নারী-চরিত।

হানামুর।

 ১৭৪৫ খৃষ্টাব্দে গ্লৌসেষ্টর প্রদেশের অন্তঃপাতি ষ্টেপল্টন্ নগরে হানামুর জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা মাতা অতিশয় ধর্ম্মপরায়ণ, বিচক্ষণ ও সদ্গুণশালী ছিলেন। তাঁহাদিগের পাঁচটী কন্যা ছিল, তন্মধ্যে হানামুর অতীব বুদ্ধিমতী। হানামুর শৈশবকালেই বিদ্যাশিক্ষায় অতিশয় অনুরাগিণী হইয়া নিয়ত জ্ঞানচর্চ্চা করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। ঐ সুমতি কামিনীটী শিক্ষাবিষয়ে এতাধিক নিবিষ্টমনা হইয়াছিলেন যে, সম্মুখে কাগজ পাইলেই তাহাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপন্যাস রচনা করিয়া মাতাকে দেখাইয়া আমোদ প্রকাশ ও সর্ব্বদা লণ্ডন নগরে যাইয়া পুস্তক বিক্রেতাদিগের বিপণীতে পুস্তক দর্শন এবং আচার্য্যদিগের সহিত আলাপ করিবার জন্য স্বীয় ভগিনীদিগকে উত্তেজনা করিতেন।

 এই সময়ে তাঁহার জ্যেষ্ঠভগিনী আপন বিদ্যালয় পরিত্যাগ করিয়া ব্রিষ্টল নগরে এক বালিকাবিদ্যালয় সংস্থাপন করেন। হানা, দ্বাদশ বৎসর বয়ঃক্রম কালে অন্যান্য ভগিনীদিগের সমভিব্যাহারে সেই বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হইয়া পাঠনা কার্য্যে নিযুক্ত হইলেন। তিনি আপন সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিবলে ও ভগিনীর সমুচিত যত্নে অল্পকাল মধ্যে বিবিধবিষয়ক জ্ঞান উপার্জ্জন করিয়াছিলেন এবং স্বদেশপ্রচলিত ভাষা শিখিয়া পিতার নিকট লাটীন ও অঙ্ক বিদ্যা অভ্যাস করিয়া তাহাতে বিশেষ ব্যুৎপন্না হইয়া উঠিলেন। তিনি যে কেবল লাটীন ভাষা শিক্ষা করিয়াই ক্ষান্ত হইলেন এমত নহে, বিবিধ যত্ন ও পরিশ্রম সহকারে ফরাশী, স্পেনিশ ও ইটালীয় প্রভৃতি কয়েকটী আধুনিক ভাষায় সমধিক পারদর্শিতা লাভ করিয়া রচনাশক্তির উৎকর্ষসাধন জন্য অবকাশ পাইলেই লাটীন ও ইটীলীয় ভাষা হইতে ইংরাজী ভাষাতে নূতন নূতন বিষয় সকল অনুবাদ করিতেন।

 ক্রমে ক্রমে বিদ্যাবিষয়ে তাঁহার অসাধারণ যত্ন ও অনুরাগ জন্মিল। এমন কি তাঁহাকে বিদ্যালোচনা ব্যতীত প্রায় অন্য কোন কার্যে নিযুক্ত হইতে দেখা যাইত না। সপ্তদশ বৎসর বয়ঃক্রম কালে, তাঁহার অধ্যাপনার প্রথম ফল স্বরূপ ‘‘সুখঅন্বেষণ” নামক এক খানি নাটক প্রকাশিত হইল। সেই রচনা দর্শনে, সকল লোকই তাঁহার বাল্যবৃদ্ধির সুতীক্ষ্ণতায় অত্যন্ত চমৎকৃত হইয়া ভূরি ভূরি প্রশংসা করিতে লাগিল।

