পঞ্চভূত/সৌন্দর্য সম্বন্ধে সন্তোষ



সৌন্দর্য সম্বন্ধে সন্তোষ


 দীপ্তি এবং স্রোতস্বিনী উপস্থিত ছিলেন না, কেবল আমরা চারি জন ছিলাম।

 সমীর বলিল, ‘দেখো, সেদিনকার সেই কৌতুকহাস্যের প্রসঙ্গে আমার একটা কথা মনে উদয় হইয়াছে। অধিকাংশ কৌতুক আমাদের মনে একটা কিছু অদ্ভুত ছবি আনয়ন করে এবং তাহাতেই আমাদের হাসি পায়। কিন্তু যাহারা স্বভাবতঃই ছবি দেখিতে পায় না, যাহাদের বুদ্ধি অ্যাব্‌স্ট্রাক্ট্‌ বিষয়ের মধ্যে ভ্রমণ করিয়া থাকে, কৌতুক তাহাদিগকে সহসা বিচলিত করিতে পারে না।’

 ক্ষিতি কহিল, ‘প্রথমতঃ তোমার কথাটা স্পষ্ট বুঝা গেল না, দ্বিতীয়তঃ অ্যাব্‌স্ট্রাক্ট্‌ শব্দটা ইংরাজি।’

 সমীর কহিল, ‘প্রথম অপরাধটা খণ্ডন করিবার চেষ্টা করিতেছি। কিন্তু দ্বিতীয় অপরাধ হইতে নিস্কৃতির উপায় দেখি না, অতএব সুধীগণকে ওটা নিজ গুণে মার্জনা করিতে হইবে। আমি বলিতেছিলাম, যাহারা দ্রব্যটাকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়া তাহার গুণটাকে অনায়াসে গ্রহণ করিতে পারে তাহারা স্বভাবতঃ হাস্যরসরসিক হয় না।’

 ক্ষিতি মাথা নাড়িয়া কহিল, ‘উঁহু, এখনো পরিষ্কার হইল না।’

 সমীর কহিল, ‘একটা উদাহরণ দিই। প্রথমতঃ দেখো, আমাদের সাহিত্যে কোনো সুন্দরীর বর্ণনা-কালে ব্যক্তিবিশেষের ছবি আঁকিবার দিকে লক্ষ্য নাই; সুমেরু দাড়িম্ব কদম্ব বিম্ব প্রভৃতি হইতে কতকগুলি গুণ বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়া তাহারই তালিকা দেওয়া হয় এবং সুন্দরীমাত্রেরই প্রতি তাহার আরোপ হইয়া থাকে। আমরা ছবির মতো স্পষ্ট করিয়া কিছু দেখি না এবং ছবি আঁকি না, সেই জন্য কৌতুকের একটি প্রধান অঙ্গ হইতে আমরা বঞ্চিত। আমাদের প্রাচীন কাব্যে প্রশংসাচ্ছলে গজেন্দ্রগমনের সহিত সুন্দরীর মন্দগতির তুলনা হইয়া থাকে। এ তুলনাটি অন্যদেশীয় সাহিত্যে নিশ্চয়ই হাস্যকর বলিয়া গণ্য হইত। কিন্তু এমন একটা অদ্ভূত তুলনা আমাদের দেশে উদ্ভূত এবং সাধারণের মধ্যে প্রচলিত হইল কেন। তাহার প্রধান কারণ, আমাদের দেশের লোকেরা দ্রব্য হইতে তাহার গুণটা অনায়াসে বিশ্লিষ্ট করিয়া লইতে পারে। ইচ্ছামতো হাতি হইতে হাতির সমস্তটাই লোপ করিয়া দিয়া কেবলমাত্র তাহার মন্দগমনটুকু বাহির করিতে পারে, এই জন্য ষোড়শী সুন্দরীর প্রতি যখন গজেন্দ্রগমন আরোপ করে তখন সেই বৃহদাকার জন্তুটাকে একেবারেই দেখিতে পায় না। যখন একটা সুন্দর বস্তুর সৌন্দর্য বর্ণনা করা কবির উদ্দেশ্য হয় তখন সুন্দর উপমা নির্বাচন করা আবশ্যক; কারণ, উপমার কেবল সাদৃশ্য-অংশ নহে, অন্যান্য অংশও আমাদের মনে উদয় না হইয়া থাকিতে পারে না। সেই জন্য হাতির শুঁড়ের সহিত স্ত্রীলোকের হাত-পায়ের বর্ণনা করা সামান্য দুঃসাহসিকতা নহে। কিন্তু আমাদের দেশের পাঠক এ তুলনায় হাসিল না, বিরক্ত হইল না; তাহার কারণ, হাতির শুঁড় হইতে কেবল তাহার গোলত্বটুকু লইয়া আর সমস্তই আমরা বাদ দিতে পারি, আমাদের সেই আশ্চর্য ক্ষমতাটি আছে। গৃধিনীর সহিত কানের কী সাদৃশ্য আছে বলিতে পারি না, আমার তদুপযুক্ত কল্পনাশক্তি নাই; কিন্তু সুন্দর মুখের দুই পাশে দুই গৃধিনী ঝুলিতেছে মনে করিয়া হাসি পায় না কল্পনাশক্তির এত অসাড়তাও আমার নাই। বোধ করি ইংরাজি পড়িয়া আমাদের না-হাসিবার স্বাভাবিক ক্ষমতা বিকৃত হইয়া যাওয়াতেই এরূপ দুর্ঘটনা ঘটে।’

