বিবি কারটর।

 ১৭১৭ খৃষ্টাব্দে ইংলণ্ডের অন্তঃপাতি কেণ্ট প্রদেশে বিবি কারটর জন্ম পরিগ্রহ করেন। তাঁহার পিতা ঐ স্থানের ধর্ম্মোপদেশক ছিলেন। যাহাতে কন্যার বিলক্ষণ রূপে লেখা পড়া শিক্ষা হয় তন্নিমিত্ত তিনি বিশেষ ইচ্ছুক হইয়া আপনি শিক্ষা দিতে লাগিলেন। কিন্তু কারটরের স্বাভাবিক সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি না থাকাতে বহু পরিশ্রম ও যত্ন করিয়াও শিক্ষা বিষয়ে উন্নতি লাভ করিতে পারিলেন না। সুতরাং ভাবিকালে যে তিনি এক জন অসামান্য বিদ্যাবতী ও বিবিধ গুণে গুণবতী হইয়া জন সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করিবেন, তাহা স্বপ্নে- রও অগোচর। আদৌ তাঁহার এরূপ স্থুল বুদ্ধি ছিল যে, তিনি অনেক চেষ্টা করিয়াও প্রথম শিক্ষার কয়েক খানি পুস্তক ভালরূপে অভ্যাস করিতে পারেন নাই, সুতরাং তাঁহার জনক, তজ্জন্য তাঁহার প্রতি একান্ত বিরক্ত হইয়া পাঠনাকার্য্যে তাঁহাকে ক্ষান্ত থাকিতে অনুমতি করিলেন। কিন্তু কারটর পিতার বাক্য না শুনিয়া অবিশ্রান্ত পরিশ্রম ও অধ্যবসায় সহকারে অধ্যয়ন করিতে আরম্ভ করিলেন ও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, যে কোন প্রকারে হউক বিদ্যা শিক্ষা করিব, কখনই ইহাতে ক্ষান্ত হইব না। তিনি এই রূপে প্রতিজ্ঞারূঢ হইয়া অহোরাত্র শিক্ষাকার্য্যে ব্যস্ত থাকিতেন। এমন কি রজনীর অধিকাংশ কাল নিদ্রা ত্যাগ করিয়া কেবল এক মনে পুস্তক অধ্যয়ন করিতেন। নিদ্রাকর্ষণের ভয়ে সিক্ত বস্ত্র মস্তকের পুরোভাগে জড়াইয়া রাখিতেন। তাঁহার পিতা, কন্যার বিদ্যা উপার্জ্জনে এরূপ অনুরাগ দেখিয়া সাতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছিলেন বটে; কিন্তু কি জানি, দিবারাত্রি কঠিন পরিশ্রম দ্বারা উৎকট পীড়া হইতে পারে ভাবিয়া তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলেন, কারটর! তোমার অধিক রাত্রি জাগরণ করিয়া পাঠ অভ্যাস করিবার আবশ্যক নাই, দ্বিপ্রহর রাত্রি মধ্যে অধ্যয়ন কার্য্য সমাপ্ত করিয়া নিদ্রা যাইও। কারটর কি করেন পিতার আজ্ঞানুসারে প্রতিদিন দ্বাদশ ঘটিকা রাত্রির মধ্যে সমুদায় পাঠ সমাপ্ত করিয়া শয়ন করিতেন ও প্রত্যুষে নিদ্রোত্থিত হইয়া গৃহকার্য্য করিতে পারেন, এজন্য শয্যার পার্শ্বে একটী ঘণ্টা ঝুলাইয়া তাহাতে রজ্জুবদ্ধ করণান্তর উদ্যানে বাঁধিয়া রাখিতেন। প্রত্যহ প্রভাতকালে ধর্ম্মশালার পরিচারক আপন কার্য্যে যাইবার সময়ে ঐ রজ্জু আকর্ষণ করিলেই ঘণ্টাধ্বনি হইত, সুতরাং তাঁহার নিদ্রা ভঙ্গ হইলে, শয্যা হইতে উঠিয়া দৈনিক গৃহকার্য্য সমাধা করিতেন। বিবি কারটর এই রূপ বহু পরিশ্রমের পর, বিদ্যাবিষয়ে বিশেষ কৃতকার্য্য হইলেন। তিনি একেবারে গ্রীক, লাটিন, ফরাশী, ইটালী, স্পেনীশ পর্টুগিজ, হিব্রু ও আর্ব্বি প্রভৃতি বিদেশীয় ভাষায় বিলক্ষণ বুৎপত্তি লাভ করিলেন। ইতিহাস, জ্যোতিষ, অঙ্ক ও পুরাকালিক ভূগোল শিক্ষায় তাঁহার সমধিক অনুরাগ ছিল। এই প্রকারে বিবি কারটর অল্প বয়সে নানা ভাষায় বিশিষ্টরূপ জ্ঞান উপার্জ্জন করাতে, তৎকালজীবী সমন্ত কৃতবিদ্যবর্গের পরিচিত হইয়াছিলেন। সুবিখ্যাত পণ্ডিত ডাক্তর জন্‌সন্‌, তাঁহার অধ্যয়ন বিষয়ে পরম পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহার সহিত বিশেষ বন্ধুত্ব স্থাপন করিয়া আপন গ্রন্থে প্রকাশ করেন যে, বিবি কারটরের তুল্য তৎকালে কেহই গ্রীক ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করিতে পারে নাই।

