেশের ও কাশীর গৃহ, স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি তাঁহার জামাতা শ্রীমান নবীনচন্দ্র দত্তের।
নবীনচন্দ্র কলিকাতার পথে গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। কৃষ্ণনাথ সকল কথা শুনিলেন, এবং দ্বিগুণ আগ্রহে প্রভাতের সহিত কন্যার বিবাহের প্রস্তাব করিলেন। প্রভাত আসিয়া খুল্লতাতকে ট্রেণে তুলিয়া দিয়া গেল।
নবীনচন্দ্র যখন গৃহে উপনীত হইলেন, তখন শিবচন্দ্র কোনও প্রতিবেশীর গৃহে একটা সামাজিক কার্য্যের জন্য ফর্দ্দ করিতেছিলেন। নবীনচন্দ্র অন্তঃপুরের দ্বার হইতে দিদিকে ডাকিয়া প্রবেশ করিলেন। পিসীমা ও বড়বধূঠাকুরাণী তাঁহার কুশল প্রশ্ন করিলেন। প্রভাতের কুশলবার্ত্তা ও কাশীর সংবাদের পর প্রভাতের বিবাহ-সম্বন্ধের কথা উঠিল। নবীনচন্দ্রের মুখে কৃষ্ণনাথের প্রশংসা আর ধরে না। তিনি বলিলেন,—কৃষ্ণনাথ মুখ্য কুলীন, স্পৃহনীয় ঘর, বিশেষ ধনবান, অতি অমায়িক, তিনি যে কয় দিন কলিকাতায় ছিলেন, প্রত্যহ তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিতেন; মেয়েটি ‘পরমাসুন্দরী’— ইত্যাদি ইত্যাদি।
পিসীমা জিজ্ঞাসা করিলেন, “প্রভাতের মন জানিলি?”
নবীনচন্দ্র উত্তর করিলেন, “দাদাকে বলিও না, তিনি শুনিলে রাগ করিবেন: এই সম্বন্ধেই ছেলের মত।”
“শিব কি মত দিবে?”
“তোমাকে আর আমাকে তাঁহার মত করাইতে হইবে। ছেলের অমতে কায করা হইবে না।তাহার সুখের অপেক্ষা কি আর কিছু বড়?”
বড়বধূঠাকুরাণীর মুখ গম্ভীর হইল।
পিসীমা বলিলেন, “কিন্তু, মিত্র বাড়ীর—”
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “চুপ কর। ও কথা আর তুলিও না। একেই দাদার মত করান সহজ হইবে না; তাহাতে আবার তুমি যদি অমত কর, তবেই বিপদ। ছেলের যখন এ বিবাহে ইচ্ছা, তখন যাহাতে এ কায হয়, তাহাই করিতে হইবে।”
পিসীমা নীরব হইলেন। প্রভাতের সুখের অপেক্ষা আর কিছুই বড় নহে।
বড়বধূঠাকুরাণীর মুখ গম্ভীর দেখিয়া নবীনচন্দ্র বলিলেন, “আপনি যেন অমত করিবেন না!”
নবীনচন্দ্র স্নান করিয়া আসিয়া দেখিলেন, শিবচন্দ্র তাঁহার আগমনবার্ত্তা পাইয়া গৃহে ফিরিয়া তাঁহার প্রত্যাবর্ত্তন প্রতীক্ষা করিতেছেন।
অগ্রজের নিকট নবীনচন্দ্র কাশীর সকল সংবাদ বিবৃত করিলেন। শুনিয়া শিবচন্দ্র বলিলেন, “তাঁহার শ্রাদ্ধের অধিকারীদিগকে সংবাদ দিয়াছ?”
নবীনচন্দ্র উত্তর করিলেন, “দিয়াছি। লিখিয়াছি, তাঁহারা যথারীতি নিয়ম পালন করেন; শ্রাদ্ধ যে স্থানে করা আপনার মত হয়, তাঁহাদিগকে জানাইলে তাঁহারা আসিয়া কার্য্য করিবেন।”
“লিখিয়াছ, ব্যয় আমাদের?”
“লিখিয়া দিব।”
তাহার পর নবীনচন্দ্র কৃষ্ণনাথের কন্যার সহিত প্রভাতের বিবাহের কথা পাড়িলেন। শিবচন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “সম্বন্ধ কিরূপ বোধ হয়?”
নবীনচন্দ্র কৃষ্ণনাথের গুণের ও তাঁহার কন্যার রূপের প্রশংসার পুনরাবৃত্তি করিলেন; বলিলেন, “প্রভাত যদি কলিকাতাতেই কায করে, তবে এখানে বিবাহ হইলে একটা মুরুব্বি হইতে পারে।”
শিবচন্দ্র বলিলেন, “সহরের ‘বড়লোকে’র সঙ্গে কুটুম্বিতা,—ইহাতে আমার মন সরিতেছে না।”
“মেয়ে আনিব বই ত মেয়ে দিব না।”
শিবচন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, “সেই ত বিপদ। গরীবের মেয়ে ‘বড়মানুষে’র ঘরে পড়িলে সুখে থাকিতে পারে; কিন্তু ‘বড়মানুষে’র মেয়ে আমাদের ঘরে আসিলে তাহার যে কষ্ট হইবে।”
নবীনচন্দ্র অগ্রজকে জানিতেন; আগ্রহ না দেখাইয়া বলিলেন, “সুবিধা অসুবিধা সব বিবেচনা করিয়া দেখুন।”
“তুমি কি বলিয়া আসিয়াছ?”
