নীল তারা ইত্যাদি গল্প/জয়হরির জেব্রা
জয়হরির জেব্রা
এই আখ্যানের নায়ক জয়হরি হাজরা, নায়িকা বেতসী চাকলাদার, উপনায়ক উপনায়িকা গুটিকতক জন্তু, যথা— একটি বিলাতী কুত্তা, একটি দেশী কুত্তী, একটি আরবী ঘোড়া এবং একটি ভারতীয় জেব্রা। লেডিজ ফার্স্ট—এই আধুনিক নীতি অনুসারে প্রথমে বেতসীর পরিচয় দেব, তার পর জয়হরির কথা বলব। জন্তুদের অবতারণা যথাস্থানে করলেই চলবে।
বেতসী বিলাতে জন্মেছিল, রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথের পাঁচ বৎসর পরে। তার বাপ মা ব্রিটিশভক্ত ছিলেন, সেজন্য মেয়ের নাম এলিজাবেথ রেখেছিলেন, সংক্ষেপে বেট্সি। কিন্তু সে নাম পরে বদলানো হয়। ভারতবর্ষে ফেরবার সময় জাহাজে একজন ইংরেজ স্ত্রীলোক বেট্সির মাকে ডার্টি নিগার বলেছিল, তাতেই রেগে গিয়ে তিনি তখনই মেয়ের বেট্সি নাম বদলে বেতসী করলেন।
বেতসীর বাবা প্রতাপ চাকলাদার ধনীর সন্তান। এদেশে শিক্ষা সমাপ্ত করে সস্ত্রীক বিলাত গিয়েছিলেন এবং সেখানে পাঁচ-ছ বৎসর বাস করে কৃষি ও পশুপালন শিখেছিলেন। ফিরে এসে উলুবেড়ের কাছে তাঁর পৈতৃক জমিদারি হোগলবেড়েতে তিন শ বিঘা জমির উপর ফুল ফল ফুলকপি বাঁধাকপি বীট গাজর টমাটো ইত্যাদির বাগান এবং বিস্তর গরু রেখে ডেয়ারি ফার্ম করলেন, তা ছাড়া ভেড়া ছাগল শুয়োর মুরগি হাঁস পুষে তারও ব্যবসা চালাতে লাগলেন। একটি উত্তম বাগানবাড়ি বানিয়ে সপরিবারে সেখানেই বাস করতেন, মাঝে মাঝে কলকাতার যেতেন। সতরো বৎসর ধরে ব্যবসা ভালই চলল, লাভও প্রচুর হতে লাগল। তার পর প্রতাপ চাকলাদার মারা গেলেন।
বেতসীর মা অতসী মুশকিলে পড়লেন। স্বামীর হাতে গড়া অত বড় ব্যবসাটি চালাবার ভার কাকে দেবেন? তাঁর ছেলে নেই, একমাত্র সন্তান বেতসী। নায়েব হরকালী মাইতি কাজের লোক বটে, কিন্তু অত্যন্ত বুড়ো হয়েছেন, তাঁর উপর নির্ভর করা চলে না। স্থির করলেন সব বেচে দিয়ে কলকাতার চলে যাবেন। কিন্তু বেতসী বলল, কিছু ভেবো না মা, আমি চালাব, বাবার কাছে সব শিখেছি। অতসী ভরসা পেলেন না, তবু মেয়ের জেদ দেখে ভাবলেন, দু বছর দেখাই যাক না, তার পর না হয় বেচে ফেলা যাবে। একটি উপযুক্ত জামাই যদি পাওয়া যায় তবে আর কোনও ভাবনা থাকে না। কিন্তু মেয়েটা যে বেয়াড়া, এত বয়সেও তার কাণ্ডজ্ঞান হল না।
