নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ/ঝড়ের পর

ঝড়ের পর

 একথা স্বীকার করতে হবে আজাদ-হিন্দ-ফৌজ চূড়ান্ত জয়লাভে সক্ষম হয় নি। শেষ পর্যন্ত অধিকতর শক্তিশালী মিত্রশক্তি তার সাম্রাজ্যবাদের উন্মত্ত প্রচেষ্টায় সিদ্ধিলাভ করেছে। কিন্তু ‘একতা—বিশ্বাস—ও—বলিদানের’ ব্রত নিয়ে ‘কদম কদম বাড়ায়ে যার’ মন্ত্র উচ্চারণ করে ‘জয় হিন্দের’ প্রচণ্ড নিনাদে যে জয়যাত্রা শুরু করেছিল ভারতের মুক্তি ফৌজ নেতাজীর অবিচলিত নেতৃত্বে আস্থা রেখে—সে জয় যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ রক্তের পঙ্কিল কদমে আজও অঙ্কিত হয়ে আছে মণিপুরের পরিত্যক্ত রণক্ষেত্রে—সে জয়যাত্রার দ্বিতীয় পদক্ষেপ কোলকাতার রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর নির্মম গুলী চালনায় নিঃসৃত রক্তস্রোতে— তারপর পর পর চট্টগ্রাম ও বোম্বাই সহরের তাণ্ডবলীলা!···

দিল্লী আর কত দূর?

 আমরা আগেই দেখেছি ১৯৪৪ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী আজাদী-ফৌজের সঙ্গে বৃটিশ বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়। তারপর ক্রমান্বয়ে এক বছর ধরে ভীষণ সংগ্রাম চলে এবং আজাদী ফৌজ শাহ নওয়াজের অধিনায়কত্বে মণিপুরের কিয়দংশ দখল করে সেখানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে সমর্থ হয়। তারপর ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয় এবং কিছু দিন পর এ্যাটম বোমার বা আনবিক বোমার অমানুষিক ধ্বংস লীলায় বিধ্বস্ত হয়ে জাপানীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু জাপানীরা আত্মসমর্পণ করলেও আজাদী ফৌজ বীব বিক্রমে কিছুদিন পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এর পর ২৩শে আগষ্ট ১৯৪৫ সালে হঠাৎ জাপান থেকে ঘোষণা করা হয় যে আজাদ-হিন্দ-সবকারের সর্বাধিনায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এক বিমান দুর্ঘটনায় আহত হযে জাপানী হাসপাতালে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। শ্রীযুক্ত বসু জাপানী সবকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবাব জন্যে ১৮ই আগষ্ট সিঙ্গাপুর থেকে টেকিওয় যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তাইহকু বিমান ক্ষেত্রে বেলা ২টার সময় এই দুর্ঘটনা ঘটে এবং তিনি সাঙ্ঘাতিকভাবে আহত হন। জাপানের এক হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় এবং সেখানেই মধ্যরাত্রে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 এই সংবাদে জগতব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ইতিপূর্বে কয়েকবার সুভাষবাবুর মৃত্যু সম্পর্কে মিথ্যা খবর রটনার ফলে এবারও লোকে, বিশেষ করে ভারতের জনসাধারণ সংবাদটি সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করে। যদিও বৃটিশ সরকার ও জাপানী সরকার নানাভাবে প্রমাণ পত্র দাখিল করে এবং নানাবিধ প্রচার কার্যের সাহায্যে সংবাদটি সমর্থন করবার চেষ্টা করছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত দেশবাসীর এবং দেশের সর্বদলীয় নেতাদের বিশ্বাস যে নেতাজী এখনও জীবিত অবস্থায় অন্য কোন দেশে আরও বৃহত্তর কিছু পরিকল্পনাকে রূপ দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। বিংশ শতাব্দীর মানুষ দেবতা মহাত্মা গান্ধী পর্যন্ত বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি সুভাষ এখনও বেঁচে আছে। সে এখন লুকিয়ে আছে, সময় হলেই ঠিক বেরিয়ে আসবে। ভগবানের আশীর্বাদে এই বিশ্বাস সত্য হোক আমাদের এইমাত্র কামনা।