 হানামুরের দ্বাবিংশতি বৎসর বয়ঃক্রম কালে টারনর নামক এক জন, ধনবান্‌ পুরুষ, তাঁহার পাণিগ্রহণের অভিলাষলাষ প্রকাশ করিলে পর, হানামুর তাহাতে সম্মত হইয়ছিলেন সুতরাং বিবাহের দিন নির্দ্ধারিত হইল। কিন্তু যুবা টারনর কোন সামান্য হেতু দর্শাইয়া সে দিন বিবাহ কার্য্যটী স্থগিত রাখিলেন, এই রূপে প্রত্যক নিশ্চিত দিবসেই টারনর নানা কারণ দেখাইয়া কালবিলম্ব করিতে লাগিলেন। অবশেষে মিস মুরের ভগিনীগণ ও তাঁহার অপরাপর বন্ধুসমূহ একত্র হইয়া সেই টার নরকে তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি লজ্জিত হইয়া অতি সত্বরে এই বিষয়ের শেষ করিতে অঙ্গীকার করিলেন; কিন্তু মিস মুৱ দৃঢ় পণ করিলেন যে, তিনি বিবাহ করিবেন না। অবশেষে তাঁহার সম্মতি ক্রমে টারনর সাহেব তাঁহাকে বার্ষিক বৃত্তি করিয়া দিলেন ও আপন মৃত্যুকালে দশ সহস্র টাকা দান করিবেন বলিয়া স্বীকৃত হইলেন। মিস মুর সেই অবধি একান্তমনে স্বদেশের হিতচেষ্টা করিয়া জীবন যাপন করিতে লাগিলেন। তদবধি কখন তাঁহার মুখে বিবাহের কথা শুনা যায় নাই।

 অনন্তর বিদ্যাবতী হানা এক সময়ে লণ্ডন নগরে যাইয়া বাস করিলেন। তথাকার লোকেরা তাঁহার বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয় পাইয়া অত্যন্ত সমাদর করিতে আরম্ভ করিল। অল্পকাল মধ্যে তিনি সকল প্রকার লোক সমাজে পরিচিত হইয়া নিয়ত সাধারণের উপকার চেষ্টায় বেড়াইতে লাগিলেন। তাঁহার স্বভাব এরূপ সমাজ প্রিয় ছিল যে, যে ব্যক্তি একবার তাঁহার সহিত আলাপ করিতেন, তিনি যাবজ্জীবন তাঁহাকে বিস্মৃত হইতে পারিত না। তিনি লণ্ডন নগরে এক পার্শ্বে সন্ত্রান্তমহিলাকুল ও অপর পার্শ্বে ডাক্তর জনসন প্রভৃতি মহাত্মাগণ কর্ত্তৃক পরিবেষ্টিত হইয়া কালহরণ করিতেন। এই সময়ে নিয়ত ধনী ও সন্ত্রান্তগণের সংসর্গে, সহবাস করাতে তাঁহার ধর্ম্মচর্চ্চার অনেক হ্রাস হইয়াছিল। একদা ডাক্তর জনসন তাঁহাকে রবিবারে কোন কার্য্যে ব্যস্ত দেখিয়া কয়েকটী উপদেশ দেন, তাহাতে তিনি অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া পুনর্ব্বার একান্তমনে ধর্ম্মানুশীলন করিতে লাগিলেন। সেই অবধি আর কখন রবিবারে তাঁহাকে কোন কার্য্য করিতে দেখা যায় নাই। উত্তরোত্তর তাঁহার ধর্ম্মচর্চ্চা অধিক বৃদ্ধি হইতে লাগিল। তদবধি তিনি প্রতিদিন ধর্ম্মপুস্তক পাঠ জন্য একটী সময় নির্দ্ধারিত করিলেন, অনন্তর যাহা পাঠ করিতেন, তাহা প্রায় নিভৃত স্থানে বসিয়া চিন্তা করিতেন।