অতসী উঠে পড়ে জামাইএর খোঁজ করতে লাগলেন। মেয়েকে নিয়ে ঘন ঘন কলকাতায় গেলেন, পার্টি দিলেন, বহু পরিবারের সঙ্গে মিশলেন, বাছা বাছা পাত্রদের হোগলবেড়েতে নিমন্ত্রণ করে আনালেন, কিন্তু কিছুই ফল হল না। প্রতাপ চাকলাদারের সম্পত্তির লোভে অনেক সুপাত্র আর কুপাত্র এগিয়ে এসেছিল, কিন্তু বেতসীর সঙ্গে দু দিন মেশার পরেই সরে পড়ল। তার গড়ন ভাল, রং খুব ফরসা, কিন্তু মুখে লাবণ্যের অভাব আছে। সে মেমের মতন ব্রীচেস পরে ঘোড়ায় চড়ে তার তিন শ বিধা ফার্ম পরিদর্শন করে, কর্মচারীদের উপর হুকুম চালায়, শাসনও করে। তার রূপ চিত্তাকর্ষক নয়, মেজাজও উগ্র, সেজন্য তার মায়ের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। বেতসী বলল, তোমার জামাই না জুটল তো বড় বয়েই গেল, আমি কারও তোয়াক্কা রাখি না, বাবার ফার্ম একাই চালাব। কিন্তু অতসী দেখলেন, ফার্মের আয় আগের মতন হচ্ছে না। বেতসী তার মাকে আশ্বাস দিল— কোনও ভয় নেই, দশ দিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
জয়হরি হাজরার নামটি সেকেলে, কিন্তু সেজন্যে তার বাপ মাকে দায়ী করা যায় না, তার হরিভক্ত ঠাকুরদাদাই ওই নাম রেখেছিলেন। জয়হরি মধ্যবিত্ত গৃহস্থের সন্তান, লেখাপড়ায় খুব ভাল, একটা স্কলারশিপ যোগাড় করে বিলাত গিয়েছিল, সুতো আর কাপড় রঙানো শিখে তিন বছর পরে ফিরে এল। এসেই আমেদাবাদের একটি বড় মিলে তার চাকরি জুটে গেল। দু বছর পরে তা ছেড়ে দিয়ে নিজেই একটি ব্লীচিং অ্যাণ্ড ডাইং ফ্যাক্টরি খুলল। সে কারখানা খুব ভালই চলছিল, লাভও বেশ হচ্ছি, তার পর এক দুর্ঘটনা হল। জয়হরির শিকারের শখ ছিল, গণ্ডাল স্টেটের জঙ্গলে একটা বলো শুয়োরের আক্রমণে তার পা জখম হল। ঘা সারল, কিন্তু জয়হরি একটু খোঁড়া হয়ে গেল, হাঁটবার সময় তাকে লাঠিতে ভর দিতে হয়। এর কিছু আগে তার বাপ মা মারা গিয়েছিলেন। সে তার কারখানা ভাল দামে বেচে দিয়ে পৈতৃক পুরনো বাস্তুভিটা খাগড়াডাঙায় চলে এল। এই গ্রামটি হোগলবেড়ের লাগাও।
জয়হরির অর্থলোভ নেই, বিবাহেরও ইচ্ছা নেই। সে হিসাব করে দেখেছে তার যা পুঁজি আছে তাতে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু যে বিদ্যা সে শিখেছে তার চর্চা একবারে ছাড়তে পারল না। খাগড়াডাঙার পুরনো ছোট বাড়িটা মেরামত করে বাসের উপযুক্ত করে নিল, এবং সেখানেই নানা রকম পরীক্ষা করে শখ মেটাতে লাগল। কিন্তু সুতো আর কাপড় ছোবানো নয়, জীবন্ত জন্তুর গায়ে রং পরানো।
জয়হরির জমির একদিকে ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা, আর তিন দিকে ধান খেত। রাস্তার দিকে সে কাঁটা তারের বেড়া লাগিয়েছে, আর সব দিকে ফণিমনসা বাগভেরেণ্ডা ইত্যাদির পুরনো বেড়াই আছে। তার বাড়ির সামনে এখন আর জঙ্গল নেই, সুন্দর একটি মাঠ হয়েছে, তার মাঝে মাঝে কয়েকটি গাছ আছে। বাড়ির পিছন দিকে গোটাকতক চালা ঘর উঠেছে, তাতে তার পোষা জন্তু আর কয়েকজন চাকর থাকে। জয়হরি এখানে আসার কয়েক মাস পরেই দেখা গেল তার বাড়ির সামনের মাঠে হরেক রকম অদ্ভুত জানোয়ার চরে বেড়াচ্ছে। আশেপাশের গ্রাম থেকে বহু লোক এসে দেখে যেতে লাগল।