 সুভাষবাবুর এই কর্মবহুল চাঞ্চল্যকর প্রবাস জীবনের মধ্যে তাঁর পরিবারে দুটি দুর্ঘটনা ঘটে। প্রথমটি হল তাঁর অন্তর্ধানের একবছরের মধ্যেই সারদার মৃত্যু। এই সারদার সেবাযত্নের মধ্যেই সুভাষচন্দ্র আবাল্য পালিত। তিনি সারদাকে মায়ের মত ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। দ্বিতীয় দুর্ঘটনা সুভাষচন্দ্রের জননী রত্নগর্ভা প্রভাবতী দেবীর পরলোক গমন। ১৯৪৩ সালের ৮ই ডিসেম্বর কোলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে পর্যন্ত প্রবাসী সন্তানের জন্য আশীর্বাদের ও কল্যাণ কামনার নীরব অভিব্যক্তিতে তাঁর মুখ এক অপূর্ব দীপ্তিতে ভাস্বর হযে থাকতে আমরা দেখেছি। স্বর্গ থেকে তিনি আজ তাঁর স্নেহের সুভাষের দিগ্বীজয়ী অভিযান দেখছেন।


 আমাদের মত নগণ্য লোকের তাঁর মত বিরাট ব্যক্তিত্বের সমালোচনা করতে যাওয়া অন্যায়,—শুধু অন্যায় কেন বাতুলতা। তবু, নিছক ইতিহাসের খাতিরে আমাদের কিছু বলতে হবে। আজাদ-হিন্দ-ফৌজের ইতিহাস পড়ে প্রত্যক্ষ জয়লাভের ইঙ্গিত আমরা পাই না বটে কিন্তু পরোক্ষভাবে সুভাষচন্দ্র কি ভাবে জয়ী হয়েছেন সে বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট ধারণা হয়।

 বরাবরই সুভাষচন্দ্র বিপ্লবপন্থী। গান্ধীবাদের অমোঘ প্রভাব যখন সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে বাস্তবিকপক্ষে তখনই রাজনীতিক্ষেত্রে সুভাষচন্দ্রের উদয়। সুভাষচন্দ্র মনেপ্রাণে গান্ধীজীকে শ্রদ্ধা করেন এবং ভারতের শ্রেষ্ঠ জননায়ক হিসাবে মেনে নিয়ে চলেন। এমন কি সুদূর ব্রহ্মদেশে যেখানে তাঁর নিজ হাতে গড়া স্বাধীন ভারতে তিনিই একমাত্র নেতা সেখানেও প্রতি পদে তিনি গান্ধীজীকে স্মরণ করে নিয়েছেন। আজাদী সেনাদের ওপর তাঁর নির্দেশ ছিল যে যদি শেষ পর্যন্ত পরাজয় ঘটে তাহলে গান্ধীজীর চরণতলেই তাদের শরণ নিতে হবে। গান্ধীজীকে শ্রদ্ধা করলেও তিনি বুঝেছিলেন আধুনিকযুগে গান্ধীবাদ অচল। তাঁর নিজস্ব পথ—বিপ্লবের পথকে সফল করবার জন্যেই গান্ধীজীর সঙ্গে তাঁর যত কিছু সংঘাত এবং আজাদ-হিন্দ ফৌজ গঠন করে তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন বিপ্লবের ভেতর দিয়ে, সামরিক শৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে দেশকে কতখানি আগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। কংগ্রেস ৬০ বছরের চেষ্টায় যা পারে নি তিন বছরের মধ্যে সুভাষচন্দ্র তা করে গেলেন। আজকের দিনে কংগ্রেসেরএ ই বিপুল জনপ্রিয়তা— এই বিপুল জনসমাবেশ— নেতাদের দর্শনের জন্য এই ব্যাকুল আগ্রহ এর মূলে আছে একটি ম্যাজিক শব্দ— জয় হিন্দ। কংগ্রেস এ কথা স্বীকার করে নিয়েছে।

 তাই বলি, দক্ষিণপন্থী দল তোমাদের ঋণ পরিশোধের দিন কি এসেছে!