 ক্ষিতি কহিল, ‘আমাদের দেশের কাব্যে নারীদেহের বর্ণনায় যেখানে উচ্চতা বা গোলতা বুঝাইবার আবশ্যক হইয়াছে সেখানে কবির অনায়াসে গম্ভীরমুখে সুমেরু এবং মেদিনীর অবতারণা করিয়াছেন; তাহার কারণ, অ্যাব্‌স্ট্র্যাক্টের দেশে পরিমাণবিচারের আবশ্যকতা নাই। গোরুর পিঠের কুঁজও উচ্চ, কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরও উচ্চ; অতএব অ্যাব্‌স্ট্র্যাক্ট্‌ উচ্চতাটুকু মাত্র ধরিতে গেলে গোরুর পিঠের কুঁজের সহিত কাঞ্চনজঙ্ঘার তুলনা করা যাইতে পারে। কিন্তু যে হতভাগ্য কাঞ্চনজঙ্ঘার উপমা শুনিবামাত্র কল্পনাপটে হিমালয়ের শিখর চিত্রিত দেখিতে পায়, যে বেচারা গিরিচূড়া হইতে আলগোছে কেবল তাহার উচ্চতাটুকু লইয়া বাকি আর সমস্তই আড়াল করিতে পারে না, তাহার পক্ষে বড়োই মুশ্‌কিল। ভাই সমীর, তোমার আজিকার এই কথাটা ঠিক মনে লাগিতেছে— প্রতিবাদ না করিতে পারিয়া অত্যন্ত দুঃখিত আাছি।’