বেতসীর কাছে খবর পৌঁছুল, খাগড়াডাঙায় একজন খোঁড়া বাবু আজব চিড়িয়াখানা বানিয়েছে, পয়সা লাগে না, কলকাতা থেকেও লোকে দেখতে আসছে। বেতসীর একটু রাগ হল। চাকলাদার বংশ এই অঞ্চলের সব চেয়ে মান্য গণ্য জমিদার। একজন বাইরের লোক এসে চিড়িয়াখানা বানিয়েছে অথচ সেখানে একবার পায়ের ধুলো দেবার জন্যে বেতসী আর তার মাঝে অনুরোধ করা হয় নি কেন? বেতসী শুনেছে, লোকটার নাম জয়হরি হলেও সে নাকি বিলাত ফেরত, সুতরাং তাকে অবজ্ঞা করে উড়িয়ে দিতে পারল না। কৌতূহল দমন করতে না পেরে একদিন সকাল বেলা সে তার প্রকাণ্ড কুকুর প্রিন্সকে সঙ্গে নিয়ে জয়হরির জন্তুর বাগান দেখতে গেল।
তারের বেড়ার ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে বেতসী অবাক হয়ে দেখতে লাগল। তিনটে নীল রঙের ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে। একটা সবুজ মেনী বেরালার কাছে চারটে বেগনী বাচ্চা লাফালাফি করছে। একটা অদ্ভুত জানোয়ার ঘাস খাচ্ছে, গায়ের রং হলদে, তার উপর ঘোর ব্রাউন রঙের ফোঁটা। বেতসী প্রথমে ভেবেছিল চিতা বাঘ, কিন্তু দাড়ি আর শিং দেখে বুঝল জন্তুটা আসলে ছাগল। একটু দূরে একটা ডোবার কাছে গোটা কতক ময়ূরকণ্ঠী রঙের রাজহাঁস প্যাঁক প্যাঁক করছে। বাড়ির ছাত থেকে হঠাৎ এক ঝাঁক লাল নারঙ্গী হলদে সবুজ নীল বেগনী রঙর পায়রা উড়ে চক্কর দিতে লাগল, যেন কেউ রামধনু কুচি কুচি করে আকাশে ছড়িয়ে দিয়েছে। বেতসী উপর দিকে চেয়ে দেখছিল, এমন সময় তার কানে এল—নমস্কার, দয়া করে, ভিতরে আসবেন কি?
বেতসী মাথা নামিয়ে দেখল, একজন সুদর্শন যুবা বেড়ার ফটক খুলে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে পায়জামা আর পঞ্জাবি, হাতে একটা মোটা লাঠি। প্রতিনমস্কার করে বেতসী বলল, আপনিই জয়হরিবাবু? আমার কুকুর নিয়ে ভিতরে যেতে পারি কি?...... থ্যাংক্স।
বেড়ার ভিতরের মাঠে এসে বেতসী বলল, অদ্ভুত সর জানোয়ার বানিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য কিছু আছে না শুধুই ছেলেখেলা?
জয়হরি সহাস্যে বলল, আর্ট মাত্রই ছেলেখেলা। আমি এক নতুন রকমের আর্টের চর্চা করছি। লোকে কাগজ আর ক্যামবিসের উপর আঁকে, কাদা পাথর ধাতুর মূর্তি গড়ে। আমি তা না করে জীবন্ত প্রাণীর উপর রং লাগাচ্ছি। আমার মিডিয়ম আর টেকনিক একবারে নতুন।
—নীল ভেড়া, সবুজ বেরাল, ছাগলের গায়ে বাঘের ছাল, একে আর্ট বলতে চান নাকি?