 ডাক্তর শিকর নামক এক সম্রান্ত ধর্ম্মাধ্যক্ষের সহিত তাঁহার এতাদৃশ প্রণয় হইয়াছিল যে, ঐ ব্যক্তির স্ত্রী-বিয়োগ হইলে পর, সকলে অনুমান করিয়াছিল, তিনি

বিবি কারটরের পাণিগ্রহণ করিবেন। কিন্তু কারটর তাহা নিয়ত অস্বীকার করিয়া কহিতেন যে, তিনি কেবল বন্ধুত্বে বশীভূত হইয়া এরূপ স্নেহভাব প্রকাশ করেন বাস্তবিক পরিণয়াকাঙ্ক্ষিণী নহেন। নরউইচ্‌ পল্লীর বিশপ, ডাক্তর হেটর, (পরে যিনি লণ্ডন নগরের বিশপের বা ধর্ম্মাধ্যক্ষের পদে অভিষিক্ত হন) তাঁহার বিষয়েও ঐরূপ জনরব হয়, বস্তুতঃ এই জনরব অমূলক নহে, কারণ কোন সময়ে উক্ত বিশপদ্বয় ও বিবিকারটর একত্র উপবিষ্ট হইয়া কথোপকথন করিতেছিলেন, এমন সময়ে ডাক্তর শিকর পরিহাসচ্ছলে হেটরকে সম্বোধিয়া কহিলেন, ভ্রাতঃ! সকলে আমাদিগের উভয়কে মান্যা কারটরের পরিণয়াভিলাষী স্থির করিয়াছে; বস্তুতঃ আমার হাতে অভিলাষ নাই, এক্ষণে তাঁহাকে, তোমায় অর্পণ করিলাম। তুমি পত্নীভাবে গ্রহণ করিয়া সুখী হও।

