পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১১১
বর্ম্মার তদানীন্তন গভর্নরকে লিখিত
রেঙ্গুন জেলের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট ও
মারফৎ প্রেরিত—
আমার ১৯শে মার্চ্চ ১৯২৭ পত্রে আমি আপনার নিকট সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট Major Flowerdew-র বিরুদ্ধে একটি বিশেষ অভিযােগ উপস্থাপিত করিয়াছিলাম। যেহেতু বিষয়টিকে জটিল করিয়া ফেলা আমার উদ্দেশ্য ছিল না সেই হেতু আমি উক্ত পত্রে অন্যান্য বিষয়ের উল্লেখ হইতে নিজেকে ইচ্ছা করিয়াই নিবৃত্ত রাখিয়াছিলাম। আমার এ পত্রে রেঙ্গুন জেলে আসার পর এই স্বল্প দিনের মধ্যে আমার প্রতি কিরূপ ব্যবহার করা হইয়াছে তাহার উদাহরণ দিতে আরও কয়েকটি বিষয় আপনার সমীপে পেশ করিতে চাই।
২। গত ডিসেম্বরে যখন আমি এ জেলে আসি তখন প্রথম আলাপেই Major Flowerdew আমাকে বলিয়াছিলেন কিংবা বলা যায় সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন যে, বাহিরের কাহারও সহিত আমার যোগাযোগ করা চলিবে না। যে সাবধানবাণী তিনি আমার প্রতি করিয়াছিলেন এবং যেভাবে ও যে ভাষায় উহা প্রয়োগ করা হইয়াছিল সব মিলাইয়া গোটা পরিস্থিতিটাই একজন রাজবন্দী হিসাবে আমার কাছে অভিনন্দনসূচক তো ছিলই না, বরং অপমানজনকই বোধ হইয়াছিল। আমি বাঙ্গলা ও বর্ম্মা দেশের আরও কয়েকজন I. M. S. অফিসারকে দেখিয়াছি এবং আরও অনেক জেলে আমাকে কাটাইতে হইয়াছে; কিন্তু Major Flowerdew আমাকে যেভাবে সাবধান করিয়াছিলেন, এরূপ অভ্যর্থনার দুর্ভাগ্য কোথাও আমার হয় নাই। অবশ্য এ কথা বুঝিবার মত বোধশক্তি Major Flowerdew-র আছে কিনা জানি না, আমার মত অবস্থার বা শ্রেণীর একজন লোকের পক্ষে উহা প্রাপ্য নয়। তবু আমি তখন উত্তেজিত হই নাই, এবং এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতিটাকে যথাসম্ভব সহজ করিবার জন্য হাসিয়া উত্তর দিয়াছিলাম—দীর্ঘদিন আমাকে যখন জেলে কাটাইতে হইয়াছে তখন উহা আমার জানারই কথা।
৩। গত ডিসেম্বরে রেঙ্গুন জেলে স্থানান্তরিত হইবার পর আমার রোগনির্ণয় বা চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি কোনও যত্ন লন নাই বরং তিনি আমার অসুস্থতাকে অস্বীকার করিতেই যেন বেশী ব্যস্ত ছিলেন। যখন আমি তাঁহাকে বলিলাম যে, আমার রোজই জ্বর হইতেছে এবং তাঁহাকে টেম্পারেচার চার্ট দেখাইলাম, তিনি মন্তব্য করিলেন—জ্বর আবার কোথায়? এতদ্বারা তিনি বোধহয় একথাই বলিতে চাহিয়াছিলেন যে, ১০১ অথবা ১০২ ডিগ্রী জ্বর না হইলে উহাকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনা চলে না। যাহা হউক, সৌভাগ্যবশতঃ রেঙ্গুন জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র ফিজিসিয়ান কর্ণেল কেলসল আমার চিকিৎসার ব্যাপারে অধিকতর যত্ন লইয়াছিলেন; এবং আমি ঐ ঘটনাকে তখনকার মত ভুলিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম।
৪। গত ফেব্রুয়ারী মাসে দ্বিতীয়বার রেঙ্গুন জেলে আসার পর আমি নিজেই সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টের অফিসে গিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করি। আমি যখন তাঁহার সহিত কথা বলিতেছিলাম তিনি আমাকে এমন কি বসিতে পর্য্যন্ত বলেন নাই। এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়াইবার জন্য আমি যথাশীঘ্র সম্ভব ভালয় ভালয় সেখান হইতে চলিয়া আসি। আমার কারাজীবনের গত আড়াই বৎসরের মধ্যে এই প্রথম একজন সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট আমাকে বসিতে বলার সৌজন্যটুকু পর্য্যন্ত দেখাইতে পারিলেন না। এ অভিযোগ করার প্রেরণা পাইতেছি এইজন্য যে, আমি বিশ্বাস করি, গভর্ণমেণ্ট তাঁহাদের অফিসারদের এই অসৌজন্যমূলক আচরণ নিশ্চয়ই অনুমোদন করেন না এবং ইহা একটা নিয়মবহির্ভূত ব্যাপার।