“আমি বলিয়া আসিয়াছি,আমি দাদাকে সব বলিব; তিনি যাহা ভাল হয় করিবেন।”
তাহার পর নবীনচন্দ্র বলিলেন, “আমাদের সন্দেহ হইয়াছিল, বুঝি বা প্রভাতের মতে এ সম্বন্ধ আসিয়াছে। আমি তাহাকে স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম; সে বলিল, আমার আবার মতামত কি? আপনি যাহা বলিবেন, সে তাহাই করিবে।”
কথাটা শুনিয়া শিবচন্দ্র সন্তুষ্ট হইলেন—সন্দেহ কাটিয়া গেল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “হরিহর কি বলিল?”
নবীনচন্দ্র উত্তর করিলেন, “প্রভাত যে ছাত্রাবাসে থাকে, তাহার সম্মুখেই কৃষ্ণনাথ বাবুর গৃহ; তাঁহার এক পুত্ত্র প্রভাতের সহপাঠী। তাঁহারা সন্ধান করিয়া হরিহরের মনিবকে ধরিয়াছিলেন; তিনি হরিহরকে দিয়া পত্র লিখাইয়াছিলেন।”
“তুমি এ সম্বন্ধ কিরূপ বিবেচনা কর?”
“আমার বোধ হয়,—মন্দ নহে।”
“এ বিষয়ে অনেক কথা আছে। দুই জনে পরামর্শ করিব।”
নবীনচন্দ্র আর কিছু বলিলেন না। তিনি জানিতেন, আর আগ্রহ প্রকাশ করিলে শিবচন্দ্রের সন্দেহ হইবে।
দেখিতে দেখিতে নবীনচন্দ্রের শ্বশুরের শ্রাদ্ধের সময় সমাগত হইল। শিবচন্দ্র গ্রামে কার্য্য করাই যুক্তিযুক্ত মনে করিয়াছিলেন। তাহাই হইল। শ্রাদ্ধের অধিকারীকে আনাইয়া শ্রাদ্ধ করান হইল।
এই শ্রাদ্ধোপলক্ষে প্রভাত গৃহে আসিল। কিন্তু বিদ্যালয়ে ছুটী না থাকায় অধিক দিন থাকিতে পারিল না। নবীনচন্দ্র পূর্ব্বেই ভগিনীকে সাবধান করিয়াছিলেন, “দিদি, প্রভাতকে বিবাহ সম্বন্ধে কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিও না। এ বিবাহে যে তাহার ইচ্ছা আছে, সে যে মেয়ে দেখিয়াছে, আমরা যে তাহার ইচ্ছা পূর্ণ করিবার জন্যই এ বিবাহের পক্ষপাতী, দাদা যদি এ সন্দেহ করেন, তবে হয় ত তিনি বাঁকিয়া বসিবেন।”
প্রভাত চলিয়া গেল। নবীনচন্দ্র ভগিনীকে বলিলেন, “দিদি, দেখিলে ত,—ছেলের আর সে শ্রী নাই। ভাবিয়া ভাবিয়া ছেলে অমন হইয়াছে। এবার ভাল করিয়া দাদাকে বলিয়া এ বিবাহে তাঁহার মত করাও। তুমি নহিলে এ কায আর কেহ পারিবে না। তুমি দাদাকে ধর।”
শ্রাদ্ধের পর হইতেই পিসীমা প্রভাতের বিবাহের জন্য জিদ করিতে লাগিলেন, “আমি কবে মরি, প্রভাতের ছেলে দেখা অদৃষ্টে নাই। যে দু’টাকে মানুষ করিয়াছি, তাহারা এখন আর কাছে থাকে না। বাড়ী শূন্য—বালকবালিকা নহিলে কি বাড়ীর শোভা হয়?” এইরূপ কথায় শিবচন্দ্র বিচলিত হইলেন; নবীনচন্দ্রকে বলিলেন, “নবীন, দিদি প্রভাতের বিবাহের জন্য বড় ব্যস্ত হইয়াছেন, ছেলেও বড় হইয়াছে। একটা সম্বন্ধ স্থির কর।”
নবীনচন্দ্র বলিলেন, “দুই স্থানে সম্বন্ধ উপস্থিত; উভয় পক্ষই বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করিতেছেন।”
ইহার পর পিসীমা’র ও নবীনচন্দ্রের আগ্রহে কৃষ্ণনাথের কন্যার সহিত পুত্ত্রের বিবাহে শিবচন্দ্রের আপত্তির হ্রাস হইতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাদের দুই জনের আগ্রহ প্রবলতরভাবে আত্মপ্রকাশ করিতে লাগিল।
শেষে এক দিন সতীশচন্দ্রকে সংবাদ দেওয়া হইল। সকলে পরামর্শ করিয়া কর্ত্তব্য স্থির করিবেন।