 অনন্তর বিবি কারটর ১৭৫৮ খৃষ্টাব্দে ইপিক্‌টিটস নামক লাটিন গ্রন্থের ইংরাজী ভাষায় অনুবাদ, ভূমিকা ও টীকা প্রচার করেন। এই অনুবাদকার্য্য এরূপ সুন্দর রূপে সিদ্ধ হইয়াছিল যে, ইহা এক খানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ মধ্যে পরিগণিত হইয়া দেশ বিদেশে বিখ্যাত হইল। তিনি ডাক্তর জন্‌সন্‌ কৃত “রেম্বলার” নামক সাময়িক পত্রের এক জন সহকারী লেখক ছিলেন এবং ১৭৬১ খৃষ্টাব্দে একখানি পদ্যময় কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ করেন, তাহা পাঠ করিয়া অনেক লোকেই পরিতুষ্ট হইয়াছিল, বস্তুতঃ তৎকৃত সকল পুস্তক অপেক্ষা ইপিক্‌টিটস্‌ গ্রন্থের অনুবাদ অতিউৎকৃষ্ট। তদ্দ্বারাই তাঁহার নাম চিরস্মরণীয় হয়। জীবনের শেষকাল পর্য্যন্তও তাঁহার বিদ্যালাভের লালসার শেষ হয় নাই; তখনও তিনি নিয়মিতরূপে হিব্রু, গ্রীক প্রভৃতি প্রাচীন ভাষার আলোচনা করিতেন।

 বিবি কারটর মাতৃক্রোড়ের ন্যায় আপন জন্মভূমির প্রতি অত্যন্ত অনুরাগিণী ছিলেন; তজ্জন্য সর্ব্বদা স্বগৃহে অবস্থান করিয়া কালহরণ করিতেন।

 তিনি প্রতি বৎসর এক এক বার লণ্ডন রাজধানীতে গমন করিয়া আপন বন্ধু-বান্ধব-বর্গের সহিত সাক্ষাৎ ও সম্ভাষণ করিয়া আসিতেন। তৎকালীন নগরবাসীরা তাঁহাকে আপন আপন বাটীতে কিছুকাল রাখিবার জন্য বিস্তর অনুরোধ করিত। কিন্তু তিনি বিনয় দ্বারা তাহাদিগকে সন্তুষ্ট করিয়া সত্বরে আপন জন্ম স্থানে প্রত্যাগত হইতেন। তিনি অতি সরল স্বভাবা, অপরিসীম নীতিজ্ঞান সম্পন্না ও সকলের প্রতি দয়াশীলা ছিলেন তজ্জন্য, সকলের নিকট প্রচুর সম্মান প্রাপ্ত হন। বৃদ্ধাবস্থা পর্য্যন্ত তিনি সকলের আদরণীয়া হইয়া ১৮০৬ খৃষ্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারিতে লণ্ডন নগরে মানবলীলা সংবরণ করেন।

 দেখ, বিবি কারটর কেমন চমৎকার স্ত্রীলোক! বাল্যকালে কত যত্ন ও কত পরিশ্রমে বিদ্যাশিক্ষা করিয়াছিলেন। স্বাভাবিক, স্থূল বুদ্ধি হইয়াও অচল প্রতিজ্ঞা সহকারে অধ্যয়ন করিয়া বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা সম্পাদন করেন। ফলতঃ কেবল অপরিসীম উৎসাহ ও একান্ত যত্নের গুণেই তাঁহার অসাধারণ বিদ্যালাভ হইয়াছিল। বিদ্যা উপার্জ্জনের জন্য অসীম কষ্ট সহ্য করিয়া, শেষে গ্রীক, লাটিন ও হিব্রু প্রভৃতি বহুতর ভাষায় বিলক্ষণ ব্যুৎপন্না হইয়া পণ্ডিত সমাজে গণ্যা ও মাননীয়া হন। বস্তুতঃ, কেবল পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের গুণে তিনি উৎকৃষ্ট উৎকৃষ্ট গ্রন্থ প্রণয়ন দ্বারা আপন নাম চিরস্থায়ী করিয়া গিয়াছেন; নতুবা কেহই তাঁহাকে জানিতে পারিত না। যাঁহারা বিবেচনা করেন যে, স্ত্রীজাতি সমধিক বিদ্যা ও জ্ঞান লাভ বিষয়ে কখন কৃতকার্য্য হইতে পারে না, তাঁহারা বিবি কারটরের বিষয় পাঠ করিয়া অন্তঃকরণ হইতে সে ভ্রম দূর করুন।