পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১১৫
শরৎচন্দ্র বসুকে লিখিত
পরম পূজনীয় মেজদাদা,
মিঃ মোবার্লীর প্রদত্ত প্রস্তাব সম্বন্ধে আমার কি মত তাহা জানিবার জন্য আপনারা নিশ্চয়ই উৎকণ্ঠিত হইয়াছেন এবং আমার মনে হয় এ সম্বন্ধে আমার মতামত প্রকাশ করিবারও সময় আসিয়াছে। আমার মতের সহিত আপনাদের মত মিলিবে কিনা জানি না; তবু আমার মতের মূল্য যাহাই হউক না কেন, নিম্নে তাহা প্রকাশ করিতেছি।
আমি মিঃ মোবার্লীর প্রস্তাব বার বার অতি সযত্নে পাঠ করিয়াছি। তাঁহার উচ্চারিত প্রতি শব্দ প্রতি কথা বার বার করিয়া ভাবিয়া দেখিয়াছি। একথা স্বীকার করিতেই হইবে যে, তিনি অতি সাবধানতার সহিত তাঁহার বক্তব্যে বাক্য সংযোজনা করিয়া তাহা প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার প্রস্তাবের সকল দিক অতি ধীরভাবে চিন্তা করিবার পর আজ আমার নিজস্ব মত জ্ঞাপন করিতেছি, ক্ষণিক ঝোঁকের বশে হঠাৎ কোনও নির্দ্ধারণ করি নাই। এখন আমি আপনাকে যাহা লিখিতেছি তাহা বারবার গভীরভাবে চিন্তার পর নির্দ্ধারণ করিয়াছি। কিন্তু তথাপি আমার যদি কোন ভুল হইয়া থাকে, কিংবা আমার তর্ক-নীতিতে যদি কিছু যোগ করিতে ভুল করিয়া থাকি, তাহা হইলে অবশ্যই আমি তাহা স্বীকার করিয়া পুনর্ব্বিবেচনা করিব।
প্রথমেই বলিয়া রাখি যে, মিঃ মোবার্লীর স্পষ্টবাদিতার আমি খুব প্রশংসা করি এবং আমার মনে হয়—তাঁহার ন্যায় আমিও যদি স্পষ্টভাবে সকল কথা প্রকাশ না করি তাহা হইলে অত্যন্ত অন্যায় হইবে, আমার কর্ত্তব্যও যথাযথরূপে পালিত হইবে না। স্পষ্টবাদিতায় আমি সর্ব্বদাই বিশ্বাস করি এবং আমার মনে হয় সকল কথা খোলাখুলি বলিলে শেষে উভয় পক্ষেরই সর্ব্বাপেক্ষা উপকার দর্শায়।
মিঃ মোবার্লীর কয়েকটী কথায় আমি তাঁহাকে ধন্যবাদ না দিয়া পারিতেছি না। যেখানে তিনি বলিতেছেন যে, আমার অতীত কার্য্যকাহিনী বা ভবিষ্যৎ কার্যপন্থার কোন স্বীকারোক্তি চাহেন না—যেখানে তিনি বলিতেছেন যে, আমি যদি প্রতিজ্ঞা করিয়া বলি তাহা হইলে তাঁহারা আমাকে মুক্তি দিবেন—শেষের দিকে যেখানে তিনি বলিতেছেন যে, তিনি এ প্রস্তাব প্রথমে আমার নিকট উত্থাপিত করেন নাই, কারণ তাহা হইলে মনে হইতে পারে যে, এ প্রস্তাবে স্বীকৃত হইতে আমাকে বাধ্য করানো হইতেছে—সে সকল পাঠ করিয়া বুঝিলাম তিনি আমাকে আত্মসম্মানবিশিষ্ট ভদ্রলোক হিসাবে যথেষ্ট মান্য করিয়াছেন এবং নিম্নলিখিত কারণগুলির জন্য তাঁহার এ প্রস্তাবে স্বীকৃত হইতে না পারিলেও তাঁহার প্রস্তাবের সম্মানজনক অংশগুলি আমি উপলব্ধি করি। পরিশেষে বঙ্গীয় আইন-সভার সদস্যরূপে আমি মাননীয় সভ্যের এরূপ ব্যবহারকে প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারি না। কারণ আমার মনে হয় কাউন্সিলের সভ্যগণের প্রতি আস্থা-স্থাপন করিয়া কোনও প্রস্তাব তাঁহাদের নিকট সর্ব্বপ্রথমেই উপস্থাপিত করার নিদর্শন বোধ হয় ইহাই প্রথম।
