নীল তারা ইত্যাদি গল্প/তিরি চৌধুরী

তিরি চৌধুরী

রুণাময় দত্তগুপ্ত কৃতী পুরুষ, মুনসেফ থেকে ক্রমে ক্রমে জেলা জজ তার পর হাইকোর্টের জজ হয়েছেন। ইস্টারের বন্ধ, সকাল বেলা বাড়িতে খাস কামরায় বসে তিনি চা খাচ্ছেন আর খবরের কাগজ পড়ছেন এমন সময় একটি মেয়ে এসে তাঁকে প্রণাম করল।

 ষোল-সতরো বছরের সুশ্রী মেয়ে, পরিপাটী সাজ। জস্টিস দত্তগুপ্ত তার দিকে তাকাতে সে বলল, আমার ঠাকুদ্দাকে আপনি চেনেন, সলিসিটার্স চৌধুরী অ্যাণ্ড সন্‌সের প্রিয়নাথ চৌধুরী। আমার নাম তিরি।

 করুণাময় বললেন, ও, তুমি প্রিয়নাথবাবুর নাতনী, আমাদের সোমনাথের মেয়ে? ব’স ওই চেয়ারটায়। তা, তোমার নাম তিরি হল কেন?

 —কি জানেন, আমার মামা অঙ্কের প্রোফেসার, আর আমি হচ্ছি তৃতীয় সন্তান, তাই মামা আমার নাম রেখেছিলেন তৃতীরা। নামটা কটমটে, আমি ছেঁটে দিয়ে তিরি করেছি।

 —তা বেশ করেছ। এখন কি চাই বল তো?

 -আজ্ঞে, আমার ঠাকুমা বড় দুর্ভাবনায় পড়েছেন, একবারে মুষড়ে গেছেন, ভাল করে খাচ্ছেন না, ঘুমুতে পারছেন না। দয়া দয়া করে আপনি তাঁকে বাঁচান।

 —ব্যাপারটা কি? যদি বৈষয়ক কিছু হয় তবে তোমার ঠাকুদ্দা আর বাবাই তো তার ব্যবস্থা করতে পারবেন।

 —বৈষয়িক নয়, হার্দিক।

 —সে আবার কি?

 —হার্টের ব্যাপার।

 —তা হলে হার্ট স্পেশালিষ্ট ডাক্তারকে দেখাও, আমি তো তাঁর কিছুই করতে পারব না।

 —আপনি নিশ্চয় পারবেন সার। আপনি অনুমতি দিন, আজ সন্ধ্যে বেলা ঠাকুমাকে আপনার কাছে নিয়ে আসব।

 —তা না হয় এনো। কিন্তু কি হয়েছে তা তো আগে আমার একটু জানা ধরকার।

 —ব্যাপারটা গোপনীয়, ঠাকুমাই আপনাকে জানাবেন। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না সার, শুধু ঠাকুমাকে আশ্বাস দেবেন যে সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি কানে একটু কম শোনেন। আমি দরকার মতন আপনাকে প্রম ট করব, ফিসফিস করে বাতলে দেব।

 করুণাময় সহাস্যে বললেন, ও, ঠাকুমার ব্যবস্থা তুমি নিজেই করবে, আমি শুধু সাক্ষিগোপাল হয়ে থাকব?

 —আজ্ঞে হাঁ। আমার কথা তো ঠাকুমা গ্রাহ্য করবেন না, আপনার মুখ থেকে শুনলে তাঁর বিশ্বাস হবে। আপনাকে দারুণ শ্রদ্ধা করেন কিনা। ঠাকুমা বলেন, হাইকোর্টের জজরা হচ্ছেন ধর্মের অবতার, হাইকোর্টের দৌলতেই ঠাকুদ্দা আর বাবা করে খাচ্ছেন।

 —বাঃ, ঠাকুমা তো বেশ বলেছেন। তোমার বাবা কি ঠাকুদ্দা আসবেন না?

 —না না না, তাঁরা এলে সব মাটি হবে। হাসবেন না সার, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। ঠাকুমার দুশ্চিন্তা আমার জন্যে নয়, আমার কোনও স্বার্থ নেই।

 —বেশ, আজ সন্ধ্যায় তাঁকে নিয়ে এস।


ন্ধ্যার সময় তিরি তার ঠাকুমাকে নিয়ে করুণাময়ের বাড়িতে উপস্থিত হল। নমস্কার বিনিময়ের পর তিনি বলল, এই ইনি হচ্ছেন আমার ঠাকুমা শ্রীমতী কনকলতা চৌধুরানী, সলিসিটার প্রিয়নাথ চৌধুরীর স্ত্রী। আর ইনি হচ্ছেন মাননীয় মিস্টার জস্টিস শ্রীকরুণাময় দত্তগুপ্ত। ঠাকুমা, ইন ট্রোডিউস করে দিলুম, এখন তুমি মনের কথা খোলসা করে বল।

 কনকলতা ধমকের সুরে বললেন, আমি কেন বলতে যাব লা? বুড়ো মাগী, লজ্জা করে না বুঝি? তোকে এনেছি কি করতে? যা বলবার তুই বল।

 তিরি বলল, বেশ, আমিই বলছি। শুনুন ইওর লর্ডশিপ—

 করুণাময় বললেন, বাড়িতে লর্ডশিপ নয়।

 —আচ্ছা শুনুন সার। আমার ঠাকুদ্দাকে তো দেখেছেন, খুব সুপুরুষ, যদিও পঁচাত্তর পেরিয়েছেন। আর আমার এই ঠাকুমাকেও দেখুন, বেশ সুন্দরী, নয়? যদিও সাতষট্টি বছর বয়সের দরুন একটু তুবড়ে গেছেন, পুরনো ঘটির মতন।

 কনকলতা একটু কালা হলেও নিজের সম্বন্ধে কথা হলে বেশ শুনতে পান। বললেন, আরে গেল যা, ও সব কথা বলতে তোকে কে বলেছে?

 তিরি বলল, এই সবই তো আসল কথা। তার পর শুনুন সার। পঞ্চান্ন বছর আগে, ঠাকুদ্দার বয়স যখন কুড়ি, তখন প্রভাবতী ঘোষ নামে একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ হয়। বারো-তেরো বছরের সুন্দরী মেয়ে, ঠাকুদ্দা তাকে একবার দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু আমার প্রঠাকুদ্দা, অর্থাৎ ঠাকুদ্দার বাবা ছিলেন একটি অর্থগৃধ্র—

 করুণাময় বললেন, অর্থগৃধ্নু?

 —আজ্ঞে না, অর্থগৃধ্র, শকুনির মতন লোলুপ। তিনি পাঁচ হাজার টাকা বরপণ হেঁকে বসলেন। প্রভাবতীর বাবা ছিলেন গরিব ইস্কুল মাষ্টার, কোথায় পাবেন অত টাকা? সম্বন্ধ ভেস্তে গেল। ঠাকুদ্দা মনের দুঃখে দিন কতক হেমচন্দ্র আওড়ালেন—ওরে দুষ্ট দেশাচার কি করিলি অভাগার। তার পর এই কনকলতা ঠাকুমার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হল। তিনি ঠকেন নি, ছ হাজার টাকা বরপণ পেলেন, এক রূপসী হারিয়ে আর এক রূপসী ঘরে আনলেন।

 করুণাময় প্রশ্ন করলেন, সেই আগেকার মেয়েটির কি হল?

