পঞ্চনদের তীরে/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
প্রথম ও দ্বিতীয় বলি
—“জয় জয়, ভারতবর্ষের জয়।”
সেই পূর্ণ-কণ্ঠের জয়ধ্বনি প্রবেশ করল আলেকজাণ্ডারের শিবিরের মধ্যে।
তারপরই সম্মিলিত গ্রীক-কণ্ঠে জাগল আবার সেই সমুদ্রগর্জনের মতো গম্ভীর ধ্বনি — “জয় জয়, আলেকজাণ্ডারের জয়!”
আলেকজাণ্ডার ভারতের ভাষা জানতেন না। জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার সৈন্যদের সঙ্গে বিদেশী ভাষায় কারা চীৎকার ক’রে কী বলছে?”
তখনি দোভাষী এসে জানালে, “তিনজন ভারতের সৈনিক এখান দিয়ে যাচ্ছিল। আমরা ভারত আক্রমণ করতে যাবো শুনে তারা ভারতের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে।”
আলেকজাণ্ডার বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, “আশ্চর্য ওদের সাহস! মাত্র ওরা তিনজন, অথচ আমার সৈন্যদের সামনে দাঁড়িয়ে ভারতের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে!”
—“সম্রাট, ওরা দাঁড়িয়ে নেই,—বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে যেতে চীৎকার করছে!”
দুই ভুরু কুঁচ্কে আলেকজাণ্ডার খানিকক্ষণ ধ’রে কি ভাবলেন। তারপর বললেন, “ঘোড়া ছুটিয়ে ওরা কোন দিকে গেল?”
—“দক্ষিণ দিকে।”
-“দক্ষিণ দিকে? তার মানে ভারতবর্ষের দিকে!” আলেকজাণ্ডার হঠাৎ এক লাফে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর চীৎকার ক’রে বললেন, “তেজী ঘোড়ায় চ’ড়ে আমার সৈনিকেরা এখনি ওদের পিছনে ছুটে যাক! ওদের বন্দী করো! ওদের বধ করো! নইলে আমরা মহাবিপদে পড়বো!”
হুকুম প্রচার করবার জন্যে দোভাষী তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে গেল। আলেকজাণ্ডার অস্থির চরণে শিবিরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বললেন, “আমার সৈন্যরা মূর্খ! কেন তারা ওদের ছেড়ে দিলে?”
কয়েকজন গ্রীক সেনানী সেইখানে উপস্থিত ছিলেন। একজন এগিয়ে এসে বললেন, “সম্রাট, তুচ্ছ কারণে আপনি এতটা উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? ঐ তিনজন মাত্র পলাতক সৈনিক আমাদের কী অপকার করতে পারে?”
আলেকজাণ্ডার বললেন, “তোমরাও কম মূর্খ নও! এই কি তুচ্ছ কারণ হ’ল? বুঝতে পারছ না, আমাদের এই অভিযানের কথা ভারত যত দেরিতে টের পায়, ততই ভালো! শত্রুদের প্রস্তুত হ’তে অবসর দেওয়া যে আত্মহত্যার চেষ্টার মতো! সারা ভারত যদি অস্ত্রধারণ করবার সময় পায়, তা’হলে আমাদের অবস্থা কী হবে? ঐ তিনজন সৈনিক ভারতে ছুটে চলেছে তাদের স্বদেশকে সাবধান করবার জন্যে! বন্দী করো, তাদের বধ করো, তাদের কণ্ঠরোধ করো!”
—সম্রাট, এখান থেকে ভারত শত-শত ক্রোশ দূরে! যাবার আগেই পলাতকরা নিশ্চয়ই ধরা পড়বে!”
