নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ/পরিশিষ্ট (গ)

পরিশিষ্ট

(গ)

 কাগজে প্রকাশিত নেতাজীর পলায়ন কাহিনীর সারাংশ—

 ১৯৪১ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাস। দারুণ শীত! চারদিকে বরফ পড়ছে। সেই সময়ে কাবুলের এক দোকানে দুটি লোক বসে আছে। একজনের নাম উত্তমচাঁদ আর অপর জনের নাম অমরনাথ—উত্তমচাঁদের সহকারী। দারুন শীত পথে ঘাটে লোক নেই। এমন সময় দাড়িওয়ালা এক পেশোয়ারীর আবির্ভাব হল। উত্তমচাঁদ পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানতে চাইলে অতিথি অমরনাথের জন্য যেন ইতস্ততঃ করতে লাগলেন। উত্তমচাঁদ অমরনাথকে চা আনতে পাঠিয়ে দিলে আগন্তুক তাঁর পরিচয় দিলেন। বল্লেন তিনি একজন ভারতীয়,—কোন রাজনৈতিক ব্যাপারে তাঁর সাহায্য পেতে এসেছেন। নাম ভগৎরাম ও বাড়ী মর্দান জেলায় খালাচের গ্রামে। তাঁর ভ্রাতা পাঞ্জাবের লাটকে গুলি করার অপরাধে দণ্ডিত হয়েছিলেন। খালাচের গ্রাম উত্তমচাঁদের খুব পরিচিত। তিনি ঐ গ্রামের নওজওয়ান সভার সম্পাদক ছিলেন। কাজেই আলাপ জমে গেল। ভগৎরাম স্পষ্ট করেই বললেন যে তিনি পলাতক সুভাষচন্দ্রের জন্য সাহায্য ভিক্ষা করতে এসেছেন। তিনি তাঁকে রাশিয়ায় পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছেন। উত্তমচাঁদ চমকে উঠলেন।

 ভগৎরাম বলে চললেন যে ১৩ দিন হল সুভাষচন্দ্র এখানে এসে উট ও গাধাওয়ালাদের এক জঘন্য আড্ডায় রয়েছেন। এখানে তাঁদের বিশেষ কেউ জ়ানা শোনা নেই, তাই খুবই অসুবিধা হচ্ছে। সুতরাং তাঁদের একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থান দরকার।

 উত্তমচাঁদ বল্লেন তাঁর বাড়ীতে সুবিধা হবে না। তবে কাছেই তাঁর বিশি বন্ধু হাজি সাহেবের বাড়ী। হাজি সাহেব সেনাদলে কাজ করতেন এবং ১ বৎসর আগে বৃটিশ অফিসারদের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় পদত্যাগ করে চলে আসেন। তিনি জাপান, জার্মান প্রভৃতি খুব ঘুরেছেন। তাঁর স্ত্রী জার্মান। তাছাড়া তিনি একদিকে যেমন বৃটিশ বিদ্বেষী তেমনি সুভাষচন্দ্রের অনুরাগী। সুতরাং তাঁর যে মোজা ও গেঞ্জীর কারখানা আছে, সেখানে একটা ব্যবস্থা করলেও করতে পারেন। যাবার আগে ভগৎরাম বলে গেলেন যে বর্তমানে তাঁরা দুজনেই ছদ্মবেশে আছেন ও ছদ্মনাম ব্যবহার করছেন। তাঁর ছদ্মনাম রহমৎ খাঁ আর সুভাষচন্দ্রের ছদ্মনাম জিয়া উদ্দীন।

 ভগৎরাম বা রহমত খাঁর প্রস্থানের পর উত্তমচাঁদ কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন কিন্তু তাঁর এই দুর্বলতা জয় করতে বিশেষ সময় লাগলো না। তিনি হাজি সাহেবের বাড়ীর দিকে চললেন। কিন্তু তাঁর অভীষ্ট সিদ্ধ হল না।

 বিকেল বেলা রহমৎ খাঁ এসে হাজির হলেন। উত্তমচাঁদ ও তিনি কথামত কাবুল নদের সেতুর ওপর গিয়ে হাজির হলেন। সেখানে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তাঁদের দেখা হল। সুভাষচন্দ্রের পরণে একটি ময়লা শালোয়ার ও ময়লা সার্ট। পায়ে বরফে ভেজা মোজা। মুখে তিন ইঞ্চি লম্বা দাড়ি, কিন্তু চোখে চশমা না থাকায় উত্তমচাঁদের তাঁকে চিনতে কষ্ট হয়েছিল।

