জাহাজের কয়টা দিন অপূর্ব্ব চিঁড়া চিবাইয়া সন্দেশ ও ডাবের জল খাইয়া সর্ব্বাঙ্গীণ ব্রাহ্মণত্ব রক্ষা করিয়া অর্দ্ধমৃতবৎ কোনমতে গিয়া রেঙ্গুনের ঘাটে পৌঁছিল। নবপ্রতিষ্ঠিত বোথা কোম্পানীয় জন-দুই দরোয়ান ও একজন মাদ্রাজী কর্ম্মচারী জেটিতে উপস্থিত ছিলেন, ম্যানেজারকে তাঁহারা সাদর সম্বর্ন্ধনা করিলেন। তিনি ত্রিশ টাকা দিয়া বাসা ভাড়া করিয়া আফিসের খরচার যথাযোগ্য আসবাব-পত্রে ঘর সাজাইয়া রাখিয়াছেন এ-সংবাদ দিতেও বিলম্ব করিলেন না।

 ফাল্গুন মাস শেষ হইতে চলিয়াছে, গরম মন্দ পড়ে নাই। সমুদ্র-পথের এই প্রাণান্ত বিড়ম্বনা-ভোগের পর নিরালা গৃহের সজ্জিত শয্যার উপরে হাত-পা ছড়াইয়া একটুখানি শুইতে পাইবে কল্পনা করিয়া সে যথেষ্ট তৃপ্তি অনুভব করিল। পাচক ব্রাহ্মণ সঙ্গে আসিয়াছিল, হালদার-পরিবারে বহুদিনের চাকরিতে তাহার নিখুঁত শুদ্ধাচারিতা করুণাময়ীর কাছে সপ্রমাণ হইয়া গেছে। তাই বাড়ির বহু অসুবিধা সত্ত্বেও এই বিশ্বস্ত লোকটিকে সঙ্গে দিয়া মা অনেকখানি সান্ত্বনা লাভ করিয়াছিলেন। আবার শুধু কেবল পাচকই নয়, পাক করিবার মত কিছু কিছু চাল ডাল ঘি-তেল গুঁড়া মশলা মায় আলু-পটল পর্য্যন্ত সঙ্গে দিতে তিনি বিস্মৃত হন নাই। সুতরাং ঈষদুষ্ণ অন্ন-ব্যঞ্জনে মুখের শুকনা চিঁড়ার স্বাদটাও যে সে অবিলম্বে ফিরাইতে পারিবে এ ভরসাও তাহার মনের মধ্যে বিদ্যুৎ-স্ফুরণের ন্যায় চমকিয়া গেল। গাড়ি ভাড়া হইয়া আসিলে কর্ম্মচারী বিদায় গ্রহণ করিলেন, কিন্তু মোট-ঘাট জিনিস-পত্র লইয়া আফিসের দরোয়ানজী পথ দেখাইয়া সঙ্গে চলিল, এবং একটানা জলযাত্রা ছাড়িয়া শক্ত ডাঙার উপরে গাড়ির মধ্যে বসিতে পাইয়া অপূর্ব্ব আরাম বোধ করিল। কিন্তু মিনিট-দশেকের মধ্যে গাড়ি যখন বাসার সম্মুখে আসিয়া থামিল, এবং দরোয়ানজী হাঁক-ডাকে প্রায় ডজনখানেক কৌরঙ্গদেশীয় কুলি যোগাড় করিয়া মোটঘাট উপরে তুলিবার আয়োজন করিল, তখন সেই তাহার ত্রিশ টাকা ভাড়ার বাটীর চেহারা দেখিয়া অপূর্ব্ব হতবুদ্ধি হইয়া রহিল। বাড়ির শ্রী নাই, ছাঁদ নাই, সদর নাই, অন্দর নাই, প্রাঙ্গণ বলিতে এই চলাচলের পথটা ছাড়া আর কোথাও কোন স্থান নাই। একটা অপ্রশস্ত কাঠের সিঁড়ি রাস্তা হইতে সোজা তেতালা পর্য্যন্ত উঠিয়া গিয়াছে, সেটা যেমন খাড়া তেমনি অন্ধকার। ইহা কাহারও নিজস্ব নহে, অন্ততঃ ছয়জন ভাড়াটিয়ার ইহাই চলাচলের সাধারণ পথ। এই উঠা-নামার কার্য্যে দৈবাৎ পা ফস্কালেই প্রথমে পথের বাঁধানো রাজায় রাজপথ, পরে তাঁহারই হাঁসপাতাল, এবং তৃতীয় গতিটা না ভাবাই ভালো। এই দুরারোহ দারুময় সোপান-শ্রেণীর সহিত পরিচিত হইয়া উঠিতে কিছু দীর্ঘকাল লাগে। অপূর্ব্ব নূতন লোক, তাই সে প্রতিপদক্ষেপে অত্যন্ত সতর্ক হইয়া দরোয়ানের অনুবর্ত্তী হইয়া উঠিতে লাগিল। দরোয়ান কতকটা উঠিয়া ডান দিকে দোতলার একটা দরজা খুলিয়া দিয়া জানাইল, সাহেব, ইহাই আপনার গৃহ।