 —আমার সেই মাইট-হ্যাভ-বিন ঠাকুমা প্রভাবতীর? তিনি কুমারী হয়েই রইলেন, খুব লেখাপড়া শিখলেন, অনেক জায়গার মাষ্টারি করলেন, আমেরিকায় গিয়ে ডক্টর অভ এডুকেশন ডিগ্রী নিয়ে এলেন, শেষকালে পাতিয়ালা উইমিন্‌স কলেজের প্রিন সিপালও হয়েছিলেন। সম্প্রতি রিটায়ার করে কলকাতায় এসেছেন। তার পর হঠাৎ একদিন সলিসিটার চৌধুরী অ্যাণ্ড সন্‌সের আফিসে উপস্থিত। কি সমাচার? না, আলিপুরে একটা ছোট বাড়ি কিনবেন, তারই দলিল আমার ঠাকুদ্দাকে দেখাতে চান। ঠাকুদ্দা তাঁর পরিচয় পেয়ে খুব খুশী—বুঝতেই পারছেন, পুরাতনী শিখা, ওল্ড ফ্লেম। তার পর প্রভাবতী আমাদের বাড়িতে ঘন ঘন আসতে লাগলেন, আর ঠাকুমা ফোঁস করে জ্বলে উঠলেন, কলেরাপটাশ আর চিনিতে অ্যাসিড ঠেকালে যেমন হয়।

 —সে আবার কি রকম? তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠাই তো শুনেছি।

 —তার চাইতে ভীষণ। জানেন না সার? আমার মেজদা একদিন দেখিয়েছিল। কলেজ থেকে কলেরাপটাশ চুরি করে এনে তার সঙ্গে চিনি মিশিয়ে ন্যাকড়ার পুঁটলিতে বেঁধে তাতে কি একটা আসিড ঠেকাল, অমন ফোঁস করে জ্বলে উঠল।

 —প্রভাবতী দেখতে কেমন?

 —এখনও খুব রূপ।

 কনকলতা চেঁচিয়ে বললেন, শাঁকচুন্নী বাবা, একবারে শাঁকচুন্নী।

 করুণাময় হেসে বললেন, তবে আপনার ভাবনা কিসের?

 —ও জজসায়েব, তা বুঝি জান না? ডাকিনী যোগিনী শাঁকচুন্নীদের বলে কত ছলা কলা, পুরুষকে ভেড়া বানিয়ে দেয়। আর এই তিরির ঠাকুদ্দাটিও বড্ড হাবাগোবা, শুধু কপালগুণেই টাকা রোজগার করে, নইলে বুদ্ধি কি কিছু আছে? ছাই, ছাই। তুমি বুঝিয়ে সুজিয়ে বড়োকে ওই ডাকিনীর হাত থেকে উদ্ধার কর বাবা।

 তিরি ফিসফিস করে বলল, দেখুন, ঠাকুদ্দার কিচ্ছু দোষ নেই, তিনি প্রভাবতীর সঙ্গে শুধু ভদ্র ব্যবহার করেছেন। কিন্তু আমার ঠাকুমাটি হচ্ছেন সেকেলে আর অত্যন্ত হিংসুটে। আপনি এঁকে বলুন— সব ঠিক হয়ে যাবে।

 করুণাময় বললেন, আপনি কিচ্ছু ভাববেন না মা, সব ঠিক হয়ে যাবে।

 তিরি বলল, সাত দিনের মধ্যেই।

 করুণাময় বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, সাত দিনের মধ্যেই আমি সব ঠিক করে দেব।

 তিন্নি বলল, ঠাকুমা, শুনলে তো? এখন বাড়ি চল, রাত্তিরে ভাল করে খেয়ো। কাল আবার আমি এঁর কাছে এসে খবর নেব। এখন তো আপনার কোর্ট বন্ধ, নয় সার? তা হলে কাল সকালে আবার দেখা করব। এখন উঠি।


রদিন সকালে তিরি এলে করুণাময় বললেন, তুমি একটি সাংঘাতিক মেয়ে। তোমার কথায় ঠাকুমাকে তো আশ্বাস দিলাম, কিন্তু তার পর কি করব? কাল সারা রাত আমি ঘুমুতে পারি নি। বড় বড় দেওয়ানী মামলার রায় আমি অক্লেশে দিয়েছি, ফাঁসির হুকুম দিতেও আমার বাধে নি। কিন্তু এরকম তুচ্ছ বেয়াড়া ব্যাপারে কখনও জড়িয়ে পড়ি নি। তোমার ঠাকুদ্দা প্রিয়নাথবাবুকে আমি কি করে বলব—মশায়, আপনার অবুঝ গিন্নী বেচারীকে কষ্ট দেবেন না, প্রভাবতীকে হাঁকিয়ে দিন?