—আজ্ঞে হাঁ। প্রকৃতির অন্ধ অনুকরণ হল নিকৃষ্ট আর্ট। যা আছে তার বৈচিত্র্য সাধন এবং তাকে আরও মনোরম করাই আর্ট। সুকুমার রায় লিখেছেন—লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ। কথাটা ঠাট্টা হলেও আর্টের মূল সূত্র এতেই আছে।
—আমি তা মনে করি না। শুনেছি আপনি সুতো আর কাপড় রাঙানো শিখে এসেছেন। এখানে সময় নষ্ট না করে কোনও মিলে চাকরি নেন না কেন? জানোয়ারের গায়ে রং লাগানো একটা বদখেয়াল ছাড়া কিছু নয়।
—সকলের দৃষ্টিতে বদখেয়াল নয়। আমাদের কলামন্ত্রী রঙ্গ বাহাদুর নাদান আমার কাজ দেখে খুব তারিফ করেছেন। বলেছেন, সোভিএট সরকারকে এক শ আটটি লাল ঘুঘু উপহার পাঠালে বড় ভাল হয়, তিনি নেহেরুজীর সঙ্গে এ সম্বন্ধে পরামর্শ করবেন।
এই সময় বেতসীর পিছন দিকে এমন একটি ব্যাপার ঘটল যার ফল সুদূরপ্রসারী। একটি গোলাপী রঙের দেশী কুকুর জয়হরির কাছে আসছিল, তাকে দেখেই বোঝা যায় মাসখানিক আগে তার বাচ্চা হয়েছে। বেতসীর বিলিতী কুকুর প্রিন্স তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। সে বিস্তর বিদেশী আর ভারতীয় কুক্কুরী দেখেছে, কিন্তু এমন পদ্মকোরকবর্ণা সারমেয়ী পূর্বে তার নজরে পড়ে নি। প্রিন্স বার কতক সেই গোলাপী কুত্তীকে প্রদক্ষিণ করে তার গা শুঁকল, তার পর আর একটু ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করল। তখন গোলাপী হঠাৎ ঘ্যাঁক করে প্রিন্সের পায়ে কামড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। কেঁউ কেঁউ করতে করতে প্রিন্স বেতসীর কাছে এল।
অগ্নিমূর্তি হয়ে বেতসী বলল, একি কাণ্ড! আপনার নেড়ী কুত্তী আমার প্রিন্সকে কামড়ে দিল আর আপনি চুপ করে রইলেন!
জয়হরি বলল, আপনি ভয় পাবেন না, আমার কুকুরটার শরীরে রোগ নেই। কুকুররা এমন কামড়াকামড়ি করে থাকে তাতে ক্ষতি হয় না। আপনি অনুমতি দেন তো আপনার কুকুরের পায়ে একটু টিংচার আয়োডিন লাগিয়ে দিতে পারি।
—আপনার হাতুড়ে চিকিৎসা আমি চাই না। কেন আপনার কুকুরকে রুখলেন না? কত বড় বংশে আমার এই আলসেশ্যনের জন্ম তা জানেন? প্রিন্সের বাপ ফ্রেডরিক দি গেট, মা মারাইয়া তেরেজা। আপনার নেড়ী কুত্তী একে কামড়াবে আর আপনি হাঁ করে দেখবেন!
—ঘটনাটা হঠাৎ হয়ে গেল, আগে টের পেলে আমি বাধা দিতাম। কিন্তু আসল দোষী আপনার কুকুর, ও কেন নেড় কুত্তীর কাছে গেল? উচ্চকুলোদ্ভব হলেও আপনার প্রিন্সের নজর ছোট। অনেক বোকা লোক পেণ্ট করা মেয়ে দেখলেে ভুলে যায়। প্রিন্সও সেই রকম নেড়ী কুত্তীর গোলাপী রং দেখে ভুলেছে, জানে না যে ওটা কংগো রেডের রং।
—কাছে গেছে বলেই প্রিন্সকে কামড়াবে?
—আপনি একটু স্থির হয়ে ব্যাপারটি বোঝবার চেষ্টা করুন আমি যদি হঠাৎ আপনাকে অপমান করতাম—খবরের কাগজে যাকে বলে শ্লীলতা হানি, তা হলে আপনি কি করতেন? চুপ করে সইতেন কি?
