নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/সপ্তম অধ্যায়
সপ্তম অধ্যায়
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/6/62/Rule_Segment_-_Wave_-_40px.svg/40px-Rule_Segment_-_Wave_-_40px.svg.png)
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/3/3d/Rule_Segment_-_Diamond_open_-_7px.svg/7px-Rule_Segment_-_Diamond_open_-_7px.svg.png)
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/6/62/Rule_Segment_-_Wave_-_40px.svg/40px-Rule_Segment_-_Wave_-_40px.svg.png)
টাস্কেজীতে পল্লীপর্য্যবেক্ষণ
এবার হ্যাম্পটনে আমার অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা এক সঙ্গে চলিয়াছিল। আমি প্রকৃত প্রস্তাবে একজন ছাত্র-শিক্ষকভাবে জীবন যাপন করিয়াছিলাম।
লোহিত ‘ইণ্ডিয়ান’ ছাত্রদিগের পরিদর্শন আমার হাতে ছিল। নবপ্রতিষ্ঠিত নৈশবিদ্যালয়ের শিক্ষকতাও আমি করিতাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজের উচ্চশিক্ষালাভও চলিতেছিল। আমি হ্যাম্পটন-বিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের সাহায্যে কতকগুলি নূতন বিষয় শিখিতে লাগিলাম। তাঁহার নাম রেভারেণ্ড ডাক্তার এইচ, বি, ফ্রিমেল। আর্মস্ট্রঙ্গের মৃত্যুর পর ইনি হ্যাম্পটনের পরিচালক হইয়াছেন।
নৈশবিদ্যালয়ে একবৎসর “কর্ম্মঠসমিতি” কে পড়াইলাম। দৈবক্রমে তাহার পর আমার একটা অভাবনীয় সুযোগ আসিল। তাহাতেই আমার জীবন-কর্ম্ম আবদ্ধ হয়—সেই কাজেই আমি এখনও লাগিয়া আছি।
১৮৮১ খৃষ্টাব্দ অর্থাৎ আমার যখন প্রায় ২২।২৩ বৎসর বয়স সেই সময়কার কথা বলিতেছি। একদিন সন্ধ্যাকালে গির্জ্জার কার্য্য শেষ হইবার পর সেনাপতি আর্মষ্ট্রঙ্গ আমাকে বলিলেন; “দেখ, আমি আলাবামা প্রদেশ হইতে একখানা চিঠি পাইয়াছি। কয়েক জন লোক সেখানে একটা শিক্ষক-বিদ্যালয় খুলিতে চাহেন। এই বিদ্যালয়ে নিগ্রোজাতিরই শিক্ষার ব্যবস্থা হইবে। সম্ভবতঃ টাস্কেজী নামক একটি ক্ষুদ্র নগরে তাঁহাদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইবে। কিন্তু তাঁহাদের একজন পরিচালক আবশ্যক। তাঁহারা আমার নিকট লোক চাহিয়াছেন।”
আলাবামার পত্রলেখকগণ ভাবিয়াছিলেন, তাঁহাদের প্রস্তাবিত বিদ্যালয়ের জন্য নিগ্রোজাতীয় শিক্ষক পাওয়া যাইবে না। তাঁহাদের বিশ্বাস ছিল সেনাপতি মহাশয় তাঁহাদিগকে একজন শ্বেতকায় লোকেরই নাম করিবেন।
