১৪

 ভারতী ও অপূর্ব্ব দুজনেই পিছনের দরজার প্রতি দৃষ্টিপাত করিল, কিন্তু কেহই কোন কথা কহিল না। অপূর্ব্ব কিছুই না বুঝিয়াও এটুকু বুঝিল যে, এমন করিয়া যে লোক নিজেকে স্বেচ্ছায় বন্দী করিয়া রাখিল তাহার সম্বন্ধে কৌতূহলী হইতে নাই। উভয়ে নীরবে হোটেলের বাহিরে আসিতে ভারতী কহিল, চলুন অপূর্ব্ববাবু আমরা ঘরে যাই—

 কিন্তু আমার যে আবার অফিসের বেলা—

 রবিবারেও অফিস?

 রবিবার, তাই ত বটে! অপূর্ব্ব খুশী হইয়া বলিল, একথা সকালে মনে হলে নাওয়া-খাওয়ার জন্য আর ব্যস্ত হতে হত না। আপনার এত জিনিস মনে থাকে, কিন্তু ওটুকু ভুলে গিয়েছিলেন।

 ভারতী একটু হাসিয়া বলিল, তা’ হবে, কিন্তু কাল রাত্রে আপনার না-খাওয়ার কথাটি তুলিনি।

 অপূর্ব্ব হঠাৎ থমকিয়া কহিল, আমার দেরি করবার জো নেই, তেওয়ারী বেচারা হয়ত ভেবে সারা হয়ে যাচ্চে।

 ভারতী বলিল, যাচ্ছে না তার কারণ, আপনি জাগবার পূর্ব্বেই সে খবর পেরেচে আপনি কুশলে আছেন।

 সে জানে আমি আপনার কাছে আছি?

 ভারতী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, জানে। ভোরবেলাতেই আমি লোক পাঠিয়ে দিয়েচি।

 এই সংবাদ শুনিয়া অপূর্ব্ব শুধু নিশ্চিন্ত নয়, তাহার মনের উপর হইতে একটা সত্যকার বোঝা নামিয়া গেল। কালরাত্রে ফিরিবার পথে, ফিরিয়া আসিয়া, খাওয়া শোয়া, সকল কাজে সকল কথার মধ্যে এই ভাবনাই বহুবার তাহাকে ধাক্কা মারিয়া গেছে, কি জানি কাল সকালে তেওয়ারী ব্যাটা তাহার কথা বিশ্বাস করিবে কি না। এই বর্ম্মাদেশের কতপ্রকার জনশ্রুতিই না প্রচলিত আছে,—হয়ত বাড়িতে মায়ের কাছে কি একটা লিখিয়া দিবে, না হয়ত ফিরিয়া গিরা গল্প করিবে,—পাকা কালীর মত, কালী গেলেও যাহার দাগ মুছিবে না—এই তুচ্ছ বস্তুটাই ছোট্ট কাঁটার মত তাহার পায়ে প্রদি পদক্ষেপেই খচ্ খচ্ করিতেছিল। এতক্ষণ পরে সে যেন নির্ভয়ে পা ফেলিয়া বাঁচিল। তেওয়ারী আর যাহাই করুক, ভারতীর মুখের কথা সে মরিয়া গেলেও অবিশ্বাস করিবে না। যে ছাড়-পত্র ভারতী লিখিয়া দিয়াছে তাহার চেয়ে নিষ্কলঙ্কতার বড় দলিল তেওয়ারীর কাছে যে আর নাই, অপূর্ব্ব তাহা ভাল করিয়াই জানিত। পুলকিতচিত্তে কহিল, আপনার সকল দিকে চোখ আছে। বাড়িতে বৌদিদেরও দেখেচি, অন্য সব মেয়েদেরও দেখেচি, আমার মাকেও দেখেচি, কিন্তু এমন সবদিকে দৃষ্টি আমি কাউকে দেখিনি। বাস্তবিক বলচি, আপনি যে বাড়ির গৃহিণী হবেন সে বাড়ির লোকেরা চোখ বুজে দিন কাটিয়ে দেবে, কখনো কাউকে দুঃখ পেতে হবে না।

