নেতাজীর জীবনী ও বাণী/কেন আমি বাঙ্গালা ত্যাগ করিলাম

কেন আমি বাঙ্গলা ত্যাগ করিলাম?

[১৯৪৩ সালের ৯ জুলাই]

সিঙ্গাপুরের বক্তৃতার অংশ:—

 .........আমার বহুমুখী অভিজ্ঞতা দ্বারা বিচার করিয়া আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, ভারতবর্ষের মধ্য হইতে আমরা যত তীব্র আন্দোলনই করি না কেন তাহা আমাদের দেশকে ব্রিটিশ প্রভুত্ব হইতে মুক্ত করিবার পক্ষে যথেষ্ট হইবে না। যদি কেবল ভারতবর্ষের মধ্যকার সংগ্রামই স্বাধীনতা লাভের পক্ষে যথেষ্ট হইত, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই নির্ব্বোধের ন্যায় বিনা প্রয়োজনে এই বিপদের ঝুঁকি লইতাম না। আমার ভারত ত্যাগ করিবার উদ্দেশ্য, ভারতবর্ষের মধ্যে যে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলিতেছে বাহির হইতে তাহাকে সাহায্য করা। প্রকৃতপক্ষে বহিঃসাহায্য ব্যতীত কাহারই পক্ষে ভারতকে স্বাধীন করা সম্ভব নয়। কিন্তু দেশের আভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা সংগ্রামে বহিঃসাহায্য অবিলম্বে প্রয়োজন, তাহার পরিমাণ প্রকৃতপক্ষে একান্ত অল্প। কারণ চক্রশক্তির আঘাতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের দৃঢ় আসন টলায়মান হইয়া পড়িয়াছে; ফলে আমাদের উদ্দেশ্য পূর্ব্বাপেক্ষা অনেক সহজেই সাফল্যমণ্ডিত হইবে। প্রথমতঃ আমাদের দেশবাসীর অন্তরে এই বিশ্বাস জন্মাইয়া দিতে হইবে যে, একদিন তাহারা স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভ করিবেই। দ্বিতীয়ত, ভারতের বাহির হইতে তাহাদের সামরিক সাহায্য প্রদান করিতে হইবে। প্রথম উদ্দেশ্য সাধন করিতে হইলে আন্তর্জাতিক যুদ্ধের পরিস্থিতি বুঝিতে হইবে এবং তাহা হইতেই যুদ্ধের ফলাফল জানা যাইবে। দ্বিতীয় কাজ করিতে হইলে ভারতের বাহিরের ভারতীয়রা তাহাদের স্বদেশবাসীদিগকে কিভাবে সাহায্য করিতে পারে এবং প্রয়োজন হইলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শত্রুদের কাছ হইতেও কি সাহায্য লাভ করা সম্ভব, তাহা জানিতে হইবে। বন্ধুগণ! আমি এখন আপনাদিগকে বলিতে পারি যে, এই উভয় উদ্দেশ্যই পূর্ণ হইবে। বিদেশে ঘুরিয়া আমি সমস্ত অবস্থা দেখিয়াছি এবং যুদ্ধরত শক্তিগুলির অবস্থা জানিয়াছি। ইঙ্গমার্কিণ সাম্রাজ্যবাদ পরাজিত হইবে—ইহা বুঝিয়াই তাহা দেশে আমার স্বদেশবাসীদিগকে জানাইয়াছি। এক্সিস শক্তিরাও ভারত স্বাধীনতা লাভ করুক ইহা চাহে এবং যদি ভারতীয় জনগণ আবশ্যক বোধ করে, তবে তাহারা তাহাদের শক্তি অনুযায়ী সাহায্য করিতে প্রস্তুতও আছে। বিদেশে ভারতীয় এমন কোন নরনারী নাই, যিনি ভারতের স্বাধীনতা চাহেন না এবং জাতীয় সংগ্রামে সাহায্য করিতে প্রস্তুত নহেন। প্রচুর প্রমাণ সহ আমি বলিতে পারি যে, আমাদের দেশবাসীদের অদ্যকার এই পৃথিবীতে এক্সিস শক্তিই আমাদের বন্ধু। আমার দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে আমি কিছু করিতে পারি—একথা আমার শত্রুরাও বলিবে না। যদি ব্রিটিশ সরকার আমার নৈতিক শক্তি নষ্ট করিতে না পারিয়া থাকে অথবা আমাকে প্রতারিত বা প্রলুব্ধ করিতে সমর্থ না হয়, তবে পৃথিবীর কোন শক্তি আমাকে প্রতারিত করিতে পারিবে না। সুতরাং আমাকে বিশ্বাস করুন স্বাধীনতা সংগ্রামে যদি বাহিরের সাহায্য আপনারা চাহেন, তবে এক্সিস শক্তির সাহায্য আপনারা পাইবেন।