আমার মনে হয় মিঃ মোবার্লীর প্রস্তাবের স্বপক্ষে আর অধিক কিছু বলিবার নাই।
প্রথমেই একটি বিষয় সম্বন্ধে আপনাদের ধারণা মন হইতে দূরীভূত করিতে চাই—ছোটদাদার (ডাঃ সুনীলচন্দ্র বসুর) রিপোর্ট প্রকাশের সঙ্গে আমার মতভেদের কোনই সম্পর্ক নাই, কারণ তিনি রিপোর্ট লিখিবার পূর্ব্বে বা পরে কি লিখিবেন বা আমার জন্য কি অনুমোদন করিবেন তদ্বিষয়ে কোন কথা পরামর্শ আমার সঙ্গে হয় নাই। আমাকে যদি পূর্ব্বে জানাইতেন তাহা হইলে আমি অবশ্যই সুইট্জারল্যাণ্ডে পাঠাইবার প্রস্তাব অনুমোদনের বিপক্ষে মত দিতাম।
ঐরূপ প্রস্তাব করিয়া পাঠাইবার পর যখন তিনি তাহা আমাকে জানাইলেন আমি তখনই সন্দেহ করিয়াছিলাম ইহার ফল ভাল হইবে না এবং পরে আমার এ সন্দেহই সত্য হইয়াছে। অবশ্য ছোটদাদা ডাক্তার হিসাবে আমাকে পরীক্ষা করিতে আসিয়াছিলেন এবং ডাক্তার হিসাবে তাঁহার মতামত প্রকাশ করিয়া আমার মনে হয় প্রকৃত সমদর্শী চিকিৎসক এবং অভিজ্ঞ বৈজ্ঞানিকের মত ব্যবহার করিয়াছেন। তাঁহার অনুমোদনের কিরূপ রাজনৈতিক ব্যাখ্যা হইতে পারে এবং সরকারই বা এ অনুমোদনকে কিরূপ রাজনৈতিক চাল চালিবার জন্য ব্যবহার করিবেন তাহা বিচার করিবার কোন প্রয়োজন তাঁহার ছিল না; তজ্জন্য আমিও তাঁহার এ কার্য্যের নিন্দা করিতে পারি না। তাঁহার কয়েকজন রোগী সুইস্ স্বাস্থ্যাশ্রমে গিয়া রোগমুক্ত হইয়াছে তাহা দেখিয়াই তিনি আমার সম্বন্ধেও অনুরূপ প্রস্তাব করিয়াছেন—অন্যান্য যক্ষ্মারোগীকেও যেরূপ করিয়া থাকেন। যে সকল অর্থবান্ রোগী সুইট্জারল্যাণ্ডের বাস ও শুশ্রূষার ব্যয় বহন করিতে পারেন তাঁহাদের পক্ষে এ প্রস্তাবই শ্রেষ্ঠ। এ অবস্থায় আমি যে কোনরূপে নিজেকে কোন প্রস্তাব পালনে বাধ্য করি নাই তাহা স্পষ্ট বুঝা যাইবে।
দেখা যাইতেছে, সরকার ছোটদাদার প্রদত্ত রোগ বিবরণ গ্রহণ করেন নাই, যদিও তাঁহার প্রদত্ত স্বাস্থ্য অর্জ্জন উপায় গ্রহণ করিয়াছেন, কারণ মিঃ মোবার্লী স্পষ্টই বলিয়াছেন, “সুভাষচন্দ্র যে অত্যধিক পীড়িত হন নাই এবং একেবারে কর্ম্মশক্তিহীন হন নাই, তাহা সকলেই বুঝিতে পারিবেন।” আমার জানিতে কৌতূহল হয়, সরকার কবে আমাকে “অত্যধিক পীড়িত” বা “একেবারে কর্ম্মশক্তিহীন” মনে করিবেন। যেদিন সকল চিকিৎসক ঘোষণা করিবেন, আমার রোগমুক্তি অসম্ভব এবং মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে মৃত্যু হইতে পারে, সেই দিন কি? তা ছাড়া, ছোটদাদার রোগ-বিবরণ যদি তাঁহারা স্বীকার করিতে রাজী না হন, তাহা হইলে যাহা মাত্র বাহ্যতঃ তাহার অনুমোদন—তাহা গ্রহণ করিতেই বা সরকার এত ব্যস্ত কেন? ছোটদাদা এ অনুমোদন