 ভারতীর মুখের উপর দিয়া যেন বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। অপূর্ব্ব ইহার কিছুই দেখিল না, সে পিছনে আসিতেছিল, পিছন হইতেই পুনরায় কহিল, এই বিদেশে আপনি না থাকলে আমার কি হোত বলুন ত! সমস্ত চুরি যেত, তেওয়ারী হয়ত ঘরেই মরে থাকতো,—বামুনের ছেলেকে মেথর মুদ্দফরাসে টানা হেঁচড়া করত,— এই ভয়ানক সম্ভাবনায় তাহার গায়ে কাঁটা দিয়া গেল। একটু থামিয়া কহিল,—আমিই কি আর থাকতে পারতাম? চাকরি ছেড়ে দিয়ে হয়ত চলে যেতে হ’তো, তারপরে আবার যা-কে তাই। সেই বউদিদির গঞ্জনা আর মায়ের চোখের জল। আপনিই ত সব। সমস্ত বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

 ভারতী বলিল, অথচ, এসেই আমার সঙ্গে ঝগড়া করেছিলেন।

 অপূর্ব্ব লজ্জা পাইয়া কহিল, সমস্ত এই তেওয়ারী ব্যাটার দোষ, কিন্তু মা এসব শুনলে আপনাকে যে কত আশীর্ব্বাদ করবেন তা আপনি জানেন না।

 ভারতী কহিল, কেমন করে জানবো? মা এলেই ত তবেই তাঁর মুখ থেকে শুনতে পাবো!

 অপূর্ব্ব আশ্চর্য হইয়া বলিল, মা আসবেন বর্ম্মায়? আপনি বলেন কি?

 ভারতী জোর দিয়া কহিল, কেন আসবেন না,—কত লোকেরই ত মা নিত্য আসচেন। এখানে এলেই কি কারও জাত যেতে পারে নাকি?

 অপূর্ব্ব ধরে ঢুকিয়া সেই আরাম চৌকিটাতেই পুনরায় আসিয়া বসিল। পাশের জানালা দিয়া তাহার মুখে রোদ লাগিতেই ভারতী হাত বাড়াইয়া বন্ধ করিয়া দিয়া কহিল, বৌদিদিরা মাকে তেমন যত্ন করেন না এবং আপনাকে চিরকাল যদি বিদেশে চাকরি করেই কাটাতে হয়, এ বয়সে তাঁর সেবা কে করবে বলুন ত?

 অপূর্ব্ব কহিল, মা বলেন ছোট বৌ এসে তাঁর সেবা করবে।

 ভারতী বলিল, আর সে যদি সেবা না করে! আপনি থাকবেন বিদেশে, বড় জায়েদের দেখে সে যদি তাঁদের মতই হয়ে দাঁড়ায়, মাকে যত্ন না করে কষ্ট দিতেই শুরু করে, কি করবেন বলুন ত?

 অপূর্ব্ব ভীত হইয়া কহিল, সে রকম কখ্‌খনো হবে না। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের বংশ থেকে এসে কিছুতেই মাকে দুঃখ দিতে পারবে না, আপনাকে আমি নিশ্চয় বলচি।

 নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের বংশ? এই বলিয়া ভারতী মুচকিয়া শুধু একটু হাসিয়া কহিল, এখন থাক, যদি প্রয়োজন হয় ত সে গল্প আপনার কাছে অন্য একদিন করব। ক্ষণকাল নিঃশব্দে থাকিয়া প্রশ্ন করিল, কেবল মাত্র মায়ের সেবা করবার জন্যই যাঁকে বিবাহ ক’রে আপনি ফেলে আসবেন, তাতে কি তার প্রতি অত্যন্ত অবিচার করা হবে না।

 অপূর্ব্ব তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া স্বীকার করিয়া বলিল, তা হবে।

 ভারতী কহিল, এবং সেই অবিচারের বদলে তার কাছ থেকে নিজে সুবিচার দাবী করবেন?

 অপূর্ব্ব অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া শেষে আস্তে আস্তে বলিল, কিন্তু এ ছাড়া আর আমার উপায় কি ভারতী?