 তাঁহার প্রিয়তম বন্ধু ও কর্ত্তৃপক্ষ গেবিক নামক জনৈক ব্যক্তির মৃত্যু হইলে, তিনি অত্যন্ত শোকাকুল হইলেন ও সেই অবধি তাঁহার চরিত্র সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তিত হইতে দেখা গেল। তিনি ক্রমে ক্রমে নগরবাসী সম্ভ্রান্তদিগের সংসর্গ পরিত্যাগ করিবার মানসে লণ্ডন পরিত্যাগ করিয়া ব্রিষ্টল নগরের অনতিদূরে “কাউস্লিপ গ্রীন” নামক পল্লীতে বাস করিতে লাগিলেন। তথায় অহরহ ধর্ম্মচিন্তা ও ধর্ম্মানুষ্ঠান ব্যতিরেকে অন্য কোন কার্য্যে মনঃসংযোগ করিতেনরিতেন না। উত্তর কালে জনসমাজের হিতচেষ্টা ও স্বধর্ম্ম প্রচার করিতে পণ করিয়া দুঃখী ও দীনহীনদিগের অভাব মোচন এবং রোগীদিগের সান্ত্বনা করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। তিনি অনেক বিবেচনা করিয়া স্থির করিয়া ছিলেন, যে দীন ও দুঃখী সন্তানদিগের বিদ্যাদান জন্য স্থানে স্থানে বিদ্যালয় সংস্থাপন, অধার্ম্মিকবর্গের মনে চৈতন্য সম্পাদন ও পুস্তক প্রকাশ দ্বারা ধর্ম্ম সঞ্চার করা এই জগতে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কার্য্য। হানামুর এই সকল কার্য্যে কৃতকার্য্য হইবার জন্য বহু দিবস অবধি যত্ন করিয়া আসিতেছিলেন, এক্ষণে তাঁহার ভগিনীরা আপন আপন কার্য্যের অবসর পাইয়া তথায় উপস্থিত হইলেন, এই সময়ে একদিন তিনি আপন কনিষ্ঠ ভগিনী সমভিব্যাহারে নিকটবর্ত্তী পল্লিসমূহে ভ্রমণ করিতে গিয়া দেখিলেন, যে তথাকার অধিবাসীরা অতিশয় মূর্খ ও ধর্ম্মবুদ্ধি হীন। তাহারা কেবল অসৎকর্ম্ম দ্বারা কাল হরণ করে। বিবি মুর এই সকল দেখিয়া অত্যন্ত দুঃখিত হইলেন। তিনি তাহাদিগের চরিত্র সংশোধন ও ধর্ম্ম শিক্ষা দিবার জন্য একটী বিদ্যালয় সংস্থাপন করিতে প্রতিজ্ঞা করিয়া ভগিনীর সহিত উপযুক্ত স্থান অন্বেষণ করিতে করিতে চেড্‌র নামক পল্লী মনোনীত করিয়া সেই স্থানে একটী বিদ্যামন্দির স্থাপন করিলেন। প্রথমতঃ কেহই আপন সন্তানদিগকে বিদ্যালয়ে প্রেরণ করিতে ইচ্ছুক হয় নাই। পরে বিবিমর ও তাঁহার ভগিনী বহু আয়াসে তাহাদিগের মন নত করিলে, তাহারা সকলেই আপন আপন সন্তান দিগকে বিদ্যালয়ে প্রেরণ করিতে লাগিল। তিনি যুবকদিগের জন্য প্রতি রবিবারের সায়ংকালিক এক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। সেই বিদ্যালয়ে উক্ত গ্রামবাসী লোকদিগকে আহ্বান করিয়া ধর্ম্মশিক্ষা দিতেন, সুতরাং ক্রমশঃ উপদেশ দ্বারা তাহাদিগের মন সত্যপথে আনীত হইলে সকলেই ধর্ম্মানুশীলনে যত্নবান্ হইলে বিদ্যালয়ের শ্রীবৃদ্ধির সহিত দিন দিন চেডর পল্লীর উন্নতিসাধন হইতে লাগিল।