 তিরি বলল, আপনাকে কিছুই করতে হবে না সার, শুধু সাক্ষী হয়ে থাকবেন। কাল আপনাকে এক তরফের ইতিহাস বলেছি, আজ অন্য তরফের ব্যাপারটা শুনুন।

 —অন্য তরফ আবার কে? তোমার ঠাকুমা নাকি?

 —আজ্ঞে হাঁ। আমি বিস্তর রিসার্চ করে যা আবিষ্কার করেছি তাই বলছি শুনুন। ঠাকুদ্দা প্রিয়নাথের সঙ্গে বিয়ে হবার আগে ঠাকুমা কনকলতার একটি খুব ভাল সম্বন্ধ এসেছিল, বাগবাজারের হারু মিত্তিরের ছেলে গৌরগোপাল মিত্তির, এখন যিনি অল্ডারম্যান হয়েছেন। আমার ঠাকুদ্দা সুপুরুষ বটে, কিন্তু গৌরগোপাল হচ্ছেন সুপার-সপুরুষ, মূর্তিমান কন্দর্প। তাঁর বয়স যখন ঊনিশ-কুড়ি তখন ঠাকুমাকে একবার লুকিয়ে দেখেছিলেন এবং তৎক্ষণাৎ সেই বারো বছরের নোলক-পরা বোধোদয়-পড়া খুকীর প্রেমে পড়েছিলেন। তখন ওইরকমই রেওয়াজ ছিল কিনা। তাঁর বাবা হারু মিত্তিরও মেয়েটিকে পছন্দ করলেন আর ছ হাজার টাকা পণে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজী হলেন। সব ঠিক, এমন সময় গৌরগোপালের আর এক সম্বন্ধ এল বউবাজারের বিপিন দত্তর মেয়ে, একমাত্র সন্তান, অগাধ বিষয়, সব সেই মেয়ে পাবে। হারু মিত্তির বিগড়ে গেলেন। আমার প্রপিতামহ ছিলেন অর্থগৃধ্র, কিন্তু হারু মিত্তির একবারে দুকান-কাটা চশমখোর চামচিকে, চামার পয়সা-পিশাচ। আমার ঠাকুমা কনকলতাকে তিনি নাকচ করে দিলেন, সম্পত্তির লোভে বিপিন দত্তর সেই বিশ্রী মেয়েটার সঙ্গে ছেলের বিয়ে স্থির করলেন। ছেলে গৌরগোপাল রামচন্দ্রের মতন সুবোধ, এখনকার তরুণদের মতন একগুঁয়ে নয়। কনকলতার বিরহে তিনিও দিনকতক হেমচন্দ আওড়ালেন—আবার গগনে কেন সুধাংশু উদয় রে। তার পর শুভদিনে ভেলভেটের ভাড়াটে ইজের-চাপকান পরে সঙ সেজে তক্তনামায় চড়ে অ্যাসিটিলীন জ্বালিয়ে ব্যাণ্ড বাজিরে সেই অগাধ বিষয়ের উত্তরাধিকারিণী কুৎসিত মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেললেন। তার কিছু দিন পরেই ঠাকুমার সঙ্গে ঠাকুদ্দার বিয়ে হল।

 করুণাময় বললেন, খাসা ইতিহাস। এখন করতে চাও কি?