—আপনাকে লাথি মারতাম, হাতে চাবুক থাকলে আচ্ছা করে কষিয়ে দিতাম।
—ঠিক কথা, সে রকম করাই আপনার উচিত হত। নারী মাত্রেরই আত্মসম্মান রক্ষার অধিকার আছে। আমাদের এই ভারতবর্ষ হচ্ছে বীরাঙ্গনা সতী নারীর দেশ। সেই ট্রাডিশন এ দেশের কুত্তীদের মধ্যেও একটু থাকবে তা আর বিচিত্র কি।
—ওসব বাজে কথা শুনতে চাই না। আপনি ওই নেড়ীটাকে গুলি করে মারবেন কিনা বলুন। আর আমার প্রিন্সের যে ইনফেকশন হল তার ড্যামেজ কি দেবেন বলুন।
—মাপ করবেন মিস চাকলাদার, কুত্তীটার বা আমার কিছুমাত্র অপরাধ হয় নি। শুধু শুধু দণ্ড দেব কেন?
— বেশ। আমার উকিল আপনাকে চিঠি পাঠাবেন। আদালত আপনাকে রেহাই দেয় কিনা দেখব।
বাড়ি ফিরে এসে বেতসী স্থির হয়ে থাকতে পারল না, তখনই মোটরে চড়ে উলুবেড়ে গেল। সেখানকার উকিল বিষ্ণু বাঁড়জ্যের সঙ্গে তার বাবার খুব বন্ধুত্ব ছিল। তাঁকে সব কথা উত্তেজিত ভাষায় তড়বড় করে জানিয়ে বেতসী বলল, ওই জয়হরি হাজরাকে সাজা দিতেই হবে জেঠামশাই, যত টাকা লাগে খরচ করব।
বিষ্ণুবাবু বললেন, আগে মাথা ঠাণ্ডা করে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা কর। যদি মনে কর যে তোমার কুকুরের রোগ হবার ভয় আছে তবে আজই ওকে কলকাতায় পাঠাও, বেলগাছিয়া হাসপাতালে অ্যাণ্টিরাবিজ ইনজেকশন দিয়ে দেবে। কিন্তু মকদ্দমার খেয়াল ছাড়। জয়হরির কুকুরটা যদি খেপা হত আর তোমার কুকুরকে রাস্তায় কামড়ে দিত তা হলেও বা কথা ছিল। কিন্তু তোমার কুকুর জয়হরির কম্পাউণ্ডে ঢুকে কামড় খেয়েছে, এতে কোনও ক্লেম আনা যায় না, মকদ্দমা করলে লোক হাসবে।
বিষ্ণুবাবু কিছুই করতে রাজী হলেন না। বেতসী তাঁর কাছ থেকে সোজা মহকুমা হাকিম অরুণ ঘোষের বাড়ি গেল। তাঁকে নিজের পরিচয় আর ব্যাপারটা জানিয়ে বলল, সার, আপনাকে এর প্রতিকার করতেই হবে, আপনি পুলিসকে অর্ডার দিন। জয়হরির খেঁকী কুকুরটা ডেঞ্জারস, তাকে এখনই মারা দরকার। আর জয়হরি একটা বুজরুক শারলাটান, নকল জানোয়ার বানিয়ে লোক ঠকাচ্ছে। জন্তুর গায়ে রং ধরানো তো একরকম ক্রুয়েলটিও বটে। তাকে অর্ডার করুন যেন তিন দিনের মধ্যে তার চিড়িয়াখানা ভেঙে দেয়।
অরুণ ঘোষ একটু হেসে বললেন, আচ্ছা, আমি পুলিসকে বলে দিচ্ছি যেন জয়হরিবাবুর কুকুরটার খবর রোজ নেওয়া হয়। হাইড্রোফোবিয়ার লক্ষণ দেখলে অবশ্যই তাকে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু জয়হরিবাবু যা করছেন তা তো বেআইনী নয়, সাধারণের অনিষ্টকরও নয়। তাঁকে তো আমি জব্দ করতে পারি না মিস চাকলাদার।
বেতসী অত্যন্ত রেগে গিয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এল। অনেকক্ষণ ভেবে ঠিক করল, সে নিজেই জয়হরিকে সাজা দেবে। আগে একটা আল্টিমেটম দেবে, তা যদি না শোনে তবে মার লাগাবে। লোকটা খোঁড়া, বেশী মারা ঠিক হবে না, এক ঘা চাবুক লাগালেই যথেষ্ট। জনকতক লোক হাতে জয়হরির নিগ্রহ দেখে তারও ব্যবস্থা করতে হবে। লোকে জানুক যে বেতসী চাকলাদার নিজেই বজ্জাতকে শাসন করতে পারে।
বেতসী তার ধোবা নিমাই দাস আর সর্দার-মালী গগন মণ্ডলকে ডেকে আনিয়ে বলল, ওহে, কাল সকালে আটটার সময় তোমরা জয়হরি হাজরার চিড়িয়াখানার সামনে হাজির থেকো!