করেন নাই যে, আমাকে বাড়ীতে যাইতে দেওয়া হইবে না। বা বিদেশে যাইবার পূর্ব্বে আমি আমার আত্মীয়-স্বজনকে দেখিতে পাইব না। তিনি একথাও বলেন নাই যে, আমি যে জাহাজে যাইব তাহা কোন ভারতীয় বন্দরে নোঙর করিতে পারিবে না। তিনি এ-কথাও বলেন নাই যে, যদি আমার নষ্ট স্বাস্থ্য উদ্ধার হয় তাহা হইলে যতদিন অর্ডিনান্স আইন থাকিবে ততদিন দেশে থাকিতে পারিব না। এই সকল দেখিয়া আমার সন্দেহ হয়, সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য আমার নষ্ট স্বাস্থ্য উদ্ধারের ব্যবস্থা নয়।
মিঃ মোবার্লী প্রকৃত পক্ষে বলিয়াছেন যে, দুইটি পথ অবশিষ্ট আছে। তাহা (১) জেলে বন্দী হইয়া অবস্থান কিংবা (২) কোন বিদেশে যাইয়া স্বাস্থ্য অর্জ্জনের চেষ্টা ও অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য অবস্থান।
কিন্তু সত্যই কি এই দুয়ের মধ্যে অন্য কোন মধ্যপন্থা অবশিষ্ট নাই? আমার তা মনে হয় না। সরকারের ইচ্ছা যে আমি অর্ডিনান্স আইন উঠিয়া না যাওয়া পর্য্যন্ত, অর্থাৎ জানুয়ারী ১৯৩০ সাল পর্য্যন্ত বন্দী থাকি। কিন্তু এ আইন যে ১৯৩০ সালের পরেও পুনরায় নূতন করিয়া আলোচনা হইবে না তাহা কে বলিতে পারে? গত অক্টোবর মাসে সি, আই, ডি, পুলিশের কর্ত্তা মিঃ লোম্যানের সহিত এ প্রসঙ্গে আমার যে কথা হইয়াছিল তাহা একেবারেই আশাপ্রদ নয়, এবং ১৯২৯ সালে যদি এই অর্ডিন্যান্স আইন চিরকালের জন্য বিধিবদ্ধ করিয়া রাখিবার আন্দোলন হয় তাহাতে কিছুমাত্র আশ্চর্য্যান্বিত হইব না। তাহা হইলে আমাকে চিরস্থায়ী ভাবে বিদেশে বাস করিতে হইবে এবং এইরূপ নির্ব্বাসনের জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করিতে হইবে। যদি এ সম্বন্ধে সরকারের সত্যই কোন স্পষ্ট ইচ্ছা থাকিত তাহা হইলে আমি কবে বিদেশ হইতে ফিরিয়া আসিতে পারিব, সে কথাও ঐ প্রস্তাবে উল্লিখিত থাকিত।
তারপর প্রবাসে আমি কিরূপ স্বাধীনতা ভোগ করিতে পাইব তাহার কোনও স্পষ্ট আশ্বাস পাওয়া যায় নাই। সুইজারল্যাণ্ডে ঝাঁকে ঝাঁকে যে সকল সি, আই, ডি, বিচরণ করে, ভারত সরকার কি আমাকে তাহাদের হাত হইতে রক্ষা করিতে পারিবেন? এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, আমি রাজনৈতিক সন্দেহে অভিযুক্ত এবং যতদিন না মত পরিবর্ত্তন করিয়া পুলিশ গোয়েন্দা হইতেছি ততদিন সরকার আমাকে সন্দেহের চক্ষেই দেখিবেন এবং ইহা খুব সম্ভব যে, এই সকল গোয়েন্দা আমাকে প্রতি পদক্ষেপে অনুসরণ করিয়া আমার জীবন দুর্ব্বিসহ করিয়া তুলিবে।