 —আজ বিকেলে সেই গৌরগোপালবাবুর সঙ্গে দেখা করব, তার পর কর্তব্য স্থির করে আপনাকে জানাব। আজকের মতন উঠি সার।


গৌরগোপাল মিত্র বিকাল বেলা তাঁর প্রকাণ্ড বৈঠকখানা ঘরে প্রকাণ্ড ফরাসে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে গড়গড়া টানছেন আর চৈতন্যভাগবত পড়ছেন এমন সময় তিরি এসে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে পায়ের ধূলো নিল।

 গৌরগোপাল বললেন, তুমি কে দিদি? চিনতে পারছি না তো।

 —আজ্ঞে, আমার নাম তিরি।

 —তিরি কেন? টেক্কা কি বিবি হলেই তো মানাত।

 —আমি মা-বাপের তৃতীয় সন্তান কিনা, তাই তিরি নাম। আমার ঠাকুদ্দার নাম শুনেছেন বোধ হয়—সলিসিটার প্রিয়নাথ চৌধুরী, আপনারই সমবয়সী হবেন।

 —ও, তুমি প্রিয়নাথ চৌধুরীর নাতনী? তাঁর সঙ্গে মৌখিক আলাপ নেই, তবে বছর চার আগে একটা মকদ্দমায় তিনি আমার বিপক্ষের অ্যাটর্নি ছিলেন। খুব ঝানু লোক।

 —সে মকম্পমার আপনি জিতেছিলেন?

 —না দিদি, হেরে গিয়েছিলুম, লাখ দুই টাকা লোকসান হয়েছিল।

 —তবেই তো মুশকিল। হেরে গিয়েছিলেন তার জন্যে প্রিয়নাথ চৌধরীর নাতনীর ওপর তো আপনার রাগ হবার কথা।

 —আরে না না, তোমার ওপর রাগ করে কার সাধ্য! এখন বল তো, কি দরকার।

 তিরি মাথা নীচু করে হাত কচলাতে কচলাতে বলল, দেখুন, আপনার সঙ্গে আমার একটা নিগূঢ় সম্পর্ক আছে, আপনি হচ্ছেন আমার হতে-হতে-ফসকে-যাওয়া ঠাকুদ্দা।

 গৌরগোপাল বললেন, বুঝতে পারলুম না দিদি, খোলসা করে বল।

 —পঞ্চান্ন বছর আগেকার কথা স্মরণ করুন দাদু। কনকলতা বলে একটি মেয়ে ছিল, তাকে মনে পড়ে?

 —কনকলতা? সে আবার কে?

 তিরি বলল, সেকি দাদু এর মধ্যেই মন থেকে মুছে ফেলেছেন? হায় রে হৃদয়, তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়! বারো বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে, একবার দেখেই তাকে আপনি ভীষণ ভালবেসেছিলেন। তার সঙ্গে আপনার বিয়ের সম্বন্ধও স্থির হয়েছিল, কিন্তু শেষটায় আপনার বাবা ভেস্তে দিলেন। কিচ্ছু মনে পড়ছে না?

 — হাঁ হাঁ এখন মনে পড়েছে, নামটা কনকলতাই বটে। ওঃ, সে তো মান্ধাতার আমলের কথা, লর্ড এলগিন কি কর্জনের সময়। তা কনকলতার কি হয়েছে?

 —তিনিই আমার ঠাকুমা। ঠাওর করে দেখুন তো, পঞ্চান্ন বছর আগে দেখা সেই মেয়েটির সঙ্গে আমার চেহারার কিছু মিল পান কিনা। আপনি যদি অত পিতৃভক্ত না হতেন, একটু জেদ করতেন, তবে সেই কনকলতার সঙ্গেই আপনার বিয়ে হত আপনিই আমার ঠাকুদ্দা হতেন।

 —ওঃ, কি চমৎকার হত! আমার কপাল মন্দ তাই তোমার ঠাকুদ্দা হতে পারি নি। কিন্তু এখনই বা হতে বাধা কি? আমার তিন তিনটে নাতি আছে, অবশ্য তোমার মতন সুন্দর নয়। তাদের একটাকে বিয়ে করে ফেল না? ডাকব তাদের?