“সত্যই তাই! সমরখন্দ এবং ভারতবর্ষ! তাদের মাঝখানে বিরাজ করছে শত-শত ক্রোশ ব্যাপী পথ ও বিপথের মধ্যে আমুদরিয়া প্রভৃতি নদী, হিন্দুকুশ প্রভৃতি পর্বত, বিজন অরণ্য, বৃহৎ মরুপ্রান্তর এবং আরো কত কি বিষম বাধা! এত বাধা-বিপত্তিকে ঠেলে দুর্গম পথের তিন যাত্রী কি আবার তাদের স্বদেশের আশ্রয়ে ফিরে আসতে পারবে? কত সূর্য ডুববে, কত চন্দ্র উঠবে, কত তারকা ফুটবে, বাতাস কখনো হবে আগুনের মতো গরম ও কখনো হবে তুষারের মতো শীতল, আকাশ কখনো করবে বজ্রপাত এবং কখনো পাঠিয়ে দেবে প্রবল ঝঞ্ঝার দলবল, বনে বনে গর্জন ক’রে জাগবে হিংস্র জন্তুুরা, আনাচে-কানাচে অতর্কিতে আবির্ভূত হবে তাদের চেয়ে আরো নিষ্ঠুর দস্যুরা এবং সেই সঙ্গে তাদের লক্ষ্য ক’রে রয়ে আসছে দৃঢ়-পণ নিয়ে ত্রিশজন অশ্বারোহী গ্রীক সৈনিক! ভারতের ছেলে আর কি ভারতে ফিরবে?
শেষোক্ত বিপদের কথা আগে তারা টের পায় নি। প্রত্যাবর্তন আরম্ভ ক’রে তাদের বেগবান অশ্বেরা অনেকখানি পথ এগিয়ে যাবার সুযোগ পেয়েছিল। ত্রিশজন গ্রীক সৈনিক সাজসজ্জা ক’রে বেরুতেও কম সময় নেয়নি। ভারতের তিন ভাগ্যান্বেষী বীর স্বদেশে ফেরবার পথ-ঘাটও ভালো ক’রে জানত, গ্রীকদের যা জানা ছিল না। তিনজন ভারতবাসী কখন্ কোন্ পথ অবলম্বন করছে, গ্রামে গ্রামে দাঁড়িয়ে প’ড়ে সে খবর সংগ্রহ করতেও গ্রীকদের যথেষ্ট বিলম্ব হয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু গ্রীকরা নিশ্চিত ভাবেই তিন বীরের পিছনে এগিয়ে চলেছে। কেবল তাই নয়, তারা ক্রমেই তাদের নিকটস্থ হচ্ছে।
সেদিন সকালে আমু-দরিয়া নদী পার হয়ে তিন বন্ধুতে বিশ্রাম করছিল।
হঠাৎ সুবন্ধু চম্কে দাঁড়িয়ে উঠে নদীর পরপারে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলে।
তার দৃষ্টি অনুসরণ ক’রে চিত্ররথ ও পুরঞ্জনও দেখলে, একখানা ধূলোর মেঘ নদীর ওপারে এসে থেমে পড়ল।
ধীরে ধীরে ধূলোর মেঘ উড়ে গেল এবং সেই সঙ্গেই দেখা গেল, একদল অশ্বারোহী সৈনিকের উজ্জ্বল শিরস্ত্রাণ ও বর্মের উপরে প’ড়ে ঝক্মক্ ক'রে উঠছে প্রভাতের সূর্যকিরণ!
সুবন্ধু সচকিত কণ্ঠে বললে, “গ্রীক সৈন্য!”
চিত্ররথ বললে, “ওরা পার-ঘাটে গিয়ে ঘোড়া থেকে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ল! ওরা নদী পার হ’তে চায়!”
পুরঞ্জন বললে, “এত শীঘ্র অত-বড় শিবির তুলে ওরা কি অভিযান আরম্ভ ক’রে দিয়েছে?”
সুবন্ধু ঘাড় নেড়ে বললে, “আসল বাহিনী হয়তো শিবির তোলবার চেষ্টাতে এখনো ব্যস্ত হয়ে আছে।”
—“তবে কি ওরা অগ্রবর্তী রক্ষীর দল?”