সুইট্জারল্যাণ্ডে শুধু বৃটিশ গোয়েন্দা নাই, তথায় বৃটিশ সরকার কর্ত্তৃক নিযুক্ত সুইস, ইটালীয়, ফরাসী, জার্ম্মান ও ভারতীয় গোয়েন্দা আছে এবং কোনও কোনও উগ্র উৎসাহী গোয়েন্দা, আমাকে যে সরকারের কাছে গভীর কালিমাময় করিবার জন্য মিথ্যা ঘটনার সুবিস্তৃত বর্ণনা দিবে না, তাহারই বা প্রমাণ কি? আমি গত বৎসর মিষ্টার লোম্যানকে বলিয়াছিলাম, গোয়েন্দা বিভাগ ইচ্ছা করিলে যে কোন লোকের বিরুদ্ধে কতকগুলি মিথ্যা অভিযোগ উপস্থিত করিয়া তাহাকে কোনরূপ অর্ডিনান্সে বন্দী করিয়া রাখিবার ব্যবস্থা করিতে পারে। ইউরোপ হইতে এরূপ করা আরও সহজ। বিদেশে যাঁহাদিগকে সন্দেহের চক্ষুতে দেখা হইত, তাঁহাদের ভারতে ফিরিতে কিরূপ অসুবিধা ভোগ করিতে হইয়াছে, তাহা সকলেই অবগত আছেন। বিলাতের পার্লামেণ্টের ও মন্ত্রী-সভার কয়েকজন বিশিষ্ট সদস্য বিশেষভাবে চেষ্টা না করিলে লালা লাজপৎ রায়ের ন্যায় নেতাও দেশে ফিরিতে পারিতেন না। সরকার যখন আমাকে একবার সন্দেহের চক্ষুতে দেখিয়াছেন, তখন আমার ভবিষ্যৎ অবস্থা কিরূপ হইবে সহজেই অনুমান করা যায়।
আমি জানি, পুলিসের গোয়েন্দারা এ বিষয়ে একটু অধিক কার্য্যতৎপরতা দেখাইয়া থাকেন। আমি ইউরোপে যত শান্তভাবে এবং সাবধানতার সহিত বাস করি না কেন, তাঁহারা ভারত সরকারের নিকট আমার বিরুদ্ধে অন্যায় বিপোর্ট পাঠাইবেন, আমি কিছু না করিলেও এবং খুব শান্তভাবে থাকিলেও তাঁহারা আমাকে ভীষণ ষড়যন্ত্রের কর্ত্তা বলিয়া রিপোর্ট দিবেন, তাঁহারা কি রিপোর্ট দিতেছেন, তাহার কিছুই আমি জানিতে পারি না। কাজেই কোন সময়েই সে সম্বন্ধে সত্য প্রকাশের বা আমার বিবরণ প্রদানের সম্ভাবনা থাকিবে না। এইরূপ ভাবে ইহা খুব সম্ভব যে ১৯২৯ খৃষ্টাব্দ আসিবার পূর্ব্বেই তাঁহারা আমাকে একজন বড় বলশেভিক নেতা জাহির করিয়া দিবেন এবং তাহার ফলে হয় ত আমার ভারতে প্রত্যাগমনের পথ চিরতরে রুদ্ধ হইয়া যাইবে, কারণ ইউরোপের লোক বর্ত্তমানে এক বলশেভিককেই ভয় করে। এই জন্যই আমি স্বেচ্ছায় আমার জন্মভূমি হইতে নির্ব্বাসিত হইতে ইচ্ছা করি না। সরকার পক্ষও যদি আমার দিক হইতে একবার এ বিষয়ে আলোচনা করেন, তাহা হইলে আমার অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবেন।
যদি আমার বলশেভিক এজেণ্ট হইবার ইচ্ছা থাকিত, তবে আমি সরকার বলিবামাত্র প্রথম জাহাজেই ইউরোপ যাত্রা করিতাম। তথায় স্বাস্থ্য পুনঃপ্রাপ্তির পর বলশেভিক দলে মিশিয়া সমগ্র জগতে এক বিরাট বিদ্রোহ ঘোষণা করিবার উদ্দেশ্যে প্যারিস হইতে লেনিনগ্রাড পর্য্যন্ত ছুটাছুটি করিতাম; কিন্তু আমার সেরূপ কোন ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা নাই। যখন শুনিলাম যে, আমাকে ভারত, ব্রহ্মদেশ ও সিংহল ফিরিয়া আসিতে দেওয়া হইবে না, তখন বার বার মনে ভাবিলাম, সত্যই কি আমি ভারতে ব্রিটিশ শাসন রক্ষার পক্ষে এতই বিপজ্জনক যে, বাঙ্গলা দেশ হইতে নির্ব্বাসিত করিয়াও সরকার সন্তুষ্ট হইতে পারেন না, অথবা সমস্ত ব্যাপারটাই একটা বিরাট ধাপ্পাবাজি?
