নেতাজীর জীবনী ও বাণী/চরিত্র গঠন ও মানসিক উন্নতি
নেতাজীর বাণী।
পত্রাবলীর মর্মাংশ।
ক
চরিত্র গঠন ও মানসিক উন্নতি
নেতাজী নিজে পূতচরিত্রের লোক। তিনি মর্ম্মে মর্ম্মে অনুভব করিয়াছিলেন যে, কর্ম্মীগণ চরিত্রবান খাঁটি মানুষ না হলে দেশ কখনও স্বাধীন হবে না। মেকি স্বার্থপর, দুর্ব্বলচিত্ত মানুষ দ্বারা দেশোদ্ধার হয় না। তাই তিনি যুবকদের এ কর্ম্মীদের চরিত্র গঠনের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেন। চরিত্র গঠন বিষয়ে মান্দালর জেল হইতে একজন কর্ম্মীকে লিখিত পত্রাবলীর কিয়দংশ উদ্ধত করা হইল। যুবকণের চরিত্র গঠনে এই বাণীর বিশেষ উপকারিতা আছে।
১
......"শুধু কাজের দ্বার। মানুষের আত্মবিকাশ সম্ভবপর নয়। কাজের মধ্য দিয়া যেমন বাহিরের উশৃঙ্খলতা নষ্ট হইয়া যায় লেখাপড়া ও ধ্যান ধারণার দ্বারা internal discipline বা ভিতরের, সংযম প্রতিষ্ঠিত হয়। নিয়মিত ব্যায়াম করিলে শরীরের উন্নতি হয় এবং নিয়মিত সাধন করিলে সদ্বৃত্তির অনুশীলন ও রিপুর ধ্বংস হইয়া থাকে। সাধনার উদ্দেশ্য দুইটি— ১) রিপুর ধ্বংস এবং প্রধানতঃ কাম, ভয় ও স্বার্থপরতা জয় করা; (২) ভালবাসা, প্রেম, ভক্তি, ত্যাগ, বুদ্ধি প্রভৃতি গুণের বিকাশ সাধন করা।
কাম জয়ের প্রধান উপায় সকল স্ত্রীলোকের মধ্যে মাতৃরূপ দেখা ও মাতৃভাব আরোপ করা এবং স্ত্রীমূর্ত্তিতে। যেমন দুর্গা, কালী) ভগবানের চিন্তা করা। স্ত্রীমূর্ত্তিতে ভগবানকে বা গুরুর চিন্তা করিলে মানুষ ক্রমশঃ সকল স্ত্রীলোকের মধ্যে ভগবানকে দেখিতে শিখে; সে অবস্থায় পৌঁছিলে মানুষ নিষ্কাম হইয়া যায়। ব্যবহারিক জীবনে সকল স্ত্রীলোককে “মা” বলিয়া ভাবিতে ভাবিতে মন ক্রমশঃ পবিত্র ও শুদ্ধ হয়।
ভক্তি ও প্রেমের দ্বারা মানুষ নিঃস্বার্থ হইয়া পড়ে। মানুষের মন ব্যক্তি বা আদর্শের প্রতি যেমন ভালবাসা বা ভক্তি বাড়ে তেমন স্বার্থপরতাও কমে। ...ভালবাসিতে বাসিতে মনটা ক্রমশঃ সঙ্কীর্ণতা ছাড়াইয়া বিশ্বের মধ্যে লীন হইতে পারে।....মানুষ যাহা চিন্তা করে ঠিক সেইরূপ সে হইয়া পড়ে। “যাদৃশী ভাবনা সস্য সিদ্ধিভবতি তাদৃশী”॥ নিজেকে “দুর্ব্বল ও পাপী” ভাবিলে মানুষ দুর্ব্বল ও ও পাপী এবং “শক্তিমান ও পবিত্র” ভাবিলে মানুষ শক্তিমান ও পবিত্র হইয়া উঠে।
ভয় জয় করার উপায় শক্তিসাধনা। দুর্গা, কালী প্রভৃতি মূর্ত্তি শক্তির রূপ বিশেষ। ইহাদের নিকট শক্তি প্রার্থনা করিলে এবং তাঁহাদের চরণে মনের দুর্ব্বলতা ও মলিনতা বলিস্বরূপ প্রদান করিলে মানুষ শক্তিলাভ করে। আমাদের মধ্যে অনন্ত শক্তি নিহিত আছে সেই শক্তির বোধন করিতে হইবে। পূজার উদ্দেশ্য মনের শক্তির বোধন করা। প্রত্যহ পঞ্চেন্দ্রিয় ও সকল রিপুকে তাঁহার চরণে নিবেদন করিবে। পঞ্চপ্রদীপ অর্থ পঞ্চেন্দ্রিয়। ......বলির অর্থ রিপু বলি —কারণ ছাগই কামের রূপবিশেষ। সাধনার কাজ একদিকে রিপু ধ্বংস করা, অপরদিকে সদ্বৃত্তির অনুশীলন করা। রিপুর ধ্বংস হইলেই দিব্যভাবের দ্বারা হৃদয় পুর্ণ হইয়া উঠিবে। আর দিব্যভাব হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করিলেই সকল দুর্ব্বলতা পলায়ন করে। প্রত্যহ দুইবেলা ধ্যান করিবে। কিছুদিন ধ্যান করার সঙ্গে সঙ্গে শক্তি পাইবে, শান্তিও হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিবে।