 ব্যোম কহিল, ‘কিছু প্রতিবাদ করিবার নাই তাহা বলিতে পারি না। সমীরের মতটা কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে বলা আবশ্যক। আসল কথাটা এই, আমরা অন্তর্জগৎবিহারী। বাহিরের জগৎ আমাদের নিকট প্রবল নহে। আমরা যাহা মনের মধ্যে গড়িয়া তুলি বাহিরের জগৎ তাহার প্রতিবাদ করিলে, সে প্রতিবাদ গ্রাহ্যই করি না। যেমন ধূমকেতুর লঘু পুচ্ছটা কোনো গ্রহের পথে আসিয়া পড়িলে তাহার পুচ্ছেরই ক্ষতি হইতে পারে, কিন্তু গ্রহ অপ্রতিহত ভাবে অনায়াসে চলিয়া যায়, তেমনি বহির্জগতের সহিত আমাদের আন্তর্জগতের রীতিমতো সংঘাত কোনো কালে হয় না— হইলে বহির্জগৎটাই হঠিয়া যায়। যাহাদের কাছে হাতিটা অত্যন্ত প্রত্যক্ষ প্রবল সত্য, তাহারা গজেন্দ্রগমনের উপমায় গজেন্দ্রটাকে বেমালুম বাদ দিয়া কেবল গমনটুকুকে রাখিতে পারে না— গজেন্দ্র বিপুল দেহ বিস্তার-পূর্বক আটল ভাবে কাব্যের পথরোধ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকে। কিন্তু আমাদের কাছে, গজ বলো, গজেন্দ্র বলো, কিছুই কিছু নয়। সে আমাদের কাছে এত অধিক জাজ্বল্যমান নহে যে, তাহার গমনটুকু রাখিতে হইলে তাহাকে সুদ্ধ পুষিতে হইবে।’

 ক্ষিতি কহিল, ‘আমরা অন্তরে বাঁশের কেল্লা বাঁধিয়া তীতুমীরের মতো বহিঃপ্রকৃতির সমস্ত ‘গোলা খা ডালা’— সেই জন্য গজেন্দ্র বলে, সুমেরু বলো, মেদিনী বলো, কিছুতেই আমাদিগকে হঠাইতে পারে না। কাব্যে কেন, জ্ঞানরাজ্যেও আমরা বহির্জগৎকে খাতিরমাত্র করি না। একটা সহজ উদাহরণ মনে পড়িতেছে। আমাদের সাত সুর ভিন্ন ভিন্ন পশুপক্ষীর কণ্ঠস্বর হইতে প্রাপ্ত, ভারতবর্ষীয় সংগীতশাস্ত্রে এই প্রবাদ বহুকাল চলিয়া আসিতেছে। এ পর্যন্ত আমাদের ওস্তাদদের মনে এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহমাত্র উদয় হয় নাই, অথচ বহির্জগৎ হইতে প্রতিদিনই তাহার প্রতিবাদ আমাদের কানে আসিতেছে। স্বরমালার প্রথম সুরটা যে গাধার সুর হইতে চুরি, এরূপ পরমাশ্চর্য কল্পনা কেমন করিয়া যে কোনো সুরজ্ঞ ব্যক্তির মনে উদয় হইল তাহা আমাদের পক্ষে স্থির করা দুরূহ।’

 ব্যোম কহিল, ‘গ্রীকদিগের নিকট বহির্জগৎ বাষ্পবৎ মরীচিকাবৎ ছিল না, তাহা প্রত্যক্ষ জাজ্বল্যমান ছিল; এই জন্য অত্যন্ত যত্ন-সহকারে তাঁহাদিগকে মনের সৃষ্টির সহিত বাহিরের সৃষ্টির সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে হইত। কোনো বিষয়ে পরিমাণলঙ্ঘন হইলে বাহিরের জগৎ আপন মাপকাঠি লইয়া তাঁহাদিগকে লজ্জা দিত। সেই জন্য তাঁহারা আপন দেবদেবীর মুর্তি সুন্দর এবং স্বাভাবিক করিয়া গড়িতে বাধ্য হইয়াছিলেন; নতুবা জাগতিক সৃষ্টির সহিত তাঁহাদের মনের সৃষ্টির একটা প্রবল সংঘাত বাধিয়া তাঁহাদের ভক্তির ও আনন্দের ব্যাঘাত করিত। আমাদের সে ভাবনা নাই। আমরা আমাদের দেবতাকে যে মূর্তিই দিই না কেন, আমাদের কল্পনার সহিত বা বহির্জগতের সহিত তাহার কোনো বিরোধ ঘটে না। মূষিকবাহন চতুর্ভুজ একদন্ত লম্বোদর গজানন মূতি আমাদের নিকট হাস্যজনক নহে; কারণ আমরা সেই মূর্তিকে আমাদের মনের ভাবের মধ্যে দেখি— বাহিরের জগতের সহিত,চারি দিকের সত্যের সহিত তাহার তুলনা করি না। কারণ, বাহিরের জগৎ আমাদের নিকট তেমন প্রবল নহে, প্রত্যক্ষ সত্য আমাদের নিকট তেমন সুদৃঢ় নহে; আমরা যে কোনো একটা উপলক্ষ্য অবলম্বন করিয়া নিজের মনের ভাবটাকে জাগ্রত করিয়া রাখিতে পারি।’