 চারিদিকে তখন প্রবল তুষারাপাত হচ্ছে। সুভাষচন্দ্রের অনভ্যস্ত আবহাওয়ায় পথ চলতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। তাছাড়া সকলের সন্দেহ এড়িয়েও তাঁকে চলতে হবে। যাই হোক বাড়ী পৌঁছে উত্তমচাঁদ তাঁর পোষাক বদলাতে সাহায্য করলেন। তার পর চায়ের ব্যবস্থা করলেন। সুভাষচন্দ্র উত্তমচাঁদের এই আত্মীয়তায় খুবই সন্তোষ বোধ করলেন।

 এই সময় সুভাষবাবু উত্তমচাদের কাছে তাঁর এই বিচিত্র ভ্রমণকাহিনীর কিছু কিছু বর্ণনা করেন। তিনি বলেন কোনগতিকে কাবুলে এসে পৌঁছলেও তাঁর এবং রহমৎ খাঁর দুজনেরই অচেনা জায়গার জন্য খুবই অসুবিধা হয়েছিল। মুস্কিল হয়েছিল আশ্রয়স্থান নিয়ে। স্থানীয় লোকেরা লাহোর গেটের কাছে যে সরাইয়ের কথা বলে দিলে সেখানে এসে দেখা গেল যে সেটা একটা গাধা ও উটওলাদের আস্তাবল। যাই হোক দোতলায় এক টাকা (আফগানী) ভাড়ায় একখানা অন্ধকার কুঠুরী পাওয়া গেল। সেইখানেই তাঁরা উঠলেন। ভীষণ শীত— আগুন জ্বালাতে হয়। কিন্তু ধোঁয়া বেরোবার পথ নেই। তবু কোনমতে তাঁরা ত রইলেন। সন্ধ্যাবেলার দিকে রহমৎ খাঁ চা, রুটি ও কাবাব নিয়ে এলেন। এবং দুজনে মিলে তার সদ্ব্যবহার করলেন। রাত্তিরের জন্যে দৈনিক আট আনা ভাড়ায় এক একটি বিছানা জোগাড় করা হল চৌকিদারের কাছ থেকে।

 কয়দিন ধরেই একটা আফগান গোয়েন্দা ওঁদের পেছনে ঘোরাফেরা করছিল। একদিন লোকটা সরাসরি তাঁদের কুঠুরীর সামনে এসে তাঁদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করে বসলো। রহমৎ খাঁ বললেন যে তাঁরা মুসাফির—সীমান্ত থেকে এসেছেন। তার পর সুভাষবাবুকে দেখিয়ে বললেন ইনি তাঁর ভাই—কালা ও বোবা—অসুখে ভুগছেন, তাঁকে নিয়ে সাখি সাহেবের তীর্থে যাবেন কিন্তু বরফ পড়ার জন্য রাস্তা বন্ধ বলে যেতে পারছেন না। এসব শুনে লোকটা প্রথমটা খুব খানিকটা মেজাজ দেখালে, বললে থানায় যেতে হবে তাঁদের ইত্যাদি। কিন্তু তারপর রহমৎ খাঁ একখানি আফগানী দশ টাকার নোট তার হাতে গুঁজে দিতে লোকটা আপ্যায়িত হয়ে চলে গেল।

 টাকা পাওয়ার ফলে লোকটা লোভে লোভে এসে ভয় দেখিয়ে আর একদিন ৫ টাকার নোট নিয়ে গেল! আর একদিন এসে বললে দারোগা সাহেব তাঁদের বিদ্রোহী মনমদ দলের লোক বলে সন্দেহ করছেন সুতরাং থানায় যেতেই হবে ইত্যাদি। অগত্যা সেদিন ১৭ টাকা দিয়ে তাকে বিদায় করতে হল। তাছাড়া টাকার সঙ্গে সুভাষবাবুর দামী হাত ঘড়িটা পর্যন্ত আদায় করে নিয়ে যেতে ভুললো না। পরের দিন লোকটা এসে জানালো যে দারোগা তার কাছ থেকে ঘড়িটা নিয়েছে সুতরাং রহমৎ খাঁর আরও ৫টি টাকা খসলো। লোকটা রোজই বলতো তোমরা যত শীগগীর পারো এখান থেকে চলে যাও আর এঁরাও ভেতরে ভেতরে উত্তমচাঁদের খোঁজ খবর করছিলেন। সুতরাং দুদিন খোঁজাখুঁজির পর উত্তমচাঁদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।

