নারী-চরিত/মেরিয়া জী এগ্নিসি
মেরিয়া জী এগ্নিসি।
১৭১৮ খৃষ্টাব্দে ইটালীর অন্তর্গত মিলান নগর নিবাসী কোন সম্ভান্ত বংশে মেরিয়ার জন্ম হয়। এই রমণী শৈশবকাল হইতে বিদ্যা শিক্ষায় অনুরক্ত ছিলেন। প্রথমতঃ তিনি পিতার আদেশ ক্রমে লাটিন ভাষা শিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন। অতি অল্পকালেই উক্ত ভাষায় এরূপ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, যে তাঁহার সহধ্যায়ী ভ্রাতৃগণ অপেক্ষাও তিনি ঐ ভাষায় উত্তম রূপে আপন মনের ভাব প্রকাশ ও কথোপকথন করিতে পারিতেন। এমন কি, নয় বৎসর বয়ঃক্রম কালে কয়েক জন বিদ্যাবতীর সাহায্যে উক্ত ভাষায় এক উৎকৃষ্ট গ্রন্থ রচনা করিয়া সর্ব্বসাধারণকে চমৎকৃত করিয়া ছিলেন।
মেরিয়া, বিদ্যাশিক্ষা বিষয়ে অসামান্য যত্নবতী ছিলেন। তিনি অতীব যত্ন ও অধ্যবসায় সহকারে একাদশ বর্ষ বয়ঃক্রম কালেই হিব্রু, গ্রীক প্রভৃতি কয়েকটী প্রাচীন ভাষায় সমধিক জ্ঞান লাভ করেন; বিশেষতঃ ঐ সকল ভাষায় পরিপাটী রূপে কথোপকথন করিতে তাঁহার বিলক্ষণ অধিকার জন্মিয়াছিল। অনন্তর ত্রয়োদশ বৎসর বয়সে তিনি এক খানি পূরাবৃত্তের ক্রোড়পত্র, ইটালী, ফরাসী ও জর্ম্মনি ভাষায় অনুবাদ করেন, এবং পর বৎসরে এক জন প্রধান ধর্মাধ্যক্ষ কৃত “ধর্ম্ম যুদ্ধ” নামক পুস্তক, ইটালীয় হইতে গ্রীক ভাষায় অনুবাদিত করিয়া জন সমাজে সমধিক আদরণীয়া হন।
মেরিয়ার পিতা, গণিত বিদ্যায় অধিক অনুরাগিণী দেখিয়া তাঁহাকে তৎপাঠনাতে নিযুক্ত করেন। তিনি চতুর্দ্দশ বৎসর বয়ঃক্রম মধ্যেই সাতিশয় পরিশ্রম সহকারে ক্ষেত্রতত্ত্ব ও বিজ্ঞান শাস্ত্রাদির অধ্যয়ন সমাপন করিয়াছিলেন। অনন্তর কোন বিখ্যাত গণিতবিৎকৃত শুণ্ডাকৃতি পদার্থের পরিমাণ বিষয়ক গ্রন্থের টীকা প্রস্তুত করিয়া পণ্ডিত সমাজে বিলক্ষণ প্রশংসা ভাজন হন।
১৭৩৮ খৃষ্টাব্দে এগ্নিসি, প্রগাঢ় অধ্যবসায়ের ফল স্বরূপ ১৯১ টী সন্দর্ভ ও এক খানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ প্রকাশ করেন। শেষোক্ত গ্রন্থ খানি পাঠ করিয়া ইউরোপীয় পণ্ডিত মণ্ডলী গ্রন্থ-কর্ত্রীকে এক অপূর্ব্ব স্ত্রীরত্ন বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন। ফলতঃ ফন্টেনেল্ নামক এক সুবিখ্যাত পণ্ডিত এই পূস্তককে অত্যুৎকৃষ্ট গ্রন্থ মধ্যে পরিগণিত করেন। অধিকন্তু বসাওট্, ফরাশী ভাষায় ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কল্সন্ সাহেব উক্ত গ্রন্থ ইংরাজিতে অনুবাদ করত উভয়েই তাঁহার রচনাশক্তির ভূরি ভূরি প্রশংসা করিয়াছেন। এগ্নিসি এই পুস্তকে বীজগণিত শিক্ষার উপযোগিতা সপ্রমাণ করিয়া স্বদেশে প্রচলিত করিতে যত্ন পান।