 সমীর কহিল, ‘যেটাকে উপলক্ষ্য করিয়া আমরা প্রেম বা ভক্তির উপভোগ অথবা সাধনা করিয়া থাকি, সেই উপলক্ষ্যটাকে সম্পূর্ণতা বা সৌন্দর্য বা স্বাভাবিকতায় ভূষিত করিয়া তোলা আমরা অনাবশ্যক মনে করি। আমরা সম্মুখে একটা কুগঠিত মূর্তি দেখিয়াও মনে তাহাকে সুন্দর বলিয়া অনুভব করিতে পারি। মানুষের ঘননীলবর্ণ আমাদের নিকট স্বভাবতঃ সুন্দর মনে না হইতে পারে, অথচ ঘননীলবর্ণে চিত্রিত কৃষ্ণের মূর্তিকে সুন্দর বলিয়া ধারণা করিতে আমাদিগকে কিছুমাত্র প্রয়াস পাইতে হয় না। বহির্জগতের আদর্শকে যাহারা নিজের ইচ্ছামতে লোপ করিতে জানে না, তাহারা মনের সৌন্দর্যভাবকে মূর্তি দিতে গেলে কখনোই কোনো অস্বাভাবিকতা বা অসৌন্দর্যের সমাবেশ করিতে পারে না। গ্রীকদের চক্ষে এই নীলবর্ণ অত্যন্ত অধিক পীড়া উৎপাদন করিত।’

 ব্যোম কহিল, ‘আমাদের ভারতবর্ষীয় প্রকৃতির এই বিশেষত্বটি উচ্চ অঙ্গের কলাবিদ্যার ব্যাঘাত করিতে পারে, কিন্তু ইহার একটু সুবিধাও আছে। ভক্তি স্নেহ প্রেম, এমন কি, সৌন্দর্যভোগের জন্য আমাদিগকে বাহিরের দাসত্ব করিতে হয় না, সুবিধা-সুযোগের প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিতে হয় না। আমাদের দেশের স্ত্রী স্বামীকে দেবতা বলিয়া পূজা করে, কিন্তু সেই ভক্তিভাব উদ্রেক করিবার জন্য স্বামীর দেবত্ব বা মহত্ত্ব থাকিবার কোনো আবশ্যক করে না; এমন কি, ঘোরতর পশুত্ব থাকিলেও পূজার ব্যাঘাত হয় না। তাহারা এক দিকে স্বামীকে মানুষভাবে লাঞ্ছনা গঞ্জনা করিতে পারে, আবার জন্য দিকে দেবতাভাবে পূজাও করিয়া থাকে। একটাতে অন্যটা অভিভূত হয় না। কারণ, আমাদের মনোজগতের সহিত বাহ্যজগতের সংঘাত তেমন প্রবল নহে।’