পরদিন সকালে সেনাপতি আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। আমি ঐ কাজ লইতে প্রস্তুত আছি কি না জিজ্ঞাসা করায় আমি বলিলাম “চেষ্টা করিতে পারি।” তিনি আলাবামায় উত্তর দিলেন “আমি একজন নিগ্রোকে পছন্দ করিয়াছি তাঁহার নাম বুকার ওয়াশিংটন। কোন শ্বেতাঙ্গের সন্ধান আমি দিতে পারিলাম না। যদি এই নিগ্রো যুবককে আপনারা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত থাকেন পত্রপাঠ লিখিবেন। ইহাঁকে পাঠাইয়া দিব।”
কয়েক দিন পরে আর্মষ্ট্রঙ্গের নিকট একটা তার আসিল। তিনি ছাত্রদের সঙ্গে রবিবারে সন্ধ্যা উপাসনা করিতেছিলেন। কার্য্য শেষ হইয়া গেলে তিনি তারের খবর ছাত্রদিগকে দিলেন। তাঁহাতে লেখা ছিল:—“বুকার ওয়াশিংটনের দ্বারা কাজ বেশ চলিবে। শীঘ্রই তাঁহাকে পাঠাইয়া দিন।”
বিদ্যালয়ের মধ্যে আনন্দ উৎসব হইল। শিক্ষক ও ছাত্রগণ মিলিয়া আমাকে বিদায়ভোজ দিলেন। আমি টাস্কেজী যাত্রা করিলাম। পথে কয়েকদিন আমার পল্লী ম্যাল্ডেনে কাটাইয়া গেলাম।
আলাবামায় টাস্কেজী একটি ক্ষুদ্র নগর। ইহার লোক সংখ্যা মাত্র ২০০০। তাহার মধ্যে ১০০০ নিগ্রো! দক্ষিণপ্রান্তের “কৃষ্ণবিভাগে” এই জনপদ অবস্থিত। আলাবামা প্রদেশের অনেকগুলি “কাউণ্টি” বা জেলা। তাহার কয়েকটিতে নিগ্রোসংখ্যা খুব বেশী। কোন জেলায় শতকরা ৬০, কোন জেলায় শতকরা ৭৫ জন, কোন জেলায় এমন কি শত করা ৯০ জন নিগ্রোর বাস। যে জেলায় টাস্কেজী নগর সেই জেলায় শ্বেতাঙ্গদিগের সংখ্যা নিতান্তই অল্প। এই জন্যই বোধ হয় ঐ অঞ্চলকে কৃষ্ণ-বিভাগ বলা হইত
শুনিয়াছি ঐ অঞ্চলের মাটি কাল বলিয়া উহার নাম কৃষ্ণবিভাগ হইয়াছিল। কাল মাটিই উর্ব্বর। এজন্য চাষাবাদের সুবিধা এই সকল স্থানে বেশী। কাজেই এ অঞ্চলে গোলাম খাটাইলে লাভ হইবার আশা যথেষ্ট। এই সকল কারণে গোলামীর যুগে গোলামখানা, গোলামাবাদ ইত্যাদি এই বিভাগকে ছাইয়া ফেলিয়াছিল। একে কাল মাটি তাহার উপর কাল লোকের বাস। সুতরাং কৃষ্ণ-বিভাগ নাম শীঘ্রই সমাজে প্রচারিত হইয়া গেল। আমাদের স্বাধীনতালাভের পর হইতে কৃষ্ণ-বিভাগ বলিলে প্রদেশ বিশেষ বুঝায়। আজকাল যেসকল স্থানে নিগ্রোর সংখ্যা বেশী সেই সকল স্থান কৃষ্ণ-বিভাগের অন্তর্গত বুঝিতে হইবে।
টাস্কেজীতে পৌঁছিবার পূর্ব্বে মনে করিয়াছিলাম যে, ওখানে বাড়ীঘর সাজসরঞ্জাম ইত্যাদি সকলই বোধ হয় আছে। আমাকে যাইয়াই শিক্ষকতার কর্ম্ম আরম্ভ করিতে হইবে। আমি পৌঁছিয়া দেখি কিছুই নাই বাড়ী ঘর আস্বাব পত্রত নাইই, এমন কি বিদ্যালয়ের জন্য কোন স্থানও নির্ব্বাচিত হয় নাই। সবই আমাকে নিজ হাতে করিয়া লইতে হইবে। তবে একথা আমি বলিতে বাধ্য যে, এখানে ইট কাঠ, চূণ শুরকি, খাতাপত্র ইত্যাদি নির্জ্জীর পদার্থ ছিল না সত্য। কিন্তু এই সমুদয় অপেক্ষা সহস্রগুণ মূল্যবান্ এবং প্রয়োজনীয় পদার্থ ছিল। সে ওখানকার নিগ্রো সন্তানগণের শিখিবার আকাঙ্ক্ষা, মানুষ হইবার ব্যাকুলতা, জ্ঞানার্জ্জনের জন্য আন্তরিক পিপাসা। তাহাদের বিদ্যালাভের নিমিত্ত আগ্রহ দেখিয়া আমি বুঝিলাম এবং মনে মনে বলিলাম যে “ইহাই বিদ্যালয়, এই ক্ষুধা ও পিপাসাই বিদ্যালয়ের প্রাণ। এই ব্যাকুলতা হইতেই বিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হইবে। এই প্রাণ হইতেই শরীর আসিবে। জায়গাজমি বাড়ীঘর আলমারী চেয়ার ইত্যাদির অভাব এই আন্তরিকতাই পূরণ করিয়া লইবে। যেখানে আত্মা আছে সেখানে দেহের অভাব থাকিবে না।”
টাস্কেজী সহরটা নিগ্রো-বিদ্যালয়ের পক্ষে একটি অতি উপযুক্ত স্থান মনে হইল। ইহার চারিদিকেই অনেকগুলি নিগ্রো-পল্লী। স্থানও কিছু নির্জ্জন—বড় রেল রাস্তা হইতে প্রায় ৫।৬ মাইল দূরে। অথচ তাহার সঙ্গে একটা ছোট রেল লাইনের যোগ ছিল। তাহা ছাড়া আর একটা সুবিধাও দেখিলাম। এই পল্লীর শ্বেতাঙ্গগণ বিদ্যার আদর করিতেন। গোলামীর যুগ হইতে এখন পর্য্যন্ত এখানে শ্বেতাঙ্গেরা একটা বিদ্যালয় চালাইয়া আসিতেছিলেন। সুতরাং লেখা পড়ার একটা আব্হাওয়া এই অঞ্চলে মানসিক ও নৈতিক স্বাস্থ্যের সৃষ্টি করিত। অধিকন্তু নিগ্রোরাও নিতান্ত দুশ্চরিত্র ছিল না। তাহারা লিখিতে পড়িতে পারিত না বটে, কিন্তু শ্বেতাঙ্গদিগের সংস্পর্শে আসিয়া অনেক বিষয়ে তাহারা উন্নত হইয়া ছিল। দুই জাতির মধ্যে সদ্ভাবও মন্দ বুঝিলাম না। একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি। এই সহরে একটা ধাতুর কারখানা ছিল। একজন শ্বেতাঙ্গ ও একজন নিগ্রো দুই জনে মিলিয়া ইহার যৌথ মালিক ও স্বত্ত্বাধিকারী ছিলেন। শ্বেতাঙ্গ মালিকের মৃত্যুর পর ইহা সর্ব্বাংশে নিগ্রোর সম্পত্তি হয়।
আমি এক বৎসর পূর্ব্বেকার বৃত্তান্ত অবগত হইলাম। হ্যাম্পটনের সুনাম এ অঞ্চলে বেশ কাজ করিতে ছিল বুঝিতে পারিলাম। টাস্কেজীর নিগ্রো সমাজ হ্যাম্পটনের আদর্শে এখানে একটি শিক্ষক বিদ্যালয় খুলিতে চাহিয়াছিলেন। এজন্য তাঁহারা আলাবামার প্রাদেশিক রাষ্ট্রের নিকট আবেদন করিয়া বার্ষিক ৬০০০৲ পাইবার আশা পাইয়াছেন। রাষ্ট্রের কর্ত্তারা নিয়ম করিয়াছেন যে, এই টাকা হইতে শিক্ষকগণের বেতনাদি দেওয়া যাইবে মাত্র। জমি, বাড়ী আস্বাব লাইব্রেরী ইত্যাদির জন্য এই টাকা হইতে কিছু মাত্র খরচ করিতে পারা যাইবে না।
আমাকে পাইয়া নিগ্রোরা যারপরনাই সন্তুষ্ট হইল। সকলেই নানা উপায়ে আমার কার্য্যে সাহায্য করিতে আসিল।