 বিবিমুর ও তাঁহার ভগিনীগণ চেডর পল্লীর উন্নত অবস্থায়, অত্যন্ত আহ্লাদিতা ও উৎসাহিতা হইয়া কয়েকটী বিদ্যালয় স্থাপন দ্বারা অজ্ঞদিগকে জ্ঞান ও অধার্ম্মিকদিগকে ধর্ম্মশিক্ষা প্রদান করিবার জন্য অত্যন্ত যত্নবতী হইলেন। অনন্তর যে যে পল্লীতে ধর্ম্ম প্রচার করিবার জন্য ধর্ম্মেপদেশক ছিল না, মিস মুর ভগিনীদিগের সাহায্যে, নিকটবর্ত্তী এরূপ দশটী পল্লিতে বিদ্যালয় সংস্থাপন করিয়া ধর্ম্ম ও বিদ্যাদান করিতে আরম্ভ করিলেন।

 সমুদায় বিদ্যালয়ের ব্যয় নির্ব্বাহ করা তাঁহাদিগের সাধ্য ছিল না, সুতরাং শীঘ্র অর্থের অনাটন হইয়া উঠিল। তখন তাঁহারা কি করেন, অগত্যা ধর্ম্মপরায়ণ ধনীদিগের নিকট দান প্রার্থনা করাতে, অল্প সময় মধ্যে বিপুল অর্থ সঞ্চয় হইলে, তাহাতে বিদ্যালয়ের ব্যয় সুচারুরূপে নির্ব্বাহ হইতে লাগিল। তাঁহাদিগের কয়েকটী বিদ্যালয়ে প্রতিদিন ১২০০ ছাত্রের অধিকও অধ্যয়ন করিত, কিন্তু মিসমুর তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া, বালকদিগের পিতা মাতাকে সময়ে সময়ে আহ্বান ও তাহাদিগের বাটীতে গমন করিয়া ধর্ম্মবিষয়ের আলাপ ও ধর্ম্মপুস্তক বিতরণ করাতে, অনেকানেক পরিবারের চরিত্র সংশোধন হইয়া ধর্ম্মপালনে মতি হইয়াছিল। তিনি বিদ্যালয় সমূহের তত্ত্বাবধারণ ও দরিদ্র পরিবারদিগের ধর্ম্ম শিক্ষায় অধিক সময় অতিবাহিত করিয়াও অবকাশ পাইলেই সাধারণের কোন না কোন উপকার সাধন করিতেন। তাঁহার অসীম দয়ালুস্বভাবে সকলেই তাঁহাকে আপন আপন আত্মীয় স্বজন বিবেচনা করিত। তিনিও প্রতিবেশীমণ্ডলীর মধ্যে থাকিয়া তাহাদিগের হিতচেষ্টায় অহর্নিশি ব্যাপৃত থাকিতেন। তাঁহার দানশীলতা, দয়া ও সকরুণ স্বভাবের যশঃসৌরভ রাজ্যের সমস্ত প্রদেশকে আমোদিত করিয়াছিল।