 —এখন থাক দাদু। আমি বি.এ পাস করব, এম.এ পাস করর, বিলেত যাব, তার পর সংসারের চিন্তা। শেকস্পীয়ার পড়েছেন তো? আমি এখন ইন মেডেন মেডিটেশন ফ্যান্সি ফ্রী। ছ বছর পরে যদি আপনার কোনও নাতি আইবুড়ো থাকে তো আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবেন।

 —জো হুকুম তিরি দেবী চৌধুরানী। কি দরকারে এসেছ তা তো বললে না?

 —সেই ছোট্ট কনকলতা মেয়েটি এখন কত বড়টি হয়েছে দেখতে আপনার ইচ্ছে হয় না দাদু?

 —এত দিন তো তার কথা মনেই ছিল না, তবে আজ তোমাকে দেখে তোমার ঠাকুমাকেও দেখবার একটু ইচ্ছে হচ্ছে বটে। কি লেখাই হেম বাঁড়জ্যে লিখে গেছেন— ছিন্ন তুষারের ন্যায় বাল্যবাঞ্ছা দূরে যায় তাপদগ্ধ জীবনের ঝঞ্ঝাবায়ু প্রহারে! কিন্তু তোমার ঠাকুমা তো আমাকে চিনবেন না। আমি তাঁকে লুকিয়ে দেখেছিলুম বটে, কিন্তু তিনি আমাকে কখনও দেখেন নি।

 —নাই বা দেখলেন। শুনুন দাদু— আসছে শনিবার আমার জন্মদিন, আপনাকে আমাদের বাড়ি আসতেই হবে, এখানকার ঠাকুমাকেও নিয়ে যাবেন। তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করে যেতে চাই।

 —দেখা তো হবে না দিদি। তিনি এখানে নেই, দু বছর হল স্বর্গে গেছেন। সেখানে তাঁর অনেক কাজ ঘর দোর জিনিসপত্র পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখবেন, চাকরদের তো বিশ্বাস করেন না, হলই বা স্বর্গের চাকর। আমি সেখানে গিয়েই যাতে চটি জুতো, ফুলেল তেল, নাইবার গরম জল, সরু চালের ভাত, মাগুর মাছের ঝোল, চিনিপাতা দই, পানছেঁচা আর তৈরী তামাক পাই তার ব্যবস্থা করে রাখবেন।

 —সতী লক্ষী স্বর্গে গিয়েও ধান ভানবেন। তবে কি আর হবে, আপনি একাই আসবেন, আমি কাল নিমন্ত্রণের কার্ড পাঠিয়ে দেব।

 তিরি প্রণাম করে বিদায় নিল, তার পর জস্টিস করুণাময় দত্তগুপ্ত আর ডক্টর প্রভাবতী ঘোষের সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরল।


তিরির বিস্তর বন্ধু ইরা ধীরা মীরা ঝুনু বেণু রেণু উল্লোলা কল্লোলা হিল্লোলা প্রভৃতি একটি দঙ্গল। তিরি তাদের বলেছে, জানিস, আমি ঠিক রাত বারোটায় জন্মেছিলুম, একবারে জিরো আওয়ার। কাজেই কোন্‌টা জন্মদিন, আগেরটা কি পরেরটা তা বলা যায় না। এখন থেকে দুটো জন্মদিন ধরব। আসছে শনিবার বিকেলে শুধু বড়ো বুড়ীরা চা খেতে আসবে। রবিবারে তোরা সবাই আসবি হুল্লোড় করবি, গাণ্ডে পিণ্ডে গলবি। বুঝেছিস? বন্ধুরা সমস্ববে জবাব দিয়েছে— আসিব সখী নিশ্চয় আসি-ই-ই-ব।