আমি প্রথমেই স্থান খুঁজিতে বাহির হইলাম। একটা জায়গা পাওয়া গেল। সহরের মধ্যে নিগ্রোদিগের একটা ধর্ম্মমন্দির ছিল তাহারই পার্শ্বে একটা ভাঙ্গা বাড়ী দেখিতে পাইলাম। এই “পোড়ো বাড়ী”-টাতেই বিদ্যালয় খোলা হইল। বিশেষ বিশেষ উৎসবাদি বা বক্তৃতা ও সম্মিলনের জন্য গির্জ্জাঘরটি ব্যবহার করিতাম।
ঘর দুইটাই অতি জীর্ণ অবস্থায় ছিল। বর্ষাকালে ঘরের ভিতর বৃষ্টির জল চুঁইতে থাকিত। অনেক দিন ছাত্রেরা আমার মাথায় ছাতা ধরিয়া বসিত—আমি ছেলেদের পড়া শুনিতাম। কোন কোন সময়ে আমি যখন খাইতে বসিতাম আমাদের বাড়ীর মালিক আমার মাথায় ছাতা ধরিয়া দাঁড়াইতেন।
আলাবামার নিগ্রোরা এসময়ে রাষ্ট্রনৈতিক হুজুগে খুব মাতিয়া গিয়াছিল। তাহাদের ইচ্ছা, আমিও তাহাদের আন্দোলনে যোগ দিয়া তাহাদের কার্য্যে সাহায্য করি। তাহারা অন্য জাতীয় লোককে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে বেশী বিশ্বাস করিত না। এজন্য তাহারা আমাকে রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে যোগ দিতে বড় পীড়াপীড়ি করিল। এক বৃদ্ধ আসিয়া আমার কাণে প্রায়ই জপিত—“ভায়া, তুমি এবার কাহাকে ভোট দিবে স্থির করিয়াছ? আমার ইচ্ছা আমরা যাঁহাকে দিব মনে করিয়াছি তাঁহাকেই তুমিও দিও। অনুরোধটা রাখিবে কি? আমরা কাগজ পত্র পড়িতে জানি না, জানইত। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়? আমরা ভোট দিতে শিখিয়াছি। আমাদের ইচ্ছা তুমিও আমাদের মতানুসারেই ভোট দাও।” আর একজন বলিল, “আমরা কেমন করিয়া ভোট দিয়া থাকি জান? সাদা চামড়া ওয়ালারা কি করে আগে দেখি। দূরে দূরে থাকিয়া খবর লই তাহারা কাহাকে ভোট দিল। যখন আমাদের ভোট দিবার পালা আসে আমরা চোখ কাণ বুঁজিয়া ঠিক তাহাদের উল্টা করি। কি বল, ভায়া, আমরা মন্দ করি কি?”
এই ছিল বিশ বৎসর আগেকার নিগ্রো রাষ্ট্রনীতি, আজ আমি আনন্দের সহিত বলিতে পারি যে, এরূপ মনোভাব আমাদের সমাজ হইতে চলিয়া গিয়াছে। আমরা এখন কর্ত্তব্য বুঝিয়াই কাজ করিয়া থাকি। শ্বেতাঙ্গ যাহা করে কৃষ্ণাঙ্গের ঠিক তাহার বিপরীত করা উচিত—এরূপ ভাবনা আমাদের নিগ্রো মহলে অনেকটা কমিয়াছে।
১৮৮১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি টাস্কেজীতে পৌঁছি। প্রথম মাসেই আমি বিদ্যালয়ের জন্য স্থান বাছিয়া লইলাম এবং আলাবামা প্রদেশের জেলায় জেলায় ভ্রমণ করিলাম। লোক জনের আর্থিক অবস্থা, নৈতিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থা সবই তন্ন তন্ন করিয়া বুঝিতে যত্ন লইলাম। সঙ্গে সঙ্গে জেলাগুলির ভিন্ন ভিন্ন পল্লীতে টাস্কেজী বিদ্যালয়ের কথা প্রচার করিয়া বেড়াইলাম। অভিভাবকগণের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়া ছাত্র সংগ্রহেও নিযুক্ত রহিলাম!