 ইহার মুখোমুখি বামদিকের রুদ্ধ দ্বারটা দেখাইয়া অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, এটাতে কে থাকে?

 দরোয়ান কহিল, কোই এক চীনা সাহেব রহতেঁ হে শুনা।

 অপূর্ব্ব ঠিক তাহার মাথার উপরে তেতালায় কে থাকে প্রশ্ন করায় সে কহিল, এক কালা সাহেব ত রহতেঁ হে দেখা। কোই মান্দ্রাজ-বালে হোয়েঙ্গে জরুর।

 অপূর্ব্ব চুপ করিয়া রহিল। এই একমাত্র আনাগোনার পথে উপরে এবং পার্শ্বে এই দুটি একান্ত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর পরিচয়ে তাহার মুখ দিয়া কেবল দীর্ঘশ্বাস পড়িল। নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া তাহার আরও মন খারাপ হইয়া গেল। কাঠের বেড়া দেওয়া পাশাপাশি ছোট বড় তিনটি কুঠরী। একটিতে কল, স্থানের ঘর, রান্নার জায়গা প্রভৃতি অত্যাবশ্যকীয় যাহা কিছু সমস্তই, মাঝেরটি এই অন্ধকার সিঁড়ির ঘর, গৌরবে বৈঠকখানা বলা চলে, এবং সবশেষে রাস্তার ধারের কক্ষটি অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার এবং আলোকিত,—এইটি শয়ন-মন্দির। অফিসের খরচায় এই ঘরটিকেই খাট, টেবিল এবং গুটিকয়েক চেয়ার দিয়া সাজনো হইয়াছে। পথের উপর ছোট একটুখানি বারান্দা আছে, সময় কাটানো অসম্ভব হইলে এখানে দাঁড়াইয়া লোক-চলাচল দেখা যায়। ঘরে হাওয়া নাই, আলো নাই, একটার মধ্যে দিয়া আর একটার যাইতে হয়,—ইহার সমস্তই কাঠের,—দেয়াল কাঠের, মেঝে কাঠের, ছাত কাঠের সিঁড়ি কাঠের, আগুনের কথা মনে হইলে সন্দেহ হয় এতবড় সর্বাঙ্গ-সুন্দর জতুগৃহ বোধ করি রাজা দুর্যোধনও তাঁর পাণ্ডব ভায়াদের জন্য তৈরী করিয়া উঠিতে পারে নাই। ইহারই অভ্যন্তরে এই সুদূর প্রবাসে ঘর-বাড়ি, বন্ধু-বান্ধুব, আত্মীয়-স্বজন ছাড়িয়া, বৌদিদিদের ছাড়িয়া, মাকে ছাড়িয়া থাকিতে হইবে স্মরণ করিয়া মুহূর্ত্তের দুর্ব্বলতায় তাহার চোখে জল আসিতে চাহিল। সামলাইয়া লইয়া সে খানিকক্ষণ এঘর-ওঘর করিয়া একটা জিনিস দেখিয়া কিছু আশ্বস্ত হইল যে কলে তখনও জল আছে। স্নান ও রান্না দুইই হইতে পারে। দরোয়ান সাহস দিয়া জানাইল, অপব্যয় না করিলে এ সহরে জলের অভাব হয় না, যেহেতু প্রত্যেক দুই ঘর ভাড়াটিয়ার জন্য এ বাড়িতে একটা করিয়া বড় রকমের জলের চৌবাচ্চা উপরে আছে তাহা হইতে দিবারাত্রিই জল সরবরাহ হয়। ভরসা পাইয়া অপূর্ব্ব পাচককে কহিল, ঠাকুর, মা ত সমস্তই সঙ্গে দিয়েচেন, তুমি স্নান করে দুটি রাঁধবার উদ্যোগ কর, আমি ততক্ষণ দরোয়ানজীকে নিয়ে জিনিস-পত্র কিছু কিছু গুছিয়ে ফেলি।