নিমাই বলল, সেখানে গিয়ে কি করতে হবে দিদিসায়েব?
—কিছু করতে হবে না, শুধু একটা তামাশা দেখবে।
—যে আজ্ঞে, আমার ভাগনে নুটুকেও নিয়ে যাব।
গগন মণ্ডল বলল, আমার ছেলে দুটোকেও নিয়ে যাব দিদিসাহেব।
পরদিন সকাল বেলা বেতসী তার আরবী ঘোড়ায় চড়ে একটা চাবুক হাতে নিয়ে জয়হরির মাঠের সামনে উপস্থিত হল। নিমাই ধোবা আর গগন মালী তাদের পরিবারবর্গের সঙ্গে আগেই সেখানে হাজির ছিল।
জয়হরি বেড়ায় ধারে ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে তার ভেড়া আর ছাগলের পরস্পর ঢুঁ মারা দেখছিল। বেতসীকে দেখে স্মিতমুখে বলল, গুড মর্নিং মিস চাকলাদার, আপনার প্রিন্স ভাল আছে তো?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেতসী বলল, আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে। একবার বাইরে আসুন।
ফটকের বাইরে এসে জয়হরি বলল, হুকুম করুন।
ঘোড়ার উপর সোজা হয়ে বসে বেতসী বলল, দেখুন জয়হরিবাবু, আপনাকে একটা আল্টিমেটম দিচ্ছি। কাল আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছেন তার জন্যে দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চাইবেন কি না? আর সেই নেড়ী কুত্তাটাকে গুলি করবেন কি না? নিতান্ত যদি মায়া হয় তবে গঙ্গার ওপায়ে বিদায় করবেন কি না?
জয়হরি বলল, দুঃখপ্রকাশে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নেই, আপনি অকারণে আমার উপর চটেছেন তাতে আমি দুঃখিত। কিন্তু ক্ষমা চাইতে বা নেড়ী কুত্তীকে মারতে বা তাড়াতে পারব না।
চাবুকে তুলে বেতসী বলল, তবে এই নিন।
বেতসীর চাবুক জয়হমির পিঠে পড়বার আগে একটু পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীর বিবরণ আবশ্যক। মাঠের একটা কদম গাছের আড়াল থেকে একটি জেব্রা বেরিয়ে এল, কিন্তু বেতসীর নজর সেদিকে ছিল না। এই ভারতীয় জন্তুটি আফ্রিকার জেব্রার চাইতে কিছু ছোট, পেট একটু বেশী মোটা, কিন্তু গায়ের রং আর ডোরা দাগে কোনও তফাত নেই। অচেনা জানোয়ার দেখে নিমাই ধোবার ভাগনে নুটু বলল, মামা, ওটা কি গো?