আমি অধিকাংশ সময়টা পল্লীতে পল্লীতে ভ্রমণ করিয়া কাটাইতাম। একটা গরুর গাড়ীতে অথবা একটা খচ্চরে চড়িয়া আমার এই ‘সফর’ হইত। দরিদ্র পল্লীবাসীদিগের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কামরায় আতিথ্য গ্রহণ করিতাম। তাহাদের সঙ্গেই খাওয়া দাওয়া এবং সুখ দুঃখের গল্প চলিত। তাহাদের বাগান আবাদ পাঠশালা মন্দির ইত্যাদি সবই দেখিতাম। অবশ্য তাহাদিগকে আগে কোন খবর পাঠাইতাম না। হঠাৎ যে গ্রামে যাইয়া উপস্থিত হইতাম তাহার কোন গৃহস্থের ঘরে অতিথি হইয়া পড়িতাম। এ জন্য তাহারা আমাকে আদর অভ্যর্থনা ইত্যাদি করিবার সুযোগ পাইত না। ইহাতে আমার লাভই হইত। কারণ এই উপায়ে তাহাদের স্বাভাবিক “আটপৌরে” চাল চলন বেশ ভাল রকম বুঝিতে পারিতাম
এইরূপে আলাবামা প্রদেশের পল্লীতে পল্লীতে ভ্রমণ করিয়া নিগ্রোসমাজের পূর্ব্বাপর সকল অবস্থাই আমি জানিতে পারিলাম। আমি শেষে এই অঞ্চলের জেলা, নগর, গ্রাম, রাস্তাঘাট, অলিগলি ইত্যাদি আমার নখদর্পণে দেখিতে পাইতাম।
নিগ্রো সমাজে দারিদ্র্যের প্রকোপ অত্যধিক দেখিলাম। তাহাদের বাড়ীঘর ছিলই না বলিলে অন্যায় হইবে না। একটা ছোট কামরার মধ্যে সমস্ত পরিবার শুইয়া থাকিত। আত্মীয় স্বজন কুটুম্ব বন্ধুবান্ধব অতিথি সকলেরই সেই কামরায় স্থান হইত। আমাকে এইরূপ সকলের সঙ্গে একই কামরায় এবং এমন কি একই বিছানায় বহু রাত্রি কাটাইতে হইয়াছে। স্নানের সুবিধা প্রায় কোন বাড়ীতেই থাকিত না। এমন কি মুখ হাত ধুইবারও জায়গা ছিল না। তবে ঘরের বাহিরে উঠানের কোন স্থানে হাত পা ধুইবার জন্য জল রাখা হইত।
রুটি ও শূকরের মাংস প্রধান খাদ্য ছিল। রুটি ও ডাল ছাড়া অনেক পরিবারে আর কোন খাদ্য জুটিত না। নিকটবর্ত্তী কোন সহরের দোকান হইতে পল্লীবাসীরা বেশী দামে মাংস ও রুটি ইত্যাদি কিনিয়া আনিত। বড়ই আশ্চর্য্যের কথা, তাহারা নিজে জমি চষিয়া শাকশব্জী ফলমূল ইত্যাদি তৈয়ারী করিয়া লইতে চেষ্টা করিত না। এমন কি, এ বিষয়ে তাহাদের কেন ধারণাই ছিল না। দুনিয়ায় যাহা কিছু কিনিতে পাওয়া যায় তাহার সমস্তই যে ঘরের সম্মুখবর্ত্তী জমিতে উৎপন্ন করিয়া লওয়া যাইতে পারে এ কথা তাহারা ভাবিতে পারিত না। সহর হইতে মামুলি ডাল, আটা ও মাংস বেশী পয়সায় কিনিয়া আনিতেও তাহারা প্রস্তুত। অথচ অল্প ব্যয়ে