 সেদিন রাতে সুভাষবাবু বসে বসে বেতারবার্তা—বিশেষ করে যুদ্ধ সংবাদ শুনলেন। তিনি বললেন বহুদিন তিনি যুদ্ধ সংবাদ শোনেন নি! পরে অবশ্য উত্তমচাঁদ সিভিল এবং মিলিটারী গেজেট আনিয়ে তাঁকে পড়িয়েছিলেন।

 সে রাতে উত্তমচাঁদের স্ত্রী একরকম জোর করেই উত্তমচাঁদের কাছ থেকে বলিয়ে নিলেন তাঁদের এই নতুন অতিথির আসল পরিচয় কি? এবং প্রথমটা এতে ভয় পেলেও পরবর্তীকালে দেখা গিয়েছিল যে, ৪৮ দিন সুভাষবাবু ওঁদের কাছে ছিলেন ততদিন উত্তমচাঁদের স্ত্রী তাঁকে সর্বরকমে সাবধান করে রেখেছিলেন।

 সুভাষবাবু উত্তমচাঁদের কাছে কোলকাতা থেকে কাবুলের যাত্রাকাহিনীর যে বর্ণনা করেছিলেন তা এইরকম।

 তিনি বলেন যে দু’মাস আগে যদি তিনি বেরিয়ে পড়তে পারতেন তাহলে মস্কো যাওয়া বিশেষ অসুবিধা হত না। কিন্তু কর্পোরেশনের একটা কাজ থাকায় তাঁর দেরী হয়ে যায় এবং ফলে তাঁর সঙ্গী মস্কো যাত্রা করেন বটে কিন্তু তাঁর যাওয়া হয় না। তাছাড়া ততদিন তাঁর দাড়িও বিশেষ গজায় নি।

 পলায়নের কিছুদিন আগে থেকে লোকের সঙ্গে দেখা করা বা কথা কওয়া একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন কিন্তু পলায়নের কাজে যারা সাহায্য করছিলেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় ছিল। এবং সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেলে ১৫ই জানুয়ারী রাত আটটার সময় মৌলবীর বেশে বাড়ী ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন। পেশোয়ারের পথে ট্রেনে সহযাত্রিদের কাছে তিনি নিজেকে জিয়াউদ্দীন বলে পরিচয় দেন এবং স্টেশন এলেই কাগজ দিয়ে মুখ আড়াল করে রাখেন।

 পেশোয়ারে পৌঁছে অপেক্ষমান নির্দিষ্ট গাড়ীতে উঠে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছলেন। পেশোয়ারে দুদিন থাকার পর তিনি কাবুল যাত্রা করলেন। এই পথ অত্যন্ত দুর্গম এবং বিপদ সঙ্কুল। অবশ্য অনেকে তাঁকে এই সময়ে সাহায্য করেছিলেন বিশেষ করে লালুপুরার খান সাহেব। তিনি তাঁকে একটি বিশেষ পরিচয় পত্র লিখে দিয়েছিলেন। তবে এই সময়ে তাঁর প্রধান সঙ্গী ছিলেন রহমৎ খাঁ। আর প্রায়ই তাঁর দেহরক্ষী হিসাবে দুজন করে বন্দুকধারী পাঠান তাঁর সঙ্গে থাকতেন। তবে এই সময় থেকেই সুভাষবাবু বোবা-কালা সেজে থাকতেন। পথিমধ্যে কি ভাবে ভিস্তির থলেয় চড়ে নদী পার হয়েছিলেন এবং বরফ-পড়া রাত্রির মধ্যে খোলা লরী চড়ে মাইলের পর মাইল অতিক্রম করেছিলেন তা সত্যিই চিত্তাকর্ষক।

 কাবুলে এসে রাশিয়ার দূতাবাসের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হন কারণ রাশিয়ার দূতাবাসে তাঁর পরিচিত কেউ ছিল না। তারপর তিনি ইতালীর দূতাবাসে যান। সেখানে ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী সিনর কারোনি এবং জার্মান ব্যবসায়ী টমাস তাঁর রোমে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন।