নিমাই বলল, চিনতে লারছিস? ও তো আমাদের সৈরভী রে, সেই যে গাধীটার মাজায় বাত ধরেছিল, বোঁচকা বইতে লারত, তাই তো জয়হরিবাবুকে দশ টাকায় বেচে দিনু। আহা, এখন ভাল খেয়ে আর জিরেন পেয়ে সৈরভীর কিবে রূপ হয়েছে দেখ! বাবু আবার চিত্তির বিচিত্তির করে বাহার বাড়িয়ে দিয়েছে।
সৈরভী তার পুরনো মনিবকে চিনতে পেরে খুশী হয়ে এগিয়ে আসছিল। বেতসীর চাবুকে যখন জয়হরির পিঠে পড়বার উপক্রম করছে ঠিক সেই মুহূর্তে সৈরভীর কণ্ঠ থেকে আনন্দধ্বনি নির্গত হল— ভুঁ-চী ভুঁ-চী। তার অদ্ভূত রূপ দেখে আর ডাক শুনে বেতসীর ঘোড়া সামনের দু পা তুলে চিঁ-হি-হি করে উঠল। বেতসী সামলাতে পারল না, ধপ করে পড়ে গেল। পড়েই অজ্ঞান।
জ্ঞান ফিরে এলে বেতসী দেখল, একটা ছোট গেলাস তার মুখের কাছে ধরে জয়হরি বলছে, এটুকু খেয়ে ফেলুন, ভাল বোধ করবেন।
ক্ষীণ স্বরে বেতসী প্রশ্ন করল, কি ওটা?
—বিষ নয়, ব্র্যাণ্ডি। খেলে চাঙ্গা হয়ে উঠবেন।
—আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
—এখন দেখছেন না, একটু আগে দেখছিলেন বটে। আপনি যেন মহিষাসুর বধের জন্যে খাঁড়া উচিয়েছেন, কিন্তু আপনার বাহনটি হঠাৎ ভড়কে গিয়ে আপনাকে ফেলে দিল। তাতেই আপনার একটু চোট লেগেছে। নিমাই আর গগনের বউ ধরাধরি করে আপনাকে আমার বাড়িতে এনে শুইয়েছে। ওকি করছেন। খবরদার ওঠবার চেষ্টা করবেন না, চুপ করে শুয়ে থাকুন আপনার মায়ের কাছে লোক গেছে, ডাক্তার নাগকে আনবার জন্যে উলুবেড়েতে মোটর পাঠানো হয়েছে। তাঁরা এখনই এসে পড়বেন
একটু পরে বেতসীর মা এসে পড়লেন। আরও কিছু পরে ডাক্তার নাগ তাঁর ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বেতসীকে পরীক্ষা করে বললেন, হাতে আর কোমরে চোট লেগেছে, ও কিছু নয়, চার-পাঁচ দিনে সেরে যাবে। ডান পায়ের ফিবিউলা ভেঙেছে—সামনের সরু হাড়টা।... হাঁ হাঁ জোড়া লাগবে বইকি। ভয় নেই, খোঁড়া হয়ে যাবেন না, কিছুদিন পরেই আগের মতন হাঁটতে পারবেন।... আরে না না, জয়হরিবাবুর মতন লাঠি নেবার দরকার হবে না। আজ কাঠ দিয়ে বেঁধে দেব, তিন-চার দিন পরে সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এক্স-রে করাব, তার পর প্লাস্টার ব্যাণ্ডেজ লাগাব। দরকার হয় তো একজন নার্স পাঠাতে পারি।
বেতসী নিজের বাড়িতে এলে ডাক্তার তার চিকিৎসার যথোচিত ব্যবস্থা করলেন। বিছানায় শুয়ে সে বিগত ঘটনাবলী ভাবতে লাগল।
নায়েব হরকালী মাইতি বহুদিনের পুরনো লোক। তাঁর স্ত্রী মাইতি-গিন্নী শয্যাগত বেতসীকে রোজ সন্ধ্যাবেলা দেখতে আসেন। বাড়ীর মুখের বাঁধন নেই, কিন্তু তাঁর এলোমেলো কথায় বেতসী চটে না, বরং মজা পায়। পড়ে যাবার দু সপ্তাহ পরে বেতসী অনেকটা ভাল বোধ করছে, বিছানা ছেড়ে ইজিচেয়ারে বসেছে।
মাইতি-গিন্নী তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন—সবই গেরোর ফের দিদিমণি, কপালের লিখন। ভদ্দর লোকের ছেলের ওপর কেনই বা তোমার রাগ হল, কেনই বা মেমসায়েবের মতন ঘোড়সওয়ার হয়ে তাকে মারতে গেলে! তার তো কিছুই হল না, লাভের মধ্যে তুমি ঠ্যাং ভাঙলে।
বেতসী বলল, তুমি দেখো মাইতি-দিদি, আমি সেরে উঠে তাকে চাবুক মেরে জব্দ করি কি না।
—হা রে দিদিমণি, চাবুক মেরে কি বেটাছেলেকে জব্দ করা যার! ওদের একটু একটু করে সইয়ে সইয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারতে হয়, পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কাটতে হয়। বেটাছেলে ঢিট করবার দাবাই হল আলাদা।
—দাবাইটা তুমি জান নাকি?