সুখে খাইবার পরিবার সুযোগ যে তাহাদের বাড়ীতেই রহিয়াছে তাহা এই সকল পল্লীর অধিবাসীরা জানিতই না! ঘরে তাহারা শস্য যে একেবারে বুনিতই না—তাহা নয়। তাহারা কেবলমাত্র তূলার চাষই করিতে শিখিয়াছিল। এদিকে তাহারা এতই মজিয়াছিল যে, ঘরের দুয়ার পর্য্যন্ত তাহাদের তূলার ক্ষেত আসিয়া পৌঁছিত। তথাপি দুই চারি হাত জমি স্বতন্ত্র করিয়া দৈনিক আহারের জন্য ফসল তৈয়ারী করিতে তাহারা যত্ন লইত না।
দুঃখের কথা আর কি বলিব? এই সকল দরিদ্রের কুটীরে অনেক স্থলে আমি মহামূল্য শেলাইয়ের কলও দেখিয়াছি। প্রায় ২০০৲ দিয়া কল কেনা হইয়াছে কিন্তু ব্যবহার করিবার যোগ্যতা খুব কম লোকেরই দেখিতে পাইতাম। মাস মাস আংশিকভাবে, ৫৲ বা ১০৲ করিয়া তাহারা অতি কষ্টে কলের দাম শোধ করিত কিন্তু কল ঘরের এক কোণে পড়িয়াই থাকিত। আবার সৌখীন ঘড়িও অনেক পরিবারের আস্বাবের মধ্যে দেখিতাম। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়াছি—এই সকল ঘড়ির মূল্য প্রায় ৫০৲! এ দিকে ত এত সভ্যতা, বিলাস ও বাবুগিরির লক্ষণ। কিন্তু সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনের নিয়মই তাহারা শিখে নাই। তাহারা খাইতেই জানিত না। আমি এক গৃহস্থের বাড়ীতে অতিথি হইয়াছিলাম। তাহার ঘরে ঐ সকল হাল ফ্যাশনের আস্বাব পত্র কিছু কিছু ছিল। কিন্তু খাইতে বসিয়া দেখি—একটা টেবিলে আমরা পাঁচ জন খাইতেছি অথচ একটি মাত্র চামচ! এবং একটি মাত্র কাঁটা! ঐ একটির দ্বারাই পাঁচ জনের কাজ চালাইতে হইল! অথচ সেই কামরারই এক কোণে একটা প্রকাণ্ড টেবিল হারমনিয়াম শোভা পাইতেছে। তাহার মূল্য ২০০৲। দেখিয়া অবাক্ হইলাম আর ভাবিলাম ইহাদের কি কাণ্ডজ্ঞান নাই! ‘অর্গ্যান’ বাজাইয়া সভ্য হইতে শিখিয়াছে—অথচ এখনও আহারের নিয়মই জানে না।
অবশ্য বলা বাহুল্য প্রায়ই দেখিতাম মালিকেরা কেহই অর্গ্যান বাজাইতে জানে না। ঘড়ি দেখিয়া সময় বলিবার বিদ্যা কাহারও নাই। ঘড়ি মেরামত করা ত দূরের কথা, কাঁটা চালাইয়া সময় ঠিক রাখিতেই কেহ জানিত না। ব্যবহারাভাবে উহার চাবি নষ্ট হইয়া গিয়াছে। আর শেলাইয়ের কলও যত্নাভাবে এবং লোকাভাবে ধ্বংসের পথে যাইতেছে। অথচ অত দামী জিনিষের মূল্য একবারে দিবার ক্ষমতা নাই বলিয়া তখনও মাসিক ৫।৭৲ হিসাবে দাম শোধ করা হইতেছে!
