পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১০৮

১০৮

শ্রীসন্তোষকুমার বসুকে লিখিত

মান্দালয় জেল
৪-২-২৭

প্রিয়বরেষু

 শ্রীযুক্ত বসু, আপনার ১০।১২।২৬ ও ১৯।১২।২৬ তারিখের পত্র দুখানা যথাসময়ে পাইয়া বিশেষ আনন্দিত হইয়াছি। নির্ব্বাচন ও এ বিষয়ে জনগণের সহানুভূতি সম্বন্ধে আপনি যাহা লিখিয়াছেন উহা আমার হৃদয় গভীরভাবে স্পর্শ করিয়াছে। আমি একজন মানুষ এবং ভাগবদ্গীতার আদর্শে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও ভালবাসা ও ঘৃণা আমার নিকট এক বস্তু নয়। আমার মত অবস্থার একজন লোক বিবেকের অনুশাসন মানিয়া ইহার বেশী আর কি প্রত্যাশা বা লাভ করিতে পারে? আপনি অনুগ্রহ করিয়া যে ভালবাসার বাণী পাঠাইয়াছেন, যদিও অনেক দেরী হইয়া গিয়াছে তবু উহার জন্য আমার প্রীতি ও ভালবাসা জানাইতেছি।

 আশা করি, গত তিন বৎসর ধরিয়া আপনি কলিকাতা শহরের করদাতাদের প্রতি যে মহৎ সেবায় ব্রতী আছেন উহার জন্য পুনরায় নির্বাচন-প্রার্থী হইবেন। আমার কোনও সন্দেহ নাই যে, আপনি যে অঞ্চল হইতে দাঁড়াইবেন সেখানকার নির্বাচকমণ্ডলী আপনাকেই পুনরায় ভোট দিবে। আমার নিজের শ্রদ্ধা বা আস্থাও কম নয়, একথা বলাই বাহুল্য।

 জানিয়া আনন্দিত হইলাম যে, ছুটি কাটাইতে আপনি জামসেদপুর গিয়াছিলেন আমি কখনও জামসেদপুরে যাই নাই, তবে রাঁচীতে ছিলাম। অতএব জামসেদপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আমি কল্পনা করিতে পারি।

 খিদিরপুরের “মনসা” ও “মনসা মেলার” প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে আরও তথ্য সংগ্রহ করিবার জন্য আমি অপেক্ষা করিব। এ ব্যাপারে কিছু উৎসাহী যুবককে নিয়োগ করিলে ভাল হয়। তাহারা ঐ অঞ্চলের প্রবীণ ব্যক্তিদের নিকট হইতে তথ্য সংগ্রহ করিয়া সাময়িক পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখিতে বা পুস্তিকা প্রকাশ করিতে পারে।

 দুইটি কারণে ধোবিখানাকে বিভক্ত করা সঙ্গত হইবে না বলিয়া আমার মনে হয়। প্রথমতঃ, বৈদ্যশাস্ত্রপীঠের পক্ষে আরও বৃহৎ একখণ্ড জমি দরকার; কেননা ভবিষ্যতে প্রয়োজন হইতে পারে। দ্বিতীয়তঃ, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিকটে বিধবা আশ্রম থাকাটা বাঞ্ছনীয় নয়। কর্পোরেশনে যখন এ প্রস্তাব উত্থাপিত হইবে তখন অনুগ্রহ করিয়া এই দুইটি বিষয়ে বিশেষভাবে বিবেচনা করিবেন। এ বিষয়ে মেজদাদাকেও এক পত্র দিয়াছি। বিধবা আশ্রমের জন্য আমার যথেষ্ট ভাবনা আছে; তাই বলিতেছি, অন্যত্র তাহাদের জন্য ভাল জমি খুঁজিয়া বাহির করা কষ্টকর হইবে না।

