আট

আমাকে এনে দিল এই বুনো চারাগাছটি।
পাতার রং হলদে সবুজ,
ফুলগুলি যেন আলো পান করবার
শিল্প-করা পেয়ালা, বেগুনি রঙের।
প্রশ্ন করি, নাম কী,
জবাব নেই কোনোখানে।
ও আছে বিশ্বের অসীম অপরিচিতের মহলে
যেখানে আছে আকাশের নামহারা তারা।
আমি ওকে ধ’রে এনেছি একটি ডাক-নামে
আমার একলা জানার নিভৃতে।
ওর নাম পেয়ালী।
বাগানের নিমন্ত্রণে এসেছে ডালিয়া, এসেছে ফুশিয়া,
এসেছে ম্যারিগোল্ড্,
ও আছে অনাদরের অচিহ্নিত স্বাধীনতায়,
জাতে বাঁধা পড়েনি।
ও বাউল, ও অসামাজিক।
দেখতে দেখতে ঐ খসে পড়ল ফুল।
যে শব্দটুকু হোলো বাতাসে
কানে এল না।

ওর কুষ্ঠির রাশিচক্র যে নিমেষগুলির সমবায়ে
অণুপরিমাণ তার অঙ্ক,
ওর বুকের গভীরে যে মধু আছে
কণাপরিমাণ তার বিন্দু।
একটুকু কালের মধ্যে সম্পূর্ণ ওর যাত্রা,
একটি কল্পে যেমন সম্পূর্ণ
আগুনের পাপড়ি-মেলা সূর্যের বিকাশ।
ওর ইতিহাসটুকু অতি ছোটো পাতার কোণে
বিশ্ব-লিপিকারের অতি ছোটো কলমে লেখা।


তবু তারই সঙ্গে সঙ্গে উদ্ঘাটিত হচ্ছে বৃহৎ ইতিহাস।
দৃষ্টি চলে না এক পৃষ্ঠা থেকে অন্য পৃষ্ঠায়।
শতাব্দীর যে নিরন্তর স্রোত বয়ে চলেছে
বিলম্বিত তালের তরঙ্গের মতো,
যে ধারায় উঠল নামল কত শৈলশ্রেণী,
সাগরে মরুতে কত হোলো বেশ পরিবর্তন,
সেই নিরবধি কালেরই দীর্ঘ প্রবাহে এগিয়ে এসেছে
এই ছোটো ফুলটির আদিম সংকল্প
সৃষ্টির ঘাতপ্রতিঘাতে।


লক্ষ লক্ষ বৎসর এই ফুলের ফোটা-ঝরার পথে
সেই পুরাতন সংকল্প রয়েছে নূতন, রয়েছে সজীব সচল,
ওর শেষ সমাপ্ত ছবি আজও দেয়নি দেখা।

এই দেহহীন সংকল্প, সেই রেখাহীন ছবি
নিত্য হয়ে আছে কোন্ অদৃশ্যের ধ্যানে।
যে অদৃশ্যের অন্তহীন কল্পনায় আমি আছি,
যে অদৃশ্যে বিধৃত সকল মানুষের ইতিহাস
অতীতে ভবিষ্যতে॥

শান্তিনিকেতন ৫ নভেম্বর, ১৯৩৫