 বিবি মুর বিদ্যালয় সংস্থাপন দ্বারা দরিদ্রসন্তানদিগকে বিদ্যাদান করিয়াই যে কেবল ক্ষান্ত ছিলেন, এমত নহে; সজাতীয় ধর্ম্ম প্রচার জন্য কয়েক খানি পুস্তক প্রকাশ করিয়াছিলেন ১৭৯২ খৃষ্টাব্দে কতিপয় ফরাশী ও অন্যান্য পণ্ডিত খৃষ্টধর্ম্ম বিরুদ্ধে পুস্তক প্রচার করিলে, ইংলণ্ডবাসী অনেকানেক ব্যক্তি সেই মত গ্রহণ করিল। ধর্ম্মভীত লোকেরা নাস্তিকদিগের এই রূপ ক্রমশঃ প্রাদুর্ভাব দেখিয়া, তাহাদিগের প্রতিকূলে লেখনী ধারণ করিতে মিস মুরকেই লক্ষ্য করিল। তখন চতুর্দ্দিক হইতে অসংখ্য অনুরোধ পত্র আসিতে লাগিল। সকলেই এই কঠিন কার্য্য সাধন করিতে তাঁহাকে বিস্তর সাধনা করিলে, তিনি প্রথমতঃ এই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন; কিন্তু অবশেষে সকলের অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া ‘‘ পল্লী গ্রামবাসিদিগের কথোপকথন” নামক এক খানি উৎকৃষ্ট পুস্তক প্রকাশ করিলেন। এই পুস্তক প্রচার হইবামাত্র অতি সত্বরে রাজ্যের সমস্ত প্রদেশবাসী লোকেরা আগ্রহ প্রকাশ পূর্ব্বক গ্রহণ করিতে লাগিল এবং স্কট্‌লণ্ড, আয়র্লণ্ড প্রভৃতি নিকটবর্ত্তী রাজ্যে নীত হইয়া কৃতবিদ্যমণ্ডলী কর্ত্তৃক সবিশেষ আদৃত হইল। প্রথম বারের মুদ্রিত পুস্তক সকল নিঃশেষ হইতে না হইতেই অনেকানেক দেশহিতৈষী ব্যক্তিরা আপন আপন ব্যয়ে বহু সহস্র সংখ্যা মুদ্রিত করিয়া বিনা মূল্যে বিতরণ করিতে লাগিলেন। গ্রন্থকর্ত্রী মিস মুরের আর সম্মানের পরিসীমা রহিল না। সকলেই তাঁহাকে এক অসামান্যা স্ত্রী লোক বিবেচনা করিয়া মহাত্মাদিগের মধ্যে পরিগণিত করতঃ যথোচিত সম্ভ্রম ও সমাদর প্রদান করিতে লাগিল।

 ফরাশি পণ্ডিতেরা তাহাতেও নিরস্ত্র না হইয়া অল্প বুদ্ধি ব্যক্তিদিগকে স্বমতে আনয়ন জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুস্তক প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। বিবি মুর পুনর্ব্বার সকলের উত্তেজনায় উত্তেজিত হইয়া এক সুবিস্তীর্ণ পুস্তক প্রচারে প্রবৃত্তা হইলেন। এই তাঁহার ‘‘সুলভ ধর্ম্মবিষয়ক গ্রন্থাবলী” নামক পুস্তক সমূহ প্রচারের সূত্রপাত। এই পুস্তক প্রকাশ হইবামাত্র নানা স্থান হইতে অসংখ্য ব্যক্তি তাহা ক্রয় করিতে লাগিল। এমন কি, প্রথম বৎসরে প্রায় দুই লক্ষ পুস্তক বিক্রীত হইয়াছিল। দুরস্থ লোকদিগের সুবিধার জন্য স্থানে স্থানে সভা সংস্থাপিত হইয়া অধিক পরিমাণে পুস্তক প্রচারিত হইলে, স্বধর্ম্মত্যাগীর একেবারে দমন হইয়া গেল। বিবি মুর লোকদিগের নিকট আপনাকে গোপন রাখিবার নিমিত্ত আপন পুস্তকে স্বীয় নাম সন্নিবেশিত করেন নাই, কিন্তু তাহা কোন মতে অধিক কাল সংগোপন রহিল না। কিছু দিন পরে প্রকাশ হইলে তাঁহার আর সমাদরের পরিসীমা রহিল না। তখন চতুর্দ্দিক হইতে প্রশংসার প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল। হানামুর এই রূপে উৎসাহ পাইয়া অধিক পুস্তক প্রকাশ করিতে মানস করিয়া একাদিক্রমে তিন বৎসর কাল ঐ পুস্তকশ্রেণী ক্রমশঃ প্রকাশ করিয়াছিলেন।