 ভারতী কহিল, উপায় না থাকতে পারে, কিন্তু এ অসম্ভব আপনি অতি বড় নিষ্ঠাবানের ঘর থেকেও প্রত্যাশা করবেন না। এর ফল কখনো ভাল হবে না। আপনার নিষ্ঠুরতার ফলে যতই সে নিজের কর্ত্তব্য পালন করবে, ততই তার কাছে আপনি ছোট হয়ে যাবেন! স্ত্রীর কাছে অশ্রদ্ধেয়, হীন হওয়ায় বড় দুর্ভোগ সংসারে আর নেই অপূর্ব্ববাবু।

 কথাটা এত বড় সত্য যে অপূর্ব্ব নিরুত্তর হইয়া রহিল। শাস্ত্রমতে স্ত্রীর কর্ত্তব্য কি, পতিব্রতা কাহাকে বলে, নিঃস্বার্থ শাশুড়ী-সেবায় কতখানি মাহাত্ম্য, স্বামীর ইচ্ছামাত্র পালন করার কিরূপ পূণ্য ইত্যাদি নানাবিধ উপাখ্যান বন্ধুমহলে আধুনিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করিবার কালে সে শাস্ত্রগ্রন্থাদি হইতে নজির স্বরূপে উদ্ধৃত করিয়া তাহাদের স্তব্ধ করিয়া দিয়াছে, কিন্তু এই খ্রীষ্টান মেয়েটির সম্মুখে তাহার আভাসমাত্রও উচ্চারণ করিতে তাহার মুখ ফুটিল না। খানিক পরে সে কতকটা যেন আপনাকে আপনি বলিল, বাস্তবিক, আজকালকার দিনে এ-রকম মেয়ে বোধ হয় কেউ নেই।

 ভারতী হাসিল, কহিল, একেবারে কেউ নেই তা’ কেমন করে বলবেন? নিষ্ঠাবানের ঘরে না থাকলেও হয়ত আর কোথাও কেউ থাকতে পারে, যে আপনার জন্যে নিজেকে সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিতে পারে, কিন্তু তাকে আপনারা খুঁজে পাবেন কোথায়?

 অপূর্ব্ব নিজের চিন্তাতেই ছিল, ভারতীর কথায় মন দেয় নাই, কহিল, সে তো বটেই।

 ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কবে বাড়ি যাবেন?

 অপূর্ব্ব অন্যমনষ্কের মতই জবাব দিল, কি জানি, মা কবে চিঠে লিখে পাঠাবেন। কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া বলিতে লাগিল, বাবার সঙ্গে মতের অমিল নিয়ে মা আমার কোনদিন জীবনে সুখ ভোগ করেননি। সেই মাকে একলা ফেলে রেখে আসতে আমার কিছুতে মন সরে না। কি জানি, এবার গেলে আর আসতে পারবো কি না। হঠাৎ ভারতীর মুখের প্রতি দৃষ্টি স্থির করিয়া কহিল, দেখুন, বাইরে থেকে দেখতে আমাদের সাংসারিক অবস্থা যতই সচ্ছল হোক ভিতরে কিন্তু বড় অনটন! সহরে অধিকাংশ গৃহস্থের এমনি দশা। বৌদিদিরা যে-কোনদিন আমাদের পৃথক করে দিতে পারেন। আমি ফিরে যদি না আসতে পারি ত আমাদের কষ্টের হয়ত সীমা থাকবে না।

 ভারতী বলিল, আপনাকে আসতেই হবে।

 মায়ের কাছ থেকে চিরদিন আলাদা হয়ে থাকবো?

 তাঁকে রাজি করে সঙ্গে নিয়ে আসুন। আমি নিশ্চয় জানি, তিনি আসবেন।

 অপুর্ব্ব হাসিয়া কহিল, কখ্‌খনো না। মাকে আপনি জানেন না। আচ্ছা, ধরুন যদি তিনি আসেন, তাঁকে দেখবে কে এখানে?

 ভারতীও হাসিয়া কহিল, আমি দেখবো।

 আপনি? ঘরে ঢুকলেই ত মা হাঁড়ি ফেলে দেবেন।

 ভারতী জবাব দিল, কতবার দেবেন? আমি রোজ রোজ ঘরে ঢুকবো। দুজনেই হাসিয়া উঠিল! ভারতী সহসা গম্ভীর হইয়া কহিল, আপনি নিজেও ত হাঁড়ি ফেলার দলে, কিন্তু হাঁড়ি ফেলে দিলেই যদি সব ল্যাঠা চুকে যেতো, পৃথিবীর সমস্যা তাহলে খুব সোজা হয়ে উঠতো। বিশ্বাস না হয় তেওয়ারীকে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন।