 সমীর কহিল, ‘কেবল স্বামীদেবতা কেন, পৌরাণিক দেবদেবী সম্বন্ধেও আমাদের মনের এইরূপ দুই বিরোধী ভাব আছে— তাহারা পরস্পর পরস্পরকে দূরীকৃত করিতে পারে না। আমাদের দেবতাদের সম্বন্ধে ষে সকল শাস্ত্রকাহিনী ও জনপ্রবাদ প্রচলিত আছে তাহা আমাদের ধর্মবুদ্ধির উচ্চ আদর্শ-সংগত নহে; এমন কি, আমাদের সাহিত্যে, আমাদের সংগীতে সেই সকল দেবকুৎসার উল্লেখ করিয়া বিস্তর তিরস্কার ও পরিহাসও আছে— কিন্তু ব্যঙ্গ ও ভৎর্সনা করি বলিয়া যে ভক্তি করি না তাহা নহে। গাভীকে জন্তু বলিয়া জানি, তাহার বুদ্ধিবিবেচনার প্রতিও কটাক্ষপাত করিয়া থাকি, খেতের মধ্যে প্রবেশ করিলে লাঠি হাতে তাহাকে তাড়াও করি, গোয়ালঘরে তাহাকে একহাঁটু গোময়পঙ্কের মধ্যে দাঁড় করাইয়া রাখি; কিন্তু ভগবতী বলিয়া ভক্তি করিবার সময় সে সব কথা মনেও উদয় হয় না।’

 ক্ষিতি কহিল, ‘আবার দেখো, আমরা চিরকাল বেসুরো লোককে গাধার সহিত তুলনা করিয়া আসিতেছি, অথচ বলিতেছি গাধাই আমাদিগকে প্রথম সুর ধরাইয়া দিয়াছে। যখন এটা বলি তখন ওটা মনে আনি না, যখন ওটা বলি তখন এটা মনে আনি না। ইহা আমাদের একটা বিশেষ ক্ষমতা সন্দেহ নাই, কিন্তু এই বিশেষ ক্ষমতা-বশতঃ ব্যোম যে সুবিধার উল্লেখ করিতেছেন আমি তাহাকে সুবিধা মনে করি না। কাল্পনিক সৃষ্টি বিস্তার করিতে পারি বলিয়া অর্থলাভ জ্ঞানলাভ এবং সৌন্দর্যভোগ সম্বন্ধে আমাদের একটা ঔদাসীন্যজড়িত সস্তোষের ভাব আছে। আমাদের বিশেষ কিছু আবশ্যক নাই। যুরোপীয়েরা তাঁহাদের বৈজ্ঞানিক অনুমানকে কঠিন প্রমাণের দ্বারা সহস্র বার করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখেন, তথাপি তাঁহাদের সন্দেহ মিটিতে চায় না; আমরা মনের মধ্যে যদি বেশ একটা সুসংগত এবং সুগঠিত মত খাড়া করিতে পারি তবে তাহার সুসংগতি এবং সুষমাই আমাদের নিকট সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ বলিয়া গণ্য হয়, তাহাকে বহির্জগতে পরীক্ষা করিয়া দেখা বাহুল্য বোধ করি। জ্ঞানবৃত্তি সম্বন্ধে যেমন হৃদয়বৃত্তি সম্বন্ধে সেইরূপ। আমরা সৌন্দর্যরসের চর্চা করিতে চাই, কিন্তু সে জন্য অতি যত্ন-সহকারে মনের আদর্শকে বাহিরে মূতিমান করিয়া তোলা আবশ্বক বোধ করি না— যেমন-তেমন একটা-কিছু হইলেই সন্তুষ্ট থাকি। এমন কি, আলংকারিক অত্যুক্তি অনুসরণ করিয়া একটা বিকৃত মূর্তি থাড়া করিয়া তুলি এবং সেই অসংগত বিরূপ বিসদৃশ ব্যাপারকে মনে মনে আপন ইচ্ছা-মতো ভাবে পরিণত করিয়া তাহাতেই পরিতৃপ্ত হই। আপন দেবতাকে, আপন সৌন্দর্যের আদর্শকে প্রকৃতরূপে সুন্দর করিয়া তুলিবার চেষ্টা করি না। ভক্তিরসের চর্চা করিতে চাই, কিন্তু যথার্থ ভক্তির পাত্র অন্বেষণ করিবার কোনো আবশ্যকতা বোধ করি না— অপাত্রে ভক্তি করিয়াও আমরা সস্তোষে থাকি। সেই জন্য আমরা বলি গুরুদেব আমাদের পূজনীয়; এ কথা বলি না যে যিনি পূজনীয় তিনি আমাদের শুরু। হয়তো গুরু আমার কানে যে মন্ত্র দিয়াছেন তাহার অর্থ তিনি কিছুই বুঝেন না, হয়তো গুরুঠাকুর আমার মিথ্যা মোকদ্দমায় প্রধান মিথ্যাসাক্ষী, তথাপি তাঁহার পদধূলি আমার শিরোধার্য— এরূপ মত গ্রহণ করিলে ভক্তির জন্য ভক্তিভাজনকে খুঁজিতে হয় না, দিব্য আরামে ভক্তি করা যায়।’