 অনন্তর হানামুর ধনী ও সন্ত্রান্ত পরিবারদিগের চেতনার জন্য কএক খানি গ্রন্থ প্রকাশ করিবার অভিলাষ করিয়া ১৭৮৮ খৃষ্টাব্দে “সাধারণ সমাজের প্রতি মহৎদিগের কর্ত্তব্য সাধন বিষয়ক চিন্তা” নামক এক খানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ প্রচার করেন। তিনি এক জন বহুদর্শী নীতিজ্ঞের ন্যায় পরিপাটী রূপে এই পুস্তক খানি রচনা করিয়াছিলেন। ইহাতে ধনী সন্তানদিগের প্রধান প্রধান ভ্রম ও সংসর্গদোষের উল্লেখ করিয়া যুক্তি দ্বারা এ প্রকার অনুযোগ ও ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন যে, তিনি স্বয়ং বলিয়াছিলেন “আমাকে ইহার গ্রন্থকর্ত্রী জানিলে অনেক সভ্রান্ত পরিবারেরা আমাকে দ্বার প্রবেশের নিষেধ করিবেন’’ যাহা হউক এই পুস্তক পাঠ করিয়া অনেকের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয়, ও প্রত্যেক সন্ত্রান্ত পরিবারেরা এক এক খানি ক্রয় করিয়া আপন বাটী মধ্যে রক্ষিত করেন। ইহার গ্রাহকশ্রেণী এরূপ বৃদ্ধি হইয়াছিল যে, কয়েক মাসের মধ্যে এই পুস্তক অনেক বার মুদ্রিত হইয়া এক কালে নিঃশেষিত হইয়া গেল। তৃতীয়বার মুদ্রিত কয়েক সহস্র পুস্তক চারি ঘণ্টা কাল মধ্যে আশ্চর্য্য রূপ বিক্রীত হইয়াছিল। এই পুস্তক প্রচারের দুই বৎসর পরে, তিনি ‘‘ ধনীদিগের ধর্মালোচনা ’’ নামক আর এক খানি পুস্তক প্রচার করেন।

 এই পুস্তক সত্যধর্ম্মপ্রতিপালনের রীতি নীতি ও ধনীদিগের পরিবারের অন্তর্গত নানাপ্রকার দুষ্কর্ম্মের বিষয় উল্লেখ করিয়া দুঃখ প্রকাশ করিয়াছিলেন।

 এই সময়ে তিনি উপর্য্যুপরি কয়েক খানি পুস্তক রচনা করিয়া প্রচারিত করেন। বয়োবৃদ্ধির সহিত তাঁহার রচনা শক্তিরও বৃদ্ধি হইয়াছিল। তাঁহার ষাটি বৎসর বয়সের পর একাদশ খানি পুস্তক রচিত ও প্রকাশিত হয়। তৎকৃত সকল পুস্তকই লোক সমাজে তুল্যরূপে সমাদৃত ও গৃহীত হইয়াছিল এবং পুনঃ পুনঃ মুদ্রিত হইলেও গ্রাহক শ্রেণীর ন্যূনতা দৃষ্ট হয় নাই। আমেরিকাবাসীরা তাঁহার পুস্তক সকল সমাদর পূর্ব্বক স্বদেশে মুদ্রিত ও প্রচারিত করেন। অনন্তর তৎপ্রণীত কয়েক খানি গ্রন্থ পৃথিবীর নানা দেশীয় ভাষায় অনুবাদিত হইয়া তত্তদ্দেশীয় লোকের মনোরঞ্জন করিয়াছিল।