 আজাদ-হিন্দ-ফৌজের দ্বিতীয় ফল হিন্দু-মুসলমান ঐক্য। যে ঐক্যের অভাবে আজ আমাদের এত গৃহবিবাদ এত শক্তিক্ষয় হয়ে যাচ্ছে যে ঐক্য বৃটিশের কারসাজিতে কংগ্রেসের শত প্রচেষ্টার ফলেও সম্ভব হয় নি সেই ঐক্যের মূলভিত্তি স্থাপিত হয়ে গেছে মণিপুরের সকলজাতির সকল ধর্মের রক্ত-কর্দমে। সেই ভিত্তির ওপরই আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধের বিরাট সৌধ গড়ে উঠবে, আত্মনিয়ন্ত্রণের ভণ্ডামীর ওপর নয়। মুশ্লিম লীগ তোমরা দয়াকরে শুধু এই কথাটি মনে রেখো যে আজাদ হিন্দ-ফৌজের বীরশ্রেষ্ঠ সৈনিক শাহ নওয়াজ খান তোমাদেরই জাত ভাই। মনে রেখো ভারতের এই সন্তানের বাণী, যে বাণী দিল্লীর কেল্লায় তোমরা যখন তাঁকে রক্ষা করতে গিয়েছিলে তিনি তোমাদের দিয়েছিলেন—‘আমি যা করেছি তার সঙ্গে কোন জাতি, দল বা সম্প্রদায়ের প্রশ্ন জড়িত নেই। আমি যা করেছি তা আমার দেশমাতার জন্য করেছি কংগ্রেসই একমাত্র আমাকে সমর্থন করবার অধিকারী’।

 তৃতীয় ফল, বিশ্বের দরবারে ভারতের স্বীয় মর্যাদা ও আসন লাভ। এই পরাধীন ভারতের মানুষ হয়ে, একটি মাত্র লোক পুলিশের বেষ্টনী পার হয়ে আটত্রিশ কোটি মানুষের সমুদ্র পার হয়ে, যুদ্ধরত বিদেশী রাজ্যে—শত্রুর সীমানায় পৌঁছে দু’বছরের মধ্যে অর্থ সংগ্রহ করে মানুষ সংগ্রহ করে, অস্ত্র সংগ্রহ করে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে এসে রুখে দাঁড়ালো বিশ্বজয়ী এ্যাঙ্গলো আমেরিকানের বিরুদ্ধে, তাদের পদে পদে লাঞ্ছিত করে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দিলে বেয়নেটের আগায় শাসিত পরাধীন দেশের মাটির ওপর—এক আলাদীনের প্রদীপের গল্প ছাড়া চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে কেউ বিংশ শতাব্দীর যুগে বিশ্বাস করতে পারতো কি?

 নির্লজ্জ বৃটিশ হয়ত বলবে, কিন্তু হেরে ত গেছে!

 আমরা বলি, মনে আছে ত, কবিগুরুর বাণী?—ঘটে যাহা তাহা সতা নহে!

 ধাপ্পাবাজ বৃটিশ হয়ত বলবে, কিন্তু তোমরা ত জাপানীর চর!