 সমীর কহিল, ‘ইংরাজি শিক্ষার প্রভাবে আমাদের মধ্যে ইহার ব্যতিক্রম ঘটিতেছে। বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্র তাহার একটি উদাহরণ। বঙ্কিম কৃষ্ণকে পূজা করিবার এবং কৃষ্ণপূজা প্রচার করিবার পূর্বে কৃষ্ণকে নির্মল এবং সুন্দর করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিয়াছেন। এমন কি, কৃষ্ণের চরিত্রে অনৈসর্গিক যাহা কিছু ছিল তাহাও তিনি বর্জন করিয়াছেন। তিনি কৃষ্ণকে তাঁহার নিজের উচ্চতম আদশের উপর প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। তিনি এ কথা বলেন নাই যে, দেবতার কোনো কিছুতেই দোষ নাই, তেজীয়ানের পক্ষে সমস্ত মার্জনীয়। তিনি এক নূতন অসন্তোষের সূত্রপাত করিয়াছেন; তিনি পূজাবিতরণের পূর্বে প্রাণপণ চেষ্টায় দেবতাকে অন্বেষণ করিয়াছেন ও হাতের কাছে যাহাকে পাইয়াছেন তাহাকেই নমোনমঃ করিয়া সন্তুষ্ট হন নাই।’

 ক্ষিতি কহিল, ‘এই অসন্তোষটি না থাকাতে বহুকাল হইতে আমাদের সমাজে দেবতাকে দেবতা হইবার, পূজ্যকে উন্নত হইবার, মূর্তিকে ভাবের অনুরূপ হইবার প্রয়োজন হয় নাই। ব্রাহ্মণকে দেবতা বলিয়া জানি, সেই জন্য বিনা চেষ্টায় তিনি পূজা প্রাপ্ত হন, এবং আমাদেরও ভক্তিবৃত্তি অতি অনায়াসে চরিতার্থ হয়। স্বামীকে দেবতা বলিলে স্ত্রীর ভক্তি পাইবার জন্য স্বামীর কিছুমাত্র যোগ্যতা-লাভের আবশ্যক হয় না, এবং স্ত্রীকেও যথার্থ ভক্তির যোগ্য স্বামী -অভাবে অসন্তোষ আনুভব করিতে হয় না। সৌন্দর্য অনুভব করিবার জন্য সুন্দর জিনিসের আবশ্যকতা নাই, ভক্তি বিতরণ করিবার জন্য ভক্তিভাজনের প্রয়োজন নাই— এরূপ পরমসন্তোষের অবস্থাকে আমি সুবিধা মনে করি না। ইহাতে কেবল সমাজের দীনতা শ্রীহীনতা এবং অবনতি ঘটিতে থাকে। বহির্জগৎটাকে উত্তরোত্তর বিলুপ্ত করিয়া দিয়া মনোজগৎকেই সর্বপ্রাধান্য দিতে গেলে যে ডালে বসিয়া আছি সেই ডালকেই কুঠারাঘাত করা হয়।’