—“হতে পারে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, ওরা আমাদেরই খুঁজছে। নইলে ওরা প্রায় আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই এখানে এসেছে কেন? পথ তো ভারতে যাবার পথ নয়—এ পথ তো কেবল আমাদের মতো সন্ধানী লোকেরাই জানে! ওরা নিশ্চয় আমাদের উদ্দেশ্য ধ’রে ফেলেছে—ওরা নিশ্চয় আমাদের বন্দী করতে এসেছে!”
—“কিন্তু আমরা বন্দী হবো না। নদীপার হ’তে ওদের সময় লাগবে। ততক্ষণে আমরা অনেক দূরে এগিয়ে যেতে পারবো। ভারতে যাবার কত পথ আছে, সব পথ ওরা জানবে কি ক’রে?
—“ঘোড়ায় চড়ো, ঘোড়ায় চড়ো! ভারত এখনো বহু দূর—
তিন বীরকে পিঠে নিয়ে তিন ঘোড়া ছুটল আবার ভারতের দিকে।
ওপারে গ্রীকদের ব্যস্ততা আরো বেড়ে উঠল, মুখের শিকার আবার হাতছাড়া হ’ল দেখে।
আবার দিন যায় রাত আসে, রাত যায় দিন আসে। দিকচক্রবাল-রেখার উপরে ফুটে উঠল হিন্দুকুশের মর্মভেদী শিখরমালা। গ্রীকরা হতাশ হয়, তিন ভারত-বীরের চোখে জ্বলে আশার আলো। হিন্দুকুশের অন্দরে গিয়ে ঢুকতে পারলে কে আর তাদের নাগাল ধরতে পারবে? হিন্দুকুশের ওপার থেকে ডাকছে তাদের মহাভারতের প্রাচীন আত্মা! স্বদেশগামী ঘোড়াদের খুরে খুরে জাগছে বিদ্যুৎগতির ছন্দ!
বিস্তীর্ণ এক সমতল প্রান্তর— একান্ত অসহায়ের মতো দুপুরের রোদের আগুনে প’ড়ে প’ড়ে দগ্ধ হচ্ছে। প্রান্তরের শেষে একটা বেশ-উঁচু পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে পথ জুড়ে। তিন ঘোড়া পাশাপাশি ছুটছে সেই দিকেই।
পাহাড়ের খুব কাছে এসে হঠাৎ পুরঞ্জনের ঘোড়া প্রথমে দাঁড়িয়ে —তারপর মাটির উপরে শুয়ে পড়ল। দু-একবার ছট্ফট্ ক’রেই একেবারে স্থির!
পুরঞ্জন মাটির উপরে হাঁটু গেড়ে ব’সে ঘোড়াকে পরীক্ষা করতে লাগল, সুবন্ধু ও চিত্ররথও নিজের নিজের ঘোড়া থেকে নামল।
মৃতের মতো বর্ণহীন মুখ ঊর্ধ্বে তুলে পুরঞ্জন অবরুদ্ধ স্বরে বললে, “আমার ঘোড়া এ-জীবনে আর উঠবে না!”
সুবন্ধু বললে, “এখন ঘোড়া যাওয়ার মানেই হচ্ছে, শত্রুর হাতে বন্দী হওয়া। আমাদেরও ঘোড়ার অবস্থা ভালো নয়। এদের কোনটাই দুজন সওয়ার পিঠে নিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটতে পারবে না।”
চিত্ররথ পিছন দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিপাত ক’রে ত্রস্ত স্বরে বললে, “ওদিকে চেয়ে দেখো— ওদিকে চেয়ে দেখো!”
সকলে সভয়ে দেখলে, দূর অরণ্যের বক্ষ ভেদ ক’রে একে একে বেরিয়ে আসছে গ্রীক সৈনিকের পর গ্রাক সৈনিক! তাদের দেখেই তারা উচ্চস্বরে জয়নাদ ক’রে উঠল!
