পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১০

পরবর্ত্তী চারখানি পত্র শরৎচন্দ্র বসুকে লিখিত

১০
কটক
২২শে আগষ্ট ১৯১২

পরম পূজনীয় মেজদাদা:

 কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনাকে এই পত্র লিখিতেছি, যদিও জানি যাইবার প্রস্তুতিতে আপনি ব্যস্ত ও উদ্বিগ্ন থাকিবেন! কিন্তু এই পত্রখানিই আপনি ভারতে থাকাকালে আমার শেষ পত্র, শুধু এই ভাবিয়াই কলম ধরিলাম!

 শুধু একটি উদ্দেশ্য একটি অনুরোধ জানাইবার জন্য এই চিঠি লিখিতেছি; তাহা এই: আপনি বিলাত যাত্রার পথে যে সমস্ত বিভিন্ন জিনিষ দেখিবেন আমাকে তাহার বর্ণনা দিয়া আনন্দ ও শিক্ষা দান করিবেন এবং বৈদেশিক ও অভিনব পরিবেশে আপনার অনুভূতির আস্বাদ আমাকে দিবেন।

 জাহাজ বোম্বাই বন্দর ত্যাগ করিয়া যখন তীর হইতে দূরে আরও দূরে সরিয়া যাইবে ও যখন বনরেখা এমনকি স্বদেশের শেষ নীল তটরেখাটি পর্য্যন্ত একখণ্ড মেঘের ন্যায় দিগন্তে মিলাইয়া যাইবে, তখন উত্তুঙ্গ তরঙ্গরজি যাহা ভেদ করিয়া আপনার তরী চলিয়াছে—উপরে নীল আকাশ ও নীচে অসীম জলরাশি—প্রকৃতির এই বিভিন্ন রূপের দিকে চাহিয়া আপনার মনে কোন্ বিচিত্র ভাবের উদয় হইবে? ইহা দেখিয়া কি আপনার আরভিং-এর সেই পংক্তিগুলি মনে পড়িবে,— “মনে হইতেছে যেন আমি পৃথিবীর এক অধ্যায় শেষ করিয়া পরবর্ত্তী অধ্যায় প্রবেশের পূর্ব্বে ধ্যানমগ্ন রহিয়াছি,” অথবা আপনি ওই লেখকেরই নিম্নোক্ত পংক্তিগুলির পুনরাবৃত্তি করিবেন—“ইহার দ্বারা এই চেতনা আমাদের হয় যে আমরা সুনিশ্চিন্ত জীবন যাত্রা হইতে ছিন্ন হইয়া এক সংশয়াচ্ছন্ন পৃথিবীর দিকে ভাসিয়া চলিয়াছি।” বলা বাহুল্য যে কেহই দুইটির মধ্যে প্রথমটি বাছিয়া লইবেন না।

 আমার মনে হয় বেশ কয়েকদিন মাটি দেখিতে না পাইয়া আবার মাটি দেখিতে পাইবেন যখন এডেনের নিকটবর্ত্তী হইবেন, কে জানে তখন কেমন লাগিবে কয়দিন অদর্শনের পর আপনি আবার মাটি দেখিবেন।

 সমুদ্রে নির্ম্মল ও পরিপূর্ণ সূর্য্যাস্ত দেখিতে পাইবেন। সে এক রমণীয় দৃশ্য। যাহারা কখনও সমুদ্রে যায় নাই, তাহারা সত্যই বঞ্চিত—ইহা এমনই সুন্দর। সমুদ্রে সূর্য্যাস্তের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা লিখিয়া আপনি কি আমাকে আনন্দ দিবেন না? কি সুন্দর! অস্তগামী সূর্য্যের আভায় সীমাহীন সমুদ্র উদ্ভাসিত প্লাবিত; তরঙ্গরাশির সহিত আলোকের ওঠা পড়ার খেলা! পশ্চিম দিগন্ত অস্তগামী সূর্য্যের কিরণে রক্ত-গোলাপের আভায় রঙিন। আবার পরক্ষণে দেখিতে পাইবেন, শান্ত পদক্ষেপে আকাশে সন্ধ্যার আগমন অর্দ্ধঘণ্টায় দিগন্ত আঁধার আচ্ছন্ন হইয়া গিয়া শুধু ইতস্ততঃ স্বর্গীয় আলোকণিকার জ্যোতি! ইহা এত সুন্দর এমন নয়নাভিরাম ও প্রাণস্পর্শী!

 তারপর একটানা পক্ষকালের সমুদ্র ভ্রমণের পর আসিয়া পৌঁছিবেন আর এক পৃথিবীর কোলাহলে,—বিদেশীদের মধ্যে, শ্বেতচর্ম্ম সুনীলাক্ষ বিদেশী। এই বিচিত্র পরিবেশ, পূর্ব্ব পরিবেশের তুলনায় অদ্ভুত লাগিবে না কি? অবশ্য দু-একদিনের মধ্যেই ইহা চলিয়া যাইবে।

 জানি না কি লিখিলাম; পাগলের মত যাহা খুশী। আশা করি আমার আশা ভঙ্গ করিবেন না। যদি কনিষ্ঠের পক্ষে ধৃষ্টতা না হয় তাহা হইলে আমি সর্ব্বান্তঃকরণে কামনা করি যে আপনার যাত্রা শুভ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হউক। আমরা ভাল আছি।

 ভালবাসা ও প্রণাম জানিবেন। ইতি—

আপনার স্নেহের 
সুভাষ 

(ইংরাজি হইতে অনূদিত)