 উত্তমচাঁদের বাড়ীতে থাকবার সময় সুভাষবাবু একান্ত সাবধানতার সঙ্গে থাকতেন। যখনই তাঁরা ঘরে বসে কথা কইতেন তখন ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখা হত। উত্তমচাঁদ বেরোবার সময় তাঁর ঘরে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে যেতেন। এমন কি বেতারে বাংলা গান পর্যন্ত তিনি শুনতেন না পাছে অন্য লোকে সন্দেহ করে। কিন্তু তবু উত্তমচাঁদের এক ভাড়াটে একদিন তাঁকে দেখতে পায় এবং তিনি যে কে তা আর বুঝতে বাকী থাকে না। ব্যাপার দেখে সেই ভদ্রলোক এমনই ভয় পেয়ে যান যে তিনি নিজেই বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। ব্যাপারটা পাছে ছড়িয়ে পড়ে তাই উত্তমচাঁদ সুভাষবাবুকে দিনকতকের জন্য এক সরাইখানায় পাঠিয়ে দেন। এই সময়ের মধ্যেই ইটালীয় রাজদূত কারোনির স্ত্রী এসে খবর দেন যে রোম থেকে চিঠি এসেছে। চিঠিতে ছাড়পত্র পাবার কথা কিছু ছিল না।

 এদিকে সরাইখানাতে সুভাষবাবু আমাশয় রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর সেবাশুশ্রূষার জন্যে উত্তমচাঁদ তাঁকে নিজের বাড়ীতে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। এই সময় সুভাষবাবুর প্রায়ই কাশি হত এবং সেই কাশি পাছে অন্য কেউ শুনতে পায় তার জন্যে কাশির সঙ্গে সঙ্গেই উত্তমচাঁদের স্ত্রী জোরে জোরে আওয়াজ করে কাশির আওয়াজ চাপা দেবার চেষ্টা করতেন।

 দেখতে দেখতে তিন সপ্তাহ কেটে গেল কিন্তু ছাড়পত্রের ব্যবস্থা হল না। কারোনি বললেন বোধ হয় মস্কোর ইতালীয় দূতাবাসে এই নিয়ে কিছু গণ্ডগোল হযে থাকবে। প্রকৃতপক্ষে হয়েছিলও তাই। তখন সুভাষবাবু স্থানীয় জার্মান বা রাশিয়ানদের সাহায্যে রাশিয়ার দূতাবাসের সঙ্গে আবার যোগসাধনের চেষ্টা করাতে লাগলেন কিন্তু মনোমত ফল পেলেন না। এর মধ্যেই কারোনি এসে জানালেন যে চিঠি এসেছে। এই চিঠিতে জানানো হয়েছে যে আভ্যন্তরিক গণ্ডগোল কোন রকমে মিটেছে এবং সুভাষবাবুর জন্যে রোম থেকে বার্তাবাহক আসছেন।

 ক্রমাগত বাড়ীতে থেকে সুভাষবাবু হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তবে বাইরে বেরোতে গেলে কাবুলি বেশ ধারণ করাই ভাল। উত্তমচাঁদ তাঁকে যে পোষাক দিলেন তা তাঁর গায়ে বেশ হল, কিন্তু জুতোটা একটু কড়া হল। অগত্যা সুভাষবাবু জুতো কিনতে কাবুলির বেশে রাস্তায় বেরোলেন। দোকানে জুতো কিনতে গেলেন দোকানী তাঁকে দেখেই ভারতীয় বলে আন্দাজ করেছিলেন। সুভাষবাবু নিজে হাবিবিয়া কলেজের অধ্যাপক জিয়াউদ্দীন বলে পরিচয় দিয়ে বসলেন। দোকানী বললেন হাবিবিয়া কলেজের সব অধ্যাপককেই তিনি চেনেন কিন্তু তাঁকে চিনতে পারছেন না। অগত্যা সুভাষবাবু বলতে বাধ্য হলেন যে তিনি নতুন এসেছেন ঐ কলেজে এবং কোনমতে কাজ শেষ কবে তাড়াতাড়ি আছে বলে সরে পড়লেন।

 সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মধ্যে উত্তমচাঁদ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি রাশিয়ায় যাবার জন্যে এত ব্যস্ত কেন! সুভাষচন্দ্র বলেন যে বর্তমান অবস্থায় রাশিয়াই একমাত্র ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করতে পারে। যদিও রাশিয়া ও জার্মানের মধ্যে আপাত প্রীতি সম্বন্ধ যে কোন দিন ভেঙ্গে যেতে পারে তবু অন্তরে অন্তরে রাশিয়ার সঙ্গে ইংরাজের মিল হতে পারে না। ইংরাজ দু’শ বছরের শাসনে ভারতকে যেরকম দুর্বল করে দিয়েছে তাতে সেখানে সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করা শক্ত। কিন্তু রক্তক্ষয়কারী বিপ্লব এবং বিদেশী শক্তির সাহায্য ব্যতীত ভারতের মুক্তি সম্ভব নয়। অথচ ভারতবর্ষে জেলের মধ্যে পচে পচে এ দুটোর কোনটাই করা সম্ভব নয়। একমাত্র পথ দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে কোন শত্রুর দেশে গিয়ে হাজির হয়ে প্রচারকার্য চালানো। সেই দিক থেকে রাশিয়াই প্রশস্ত স্থান। একমাত্র রাশিয়াই ভারতকে মুক্ত করতে পারে। এই যুদ্ধই হচ্ছে তার শুভক্ষণ। এই শুভক্ষণের সুযোগ সদ্ব্যবহার না করতে পারলে ভারতের স্বাধীনতা আরও পঞ্চাশ বছর পেছিয়ে যাবে। উত্তমচাঁদ বলেন যে জার্মানী বা চক্রশক্তির অনুকূলে সুভাষবাবু একটা কথাও বলেন নি। চক্রশক্তিকে তিনি ইংরাজের মতই ঘৃণা করতেন। অথচ তিনি বলেছেন যে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে বছর কুড়ি ধরে একজন শক্তিশালী ডিক্টেটরের অধীনে শাসিত হওয়ার প্রয়োজন আছে কারণ তা না হলে ভারতবর্ষের ভেতরকার নানা রকম বিভেদ দূর হতে পারে না। তিনি বলেছিলেন তুরস্কের মত ভারতবর্ষেও কামাল পাশার মত একজন নেতার প্রয়োজন। রাশিয়ায় যাবার আন্তরিক ইচ্ছা ও চেষ্টা থাকা সত্বেও রাশিয়া ও জার্মাণীর মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ায় তা অবশ্য সম্ভব হয় নি। তাই তিনি বাধ্য হয়েই বার্লিন যাত্রা করেন।

 সুভাষবাবুর মস্কোতে যাওয়ার ব্যগ্রতা দেখে উত্তমচাঁদও নানারকম উপায়ের সন্ধান করতে লাগলেন। রাশিয়ার সীমান্ত থেকে একজন ফেরার খুনী আফগানিস্থানে এসে বাস করছিল, উত্তমচাঁদ তাকে চিনতেন। আকগানিস্থান ও রাশিয়ার মধ্যে রয়েছে হ্যাংগো নদী, এই নদী পার হতে পারলেই রাশিয়া যাওয়া যায়। অনেকে এই নদী দিয়ে গোপনে চোরাই মাল পারাপারের কারবার করতো এবং ঐ খুনী লোকটা ওদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। লোকটার আর্থিক অভাবও ছিল প্রচুর। এই লোকটিই সাতশো আফগানী টাকার বিনিময়ে সুভাষবাবুকে ও রহমৎ খাঁকে হ্যাংগো নদী পার করে রাশিয়ায় পৌঁছে দিতে রাজী হয়। এই লোকটির নাম ‘ম’।

 উত্তমচাঁদ রহমৎ খাঁর সঙ্গে ম’র পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং তাঁরা সব ব্যবস্থা করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে কারোনির স্ত্রী এসে জানিয়ে গেলেন যে শীঘ্রই নাকি রোম থেকে সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