 তিনি ১৮৩২ খৃষ্টাব্দে বালিউড নামক পল্লীতে এক খণ্ড ভূমি ক্রয় করিয়া আবাস বাটী নির্ম্মাণ করিলেন ও তথায় আপন ভগিনীগণের সহিত একত্র হইয়া বাস করিতে লাগিলেন। মনে মনে নিশ্চয় করিয়াছিলেন যে, নগর হইতে দূরে বাস করিলে, প্রতি দিন অধিক লোকের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হইবে না, সুতরাং নিভৃত প্রদেশে আপন অভীষ্ট সাধন করিব। কিন্তু তাঁহার সে আশা ফলবতী হইল না, তাঁহার নুতন বাটীতে ক্রমে ক্রমে বহুসংখ্যক লোক গমনাগমন করিতে আরম্ভ করিল। প্রতি দিন নগরবাসী কি ধনী, কি দীন প্রত্যেক ধার্ম্মিক লোকেরা তথায় উপস্থিত হইয়া, সাধারণের হিতসাধন বিষয়ের নানা প্রকার কল্পনা করিতে লাগিলেন। গ্রীষ্মকাল আসিলো বারলিউড স্থানের শোভার আর পরিসীমা রহিল না; বৃক্ষলতাদির নূতন শাখায় নূতন পল্লবাদি বহির্গত হওয়াতে চতুর্দ্দিক হরিন্ময় করিল। সেই সময়ে ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মারা দলবদ্ধ হইয়া নিয়ত বৃক্ষশ্রেণী মধ্যে পাদবিহার করিতে করিতে নানা পবিত্র বিষয়ের আলোচনা করিতেনতেন, দৃষ্ট হইত। প্রতিদিন হানামুর বহুসংখ্যক লোককে আহ্বান করিয়া আহারাদি দ্বারা আমোদ প্রকাশ করিতেন। সেই রমণীয় স্থানকে ‘‘ ধর্ম্মচর্চ্চা ও ধর্ম্মপুস্তক বিতরণের সভা” বলিলে বলা যাইতে পারে। কেননা, তথায় প্রত্যেক যাজক ও ধার্ম্মিক লোকেরা আগমন করিয়া ধর্ম্মচর্চ্চা ও প্রতিবেশীদিগকে ধর্ম্মবিষয়ক গ্রন্থাদি বিতরণ করিতেন। ক্রমে ক্রমে সুশীলা হানার বয়োধিক হওয়াতে বর্ষিয়সীগণ মধ্যে পরিগণিতা হইলেন। বহুকালাবধি কঠিন পরিশ্রম করিয়া আসাতে, এই সময়ে তাঁহার মধ্যে মধ্যে পীড়া হইতে লাগিল; শরীর ক্রমে জীর্ণ ও ক্লিষ্ট হইল বটে, তথাপি তাঁহার চিন্তাশক্তির কোন হানি হয় নাই। তিনি পূর্ব্বের ন্যায় সাধারণের উপকারজনক বিবিধ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। ১৮১৩ খৃষ্টাব্দে তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভগিনীর মৃত্যু হয়, পরে কয়েক বৎসর মধ্যে আর দুইটীও কালগ্রাসে পতিত হওয়াতে, হানামুর অত্যন্ত শোকার্ত্তা হন। এক্ষণে কেবল তিনি ও তাঁহার প্রত্যেক কার্য্যের সহকারিণী তদীয় কনিষ্ঠ ভগিনী মাত্র জীবিত ছিলেন।