এক বাড়ীতে আমি পরিবারের সকলের সঙ্গে টেবিলে খাইতে বসিলাম। তাহারা যে টেবিলে খাইতে শিখিয়াছে আমার বিশ্বাস হইল না। অতটা সৌন্দর্য্য জ্ঞান তাহাদের জন্মে নাই। অনুসন্ধানে বুঝিতে পারিলাম যে, আমি একজন ভদ্রলোক তাহাদের গৃহে অতিথি হইয়াছি, কাজেই আমার খাতিরে তাহারা টেবিলে খানা পরিবেষণের আয়োজন করিয়াছে।
সাধারণতঃ তাহাদের ভোজন-ব্যাপার নিতান্তই পশুজনোচিত। ঘুম হইতে উঠিয়া নিগ্রোরমণী উনানে কড়া চাপাইয়া দেয় তাহাতে মাংস, ডাল, যাহা হউক ভাজা হইতে থাকে। দশমিনিট পরেই উহা নামাইয়া লওয়া হয়। খানা প্রস্তুত হইয়া গেল! বাড়ীর কর্ত্তা কাজে বাহির হইবার সময়ে হাতে একটা রুটি আর কিছু তরকারী লইয়া যায়। পথে খাইতে খাইতে কর্ম্মক্ষেত্রে উপস্থিত হয়। স্ত্রী ঘরের এক কোণে বসিয়া হয়ত খাইতে থাকে অথবা উননের কড়া হইতেও খানিকটা মুখে দিয়া চিবাইতে থাকে। আর ছেলেপিলেরা উঠানে দৌড়াদৌড়ি করিতে করিতে রুটি ও মাংস যাহা পায় তাহাই গলাধঃকরণ করে। অবশ্য ছেলেদের কপালে মাংস প্রায়ই জুটিত না। মাংসের দাম খুব বেশী।
সকালবেলার খাওয়া এইরূপে সমাপ্ত হইত। পরমুহূর্ত্তে সকলে সপরিবারে তূলার ক্ষেতে হাজির। ছেলে বুড়া কেহই বাড়ীতে থাকিত না। সকলকেই যে যেমন পারে খাটিতে হইত। খোকা পর্য্যন্ত মাঠে যাইত। তূলার বস্তার পাশে তাহাকে বসাইয়া রাখা হইত। মা কাজ করিতে করিতে মাঝে মাঝে তাহাকে দেখিয়া আসিত। মধ্যাহ্ন-ভোজন এবং নৈশভোজন ব্যাপারও সকালবেলার আহারেরই মত ছিল।
তাহাদের নিত্যকর্ম্মপদ্ধতি এইরূপ। শনিবার ও রবিবারের জীবনযাপন প্রণালী কিছু স্বতন্ত্র। শনিবার নিগ্রোরা সপরিবারে সহরে আসিত। সমস্ত দিনটাই প্রায় সহরে কাটাইত। সহরে যাইত ‘বাজার করিতে’! অথচ তাহাদের যা অবস্থা তাহাতে দশ মিনিটের বেশী বাজার করিবার জন্য কোন মতেই লাগিতে পারে না। আর একজন লোক গেলেই চলিতে পারে। কিন্তু তাহা হইবে না। সমস্ত পরিবারই বাজারে যাইবে! ৮।১০ ঘণ্টা সহরে থাকিয়া বাড়ীতে ফিরিত। দিনটা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইত। মেয়ে পুরুষ জায়গায় জায়গায় জটলা করিয়া নাকে নস্যি গুঁজিত অথবা ধূমপান করিত। এই গেল শনিবারের পালা।
রবিবার তাহারা একটা বড় সভা করিত। সেই সভায় খোসগল্প বেশ চলিত।
তাহাদের আর্থিক অবস্থা বড়ই শোচনীয় দেখিতাম। প্রায় জেলারই পল্লীবাসীরা ঋণগ্রস্ত। শস্য যাহা উৎপন্ন হইত সমস্তই পূর্ব্ব হইতে পাওনাদারদিগের নিকট ‘বন্ধকি’ থাকিত।