 যদি বাহিরের সাহায্য ব্যতীতই আপনাদের চলে, তবে তাহা ভারতের পক্ষে সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা। ব্রিটিশ সরকার যদি পৃথিবীর এমন কি দাসত্ব শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত, দরিদ্র, নিপীড়িত ভারতের জনগণের নিকটও ভিক্ষার ঝুলি লইয়া বাহির হইতে পারে, তবে বাহিরের নিকট হইতে সাহায্য লইতে যদি আমরা বাধ্য হই, তবে তাহা অন্যায় হইবে না।

 পূর্ব্ব এশিয়ার ভারতীয়রা ভারতে ব্রিটিশ সৈন্য বাহিনীকে আক্রমণ করিবার জন্য এক শক্তিশালী সৈন্য বাহিনী গঠন করিতেছে। যখন আমরা তাহাদিগকে আক্রমণ করিব, তখন আমাদের দেশে জনগণের মধ্যেই শুধু বিপ্লব হইবে না, তখন ব্রিটিশ পতাকাতলে সমবেত ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মধ্যেও বিপ্লবের বহ্ণি জ্বলিয়া উঠিবে। যখন ব্রিটিশ সরকার এইভাবে দুইদিক অর্থাৎ ভিতর ও বাহির হইতে আক্রান্ত হইবে, তখন উহ ভাঙ্গিয়া পড়িবে এবং ভারতের জনগণ পুনরায় স্বাধীনতা ফিরিয়া পাইবে। ভারত সম্পর্কে এক্সিস শক্তির মনোভাব লইয়া মাথা ঘামাইবার কোন প্রয়োজন নাই। যদি বিদেশে ভারতীয়গণ এবং দেশে জনগণ তাহাদের কর্ত্তব্য পালন করে, তবে ব্রিটিশকে ভারত হইতে তাড়াইয়া দেওয়া ভারতীয় জনগণের পক্ষে সম্ভব হইবে এবং তাহাদের ৩৮ কোটি ৮০ লক্ষ দেশবাসীকে মুক্ত করা সম্ভব হইবে।

 একজাতীয় জীব আছে, যাহারা বলিবে ৩৮ কোটি ৮০ লক্ষ লোক যদি বৃটিশ শক্তিকে ভারত হইতে তাড়াইতে না পারে, তবে ত্রিশ লক্ষ ভারতীয় কি ভাবে তাহাদিগকে তাড়াইতে পারিবে? বন্ধুগণ, আয়ার্ল্যাণ্ডের ইতিহাস দেখুন, যদি ত্রিশ লক্ষ আইরিশ বৃটিশের শৃঙ্খলে সামরিক আইনের আওতায় পাচ সহস্র সিনফিন স্বেচ্ছাসেবকের সাহায্যে ১৯২১ সালে বৃটিশ গবর্ণমেণ্টকে নতজানু হইতে বাধ্য করিতে পারে, তবে স্বদেশে শক্তিশালী আন্দোলনে সচেতন জাতির শুভেচ্ছায় পুষ্ট ত্রিশ লক্ষ ভারতীয় কেন ভারত হইতে বৃটিশকে তাড়াইতে পারিবে না?

 বন্ধুগণ! পূর্ব্ব এশিয়ার ত্রিশ লক্ষ ভারতীয়ের অর্থ ও জনশক্তি দিয়া তাহাদের সমুদয় শক্তির সমাবেশ করিবার সময় আসিয়াছে। ভাসা ভাসা ব্যবস্থায় কিছুই হবে না; আমি সমুদয় শক্তির সমাবেশ চাই। ইহার কমে চলিবে না, কারণ আমাদের শত্রুরাও বলিতেছে যে, ইহা সামগ্রিক যুদ্ধ। সামগ্রিক যুদ্ধের জন্য সামগ্রিক সমাবেশ দরকার। আমি তিন লক্ষ সৈন্য ও তিন কোটী ডলার চাই, ভারতীয় নারীদের একটা দল গঠন করিতে চাই। ভারতের ভিতরে সামগ্রিক সমাবেশের ব্যবস্থা করুন! আমি দ্বিতীয় রণাঙ্গণের প্রতিশ্রুতি দিতেছি।