সুবন্ধু ব্যস্তভাবে বললে, “কি করি এখন? পুরঞ্জনকে এখানে ফেলে রেখে কি ক’রেই বা আমরা পালিয়ে যাই?”
পুরঞ্জন দৃঢ়স্বরে বললে, “শোনো হুবন্ধু! আমি এক উপায় স্থির করেছি। এখন এই উপায়ই হচ্ছে একমাত্র উপায়।”
গ্রীকরা তখন ঘোড়া ছুটিয়ে দ্রুততর বেগে এগিয়ে আসছে। সেইদিকে দৃষ্টি রেখে সুবন্ধু বললে, “যা বলবার শীঘ্র বলো। নইলে দাঁড়িয়ে দাড়িয়েই বন্দী হ’তে হবে”।
পুরঞ্জন সুদীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে বুক ফুলিয়ে বললে, “ভারতের ছেলে এত সহজে বন্দী হয় না! শোনো সুবন্ধু! সামনের উঁচু পাহাড় আর পিছনে গ্রীক সৈন্য—ঘোড়া ছুটিয়েও আমরা আর কোথাও পালাতে পারবো না! কিন্তু পাহাড়ের ঐ সরু পথটা দেখছ তো? পাশাপাশি দুজন লোক ও-পথে উপরে উঠতে পারে না! চলো, ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে ঐ পথে আমরা উপরে গিয়ে উঠি। গ্রীকদেরও ঘোড়া ছেড়ে ঐ পথেই এক-একজন ক’রে উঠতে হবে। আমি আর চিত্ররথ পাহাড়ে উঠে ঐ পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে শত্রুদের বাধা দেবো।”
সুবন্ধু বিস্মিত স্বরে বললে, “আর আমি?”
—“ভগবানের আশীর্বাদ নিয়ে তুমি ছুটে যাও ভারতের দিকে। তুমি একলা দু-চারদিন লুকিয়ে এগুতে পারবে। তারপর নতুন তাজ| ঘোড়া কিনে যথাসময়ে ভাঙিয়ে দেবে ভারতের নিশ্চিন্ত নিদ্রা।”
—“আর তোমরা?”
-—“যতক্ষণ পারি শত্রুদের ঠেকিয়ে রাখবো। তারপর স্বদেশের জন্যে হাসতে হাসতে প্রাণ দেবো।” -—“সে হয় না পুরঞ্জন! স্বদেশের জন্যে প্রাণ দেবার আনন্দ থেকে আমিই বা বঞ্চিত হবো কেন?”
পুরঞ্জন কর্কশ স্বরে বললে, “প্রতিবাদ কোরো না সুবন্ধু, এখন কথা-কাটাকাটির সময় নেই। গ্রীকরা যাচ্ছে ভারতবর্ষে, স্বদেশের জন্যে প্রাণ দেবার অনেক সুযোগ তুমি পাবে! এখন সব-চেয়ে বড় কর্তব্য তুমি পালন করো, শত্রুদের আমরা বাধা দিই।—চিত্ররথ! তুমি নীরব কেন? তোমার কি ভয় হচ্ছে?”
চিত্ররথ সদর্পে বললে, “ভয়! ক্ষত্রিয় মরতে ভয় পায়? আমি চুপ ক’রে আছি—কারণ মৌনই হচ্ছে সম্মতির লক্ষণ!”
পুরঞ্জন তরবারি কোষমুক্ত ক’রে পাহাড়ের দিকে ছুটতে ছুটতে বললে, “তা’হলে এসো আমার সঙ্গে! বলো—জয়, ভারতবর্ষের জয়!”
