পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/৪
পরম পূজনীয়া
শ্রীমতি মাতাঠাকুরাণী
শ্রীচরণ কমলেষু
মা,
অনেকদিন হইল আপনাকে কোনও পত্র লিখি নাই তজ্জন্য আমায় ক্ষমা করিবেন। নদাদা এখন কেমন আছেন লিখিয়া চিন্তা দূর করিবেন। তাঁহার কি এবার পরীক্ষা দেওয়া হইবে না?
ভগবানের দয়ার অভাব নাই—দেখিতে বসিলে জীবনের প্রতি মুহূর্ত্তে তাঁহার দয়ার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে আমরা অন্ধ, অবিশ্বাসী, ঘোর নাস্তিক, তাই তাঁহার দয়ার মাহাত্ম্য বুঝিতে পারি না। আর বুঝিব বা কি করিয়া? দুঃখে পড়িলে তাঁহাকে ডাকি—অনেকটা প্রাণ খুলিয়া ডাকি—কিন্তু যেই দুঃখ দূর হইল—যেই সুখের আলোক আসিতে লাগিল——অমনি আমাদের ডাকা বন্ধ হইল আর আমরা তাঁহাকে ভুলিয়া গেলাম। এইজন্যেই ত কুন্তীদেবী বলিয়াছিলেন, “হে ভগবান্! আমাকে সর্ব্বদা বিপদের মধ্যে রাখিও; তাহা হইলে আমি তোমায় সর্ব্বদা প্রাণ খুলিয়া ডাকিতে পারিব; সুখের সময় তোমাকে ভুলিয়া যাইতে পারি—অতএব আমার সুখে প্রয়োজন নাই।”
জন্মমৃত্যু লইয়া এ জীবন—তাহাতে একমাত্র সার জিনিষ —হরিনাম। তাহা না করিতে পারিলে জীবন নিরর্থক। আমাতে পশুতে প্রভেদ এই যে পশুরা ভগবানকে বুঝিতে বা বুঝিয়া ডাকিতে পারে না আর আমরা চেষ্টা করিলে তাহা পারি। এ ভবে আসিয়া যদি ভগবানের নাম না করিতে পারিলাম তবে এখানে আসা আমার বিফল হইল। জ্ঞান বড়, বড় জিনিস—ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে তাহা ধরিবে না—তাই ভক্তি চাই, জ্ঞান এখন চাই না। তর্ক করিতে চাই না—কারণ আমি অজ্ঞ ও অন্ধ। সুতরাং এখন চাই কেবল বিশ্বাস—অন্ধ বিশ্বাস—শুধু “হরি আছেন” এই বিশ্বাস; আর কিছু চাহি না। ভক্তি বিশ্বাস হইতে আসিবে এবং জ্ঞান ভক্তি হইতে আসিবে। মহর্ষিগণ বলিয়াছেন—“ভক্তির্জ্ঞানায় কল্পতে”—ভক্তি জ্ঞানের জন্য ধাবিত হয়। লেখাপড়ার উদ্দেশ্য— বুদ্ধিবৃত্তি পরিমার্জ্জিত করা এবং সদসৎ বিবেচনা শক্তি দেওয়া। এই দুই উদ্দেশ্য সফল হইলে লেখা পড়া সার্থক হইবে। লেখাপড়া শিখিয়াও যদি কেহ হীনচরিত্র হয় তবে তাহাকে কি পণ্ডিত বলিব? কখনই না। আর যদি কেহ মূর্খ হইয়াও বিবেকাধীন হইয়া চলিতে পারে এবং ভগবদ্বিশ্বাসী ও ভগবৎ প্রেমিক হইতে পারে তবে তাহাকে বলিব মহাপণ্ডিত। দুই চার কথা শিখিলেই কি জ্ঞানী হয়—প্রকৃত জ্ঞান—ঈশ্বরজ্ঞান। আর সমস্ত জ্ঞান—অজ্ঞান। আমি বিদ্বান বা পণ্ডিতকে শ্রদ্ধা করিতে চাহি না! ভগবানের নাম স্মরণে যাহার