মেরিয়া, রাজ্ঞী মেরিয়াথেরিসা নাম্নী এক মহিলার নামে উক্ত গ্রন্থ খানি উৎসর্গ করেন। রাজ্ঞীও ইহা আগ্রহ সহকারে গ্রহণ করিয়া তাঁহাকে এক বহু মূল্য অঙ্গরীয়ক ও কতক গুলি দুষ্পাপ্য উৎকৃষ্ট প্রস্তর পুরস্কার দেন এবং তাঁহার স্বদেশ হিতৈষিতা গুণে পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহাকে বলোনা প্রদেশীয় সভার সভ্যপদে বরণ করেন। অনন্তর তিনি চতুর্দ্দশ পোপ কর্তৃক মিলান নগরের বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈতনিক গণিতবিদ্যার অধ্যাপকের আসনে অভিষিক্ত হন। অষ্টাদশ বর্ষ বয়ঃক্রম কালে মেরিয়ার পিতৃবিয়োগ হয়, সেই অবধি তিনি চেতনা পাইয়া ধর্ম্মবিষয়ে একান্ত মনোনিবেশ পুরঃসর জীবনের শেষ দিন প্যর্যন্ত নিয়ত ধর্ম্মানুশীলনে অতিবাহিত করেন। তাঁহারা ভ্রাতা ও ভগিনীতে তেইশ জন ছিলেন, তন্মধ্যে তিনিই পিতার এক মাত্র প্রিয়পাত্রী। কোন সুকঠিন বিষয় কার্য্য উপস্থিত হইলে, তাঁহার পিতা তাঁহার নিকট হইতেই পরামর্শ গ্রহণ করিতেন। দুর্ভাগ্য বশতঃ পিতা, কালগ্রাসে পতিত হইলে, তাঁহার ভ্রাতৃগণ অপেক্ষা তিনি যে অধিকতর দুঃখভাগিনী হইলেন, ইহা বলা বাহুল্য মাত্র।
পিতার মৃত্যুর পরে, তিনি ধর্ম্মচর্চায় একান্ত অনুরক্ত হইয়া অল্পদিবস মধ্যে ধর্ম্মশাস্ত্রে এরূপ ব্যুৎপন্না হইয়া উঠেন, যে মিলান দেশীয় ধর্ম্মালয়ের প্রধান যাজক তাঁহার প্রতি, এক খানি ধর্ম্মবিষয়ক স্থাপিত মতবিরুদ্ধ গ্রন্থের পরীক্ষার ভার অর্পণ করেন। মেরিয়া এরূপ সুচতুরতা সহকারে তাহার বিচার করেন, যে তদ্দ্বারা প্রণেতার জীবন রক্ষা হয়; সুতরাং তাহাতে তিনি আপামর সাধারণ সমীপে প্রচুর যশোভাজন হইয়াছিলেন। তিনি যে কেবল বিদ্যা ও ধর্ম্ম বিষয়ে অনুরাগিণী ছিলেন, এমত নহে, পরোপকার ব্রতে ব্রতী হইয়া দীন হীন ও অনাথদিগকে যথেষ্ট সাহায্য করিতেন, এমন কি, নিঃস্ব ব্যক্তিদিগের পোষণার্থ এত অধিক ব্যয় করিতেন, যে কোন কোন মাসে আয় অপেক্ষা তাঁহার দ্বিগুণ ব্যয় হইয়া যাইত। বিবিধ-গুণ-বিভূষিতা ও বহু বিদ্যায় পারদর্শিনী ধার্ম্মিকা এগ্নিসি ১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে জানুয়ারি মাসের নবম দিবসে, ৮১ বৎসর বয়ঃক্রম কালে এই জাগতিক কলেবর পরিত্যাগ করেন।
দেখ! মেরিয়া জি এগ্নিসি কেমন চমৎকার স্ত্রীলোক! আমাদিগের জ্ঞানে যে সকল সুকঠিন কার্য্য স্ত্রীলোকের অসাধ্য বলিয়া বোধ হয়, তিনি প্রগাঢ় যত্ন সহকারে তাহাও সুসম্পন্ন করিয়া সাধারণের প্রতিষ্ঠাভাজন হইয়াছিলেন। গ্রন্থ প্রণয়ন করা সামান্য বিদ্যার কার্য্য নহে, তিনি তদ্বিষয়েও কৃতকার্য্য হন। অতি দুরূহ অঙ্কবিদ্যা বিষয়ক পুস্তক প্রণয়ন করিয়া ভূমণ্ডলে যারপর নাই খ্যাতি রাখিয়া গিয়াছেন। তিনি যে কেবল কতগুলি ভাষা শিক্ষা ও পুস্তক রচনা করিয়া ক্ষান্ত ছিলেন, এরূপ নহে, যাহাতে স্বদেশে বিদ্যাবিশেষের উন্নতি ও কুসংস্কারময় দুর্নীতি সকল দূরীভূত হয়, তজ্জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেন। ধর্ম্ম বিষয়ে তাঁহার প্রগাঢ় যত্ন ছিল, সুতরাং ধর্ম্ম সম্পর্কীয় কর্ম্মচারিদিগের সন্নিধানে বাস, ধর্ম্ম বিষয়ক পুস্তকাদির রচনা ও অনুবাদ করিতে, তিনি ক্রটি করেন নাই। অবলা স্ত্রীলোক হইয়াও একটী বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদে অধিরূঢ হন, ইহা কি সামান্য শ্লাঘার কথা। যাঁহারা স্ত্রীজাতিকে ক্রীতদাসী, বুদ্ধিহীন ও নিতান্ত অকর্ম্মণ্য বলিয়া স্বীকার করেন, তাঁহারা এই অসামান্য স্ত্রীরত্নের বিষয় পাঠ করিয়া, তাঁহাদিগের জ্ঞান, বুদ্ধি ও প্রগাঢ় অধ্যবসায়ের কথা জ্ঞাত হউন্।