ভারতবর্ষের নামে জয়ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস পরিপূর্ণ ক’রে তিনজন ভারত-সন্তান সামনের পাহাড়ের দিকে বেগে ছুটে চলল। সেখানে গিয়ে পৌঁছেই সুবন্ধু বুঝলে,পুরঞ্জন ভুল বলে নি, এই সরু পথ রুখে দাঁড়ালে দুজন মাত্র লোক অনেকক্ষণ ধ’রে বহু লোককে বাধা দিতে পারবে!
প্রায় সত্তর-আশী ফুট উপরে গিয়ে পথটা আবার আরো সরু হয়ে গেছে।
পুরঞ্জন বললে, “এই হচ্ছে আমাদের দাঁড়াবার জায়গা! এখন অগ্রসর হও সুবন্ধু, আমাদের পিতৃভূমির পবিত্র পথে! জয়, ভারতবর্ষের জয়!”
সুবন্ধু ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললে, “ভাগ্যবান বন্ধু! দুদিন পরে বিরাট ভারতবর্ষ দেবে কৃতজ্ঞ হৃদয়ে তোমাদেরই নামে জয়ধ্বনি! এসো একবার শেষ আলিঙ্গন দাও! তারপর আমি চলি ঘুমন্ত ভারতের পথে, আর তোমরা চল জাগন্তু মৃত্যুর পথে!”
পুরঞ্জন সজোরে সুবন্ধুকে বুকের ভিতরে চেপে ধ’রে বললে, “না বন্ধু, মৃত্যুর পথ এখন ভারতের দিকেই অগ্রসর হয়েছে! আমরাও বাঁচবো না, তোমরাও বাঁচবে না, বিদায়!”
চিত্ররথকে আলিঙ্গন ক’রে সুবন্ধু যখন বেগে ছুটতে লাগল তখন তার দুই চোখ দিয়ে ঝরছে ঝর ঝর্ ক’রে অশ্রুর ঝরণা!
চিত্ররথ তার বিরাট দেহ নিয়ে সেই দেড়-হাত-সরু পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে অট্টহাস্য ক’রে বললে, “ভাই পুরঞ্জন, কাঁধ থেকে ধনুক নামাও! দেখছ, নির্বোধ গ্রীকদের কেউ ধনুক-বাণ আনেনি। আমাদের ধনুকের বাণগুলোই আজ ওদের উপরে উঠতে দেবে না।” ব’লেই সে নিজের ধনুক হাতে নিলে।
ওদিকে ত্রিশজন গ্রীক সৈনিক তখন পাহাড়ের তলদেশে এসে হাজির হয়েছে। এখানে ঘোড়া অচল এবং পদব্রজেও উপরে উঠে একসঙ্গে আক্রমণ করা অসম্ভব দেখে তারা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে পরামর্শ করতে লাগল।
তাদের অধ্যক্ষ তরবারি নেমে নীচে থেকে চেঁচিয়ে বললে, “ওরে ভারতের নির্বোধরা! ভালো চাস তো এখনো আত্মসমর্পণ কর, নইলে মৃত্যু তোদের নিশ্চিত!”
পুরঞ্জন ও চিত্ররথ কোনো জবাব দিলে না, কেবল ধনুকে বাণ লাগিয়ে পাথরের মূর্তির মতন স্থির হয়ে রইল ৷
অধ্যক্ষ চীৎকার ক’রে বললে, “শোনো গ্রীসের বিশ্বজয়ী বীরগণ! সম্রাটের আদেশ, হয় ওদের বন্দী, নয় বধ করতে হবে! প্রাণের ভয়ে ঐ কাপুরুষরা নীচে যখন নামতে রাজি নয়, তখন ওদের আক্রমণ করা ছাড়া উপায় নেই! যাও, তোমরা ওদের বন্দী করো, নয় ইঁদুরের মতো টিপে মেরে ফেলো!”