যদি প্রথম কথা সত্য হয়, তাহা হইলে ব্যুরোক্রেশীর নিকট সেরূপ ভয়ের কারণ হওয়া আমার পক্ষে শ্লাঘার কথা। কিন্তু পরক্ষণেই যখন আমি আমার নিজ জীবন ও কার্য্যাবলীর কথা মনে মনে চিন্তা করি, তখন বুঝিতে পারি যে, একদল স্বার্থান্ধ হিংসাপরায়ণ লোক আমাকে যে ভাবে দেখিতেছেন আমি প্রকৃতই সেইরূপ নহি। আমি বাঙ্গলার বাহিরে কোন রাজনীতিক কার্য্য করি নাই, এবং ভবিষ্যতে করিব বলিয়াও মনে করি না, কারণ বাঙ্গলাকেই আমি আমার কার্য্যক্ষেত্র ও আদর্শের পক্ষে বিরাট বলিয়া মনে করি। বাঙ্গলা সরকার ছাড়া অন্য কোন সরকারের আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আছে বলিয়া আমার মনে হয় না; ছয় বৎসরের মধ্যে আমি কংগ্রেসে যোগদান ও পারিবারিক কারণ ব্যতীত অন্য কোনও কার্য্যে বাঙ্গলার বাহিরে যাই নাই। তবে কেন আমাকে সমস্ত ভারত, ব্রহ্মদেশ ও সিংহলে প্রবেশ করিতে নিষেধ করা হইতেছে? সিংহল ত খাস বৃটিশ উপনিবেশ, ভারত সরকারের নিষেধ-আজ্ঞা আইনানুসারে তথায় খাটিবে কি না সন্দেহ।
বাঙ্গলা সরকার এখন আমার গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত করিতে চাহেন। আমি যখন স্বাধীন ছিলাম, তখনই বা আমার কি গতিবিধি ছিল? ১৯২৩ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর হইতে ১৯২৪ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর পর্য্যন্ত এক বৎসরের মধ্যে আমি মাত্র দুইবার কলিকাতার বাহিরে গিয়াছিলাম। প্রথম খুলনা জিলা কন্ফারেন্সে যোগদান করিবার জন্য এবং দ্বিতীয় নদীয়া জিলার কাউন্সিল নির্ব্বাচনে একজন সভ্যপদ প্রার্থীর পক্ষে বক্তৃতা করিবার জন্য। ১৯২৪ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী হইতে অক্টোবরের মধ্যে আমি একবারও কলিকাতার বাহিরে যাই নাই। আমাকে সিরাজগঞ্জ কন্ফারেন্সের সহিত জড়াইবার নানারূপ চেষ্টা হইয়াছে বটে, কিন্তু সে কন্ফারেন্সের সময় আমি কলিকাতা কর্পোরেশনের চীফ্ একজিকিউটিভ অফিসাররূপে মিউনিসিপ্যাল কার্য্যে বিশেষ ব্যস্ত ছিলাম। ঠিক কন্ফারেন্সের সময় কলিকাতায় ঝাড়ুদারদিগের ধর্ম্মঘটের সম্ভাবনা হওয়ায় আমার পক্ষে এক মিনিটের জন্যও কলিকাতা ত্যাগ করা সম্ভব ছিল না। ১৯২৪ খৃষ্টাব্দের মে হইতে অক্টোবর পর্য্যন্ত আমি যাহা করিয়াছি তাহা সকলেই অবগত আছেন। সে সময় আমার সর্ব্বপ্রকার গতিবিধির কথা সরকার জানিতেন। আমার গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত করাই আমাকে যদি গ্রেপ্তার করার উদ্দেশ্য হয়, তাহা হইলে আমি বলিব, আমাকে গ্রেপ্তার করার কোন প্রয়োজন ছিল না।