 নেতাজীর কণ্ঠে তার প্রত্যুত্তর আমরা শোনাবো—

 আমি ত্রি-শক্তির সমর্থন করে কিছু বলছি না। ত্রি-শক্তির সমর্থন করে কিছু বলা আমার কাজ নয়। বৃটেনে ভাড়াটে প্রচারকগণ আমাকে শত্রুর চর বলে অভিহিত করছে। আমার সমগ্র জীবনই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবিরাম ও আপোষহীন সংগ্রামের সুদীর্ঘ ইতিহাস। চির জীবন ধরেই আমি ভারতমাতাব সেবক। আমার জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত আমি ভারতের সেবক থাকব এবং পৃথিবীর যে অংশেই আমি বাস করি না কেন, একমাত্র ভারতবর্ষের প্রতিই আমার আনুগত্য ও অনুরাগ আছে এবং চিরকাল থাকবে।

 আমি বিশেষ যত্নের সঙ্গে দু’শ বছরের ইতিহাস পড়ে দেখেছি। বৈদেশিক শক্তির সাহায্য ব্যতীরেকে স্বাধীনতা লাভ হয়েছে এমন একটা দৃষ্টান্তও পাই নি। বৃটেন নিজে জগতের সব স্বাধীন রাজ্যের সাহায্যই চাইছে না, সে ভারতবর্ষের মত পরাধীন দেশগুলোর সাহায্যও চাইছে। বৃটেনের পক্ষে সাহায্য গ্রহণ করা যদি দোষ না হয়ে থাকে তাহলে শৃঙ্খলিত ভারতবাসীর পক্ষে যে সাহায্য একান্ত প্রয়োজন সেই সাহায্য গ্রহণ করলে ভারতবর্ষেরও কোন দোষ হতে পারে না। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামে কোন সাহায্য পেলে আমরা ভারতবর্ষে তা বরণ করে নেবো।


 যুগে যুগে সূর্য ওঠে আকাশের পূর্ব দিগন্তে—সূর্য ওঠে ভারতের পূর্ব সীমান্তে এবারের সূর্য উঠলো আরও পূর্বে—পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ রণ-ক্ষেত্রে!

 আগামী দিনের স্বাধীন ভারতের সেই সোনার সূর্যের আলোর পরশ পেয়েছে বন্ধু? সে আলোর অগ্নিতে শুদ্ধ করে নিয়েছো তোমার আত্মা?

 যদি না দেখে থাকো ত আমার সঙ্গে এসো, পাহাড়ের উচ্চ শিখর থেকে সে সূর্যকে দেখবে চল।

 একটা আধটা পাহাড় নয়—অনেকগুলো পাহাড় পেরোতে হবে শিখরে উঠতে গেলে— দেড় শ’ বছরের অন্ধকার আর আত্মগ্লানির পাহাড়····তারপর শুধু ১৯৪২’এর নয় বহু আগষ্টের বহু কঙ্কালের স্তূপ····হ্যাঁ নদীস্রোতও আছে···বহু জালিয়ানওয়ালাবাগের উন্মত্ত রক্তস্রোত····! এসব পেরিয়ে ঐ যে শিখর ওর ওপর থেকে দেখতে হবে প্রথম সূর্যোদয়···! ওকি? শিউরে উঠলে কেন বন্ধু আতঙ্কে?···ও ত’ ঝড় নয়—ওযে বহু অশান্ত আত্মার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস···চল আমরা পেরিয়ে যাই।···

 এই ত’ আমরা এসে গেছি···। দেখতে পাচ্ছো বন্ধু? দেখতে পাচ্ছো বহু দিনের নির্যাতন আর বেদনার উত্তপ্ত গোলোক ঐ উঠছে···। তার আলো তোমার গায়ে আমার গায়ে সমানভাবে এসে পড়ছে···। ওকি? রক্তের মধে এ কিসের দোলা? কিসের তাপ?

 তবে কি ঘুম ভাঙ্গার দিন এসে গেল? তোমার হাতিয়ারটায় শান দিয়ে রেখেছো ত বন্ধু?—কংগ্রেসের দেওয়া অহিংসার ক্ষুরধার হাতিয়ার?···

 মনে আছে ত’ তোমার আদর্শ—একতা—বিশ্বাস—বলিদান?

 মনে আছে ত’ তোমার মুক্তিমন্ত্র—জয়-হিন্দ?

 তবে চল—সবাই যেদিকে চলেছে সেই দিক পানে কদম্ কদম্ পা বাড়ায়ে চল···

 কিন্তু, বলতে পারো, দিল্লী আর কতদূর?