ঢাল, বর্শা, তরবারি নিয়ে গ্রীকরা পাহাড়ে-পথের উপরেউঠতে লাগল—কিন্তু একে একে, কারণ পাশাপাশি দুজনের ঠাঁই সেখানে নেই, এ-কথা আগেই বলা হয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে পুরঞ্জন ও চিত্ররথের ধনুকের ছিলায় জাগল মৃত্যু-বীণার অপূর্ব সঙ্গীত,—সাহসী যোদ্ধাদের চিত্তে চিত্তে নাচায় যা উন্মত্ত আনন্দের বিচিত্র নূপুর!
গ্রীকরা ঢাল তুলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে,
কিন্তু বৃথা! মিনিট-তিনেকের মধ্যেই চারজন গ্রীক সৈনিকের দেহ হত বা আহত হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নীচের দিকে নামতে লাগল!
চিত্ররথ তার প্রচণ্ড কণ্ঠে চীৎকার ক’রে বললে, “আয় রে গ্রীক কুক্কুরের দল! ভারতের দুই জোড়া বাহু আজ তোদের
ত্রিশজোড়া বাহুকে অক্ষম করে দেবে!”
পুরঞ্জন ধনুক থেকে বাণ ত্যাগ ক’রে বললে, “তোরা যদি না পারিস, তোদের সর্দার ডাকাত আলেকজাণ্ডারকে ডেকে আন!”
পাঁচ-ছয়বার চেষ্টার পর গ্রীকদের দলের এগারো জন লোক হত বা আহত হ’ল।
পুরঞ্জন সানন্দে বললে, “দু-ঘণ্টা কেটে গেছে! সুবন্ধুকে আর কেউ ধরতে পারবে না। জয়, ভারতবর্ষের জয়।”
গ্রীক সেনাধ্যক্ষ মনে মনে প্রমাদ গুণলে; ও-পথ হচ্ছে সাক্ষাৎমৃত্যুর পথ! ত্রিশজনের মধ্যে এগারোজন অক্ষম হয়েছে, বাকী আছে ঊনিশজন মাত্র! দুজনের কাছে ত্রিশজনের শক্তি ব্যর্থ, সম্রাট শুনলে কী বলবেন!
হঠাৎ একজন সৈনিক এসে খবর দিলে, “পাহাড়ে ওঠবার আর একটা নতুন পথ পাওয়া গেছে!”
সেনাধ্যক্ষ সানন্দে বললে, “জয় আলেকজাণ্ডারের জয়! আমরা নয়জনে এইখানেই থাকি। বাকী দশজনে নতুন পথ দিয়ে উপরে উঠে শত্রুদের পিছনে গিয়ে দাঁড়াক! তারপরে দুই দিক থেকে ওদের আক্রমণ করো!
বেশ-খানিকক্ষণ কেটে গেল! শত্রুদের কেউ আর উপরে ওঠবার চেষ্টা করছে না দেখে চিত্ররথ আশ্চর্য হয়ে বললে, “পুরঞ্জন, তাহ’লে আমরা কি অনন্ত কালের জন্যে এইখানেই ধনুকে তীর লাগিয়ে ব’সে থাকবো?
পুরঞ্জন, বললে, “হাঁ। যত সময় কাটবে, সুবন্ধু ততই দূরে গিয়ে পড়বে। আমরা তো তাইই চাই!”
পাহাড়ের গায়ে ছায়া ক্রমেই দীর্ঘতর হয়ে উঠতে লাগল। সূর্য গিয়েছে আকাশের পশ্চিমে।
আচম্বিতে পাহাড়ের উপর জেগে উঠল ঘন ঘন পাদুকার পর পাদুকার শব্দ!
চিত্ররথ মুখ ফিরিয়ে দেখেই কঠোর হাসি হেসে বললে, “পুরঞ্জন, এ-জীবনে শেষবারের মতো ভারতের নাম ক’রে নাও! জয় ভারতবর্ষের জয়! চেয়ে দেখো, শত্রুরা আমাদের পিছনে!”
—“শত্রুরা আমাদের দুই দিকেই! দেখো চিত্ররথ, নীচে থেকেও ওরা উপরে উঠছে!”