 এদিকে আবার নতুন বিপদ দেখা দিল। উত্তমচাঁদের এক ব্যবসায়ী বন্ধু জীবনলাল প্রায় প্রতি বৎসরই কাজের জন্য এই সময়ে তাঁর বাড়ীতে আসতেন। তিনি এসে পড়ায় একটু মুস্কিল বাধলো। অবশ্য স্ত্রীর অসুখের অজুহাত দেখিয়ে উত্তমচাঁদ জীবনলালকে তাঁর বাড়ীতে উঠতে দিলেন না কিন্তু একদিন ঘটনাচক্রে ‘ম’ ও রহমৎ খাঁর সঙ্গে যখন তিনি কথা কইছিলেন তখন জীবনলাল এসে উপস্থিত হলেন। জীবনলাল ম’কে চিনতেন তাই তিনি এই জুয়াড়ীটার সঙ্গে উত্তমচাঁদের সম্বন্ধ আছে দেখে রেগে উঠলেন। তখন কোনগতিকে এড়িয়ে গেলেও সেদিনই দুপুরে উত্তমচাঁদ ‘ম’কে যখন একখানি ১০০ টাকার নোট দিচ্ছিলেন সেই সময় জীবনলাল এসে পড়লেন। জীবনলাল আন্দাজ করছিলেন ভেতরে একটা ব্যাপার আছে কিন্তু উত্তমচাঁদ সুভাষবাবুর সঙ্গে আলোচনা না করে সমস্ত কথা প্রকাশ করা সমীচীন বোধ করলেন না। প্রকৃত পক্ষে সুভাষবাবুও ষতদিন না তিনি চলে যাচ্ছেন ততদিন প্রকাশ করতে বারণ করে দিলেন। এদিকে ম’ এর ব্যবস্থা সব ঠিক, অথচ যেদিন যাওয়া হবে তার আগের দিন কারোনির স্ত্রী জানিয়ে গেলেন যে সব ব্যবস্থা ঠিক হয়ে গেছে। রোম থেকে বার্তাবাহক যাত্রা করেছে। তবে তার আগে সুভাষবাবুর একখানা ফোটো নিতে হবে। এবং তাঁরা গোপনে সুভাষবাবুকে গাড়ী করে নিয়ে গিয়ে ফোটা তুলে আনবেন। অগত্যা রহমৎ খাঁ ম’কে জানালেন যে তাঁর অপর বন্ধুটি যাঁর যাবার কথা ছিল তিনি অসুস্থ হয়ে পড়াতে এখনও কাবুলে এসে পৌঁছতে পারেন নি। এই অপর বন্ধুটির (অর্থাৎ সুভাষবাবুর সঙ্গে ম’ এর অবশ্য এযাবৎ পরিচয় হয় নি।

 প্রশ্ন উঠলো কোন পথে সুভাষবাবু যাবেন। রহমৎ খাঁ ও উত্তমচাঁদের মতে ম’এর সঙ্গে যাওয়াই ভাল কিন্তু সুভাষবাবুর নিজের মত অন্যরূপ। তিনি বললেন যে রাশিয়ান্‌রা একবার তাঁকে সাহায্য করতে অসম্মত হয়েছে অথচ ইটালিয়ানরা সব রকম ব্যবস্থা নিজের থেকেই করেছে। সুতরাং প্রথমে ইটালীতে যাওয়াই সঙ্গত, সেখান থেকে মস্কো যাওয়া সহজতর হবে। তাছাড়া ম’এর পথ বিপদসঙ্কুল যে কোন মুহূর্তে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

এর মধ্যে কারোনি আবার এসে জানালেন যে ফোটো খুব সুন্দর হয়েছে এবং অন্যান্য ব্যবস্থাও সব প্রস্তুত।

 যাবার আগে দরকারী জিনিষপত্র সব কেনাকাটা করা হতে লাগলো। হাজি সাহেবের দর্জিকে দিয়ে সুভাষবাবুর দুটো পোষাক তৈরী করা হল। এর মধ্যে সুভাষবাবু একদিন জীবনলালকে দেখা দিয়েছিলেন, অবশ্য সেটা জীবনলালকে বহু অনুনয় বিনয়ের ফলে। সেইজন্য পরবর্তীকালে জীবনলাল গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

 এর পর ইটালীয় দূত জানিয়ে গেলেন যে ১৮ই মার্চ তাঁর যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে। ১৬ই মার্চ সিনরা কারোনি এসে তাঁর স্যুটকেশ নিয়ে গেলেন। ১৪ই মার্চ হাজি সাহেব সুভাষবাবুকে মধ্যাহ্ন ভোজনে সম্বর্দ্ধিত করলেন।

 নির্ধারিত দিনে বেলা ১টার সময় সুভাষচন্দ্র দুজন জার্মান ও একজন ইটালীয়ানের সঙ্গে যাত্রা করলেন। ছাড়পত্রে তাঁর নাম লেখা ছিল তারাতাইন। পরে খবর আসে মস্কো হয়ে ২৮শে মার্চ তিনি বার্লিনে গিয়ে পৌঁছান।


তারপর আর ঘটনা নয়—ইতিহাস।