মিষ্টার মোবার্লী একটা বিষয়ে বিশেষ হৃদয়হীনতার পরিচয় দিয়াছেন। সরকার জানেন যে, প্রায় আড়াই বৎসর কাল আমি নির্ব্বাসিত আছি—এই সময়ের মধ্যে আমি আমার কোন আত্মীয়, এমন কি পিতামাতার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারি নাই। সরকার প্রস্তাব করিয়াছেন, আমাকে আরও আড়াই বা তিন বৎসরকাল বিদেশে থাকিতে হইবে, সে সময়েও তাঁহাদের সহিত সাক্ষাতের কোন সুবিধা হইবে না। ইহা আমার পক্ষে কষ্টদায়ক সন্দেহ নাই, কিন্তু যাঁহারা আমাকে ভালবাসেন, তাঁহাদের পক্ষে আরও অধিক কষ্টদায়ক। প্রাচ্যের লোকেরা তাঁহাদের আত্মীয়-স্বজনের সহিত কিরূপ গভীর স্নেহের বন্ধনে জড়িত থাকেন, তাহা পাশ্চাত্ত্য দেশীয় কাহারও পক্ষে অনুমান করাও সম্ভব নহে। আমার মনে হয়, এই অজ্ঞতার জন্যই সরকার এইরূপ হৃদয়হীনতার পরিচয় দিয়াছেন। পাশ্চাত্ত্য দেশীয়েরা মনে করেন, যেহেতু আমার বিবাহ হয় নাই, অতএব আমার পরিবার থাকিতে পারে না এবং কাহারও প্রতি আমার ভালবাসাও থাকিতে পারে না।
গত আড়াই বৎসর আমাকে কিরূপ কষ্ট ভোগ করিতে হইয়াছে, সরকার বোধ হয় তাহা ভুলিয়া গিয়াছেন। আমি কষ্ট পাইয়াছি—তাঁহারা নহেন। বিনা কারণে তাঁহারা এতদিন ধরিয়া আমাকে আটক রাখিয়াছেন। আমাকে তবু বলা হইয়াছিল যে অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক প্রভৃতি আমদানী, সরকারী কর্ম্মচারী হত্যা প্রভৃতি ষড়যন্ত্রের অভিযোগে আমি অপরাধী। ঐ সম্বন্ধে অনেকে আমার বক্তব্য জানাইতে বলিয়াছিলেন। আমি উত্তরে জানাইতেছি যে, আমি নির্দ্দোষ। আমার বিশ্বাস পরলোকগত স্যর এডওয়ার্ড মার্শাল হল বা স্যর জন সাইমন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ইহা অপেক্ষা অধিক কিছু বলিতে পারিতেন না। দ্বিতীয় বার অভিযোগগুলি আমার নিকট উপস্থিত করা হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, এত লোক থাকিতে পুলিশ আমাকে ধরিল কেন? আমার মনে হয়, উহাই সন্তোষজনক উত্তর। আমার গ্রেপ্তারের পর হইতে বাঙ্গলা সরকার আমার অধীন ব্যক্তিদিগকে প্রতিপালনের জন্য বা আমার গৃহাদি রক্ষার জন্য কোনরূপ ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করেন নাই।
ঐ বিষয়ে আমি বড়লাটের নিকট আবেদন করিলে বাঙ্গলা সরকার সে আবেদন চাপিয়া রাখিয়াছিলেন। তারপর আবার আমাকে তিন বৎসর বিদেশে থাকিতে বলা হইতেছে। ইউরোপে নির্ব্বাসনের সময় আমার নিজের খরচ নিজেকে যোগাইতে হইবে। এ কিরূপ যুক্তিসঙ্গত প্রস্তাব তাহা বুঝিতে পারি না। ১৯২৪ খৃষ্টাব্দে আমার যেরূপ স্বাস্থ্য ভাল ছিল, আমাকে অন্ততঃ সেইরূপ স্বাস্থ্যবান করিয়া সরকারের মুক্তিদান করা উচিত। কারাবাসের জন্য আমার স্বাস্থ্যহানি হইলে সরকার কি তাহার ক্ষতিপূরণ দিবেন না? ইউরোপে যতদিন হৃত স্বাস্থ্য পুনঃ প্রাপ্ত না হই, ততদিন আমার সকল খরচ সরকারের বহন করা উচিত। কতদিন সরকার এই সকল বিষয়ে অনবহিত থাকিবেন? সরকার যদি ইউরোপ যাইবার পূর্ব্বে আমাকে একবার বাড়ী যাইতে দিতেন, যদি ইউরোপে আমার সকল ব্যয়ভার বহন করিতেন ও রোগ মুক্তির পর আমাকে বিনা বাধায় দেশে ফিরিতে দিতেন, তাহা হইলে এই দান সহৃদয়তার পরিচায়ক বলিয়া মনে করিতাম।