 রসুই ঘরে কয়লা মজুত ছিল, কিন্তু বাঁধানো চুল্লী। নিকানো-মুছানো তেমন হয় নাই, পরীক্ষা করিয়া কিছু কিছু কালীর দাগ প্রকাশ পাইল। কে জানে এখানে কে ছিল, সে কোন জাত, কি রাঁধিয়াছে মনে করিয়া তাহার অত্যন্ত ঘৃণা বোধ হইল, ঠাকুরকে কহিল, এতে তো রাঁধা চলবে না তেওয়ারী, অন্য বন্দোবস্ত করতে হবে। একটা তোলা-উনুন হলে বাইরের ঘরে বসে আজকের মতো দুটো চাল-ডাল ফুটিয়ে নেওয়া যেত, কিন্তু এ পোড়া দেশে কি তা মিলবে?

 দরোয়ান জানাইল কোন অভাব নাই, মূল্য পাইলে সে দশ মিনিটের মধ্যে আনিয়া হাজির করিতে পারে। অতএব সে টাকা লইয়া প্রস্থান করিল। ইতিমধ্যে তেওয়ারী রন্ধনের আয়োজন করিতে লাগিল এবং অপূর্ব্ব নিজে যথাযোগ্য স্থান মনোনীত করিয়া তোরঙ্গ বাক্স প্রভৃতি টানাটানি করিয়া ঘর সাজাইতে নিযুক্ত হইল। কাঠের আলনায় জামা-কাপড় সুট প্রভৃতি গুছাইয়া ফেলিল, বিছানা খুলিয়া খাটের উপর তাহা পরিপাটি বিছাইয়া লইল, তোরঙ্গ হইতে একটা নূতন টেবিল ক্লথ বাহির করিয়া টেবিলে পাতিয়া কিছু কিছু বই ও লিখিবার সরঞ্জাম সাজাইয়া রাখিল, এবং উত্তরে খোলা জানালার পাল্লা দুইটা আপ্রান্ত প্রসারিত করিয়া তাহার দুই কোণে একটা কাগজ গুঁজিয়া দিয়া শোবার ঘরটাকে অধিকতর আলোকিত এবং নয়নরঞ্জন জ্ঞান করিয়া সদ্যরচিত শয্যায় চিত হইয়া পড়িয়া একটা নিশ্বাস মোচন করিল। ক্ষণেক পরেই দরোয়ান লোহার চুল্লী কিনিয়া উপস্থিত করিলে তাহাকে আগুন দিয়া খিচুড়ী এবং যাহা কিছু একটা ভাজা-ভুজি যত শীঘ্র সম্ভব প্রস্তুত করিয়া ফেলিতে আদেশ দিয়া অপূর্ব্ব আর এক দফা বিছানায় গড়াইয়া লইতে যাইতেছিল, হঠাৎ মনে পড়িল মা মাথার দিব্য দিয়া বলিয়া হিয়াছিলেন নামিয়াই একটা টেলিগ্রাফ করিয়া দিতে। অতএব, অবিলম্বে জামাটা গায়ে দিয়া প্রবাসের একমাত্র কর্ণধার দরোয়ানজীকে সঙ্গে করিয়া সে পোস্ট অফিসের উদ্দেশ্যে আর একবার বাহির হইয়া পড়িল, এবং তাহারই কথামত তেওয়ারী ঠাকুরকে আশ্বাস দিয়া গেল, ফিরিয়া আসিতে তাহার একঘণ্টার বেশী লাগিবে না, কিন্তু ইতিমধ্যে সমস্ত যেন প্রস্তুত হইয়া থাকে।

 আজ কি একটা খ্রীষ্টান পর্ব্বোপলক্ষে ছুটি ছিল। অপূর্ব্ব পথের দুইধারে চাহিয়া কিছুদূর অগ্রসর হইয়াই বুঝিল এই গলিটা দেশ ও বিদেশী মেমসাহেবদের পাড়া এবং প্রত্যেক বাটীতে বিলাতী উৎসবের কিছু কিছু চিহ্ন দেখা দিয়াছে। অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা দরোয়ানজী, এখানে আমাদের বাঙালী লোকও ত অনেক আছে শুনেচি, তাঁরা সব কোন্ পাড়ায় থাকেন?