 শনিবার বিকালে প্রিয়নাথ চৌধরীর বাড়িতে জস্টিস করুণাময় দত্তগুপ্ত, অল্ডারম্যান গৌরগোপাল মিত্র, আর ডক্টর ঘোষ নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছেন। বাইরের লোক আর কেউ নেই। বাড়ির লোক আছেন তিরির ঠাকুদ্দা ঠাকুমা বাবা মা আর স্বয়ং তিরি।

 মাননীয় অতিথিদের সংবর্ধনা, সকলের সঙ্গে পরিচয়, আর উপহারের জন্য প্রশংসা শেষ হলে করুণাময়কে তিরি চুপিচুপি বলল, এইবারে আপনার ভাষণটি বলুন সার।

 করুণাময় বললেন, কল্যাণীয়া তিরির জন্মদিন উপলক্ষ্যে এই যে আমরা এখানে মিলিত হয়েছি, এটি একটি সামান্য পার্টি নয়, বিধাতার বিধানে যা ঘটে তা মাথা পেতে মেনে নেওয়া ছাড়া মানুষের গত্যন্তর নেই, কিন্তু কেউ কেউ ভবিতব্যকে অন্য রকম কল্পনা করতে ভালবাসে। এই ধরুন—দশরথ যদি স্ত্রৈণ না হতেন, গোসাঘরে ঢুকে কৈকেয়ীকে একটি চড় লাগাতেন, তবে রামায়ণ অন্য রকমে লেখা হত। শান্তনু যদি বুড়ো বয়সে এক মেছুনীর প্রেমে না পড়তেন তবে ভীষ্মই কুরুরাজ হতেন, কুরু ক্ষেত্রের যুদ্ধও হয়তো হত না। অষ্টম এডোআর্ড যদি একগুঁয়ে না হতেন, প্রাইম মিনিস্টার আর আর্চবিশপদের ফরমাশ অনুসারে বিবাহ করতেন তবে তাঁকে সিংহাসন ছাড়তে হত না। আমাদের এই তিরি মেয়েটি বিধাতার সঙ্গে ঝগড়া করে না, কিন্তু তাঁর বিধানের সঙ্গে আরও কিছু জুড়ে দিয়ে আত্মীয়ের গণ্ডি বাড়াতে চায়। সেজন্যে সে তার হলেও-হতে পারতেন ঠাকুদ্দা আর ঠাকুমাকে এখানে ধরে এনেছে। তিরির আসল ঠাকুদ্দা আর ঠাকুমা তো বাড়িতেই আছেন, তার বিকল্পিত ঠাকুদ্দা শ্রদ্ধেয় অল্ডারম্যান গৌরগোপালবাবু আর বিকল্পিতা ঠাকুমা শ্রদ্ধেয়া ডক্টর প্রভাবতী ঘোষও দয়া করে এখানে এসেছেন। প্রিয়জনের এই সমাগমে তিরি যেমন ধন্য হয়েছে আমরাও তেমনি আনন্দলাভ করেছি।

 কনকলতা তিরিকে জনান্তিকে বললেন, ওই বুড়ো আর বুড়ীটাকে এখানে কে আনলে রে?

 তিরি বলল, গৌরগোপাল আর প্রভাবতী? আমি তো জানিনা, জস্টিস দত্তগুপ্ত হয়তো বাবাকে বলে থাকবেন। ঠাকুমা, তোমার ওই ফসকে-যাওয়া বর গৌরগোপালবাবু কি সুন্দর দেখতে। আহা, ওঁর সঙ্গে তোমার যদি বিয়ে হত তা হলে বাবার রং আরও ফরস। হত, আর আমারও রূপ উথলে উঠত, একবারে ঢলঢল কাঁচা অঙ্গেরি লাবনি!

 কনকলতা বললেন দূর হ মুখপড়ী, তোর মুখের বাঁধন কি একটুও নেই?