পাঠশালা গ্রামে গ্রামে দেখিয়াছি সত্য কিন্তু প্রাদেশিক রাষ্ট্র তাহাদের জন্য বাড়ী ঘর জায়গা জমির কোন ব্যবস্থা করেন নাই। কোন গির্জ্জাঘরে অথবা মামুলি কাঠের কুঠুরীতে স্কুল বসিত। শীতকালে ঘরগুলি গরম রাখিবার কোন বন্দোবস্তই ছিল না। ছেলে ও মাষ্টারেরা বড় কষ্ট ও অসুবিধা ভোগ করিত। উঠানের এক স্থানে কাঠের আগুন জ্বালান হইত। আগুন পোহাইবার জন্য ঘর হইতে ছাত্র ও শিক্ষকেরা প্রয়োজন মত বাহিরে আসিত। এদিকে শিক্ষকদের যেমন বিদ্যা তেমন চরিত্র।
পাঁচ মাস করিয়া বৎসরে স্কুল খোলা থাকিত। একটা চোঁথা কাল বোর্ড ছাড়া বিদ্যালয়ের আবাব কিছুই কোথায়ও দেখি নাই। পুস্তকাদি সাজসরঞ্জাম ছিল না। একবার একটা ‘পোড়ো’ কাঠের কামরায় ঢুকিয়া দেখি—পাঁচজন ছাত্র জড়াজড়ি করিয়া একখানা বই পড়িতেছে! প্রথম দুইজন সম্মুখে বসিয়া পুস্তকখানা ধরিয়া আছে। ইহাদের পশ্চাতে আর দুইজন দাঁড়াইয়া প্রথম দুইজনের ঘাড়ের উপর দিয়া দেখিতেছে। এই চারিজনের পশ্চাতে একটি ছেলে উঁকি মারিয়া, যাহা হয়, পড়া বুঝিতেছে।
বিদ্যালয়ের যেরূপ অবস্থা ধর্ম্মমন্দিরগুলির অবস্থা তাহা অপেক্ষা ভাল নয়। গির্জ্জাঘরগুলি জীর্ণশীর্ণ। ধর্ম্মপ্রচারকগণও বিদ্যায় এবং চরিত্রে শিক্ষক মহাশয়গণেরই অনুরূপ।
আলাবামা প্রদেশে বেড়াইতে বেড়াইতে আমি কয়েকটি লোকের সাক্ষাৎ পাইয়াছিলাম। তাহাদের সঙ্গে কথা বার্ত্তায় নিগ্রোজাতির চিন্তার ধারা বুঝিতে পারিলাম। একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। তাহাতেই আপনারা বুঝিবেন ইহাদের মনের গতি কিরূপ ছিল। একজনকে আমি তাহার বংশ-কথা ও পরিবারের ইতিহাস সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। তাহার বয়স ৬০ বৎসর। সে বলিল তাহার জন্ম ভার্জ্জিনিয়ায়। ১৮৪৫ সালে, সে বিক্রি হইয়া আলাবামায় আসিয়াছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “তোমার সঙ্গে কয়জন বিক্রি হইয়া আলাবামা প্রদেশে আসিয়াছিল?” সে বলিল, “আমরা সর্ব্বসমেত পাঁচজন ছিলাম—আমি, আমার ভাই এবং তিনটি খচ্চর।”
জানোয়ার ও মানুষ যে একই শ্রেণীর অন্তর্গত নয় এই বৃদ্ধ গোলামের চিন্তায় তাহা আসিত না। প্রকৃতপক্ষে গোলামী করিতে করিতে মানুষে আর পশুতে কোন প্রভেদই থাকে না। মনিবেরাও মানুষে এবং পশুতে কোন প্রভেদ রাখেন না। পশু ও যেমন তাঁহার সম্পত্তি, গোলামও অঁহার ঠিক সেইরূপই সম্পত্তি বিশেষ।