চক্ষু দিয়া প্রেম বিগলিত হয় আমি তাহাকে দেবতা বলিয়া পূজা করি। মেথর হইলেও আমি তাহার পদরেণু বক্ষে ধারণ করিতে চাহি। আর একবার “দুর্গা” বা একবার “হরি” বলিলে যাহার ঘর্ম্ম, অশ্রুত্যাগ, রোমাঞ্চ প্রভৃতি সাত্ত্বিক লক্ষণ আবির্ভূত হয়, তাহার ত কথাই নাই—সে স্বয়ং ভগবান্। তাঁহাদের পাদস্পর্শে পৃথিবী পবিত্র হইয়াছে— আমরা ত অতি সামান্য তুচ্ছ জিনিষ।
আমরা বৃথা “ধন” “ধন” বলিয়া হাহাকার করি, একবারও ভাবি না, প্রকৃত ধনী কে? যাহার ভগবৎ প্রেম, ভগবদ্ভক্তি প্রভৃতি ধন আছে জগতে সেই ত ধনী। তাহার তুলনায় মহারাজাধিরাজরাও দীন ভিখারী। এরূপ অমূল্যধন হারাইয়াও আমরা যে জীবিত আছি—ইহা বড় আশ্চর্যের বিষয়।
আমরা “পরীক্ষা আসিতেছে” বলিয়া ব্যস্ত হই কিন্তু একবারও ভাবিয়া দেখি না যে জীবনের প্রতি মুহূর্ত্তে পরীক্ষা চলিতেছে। সে পরীক্ষা ঈশ্বরের নিকট, ধর্ম্মের নিকট। লেখাপড়ার পরীক্ষা কি সামান্য পরীক্ষা—তাহ দুইদিনের জন্য। কিন্তু সে সব পরীক্ষা অনন্তকালের জন্য। তাহার ফল জন্মে ২ ভোগ করিতে হইবে।
ভগবানের শ্রীচরণে জীবন সমর্পণ করিয়া যিনি আপনার জীবনতরী ভাসাইতে পারেন, তিনিই ধন্য, তাঁহার জীবন সার্থক, তাঁহার মানবজন্ম সফল। কিন্তু হায়! আমরা এ মহাসত্য বুঝিয়াও বুঝি না। আমরা এরূপ অন্ধ, এরূপ অবিশ্বাসী ও এরূপ মূর্খ যে কিছুতেই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয় না। আমরা মানুষ নহি কলিযুগের রাক্ষস।
তবে আমাদের আশা আছে—ভগবান দয়াময়—তিনি চিরকালই দয়াময়। ভীষণ পাপের তাণ্ডব নৃত্যের ভিতরেও তাঁহার দয়ার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁহার দয়ার আদিও নাই অন্তও নাই।
বৈষ্ণব ধর্ম্মের লোেপ হইবার উপক্রম হইলে, বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ অদ্বৈতাচার্য্য বৈষ্ণব ধর্ম্মের অবমাননায় ব্যথিত হইয়া প্রার্থনা করেন, “হে ভগবান্ রক্ষা কর, এ কলিযুগে আর ধর্ম্ম থাকে না, তুমি আসিয়া উদ্ধার কর।” তখন নারায়ণ চৈতন্যদেবের দেহ ধারণ করিয়া পুনরায় মর্ত্ত্যলোকে আগমন করেন। এই সব দেখিয়া পাপের অন্ধকারের ভিতরেও মাঝে ২ সত্য, জ্ঞান, প্রেম ধর্ম্মের আলোক দেখিতে পাইয়া আশা হয় যে, এখনও আমাদের উন্নতি হইতে পারে, তাহা না হইলে কেন তিনি পুনঃ পুনঃ এখানে আসিয়া মানবদেহ ধারণ করিবেন।
আপনি কলকাতায় আর কতদিন থাকবেন। আপনার সকলে কেমন আছেন লিখিয়া চিন্তা দূর করিবেন। আমরা সকলে ভাল আছি। বাবা ভাল আছেন। ইতি—
সুভাষ