পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১৩

কটক
৮।১।১৩

পরম পূজনীয় মেজদাদা,

 আর একটি বৎসর শেষ হইল। উন্নতি বা অবনতি যাহাই হইয়া থাকুক ৺ভগবানের নিকট এই বারোটি মাসের জন্য আমাদের দায়ী হইতে হইবে।

 আমার গত বৎসরের কার্য্যাবলী চিন্তা করিলে, জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন না তুলিয়া থাকিতে পারি না। টেনিসন্ বলিষ্ঠ আশাবাদী এবং তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস জগৎ উত্তরোত্তর প্রগতির পথে চলিয়াছে। কিন্তু ইহা কি সত্য? আমরা কি আমাদের আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে চলিয়াছি? আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, ভারতবর্ষ কি প্রগতির পথে চলিতেছে? আমার মনে হয় না। হয়ত অশুভ হইতে শুভের উদ্ভব হয়। হয়ত ভারত পাপের পঙ্কিল পথের মধ্য দিয়া শান্তি ও প্রগতির দিকে অগ্রসর হইতেছে। কিন্তু বিচারবুদ্ধি ও দূরদৃষ্টির দ্বারা যতদূর দেখা যায়—সবই অন্ধকার—গভীর অন্ধকার কেবল একনিষ্ঠ কর্ম্মী অথবা উচ্চমনা দেশভক্তকে অনুপ্রাণিত করিবার জন্য এখানে সেখানে ক্ষীণতম আশার আলোক। কখনো সেই আলোকরেখা উজ্জ্বলতর হইয়া উঠে, কখনো বা তমসা ঘনীভূত হয়। ভারতের ভবিষ্যৎ ইতিহাস ঝটিকাবিক্ষুব্ধ তমসাচ্ছন্ন আকাশের ন্যায়। ইংল্যাণ্ড বিশেষতঃ সমগ্র ইউরোপ হয়ত প্রগতির পথে। ধর্ম্মের তারকা ইউরোপের আকাশে উদীয়মান, কিন্তু ভারতের আকাশে অস্তাচলগামী। ভারতবর্ষ কি ছিল আর কি হইয়াছে? কি শোচনীয় পরিবর্ত্তন। কোথায় সেই মহর্ষি, মহাজ্ঞানী দার্শনিকবৃন্দ আমাদের পূর্ব্ব-পুরুষগণ, যাঁহারা জ্ঞানের শেষ সীমায় পৌঁছিয়াছিলেন? কোথায় তাঁহাদের অগ্নিগর্ভ ব্যক্তিত্ব? তাঁহাদের অনমনীয় ব্রহ্মচর্য? তাঁহাদের ভগবৎ উপলব্ধি? তাঁহাদের পরমাত্মার সহিত একাত্মবোধ? —আমরা শুধু যাহা মুখেই উচ্চারণ করি। সবই গিয়াছে। বেদমন্ত্র স্তব্ধ। পুণ্যতোয়া গঙ্গার তীরে তীরে আর সামবেদের গুঞ্জন ধ্বনিত হইয়া উঠে না। কিন্তু তবু আমার মনে হয় আশা আছে, এখনো আশা আছে। আশার দূত আমাদের মধ্যে আসিয়াছেন আমাদের প্রাণের সকল তমঃ নাশ করিয়া হৃদয়ে অনির্ব্বাণ শিখা জ্বালাইতে। তিনি ঋষি বিবেকানন্দ। তিনি তাঁহার দিব্য কান্তি, বিশাল ও অন্তর্ভেদী দৃষ্টি লইয়া সন্ন্যাসীর বেশে হিন্দুধর্ম্মের অন্তর্নিহিত বাণী বিশ্বের নিকট প্রচার করিতে আবির্ভূত হইয়াছেন। সন্ধ্যাতারা উঠিয়াছে, চন্দ্রোদয় নিশ্চয়ই হইবে। ভারতের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অবশ্যম্ভাবী। ভগবান করুণাময়। পাপ, অধর্ম্ম, অসাধুতা ও সর্ব্বপ্রকার মলিনতা হইতে তিনি আমাদের একমাত্র লক্ষ্যের দিকে লইয়া চলিয়াছেন। তিনিই সেই আকর্ষণী শক্তি, যাঁহার চতুষ্পার্শে সব কিছু আবর্ত্তন করিতেছে এবং যাহার দিকে সকল সৃষ্টি ধাবিত হইতেছে। আমাদের অগ্রসর হইতে হইবে। পথ বিপৎসঙ্কুল ও কণ্টকাস্তীর্ণ হইতে পারে—যাত্রা ক্লেশকর হইতে পারে তথাপি চলিতেই হইবে। অবশেষে তাঁহার মধ্যেই বিলীন হইয়া যাইতে হইবে। সেই দিন দূর হইতে পারে তবুও আসিবে। ইহাই আমার একমাত্র আশা। আমার কাছে আর সবই হতাশা। আমরা কি অনুভব করি না যে তিনি সর্ব্বদা আমাদের চুম্বকের শক্তিতে উপরের দিকে টানিতেছেন? আমার মনে হয় করি। আমাদের চারিদিকে প্রকৃতির রূপ তিনি উন্মোচিত করিয়াছেন তাঁহাকে উপলব্ধি করিবার জন্য। নয় কি? তারার ভাষায় তিনি তাঁহার বাণী প্রচার করিতেছেন। তিনি যে অনন্ত, অনন্ত আকাশ মানুষকে সে কথাই স্মরণ করাইতেছে। তিনি কি তাঁহার ভালবাসা উপলব্ধি করিবার জন্যই আমাদের প্রাণে ভালবাসা দেন নাই? হায়! তিনি করুণাময় আর আমরা পাপিষ্ঠ।

 মেজদাদা, জানি না কেন এইভাবে এই সব লিখিতেছি। আমি দেখিয়াছি মাঝে মাঝে হৃদয়ের ভার লাঘব করিতে ইচ্ছা হয়। সম্ভবতঃ ইহা সেইরূপ একটি মুহূর্ত্ত।

গত ডাকে আপনার পত্র পাইয়া যার পর নাই আনন্দ লাভ করিয়াছি। কিছুদিন হইতে অনুভব করিতেছিলাম যে, দেশান্তরের ব্যবধান আমাদের মধ্যে এক দূরত্বের সৃষ্টি করিয়াছে কিন্তু আপনার এই অনিন্দ্যসুন্দর চিঠিখানি সেই অনুভূতি ঘুচাইয়া দিয়াছে।

 আমাদের ভূতপূর্ব্ব সহকারী প্রধান শিক্ষক মহাশয় (বর্ত্তমান প্রধান শিক্ষক, সম্বলপুর জিলা স্কুল) বাবু সুরেশচন্দ্র গুপ্ত মহাশয়ের স্মৃতিরক্ষা করিতে চাই। আমরা ইংলণ্ড হইতে তাঁহার আবক্ষ মূর্ত্তি করাইতে চাই। যদি এক পাউণ্ডে হয় তবে অল্প ব্যয়ে হইল বলিতে হইবে। ভাড়া কত লাগিবে বলিয়া আপনার মনে হয়, ইংলণ্ড হইতে সরাসরি আনাইতে ৩৫ বা ৪০ টাকায় কি যথেষ্ট হইবে?

 এখন আমাদের টেষ্ট পরীক্ষা চলিতেছে। ভালই হইতেছে। আমরা ভাল আছি। আশা করি কুশলে আছেন। আপনি আমার প্রণাম গ্রহণ করিবেন। ইতি—

আপনার স্নেহের 
সুভাষ 

(ইংরাজী হইতে অনূদিত)