 তিনি মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন যে, সকল ভগিনী অপেক্ষা দীর্ঘজীবিনী হইয়া সেই মনোহর বার্লিউড পল্লীতে একাকী বাস করিবেন। এজন্য একদা তাঁহার কোন বন্ধু তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়া, বালি উড স্থানের ভূরি ভূরি প্রশংসা করাতে, তিনি দুঃখিতান্তঃকরণেতান্তঃকরণে কহিয়াছিলেন যে, ‘‘আপনি বার্লিউড” প্রদেশের পুনঃ পুনঃ প্রশংসা করিতেছেন বটে; কিন্তু তাহা আমার চক্ষে বিষতুল্য বোধ হইতেছে। কেননা, তথায় আমাকে প্রিয়তম ভগিনীগণের শোকে অভিভূত হইয়া একাকিনী বাস করিতে হইবে”। তিনি যাহা অনুমান করিয়াছিলেন, অতঃপর তাহাই ঘটিল। অর্থাৎ ১৮১৯ খৃষ্টাব্দে তাঁহার কনিষ্ঠ ভগিনীর মৃত্যু হইল। তিনি আপনার সহকারিণী ভগিনীর মৃত্যুতে অত্যন্ত অধৈর্য্য হইয়াও স্বাভাবিক ধৈর্য্যশীলতাগুণে সান্ত্বনা লাভ করিলেন। হানামুর এই সময়ে লিখিয়াছিলেন যে, “এতকাল পরে আমার জগতের সান্ত্বনাকারিণী, সৎকার্য্যের মন্ত্রিণী ও একমাত্র সহকারিণীকে হারাইয়াছি”। সেই সময়ে তিনি এক খানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ইহা তাঁহার রচনার শেষ গ্রন্থ হইলেও লোকের নিকট সমধিকরূপে সমাদৃত হইয়াছিল, কিন্তু তাহাতে পরিতাপিত হানার কিছুমাত্র শোকোপশম হয় নাই। তিনি যদিও বার্লি উড পল্লীতে জীবনের অবশিষ্ট কাল যাপন করিতে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন তথাপি নানা কারণে অত্যন্ত উত্যক্ত হওয়াতে অবশেষে পূর্ব্ববাসস্থান ত্যাগ করিয়া ক্লিফটন প্রদেশে বাস করিলেন। এই স্থানে আগমনাবধি তাঁহার স্বাস্থ্যভঙ্গের সহিত মানসিক বৃত্তি সমূহেরও ভঙ্গ হইতে আরম্ভ হইল। তখন তাঁহার বয়স ৮৩ বৎসর হইয়াছিল, সুতরাং বৃদ্ধকালসুলভ নানা প্রকার পীড়া হইতে লাগিল। অবশেষে সময়ে সময়ে বক্ষঃস্থলে এক প্রকার বেদনা উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে আরো জীর্ণ করিল। তখন তিনি আপন অন্তিমদশা জানিয়া ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণ পূর্ব্বক অহর্নিশি ধর্ম্মচিন্তায় সময় যাপন করিতে লাগিলেন। তাঁহার পীড়া উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হইতে লাগিল ও পরিশেষে ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মার ন্যায় অনন্ত শয্যায় শয়ন করিলেন। ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দের ৭ ই সেপ্টেম্বর দিবসে তাঁহার মৃত্যু হইল।

 হানামুর আপন সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও সৎকার্য্য প্রভাবে জাগতিক কামিনীগণ মধ্যে এক প্রধানা স্ত্রীলোক রূপে গণ্য হইয়াছিলেন। তিনি বাল্যাবস্থায় বহুবিধ যত্ন ও অধ্যবসায় সহকারে লেখা পড়া শিক্ষা করেন ও স্বজাতীয় ধর্ম্মের উন্নতি চেষ্টায় যাবজ্জীবন যাপন করেন। দেখ বিদ্যা কি চমৎকার পদার্থ! কেবল বিদ্যাপ্রভাবেই হানামুর কি ধনী, কি দীন, কি পণ্ডিত, কি সম্ভ্রান্ত সকল লোকেরই স্নেহের পাত্রী হইয়াছিলেন। ডাক্তর জনসন্‌ প্রভৃতি মহাত্মারা, তাঁহার বিদ্যা থাকাতেই কেবল এতাধিক সমাদর করিতেন। ধর্ম্মের প্রতি তাঁহার অতিশয় অনুরাগ ছিল, যাহাতে ধর্ম্মের গৌরব বৃদ্ধি হয় সেই জন্য নিয়ত ব্যস্ত থাকিতেন। দীন হীনদিগের জ্ঞানদান ও ধর্ম্মবিহীনদিগকে ধর্ম্মশিক্ষা দেওয়া, তাঁহার এক মাত্র কার্য্য ছিল। তিনি স্ত্রীলোক হইয়া এই সকল সুকঠিন কার্য্য সমাধা করিয়াছিলেন বলিয়া মহাত্মাদিগের মধ্যে গণনীয়া হইয়াছিলেন। যাহারা বাল্যকালে যত্ন ও অধ্যবসায়ের সহিত লেখা পড়া শিক্ষা করে এবং সর্ব্বদা পরোপকারে প্রবর্ত্ত থাকে, তাহারা হানামুরের ন্যায় সম্মান ও কীর্তিলাভ করিবে তাহার সন্দেহ নাই।