পত্রপুট/১০
দশ
এই দেহখানা বহন ক’রে আসছে দীর্ঘকাল
বহু ক্ষুদ্র মুহূর্তের রাগ দ্বেষ ভয় ভাবনা,
কামনার আবর্জনারাশি।
এর আবিল আবরণে বারে বারে ঢাকা পড়ে
আত্মার মুক্ত রূপ।
এ সত্যের মুখোষ প’রে সত্যকে আড়ালে রাখে;
মৃত্যুর কাদামাটিতেই গড়ে আপনার পুতুল,
তবু তার মধ্যে মৃত্যুর আভাস পেলেই
নালিশ করে আর্তকণ্ঠে।
খেলা করে নিজেকে ভোলাতে,
কেবলি ভুলতে চায় যে সেটা খেলা।
প্রাণপণ সঞ্চয়ে রচনা করে মরণের অর্ঘ্য;
স্তুতিনিন্দার বাষ্পবুদ্বুদে ফেনিল হয়ে
পাক খায় ওর হাসিকান্নার আবর্ত।
বক্ষ ভেদ ক’রে ও হাউয়ের আগুন দেয় ছুটিয়ে,
শূন্যের কাছ থেকে ফিরে পায় ছাই,—
দিনে দিনে তাই করে স্তূপাকার।
প্রতিদিন যে প্রভাতে পৃথিবী
প্রথম সৃষ্টির অক্লান্ত নির্মল দেববেশে দেয় দেখা,
আমি তা’র উন্মীলিত আলোকের অনুসরণ ক’রে
অন্বেষণ করি আপন অন্তরলোক।
অসংখ্য দণ্ড পল নিমেষের জটিল মলিন জালে বিজড়িত
দেহটাকে সরিয়ে ফেলি মনের থেকে,—
যেখানে স’রে যায় অন্ধকার রাতের
নানা ব্যর্থ ভাবনার অত্যুক্তি,
যায় বিস্মৃত দিনের অনবধানে পুঞ্জিত লেখন যত,—
সেই সব নিমন্ত্রণ-লিপি নীরব যার আহ্বান,
নিঃশেষিত যার প্রত্যুত্তর।
তখন মনে পড়ে, সবিতা,
তোমার কাছে ঋষি-কবির প্রার্থনা মন্ত্র,—
যে মন্ত্রে বলেছিলেন,—হে পূষণ,
তোমার হিরন্ময় পাত্রে সত্যের মুখ আচ্ছন্ন,
উন্মুক্ত করো সেই আবরণ।
আমিও প্রতিদিন উদয়দিগ্বলয় থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মিচ্ছটায়
প্রসারিত ক’রে দিই আমার জাগরণ,
বলি,—হে সবিতা,
সরিয়ে দাও আমার এই দেহ, এই আচ্ছাদন,—
তোমার তেজোময় অঙ্গের সূক্ষ্ম অগ্নিকণায়
রচিত যে-আমার দেহের অণু পরমাণু,
তারো অলক্ষ্য অন্তরে আছে তোমার কল্যাণতম রূপ,
তাই প্রকাশিত হোক আমার নিরাবিল দৃষ্টিতে
আমার অন্তরতম সত্য
আদি যুগে অব্যক্ত পৃথিবীর সঙ্গে
তোমার বিরাটে ছিল বিলীন
সেই সত্য তোমারি।
তোমার জ্যোতির স্তিমিত কেন্দ্রে মানুষ
আপনার মহৎস্বরূপকে দেখেছে কালে কালে,
কখনো নীল মহানদীর তীরে,
কখনো পারস্যসাগরের কূলে,
কখনো হিমাদ্রি-গিরিতটে,—
বলেছে, জেনেছি আমরা অমৃতের পুত্র,
বলেছে, দেখেছি অন্ধকারের পার হতে
আদিত্যবর্ণ মহান পুরুষের আবির্ভাব।