—“পুরঞ্জন, আমার ধনুকের জন্যে আর দু’টি মাত্র বাণ আছে!”
—“চিত্ররথ, আমার ধনুকের জন্যে আর একটিমাত্র বাণও নেই!”
—“তাহ’লে আবার বলো,—জয়, ভারতবর্ষের জয়!”
—“জয়, ভারতবর্ষের জয়! নাও তরবারি, ঝাঁপিয়ে পড়ো মৃত্যুর মুখে!”
পুরঞ্জন ও চিত্ররথের তরবারি নাচতে লাগল অধীর পুলকে, অস্তগামী সূর্যের শেষ-কিরণ আরক্ত ক’রে তুললে তাদের সাংঘাতিক আকাঙ্ক্ষাকে! তিনজন গ্রীক সৈনিকের মৃতদেহ পাহাড়ের কালো দেহকে লালে লাল ক’রে তুললে বটে, কিন্তু তারপর আর আত্মরক্ষা করতে পারলে না ভারতের বীরত্ব! ত্রিশজনের বিরুদ্ধে মাত্র দুইজন দাঁড়িয়ে চৌদ্দ জন শত্রুনাশ করেছে, কিন্তু তারপরেও অবশ্যম্ভাবীকে আর বাধা দেওয়া গেল না! গ্রীক তরবারির মুখে পুরঞ্জনের দক্ষিণ বাহু বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটির উপরে গিয়ে পড়ল, কিন্তু তখনো সে কাতর হ’ল না, বাম হাতে বর্শা নিয়ে শত্রুদের দিকে বেগে তেড়ে গেল আহত সিংহের মতো গর্জন ক’রে।
পর-মুহূর্তেই পুরঞ্জনের ছিন্নমুণ্ড দেহ ভূমিতলকে আশ্রয় করলে।
চিত্ররথেরও সর্বাঙ্গ দিয়ে ঝরছে তখন রক্তের রাঙা হাসি! প্রায়-বিবশ দেহে পাহাড়ের গা ধ’রে উঠে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে সে ব’লে উঠল, “নমস্কার ভারতবর্ষ! নমস্কার পঞ্চনদের তীর!” তারপরেই আবার এলিয়ে শুয়ে প’ড়ে অন্তিম নিশ্বাস ত্যাগ করলে।
গ্রীক সেনাধ্যক্ষ চমৎকৃত ভাবে দুই মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে বললে, “এই যদি ভারতের বীরত্বের নমুনা হয়, তাহ’লে আমাদের অদৃষ্ট নেহাৎ মন্দ বলতে হবে!”
আর একজন সৈনিক বললে, “এরা ছিল তো তিনজন, কিন্তু আর-একটা লোককে দেখতে পাচ্ছি না কেন?”
সেনাধ্যক্ষ চম্কে উঠে বললে, “ঠিক বলেছ, তাই তো! সে পালাতে পারলে এত রক্তারক্তি, হত্যাকাণ্ড সব ব্যর্থ হবে!”
গ্রীকরা ব্যস্ত হয়ে পাহাড়ের আরো উপরে উঠতে লাগল।
কিন্তু সুবন্ধু পাহাড় ছেড়ে নেমে গেছে পাঁচ ঘণ্টা আগে। স্বদেশের পথ থেকে তাকে আর কেউ ফিরিয়ে আনতে পারবে না। পুরঞ্জন ও চিত্ররথের আত্মদান বিফল হবে না।
তখনো ভীমার্জুনের বীরত্ব-গাথা প্রাচীন কাব্যের সম্পত্তি হয় নি। ভারতের বীরগণ তখন ভীমার্জুনকে প্রায় সমসাময়িক ব’লে মনে করতেন। ভারতের ঘরে ঘরে, পঞ্চনদের তীরে তাই তখন বিরাজ করত লক্ষ লক্ষ পুরঞ্জন ও চিত্ররথ!