 সহরে শিক্ষার অবস্থা সম্বন্ধে অনুসন্ধানকার্য্য চালাইবার জন্য যে অফিসারকে নিয়োগ করা হইয়াছে উহাতে Education Officer খুশী হইতে পারেন নাই বোধহয়।

 Roads Department-এর কেন্দ্রীয়করণের কাজটা খুব সহজ হইবে মনে হয় না। সমস্ত বিভাগ হইতেই একসঙ্গে বাধা আসিবে তবু ইহা করিতেই হইবে।

 এ বিষয়ে আমি আনন্দিত যে, ডেপুটি মেয়রের প্রতি কর্ত্তব্য নির্দ্ধারণের ব্যাপারে সকলেই একমত হইয়াছেন। আমি দুঃখিত, ঐ সময়ে সেখানে এমন কেহই উপস্থিত ছিলেন না যিনি অসৌজন্য প্রকাশের ইচ্ছাটাকে দমন করিতে পারিতেন! রেঙ্গুনের পত্রিকাগুলিতে দেখিলাম যে, তদন্ত কমিটি ডেপুটি মেয়রের অপসারণের প্রস্তাব করিয়াছেন। ইহাতে আমি খুব বেদনা বোধ করিয়াছি। আশা করি, এরকম কোনও সুপারিশ সত্যই করা হইলে কর্পোরেশন উহা প্রত্যাখ্যান করিবে। কোনও বিতর্কের মধ্যে না গিয়াও, কর্পোরেশনের সভা যে শীঘ্রই বন্ধ হইয়া যাইতেছে—এ যুক্তিটাই উহা করার কারণ হিসাবে যথেষ্ট বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে।

 কয়েক দিন পূর্ব্বে অস্থায়ী H.O. ডাঃ টি এন মজুমদার একখানি প্রশংসাপত্রের জন্য আমার নিকট লিখিয়াছিলেন। প্রথমে আমি একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিলাম এবং কি করিব ঠিক করিয়া উঠিতে পারি নাই। শেষ পর্য্যন্ত তাঁহাকে সাধারণভাবে একটি প্রশংসা পত্র লিখিয়া পাঠানোই ঠিক করিলাম এই ভাবিয়া যে, যদি আজ আমি কার্য্যরত থাকিতাম তাহা হইলে উহা অনায়াসেই তিনি চাহিতে পারিতেন। না লেখাই আমার উচিত ছিল, ইহা আমার মনে হয় না। যাহা হউক, আমি তাঁহাকে সম্ভব হইলে উহা সরকারীভাবে কাজে না লাগাইবার জন্য লিখিয়াছি এবং জানাইয়াছি যে, কর্পোরেশন সরকারীভাবে আমার মতামত চাহিয়া পাঠাইলেই বরং ভাল হইত।

 আপনারা আমার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে নূতন কোনও খবর জানিবার জন্য হয়তো আশা করিয়া আছেন কিন্তু আপনাদের নিরাশ করিতে হইতেছে। আমার অবস্থা পূর্ব্বের মত একই রূপ আছে তবে আজকাল জ্বর ক্রমেই বাড়িয়া চলিয়াছে। এ বিষয়ে মেজদাদাকে বিস্তারিতভাবে লিখিয়াছি— তাই আপনাদের কোনও খবর জানাইতে পারিলাম না বলিয়া ক্ষমা করিবেন। তাজকাল আর দীর্ঘ পত্র লিখিতে পারি না এবং আগের চাইতে একটুতেই ক্লান্ত হইয়া পড়ি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ—আমার মনের জোর ঠিকই আছে এবং থাকিবে। আমার স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে কর্পোরেশনে যে বিতর্ক হইয়া গিয়াছে উহার সংবাদ কলিকাতার পত্রিকাগুলিতে পড়িয়াছি।

 আশা করি, আপনারা সকলে ভাল আছেন। গভীর শ্রদ্ধা জানিবেন। ইতি—

আপনার প্রীতিভাজন
সুভাষচন্দ্র বসু

(ইংরাজী হইতে অনূদিত)