মিঃ মোবার্লী বলিয়াছেন, সরকার ও সুভাষচন্দ্র উভয়েই বুঝিতে পারিতেছেন যে, অর্ডিনান্স আইনের কার্য্যকাল শেষ না হওয়া পর্য্যন্ত সরকার সুভাষচন্দ্রকে আটক রাখিতে পারেন। এ বিষয়ে আমি মিঃ মোবার্লীর সহিত একমত। আমি জানি যে, সরকার ইচ্ছা করিলে যতদিন ইচ্ছা আমাকে আটক রাখিতে পারেন। অডিনান্স আইনের কার্য্যকাল শেষ হইলে তাঁহারা আমাকে তিন আইনে বা অন্য যে কোনও উপায়ে আটক রাখিতে পারেন। ব্যবস্থাপক সভার সদস্যেরা যতই লাফালাফি করুন না কেন বা শাসন পরিষদের সদস্যদিগের সফরের ব্যয় না-মঞ্জুর করুন না কেন, আমি জানি যে, সরকার ইচ্ছা করিলে আমাদিগকে যাবজ্জীবন আটকাইয়া রাখিতে পারেন। সরকার আমাকে চিরকাল আটক রাখিতে চাহেন কি না তাহাই আমি জানিতে চাই। পরলোকগত দেশবন্ধু দাশ মহাশয় আমাকে যুবক-বৃদ্ধ বলিয়া ডাকিতেন। তিনি আমাকে নৈরাশ্যবাদী স্থির করিয়াছিলেন। একটি বিষয়ে আমি নৈরাশ্যবাদী বটে, কারণ আমি সকল ঘটনার অশুভটাই বড় করিয়া দেখি। বর্ত্তমান ঘটনার সর্ব্বাপেক্ষা মন্দ ফল কি হইতে পারে, তাহাও আমি চিন্তা করিয়া দেখিয়াছি, কিন্তু তথাপি আমি মনে স্থির করিয়াছি, জন্মভূমি হইতে চিরকালের জন্য নির্ব্বাসন অপেক্ষা জেলে থাকিয়া মৃত্যুকে বরণ করাই শ্রেয়ঃ। এই অশুভ ভবিষ্যতের কথ ভাবিয়াও আমি নিরুৎসাহ হই নাই। কারণ, কবির উক্তিতে আমি বিশ্বাস করি:—
গৌরবের পথ শুধু মৃত্যুর দিকে লইয়া যায়।
সরকারের প্রস্তাবের পক্ষে ও বিরুদ্ধে যাহা কিছু বলিবার ছিল, তাহা আমি সবই বলিয়াছি। আমার মুক্তির সম্ভাবনা সুদূরপরাহত বলিয়া কেহ যেন দুঃখিত না হয়েন। পিতামাতার কষ্ট সর্ব্বাপেক্ষা অধিক। সে জন্য তাঁহাদিগকে সান্ত্বনা প্রদান করিবেন। মুক্তিলাভের পূর্ব্বে আমাদিগকে ব্যক্তিগতভাবে ও সঙ্ঘবদ্ধভাবে অনেক কষ্ট সহ্য করিতে হইবে। ভগবানকে ধন্যবাদ দিই যে, আমি নিজে শান্তিতে আছি এবং সম্পূর্ণ নির্ব্বিকারভাবে সকল অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হইবার জন্য প্রস্তুত আছি। আমাদের সমগ্র জাতির কৃতপাপের জন্য, আমি প্রায়শ্চিত্ত করিতেছি—ইহাতেই আমার তৃপ্তি। আমাদের চিন্তা ও আদর্শ অমর হইয়া থাকিবে—আমাদের ভাবধারা জাতির স্মৃতি হইতে কখনও মুছিয়া যাইবে না, ভবিষ্যৎ বংশধরগণ আমাদের প্রিয় কল্পনার উত্তরাধিকারী হইবেন, এই বিশ্বাস লইয়া আমি চিরদিন সকল প্রকার বিপদ ও অত্যাচার হাসিমুখে বরণ করিয়া লইয়া কাল কাটাইতে পারিব।
অনুগ্রহ করিয়া এই পত্রের উত্তর শীঘ্র দিবেন। ইতি—
(ইংরাজী হইতে অনূদিত)