২
স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য প্রত্যহ কিছু ব্যায়াম চর্চা করিবে। Muller এর “My System” যোগাড় করে এই ব্যায়াম কর। আমি নিজে Muller এর systemএ ব্যায়াম করে থাকি এবং উপকারও পেয়েছি। ছাত্রসমাজে মূলারের ব্যায়ামের বেশী প্রচলন করিলে খুব উপকার হয়।
মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম্মের যে উদ্দেশ্য বা আদর্শ অর্থাৎ আত্মবিকাশ সাধন সে কথা ভুলিলে চলিবে না। কাজই চরম উদ্দেশ্য নয়; কাজের ভিতর দিয়ে চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হবে এবং জীবনের সর্ব্বাঙ্গীন বিকাশ সাধন করিতে হবে। মানুষকে ব্যক্তিত্ব ও প্রবৃত্তি অনুসারে বৈশিষ্ট লাভ করিতে হবে এবং এই বৈশিষ্টের মূলে একটি সর্ব্বাঙ্গীন বিকাশ চাই। যে ব্যক্তির সর্ব্বাঙ্গীন উন্নতি হয় নাই তার অন্তরে সুখ নাই। সর্ব্বাঙ্গীন বিকাশের জন্য চাই:—(১) ব্যায়াম চর্চা (২) নিয়মিত পাঠ (৩) দৈনিক চিন্তা বা ধ্যান।......... নিয়মিত ভাবে প্রত্যহ পনর মিনিট করে নির্জ্জনে চিন্তা বা ধ্যান করিবে, একঘণ্টা সদ্গ্রন্থ পাঠ করিবে। প্রত্যেককে নিজের সুবিধা অনুসারে এই সময় করে নিতে হবে। বইগুলির নাম দিচ্ছি:—[ ক ]
ধর্ম্মসম্বন্ধীয়
(১) ‘শ্রীশ্রীকথামৃত’ (২) ‘ব্রহ্মচর্য্য’—সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য, (ঐ) রমেশ চক্রবর্ত্তী, ঐ ফকির চন্দ্র দে, (৩) ‘স্বামীশিষ্য-সংবাদ’ (৪) ‘পত্রাবলী’—বিবেকানন্দ, (৫) ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’—বিবেকানন্দ, (৬) ‘বক্তৃতাবলী’—বিবেকানন্দ, (৭) ‘ভাববার কথা’—বিবেকানন্দ, (৮) ‘ভারতের সাধনা’ —স্বামী প্রজ্ঞানন্দ, (৯) ‘চিকাগো বক্তৃতা’—স্বামী বিবেকানন্দ।
[ খ ]
সাহিত্য, কবিতা, ইতিহাস প্রভৃতি
। ১। “দেশবন্ধু গ্রন্থাবলী” (২) ‘বাঙ্গলার রূপ’—গিরিজা শঙ্কর রায় চৌধুরী (৩) বঙ্কিম গ্রন্থাবলী (৪) নবীন সেনের ‘কুরুক্ষেত্র’, ‘প্রভাস’, ‘রৈবতক’, ‘পলাশীযুদ্ধ’, (৫) রবীঠাকুরের ‘কথা ও কাহিনী’ ‘গীতাঞ্জলী’, ‘চয়নিকা’, ‘ঘরে বাহিরে’ ‘গোরা’; (৬) ভূদেব বাবুর ‘সামাজিক প্রবন্ধ’, ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ (৭) ভি, এল, রায়ের ‘দুর্গাদাস’, ‘মেবার পতন’, ‘রাণাপ্রতাপ’ (৮) ‘ছত্রপতি শিবাজি’ সত্য চরণ শাস্ত্রী, (৯) শিখের বলিদান (১০) রাজনারায়ণ বসুর ‘সেকাল একাল’ (১১) ‘রাজস্থান’ (১২) ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’ (১৩) ‘নব্য জাপান’ (১৪) ‘নির্ব্বাসিতের আত্মকথা’।