 অপূর্ব্ব স্বীকার করিয়া কহিল, তা সত্যি। সে বেচারা হাঁড়ি ফেলবে বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চোখ দিয়ে তার জলও পড়বে। আপনাকে সে এত ভক্তি করে যে, একটু জপালে হয়ত সে ক্রীশ্চান হতেও রাজি হয়ে পড়ে, বলা যায় না।

 ভারতী কহিল, সংসারে কিছুই বলা যায় না। চাকরের কথাও না, মনিবের কথাও না। এই বলিয়া সে হাসি গোপন করিতে যখন মুখ নীচু করিল, তখন অপূর্ব্বর নিজের মুখখানা একেবারে আরক্ত হইয়া উঠিল, কহিল, সংসারে এটুকু কিন্তু স্বচ্ছন্দে বলা যেতে পারে যে চাকর ও মনিবের বুদ্ধির তারতম্য থাকতে পারে।

 ভারতী মুখ তুলিয়া কহিল, আছেই ত। সেই জন্য তার রাজি হ’তে দেরি হ’তে পারে, কিন্তু আপনার হবে না। তাহার চোখের দৃষ্টি চাপা হাসির বেগে একেবারে চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, অপূর্ব্ব পরিহাস বুঝিতে পারিয়া খুশী হইয়া কহিল, আচ্ছা, তামাসা নয়, বাস্তবিক বলচি, আমি ধর্ম্ম ত্যাগ করিতে পারি এ আপনি ভাবতে পারেন?

 ভারতী কহিল, পারি।

 সত্যিই পারেন।

 সত্যিই পারি।

 অপূর্ব্ব কহিল, অথচ, সত্যিই আমি প্রাণ গেলেও পারিনে।

 ভারতী বলিল, প্রাণ যাওয়া যে কি জিনিস সে তো আপনি জানেন না। তেওয়ারী জানে। কিন্তু, এ নিয়ে তর্ক করে আর কি হবে, আপনার মত অন্ধকারের মানুষকে আলোতে আনার চেয়ে চের বেশি জরুরী কাজ আমার এখনো বাকী। আপনি বরঞ্চ একটু ঘুমোন।

 অপূর্ব্ব বলিল, দিনের বেলা আমি ঘুমুইনে। কিন্তু জরুরী কাজটা আবার আপনার কি?

 ভারতী কহিল, আপনার বেগার খেটে বেড়ানোই আমার একমাত্র জরুরী কাজ নাকি? আমাকেও দুটি রেঁধে খেতে হয়। ঘুমুতে না পারেন আমার সঙ্গে নীচে চলুন। আমি কি কি রাঁধি, কেমন করে রাঁধি দেখবেন। হাতে যখন একদিন খেতেই হবে তখন একেবারে অনভিজ্ঞ থাকা ভাল নয়। এই বলিয়া সে সহসা খিল খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল।

 অপূর্ব্ব কহিল, আমি মরে গেলেও আপনার হাতে খাবো না।

 ভারতী বলিল, আমি বেঁচে থেকে খাবার কথাই বলচি। এই বলিয়া সে হাসিমুখে নীচে নামিরা গেল।

 অপূর্ব্ব ডাকিয়া কহিল, আমি তাহলে এখন বাসাই যাই,—তেওয়ারী বেচারা ভেবে সারা হয়ে যাচ্চে। এই বলিয়া সে কিয়ৎকাল জবাবের জন্য উৎকর্ণ হইয়া থাকিয়া অবশেষে হেলান দিয়া শুইয়া পড়িল। হয়ত, সে শুনিতে পায় নাই, হয়ত, শুনিয়াও উত্তর দেয় নাই, কিন্তু ইহাই বড় সমস্যা নয়; বড় সমস্যা এই যে, তাহার অবিলম্বে বাসায় যাওয়া উচিত। কোন অজুহাতেই আর দেরি করা সাজে না। অথচ, ভিতর হইতে যাওয়ার তাগিদ যতই অনুভব করিতে লাগিল, ততই কিন্তু দেহ যেন তাহার অলস শিথিল হইয়া আসিতে লাগিল। শেষকালে সেই বড় চেয়ারের উপরেই মুখের উপর হাত চাপা দিয়া অপূর্ব্ব ঘুমাইয়া পড়িল।