৫। যদি খোঁজ লওয়া হয়, গত ৪০ দিনের মধ্যে Major Flowerdew আমাকে কয় বার দেখিতে আসিয়াছেন, তাহা হইলেই এবার এখানে আসার পর আমার প্রতি তাঁহার মনোযোগ বা আমার চিকিৎসার ব্যাপারে তাঁহার আগ্রহ স্পষ্ট প্রতীয়মান হইবে। সপ্তাহে অন্ততঃ একবার অর্থাৎ প্রতি সোমবার আমাকে তাঁহার দেখিতে আসার কথা; সাধারণতঃ ইহাই নিয়ম। কিন্তু এ নিয়ম তিনি মানিয়া চলেন না। এমন কি পক্ষকাল কাটিয়া গেলেও তাঁহার দর্শন মেলে না। গত ১৪ তারিখ সোমবার তিনি যখন আমাকে দেখিতে আসেন তখন আমার সেলের দরজার বাহিরে দাঁড়াইয়াই প্রশ্ন করেন—ভাল আছেন ত? আমার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় এ প্রশ্ন এতই হাস্যকর যে আমাকেও হাসিয়া জবাব দিতে হয়—হ্যাঁ ধন্যবাদ। এরূপ প্রশ্ন হইতে ইহাই বুঝিতে হয় যে, তিনি ইচ্ছা করিয়াই আমার অসুখের গুরুত্ব লাঘব করার চেষ্টা করিতেছেন কিংবা আমার যে প্রত্যহ জ্বর হয়, ওজন কমিয়া যাইতেছে এবং আমি যে অজীর্ণতা, ক্ষুধামান্দ্য ও সেই সঙ্গে শারীরিক কষ্ট ভোগ করিতেছি এ সব বিষয়ে তিনি অবহিত নন। আমার শেষের অনুমানটাই যদি সত্য হয় তাহা হইলে ইহাতে তাঁহার কোনও লাভ হইবে না; কেননা আমার ওজন নিয়মিত রেকর্ড করিয়া রাখা হয়, প্রতি চার ঘণ্টা অন্তর টেম্পারেচার চার্টও লেখা হইতেছে, তাছাড়া মাঝে মাঝে সহকারী চিকিৎসকগণ আমার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে নানা খুঁটিনাটি বিষয় লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিতেছেন। এরকম একজন নিষ্প্রাণ চিকিৎসকের নিকট হইতে উপযুক্ত মনোযোগ বা সহৃদয় ব্যবহার আশা করা কি করিয়া সম্ভব আমি ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারি না। ইহাতে আশ্চর্য্যের কিছুই নাই যে, গত ৪০ দিন যাবৎ অর্থাৎ রেঙ্গুন জেলে আসার পর হইতে আজ সকাল পর্য্যন্তও আমার আদৌ কোনও চিকিৎসা হয় নাই।
৬। এরূপ নিষেধাজ্ঞা জারী করা হইয়াছে, যদি কোনও বন্দী আমার সহিত কথা বলে তাহা হইলে তাহাকে শাস্তি দেওয়া হইবে। ইহা হইতেই আমাকে এখানে কিরূপ নিঃসঙ্গতার মধ্যে রাখা হইয়াছে তাহা আপনি বুঝিতে পারিবেন। একবার এক বন্দী আমার সেলের রক্ষীর নিকট জানিতে চাহে যে, বিশেষ একটি স্নানাগার সর্ব্বসাধারণ ব্যবহার করিতে পারে কিনা; সে তখন সবেমাত্র এ জেলে নূতন আসিয়াছে এবং এখানকার নিয়মকানুনও তাহার জানা ছিল না; কিন্তু এজন্য ডেপুটি সুপারিণ্টেণ্ডেট Mr. Sutherland তাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনিয়াছিলেন।
৭। ইতিপূর্ব্বে অন্যান্য I. M. S. অফিসারগণ আমার প্রতি যেরূপ ব্যবহার করিয়াছেন তাহার সহিত এ ব্যবহারের পার্থক্য আমি স্পষ্ট অনুভব করিতে পারিতেছি। এমন কি রেঙ্গুন জেনারেল হাসপাতালের Major Cormack-ও, যিনি আমার X-ray করিয়াছিলেন, এই জেলের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট অপেক্ষা আমার চিকিৎসার ব্যাপারে অনেক বেশী যত্ন লইয়াছেন। যখনই তিনি আমাকে দেখিতে আসিয়াছেন তখনই প্রচলিত রীতির ব্যতিক্রম ঘটাইয়া তিনি আমার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে খোঁজখবর করিয়াছেন।
৮। এই সব তুচ্ছ বিষয়ের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার কোনও ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি অবস্থা যেরূপ দাঁড়াইয়াছে তাহাতে সব কথা আপনাকে না জানাইলে কর্ত্তব্যচ্যুতি ঘটিবে বলিয়াই মনে করি। যেহেতু আপনি গভর্ণমেণ্টের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত সেই হেতু ইহা আপনাকে জানানাে আমার কর্ত্তব্য যে, রেঙ্গুন জেল আর যাহাই হউক আমার পক্ষে স্বাচ্ছন্দ্যকর নয়। ইতি—
এস সি বােস
(কলিকাতা কর্পোরেশনের চীফ
এক্সিকিউটিভ অফিসার ও বঙ্গীয়
(ইংরাজী হইতে অনূদিত)