—ওমা তা জানি না! সাড়ে তিন কুড়ি বয়েস হল, তিন কুড়ি বছর ধরে বুড়ো মাইতির কাঁধে চেপে রইছি। দাবাইটা বলছি শোন। আগে ভুলিয়ে ভালিয়ে বশ করতে হয়, আশকারা দিয়ে যত্ন আত্তি করে মাথাটি খেতে হয়। তার পর যখন খুব পোষ মানবে, তুমি না হলে তার চলবেই না, তখন নাকে দড়ি দিয়ে চরকি ঘোরাবে, নাজেহাল করবে, কড়া কড়া চোপা ছাড়বে, নাকানি চোবানি খাওয়াবে। তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি নেই দিদিমণি, আগেই চাবুক মারতে গিয়েছিলে। তাই তো গাধা ডেকে উঠল, ঘোড়া ভড়কাল, তুমি পড়ে গিয়ে পা ভাঙলে। জরহরিবাবু মানুষটা তো মন্দ নয়, এখানে এসে তোমার খবর নিয়ে যাচ্ছে। দেখতে শুনতে কথাবার্তায় ভালই, তোমারই মতন বিলেত দেখা আছে, সেও খোঁড়া তুমিও খোঁড়া। বাধা তো কিছুই দেখছি না, কিন্তু তোমার মা যে বেঁকে দাঁড়িয়েছেন। বলছেন, অমন মারমুখো খাণ্ডার মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না, কিন্তু তাই বলে জয়হরির মতন পাত্র তো হাতছাড়া করতে পারি না, আমার ভাইঝি বেবির সঙ্গে তার সম্বন্ধের চেষ্টা করব, দাদাকে লিখব বেবিকে যেন এখানে পাঠিয়ে দেন।
মাইতি-গিন্নী চলে যাবার পর বেতসীর মনে নানা রকম ভাবনা ঠেলাঠেলি করতে লাগল। সম্মুখ সমরে তার পরাজয় হয়েছে, সে জখম হয়ে বাড়িতে আটকে আছে। ডাক্তারের মতন মিথ্যাবাদী দুটি নেই, এই সেদিন বলল এক মাস, আবার এখন বলছে তিন মাস। ওদিকে শত্রু হাসছে, তার নেড়ী কুত্তী আর গাধাটাও বোধ হয় হাসছে। জয়হরির আস্পর্ধা কম নয়, এখানে এসে খোঁজ নিয়ে মহত্ব দেখাচ্ছে। বেবিকে বিয়ে করবেন? ইস, করলেই হল। বেতসী শত্রুকে কিছুতেই হাতছাড়া হতে দেবে না, মাইতি-বুড়ীর দাবাই প্রয়োগ করবে। কূট যুদ্ধে শত্রুকে কাবু করে বশে আনাতেও তো বাহাদুরি আছে। জয়হরি গাধাকে জেব্রা বানিয়েছে, বেতসী কি জয়হরিকে ভেড়া বানাতে পারবে না? সারা রাত তার ঘুম হল না, মনের মধ্যে যেন ঝড় বইতে লাগল।
সকালে উঠেই বেতসী আরশিতে নিজের মুখখানা একবার দেখে নিল, তার পর মতি স্থির করে শত্রুর প্রতি তার প্রথম বোমা ছাড়ল, জয়হরিকে দু লাইন চিঠি লিখে পাঠাল—আপনার কুত্তী আর গাধাটাকে ক্ষমা করলুম, আপনাকেও করলুম। আপনিও আমাকে ক্ষমা করতে পারেন।