 —কিন্তু ভাগ্যিস প্রভাবতীর সঙ্গে ঠাকুদ্দার বিয়ে হয় নি, তা হলে আমার মুখটা চীনে প্যাটার্ন হত। ঠাকুমা, তোমারই জিত। পঞ্চান্ন বছর আগে ওই প্রভাবতীর একটা বর হাতছাড়া হয়েছিল, কিন্তু এত পাস করেও উনি এ পর্যন্ত আর একটা বর জোটাতে পারলেন না, অথচ তুমি একমাসের মধ্যেই জুটিরেছিলে, যদিও বিদ্যে বোধোদয় পর্যন্ত। তুমি কিন্তু ওই গৌরগোপালবাবুর দিকে অমন করে আড়চোখে তাকিও না বাপু ঠাকুদ্দা মনে করবেন কি?

 কনকলতা রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, কই আবার তাকাচ্চি? কি বজ্জাত মেয়ে তুই! ও মাস্টার-দিদি প্রভা, এই তিরিটাকেে বেত মেরে সিধে করতে পার না? জ্বালিয়ে মারল আমাকে।

 প্রভাবতী বললেন, তিরি, ঠাকুমাকে জ্বালিও না, এস আমার কাছে।

 প্রভাবতী আর গৌরগোপাল পাশাপাশি বসে ছিলেন। চেয়ার টেনে নিয়ে তাঁদের কাছে বসে পড়ে তিরি বলল, জ্বালাবার দরকার হবে না, ঠাকুমা ঠাণ্ডা হয়ে গেছেন। কিন্তু আসল কাজ যে এখনও বাকী রয়েছে। আপনারা কিছু মনে করবেন না, আমি একটু স্বগতোক্তি করছি, যাকে বলে সলিলোকি। প্রিয়নাথের সঙ্গে প্রভারতীয় বিয়ে হতে হতে হল না। আচ্ছা, তা না হয় না হল। গৌরগোপালের সঙ্গেও কনকলতার বিয়ে হতে হতে হল না। তাও না হয় না হল। কিন্তু প্রজাপতির নির্বন্ধে শেষটায় প্রিয়নাথের সঙ্গে কনকলতার বিয়ে হয়ে গেল। এই পরিস্থিতিতে চিরকুমারী প্রভাবতী আর নবকুমার গৌরগোপালের কি করা উচিত? বিধাতার ইঙ্গিত কি?

 প্রভাবতী বললেন, বিধাতার ইঙ্গিত—তোমাকে আচ্ছা করে বেত লাগানো দরকার।

 গৌরগোপাল বললেন, আমার বাড়িতে পালিয়ে চল দিদি, কেউ বেত লাগাবে না।

 তিরি বলল, হায় হায়, দেওয়ালের লেখা আপনাদের নজরে পড়ছে না? প্রজাপতির নির্বন্ধ বুঝতে পারছেন না? আপনাদের মনে কিছুমাত্র রোমান্স নেই, দুজনে মনে প্রাণে বুড়িয়ে গেছেন, বাহ্যাভ্যন্তরে শক্ত পাথর হয়ে গেছেন, একেবারে পাকুড় স্টোন। ভাগ্যিস আপনাদের সঙ্গে ঠাকুদ্দা আর ঠাকুমার বিয়ে ভেস্তে গিয়েছিল, নয়তো আমার বুড়ো ঠাকুদ্দাকে বেত খেতে হত, আর বড় ঠাকুমাকে বাঁদী হয়ে জন্ম জন্ম পান ছেঁচতে হত।

 কনকলতা করুণাময়কে বললেন, হ্যাঁগা জজসাহেব, তিরি হাত নেড়ে ওদের কি বলছে?

 —বোধ হয় ধমক দিচ্ছে।

 —ছি ছি, মেয়েটার আক্কেল মোটে নেই, ভদ্রজন বাড়িতে এসেছে, তাদের ওপর তম্বি! ওর ঠাকুদ্দা আশকারা দিয়ে মাথাটি খেয়েছে। তুমি ওকে খুব করে বকুনি দিও বাবা, বাড়ির লোককে তো গ্রাহ্যি করে না।

১৩৬১