পঞ্চক মালা/প্রেম বিদ্ধা
আশ্বিন মাসের ভোরের বেলায়—
বাগান তখন্ ফুল্-পরা,
সতেজ শ্যামল তরুর তলায়
গঙ্গা ছিল কুল্-ভরা
দাঁড়িয়ে তুমি (আত্ম-মগ্ন)
শিউলি-গন্ধি বাতাসে,
খুঁজ্তেছিলে নিশার স্বপ্ন
আশায় এবং হতাসে
ক্ষণেক পরে উঠ্লে কেঁপে—
উঠ্লে ফেঁপে সহসা,—
তরঙ্গেতে অঙ্গ ছেপে
গঙ্গা যেমন বিবশা।
ডাক্ল পাখী মিঠে গলায়
তুমি কাণে তুল্লে না;
নাচ্ল ছায়া তরুর তলায়
তুমি তাতে ভুল্লে না;
পাতার গায়ে বাতাস বেজে
উঠ্ল ঘন স্বনে গো;
তোমার পানে (ফুলে সেজে)
চাইল তরু বনে গো।
তুমি ছিলে বন্যা-জলে
কূলে কূলে ফুলিয়া;—
গঙ্গা সম গেলে চলে’
তরঙ্গেতে দুলিয়া।
তাহার পরে সূর্য্য-করে—
ঝলকিল ধারণী;
শাদা মেঘের মতন্ বেগে
গঙ্গা-বক্ষে তরণী,
চল্ল ছুটে; উঠ্ল ফুটে
চূর্ণ ঢেউ এর বুদ্বুদে,—
তারার কণা, হীরের দানা,
গাঁথা সোণার বিদ্যুতে।
প্রেমের বানে, সুখের টানে,
তুমিও গেলে অম্নি ত,—
প্রীতির ধারার মাঝে ধরা
করি’ প্রতিবিম্বিত।
নিরবধি গঙ্গা নদীর
মতন যদি বহিতে,
ভোরের গাথা, কুলু কথায়
নিত্য যদি কহিতে,
সিন্ধু-পানে স্রোতের টানে
চলে যেতে ছুটিয়া;
হীরে গাঁথা ঢেউ এর মাথায়
উঠ্ত আলো ফুটিয়া।
ক্ষীণ-ধারায় বালির কারায়
গড়িয়ে অতি মন্থরে,
তিলে তিলে শুকিয়ে গেলে
শুষ্ক মরণ-প্রান্তরে।
আজো ভোরের বাগান ভোরে’
ফোটে ফুলের কলি তা;
শিশির-সিক্ত বায়ু, নিত্য
ফুলের গন্ধে দলিত।
গাছের তলায় ছায়া খেলায়
স্বপ্নে রচি জড়িমা,
গঙ্গাজলে উছ্লে চলে
কিরণ-মাখা গরিমা।
তোমার ব্যথা তোমার কথা
নেইক কারো স্মরণে;
মাটির পৃথ্বীর দৃঢ় ভিত্তি,।
মানুষ মরে মরণে।
মাটির ভাণ্ড তাপে গড়া, সুখের বাঁধন্ পাপের দড়া;
নির্ম্মম এ বিধি আতি অলংঘ্য।
প্রাণটা যাহার বিশ্ব জোড়া, তারি বেশী কপাল্ পোড়া,
প্রীতির সুধার ধারে ঝরে কলঙ্ক!
গভীর শোকে ব্যথিত প্রাণে থাক্তে চেয়ে’ অতীত পানে,
মুখ্খানি লুকিয়ে ঘরের কোণে গো!
পায়ে ঠেলে তোমায় লোকে দেখ্ত চেয়ে ঘৃণার চোখে;
মোদের চেয়ে বাঘ-ভালুকো বনে গো—
মনে হয় যে ভাল বরং। ধিক্ মানুষের পুণ্য ধরম্!
পরকে দলে’ চরণতলে, সাধুতা?
যত ভণ্ড যত চোর, গলায় তাদের তত জোর;
নীরব সাধুর মাথায় তাদের পাদুকা!
এডিয়ে ভবের দুঃখ নানা, ছড়িয়ে তোমার প্রেমের ডানা,
উড়ে গেছ প্রেম-বিন্ধা, কোথা সে?
গঙ্গাতীরে ভোরের বেলায়, শিউলি-গন্ধি ছায়ার তলায়,
খুঁজেছিলে যারে আশায় হতাশে,
আজকে আবার শরৎকালে পাখায় পাখায় তালে তালে,
তারি সাথে যাচ্ছ উড়ে সুদূরে?
ভবের জালা ফেলে পিছে, জন্ম মৃত্যু রেখে নীচে,
পেয়েছ কি প্রেম পুণ্য শুধুরে?
তুমি চলে গেছ বোন্ না জানি সে কোন্ রাজ্যে!
ফেলে গেছ হায় শিশু অসহায় আজ যে।
তুমি ভুলেছ কি তার ক্ষীণ করুণার ক্রন্দন?
ছোট বক্ষের মৃদু দুঃখের ম্পন্দন?
তুমি ভুলেছ ব্যাধের গুরু আঘাতের
স্মৃতি কি?
পেয়েছ তোমার চির সাধনার
প্রীতি কি?
তুমি চলে গেছ বোন্ বহিয়ে জীবন
বাহিনী;
ফেলে গেছ ঢের দীর্ণ প্রাণের
কাহিনী।
তোমার দুঃখ ফুরিয়ে গেছে,
জ্বালা গেছে জুড়িয়ে।
এখন তোমার ব্যাথার,দুখের, ত্যক্ত অশ্রু, রক্ত বুকের,
পাষাণ থেকে মুছে চেঁচে
রাখ্ছি আমি কুড়িয়ে।
কুড়িয়ে ইতিহাসের খাতা, জুড়ে নিয়ে ছেঁড়াপাতা,
শোক-বিদ্ধ-অনুরাগে
পড়্ছি প্রাচীন যাতনা।
মুছে গেছে অনেক লেখা; লুপ্ত দুঃখের শীর্ণ রেখা
ফুটিয়ে নিয়ে কালো দাগে
কচ্চি নানা ভাবনা।
দেখ্ছি চেয়ে ফিরে ফিরে— কঠোর সমাজ-শিলার শিরে
প্রীতির স্মৃতি-ধ্বজ যথায়
রেখে গেছ উড়িয়ে।
অশ্রু গড়ায় আমার চোখে, ঘৃণার হাসি হাসে লোকে;
তোমার আজ্কে চিন্তা কি তায়?
ভাবনা গেছ পুড়িয়ে;
তোমার দুঃখ ফুরিয়ে গেছে
জ্বালা গেছে জুটিয়ে!