 প্রত্যুত্তরে সে জানাইল যে এখানে পাড়া বলিয়া কিছু নাই, যে যেখানে খুশি থাকে। তবে ‘অপসর লোগ্’ এই গলিটাকেই বেশী পচ্ছন্দ করে। অপূর্ব্ব নিজেও একজন ‘অপসর্ লোগ্’ কারণ সেও বড় চাকরি করিতেই এ দেশে আসিয়াছে, এবং আপনি গোঁড়া হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও কোন ধর্ম্মের বিরুদ্ধে তাহার বিদ্বেষ ছিল না। তথাপি এই ভাবে আপনাকে উপরে নীচে দক্ষিণে বামে বাসায় ও বাসার বাইরে চারিদিকেই খ্রীষ্টান প্রতিবেশী পরিবৃত দেখিয়া অত্যন্ত বিতৃষ্ণা বোধ করিল। জিজ্ঞাসা করিল, আর কি কোথাও বাসা পাওয়া যায় না, দরোয়ান?

 দরোয়ানজী এ বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নহে, সে চিন্তা করিয়া যাহা সঙ্গত বোধ করিল, তাহাই জবাব দিল, কহিল, খোঁজ করিলে পাওয়া যাইতেও পারে, কিন্তু এ ভাড়ায় এমন বাড়ি পাওয়া কঠিন।

 অপূর্ব্ব আর দ্বিরুক্তি না করিয়া তাহারই নির্দ্দেশ মত অনেকখানি পথ হাঁটিয়া একটা ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসে আসিয়া যখন উপস্থিত হইল তখন মাদ্রাজী তার-বাবু টিফিন করিতে গিয়াছেন, ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করিয়া যখন তাঁহার দেখা মিলিল, তিনি ঘড়ির দিকে চাহিয়া বলিলেন, আজ ছুটির দিন, বেলা দুইটার পরে অফিস বন্ধ হইয়াছে, কিন্তু এখন দুটা বাজিয়া পনর মিনিট হইয়াছে।

 অপূর্ব্ব অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া কহিল, সে দোষ তোমার, আমার নয়। আমি একঘণ্টা অপেক্ষা করিতেছি।

 লোকটা অপূর্ব্বর মুখের প্রতি চাহিয়া নিঃসঙ্কোচে কহিল, না, আমি মাত্র মিনিট দশেক ছিলাম না।

 অপূর্ব্ব তাহার সহিত বিস্তর ঝগড়া করিল, মিথ্যাবাদী বলিয়া তিরস্কার করিল; রিপোর্ট করিব বলিয়া ভয় দেখাইল, কিন্তু কিছুই হইল না। সে নির্ব্বিকার চিত্তে নিজের খাতাপত্র দুরস্ত করিতে লাগিল, জবাবও দিল না। আর সময় নষ্ট করা নিষ্ফল বুঝিয়া অপূর্ব্ব ক্ষুধার তৃষ্ণায় ও ক্রোধে জ্বলিতে জ্বলিতে বড় টেলিগ্রাফ অফিসে আসিয়া অনেক ভিড় ঠেলিয়া অনেক বিলম্বে নিজের নির্ব্বিঘ্নে পৌঁছান সংবাদ যখন মাকে পাঠাইতে পারিল, তখন বেলা আর বড় নাই!

 দুঃখের সাথী দরোয়ানজী সনিয়ে নিবেদন করিল, সাহেব, হামকো ভি বহুত দূর যানা হ্যায়।

 অপূর্ব্ব একান্ত পরিশ্রান্ত ও অন্যমনস্ক হইয়াছিল, ছুটি দিতে আপত্তি করিল না। তাহার ভরসা ছিল নম্বর দেওয়া রাস্তাগুলা সোজা ও সমান্তরাল থাকায় গম্ভব্যস্থান খুঁজিয়া লওয়া কঠিন হইবে না। দরোয়ান অন্যত্র চলিয়া গেল, সেও হাঁটিতে হাঁটিতে এবং গলির হিসাব করিতে করিতে অবশেষে বাটীর দম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল।

 সিঁড়িতে পা দিয়াই দেখিল দ্বিতলে তাহার দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া তেওয়ারী ঠাকুর মস্ত একটা লাঠি ঠুকিতেছে এবং অনর্গল বকিতেছে, এবং প্রতিপক্ষ একব্যক্তি খালি গায়ে পেণ্টুলুন পরিয়া তেতালার কোঠায় নিজের খোলা দরজায় সুমুখে দাঁড়াইয়া হিন্দী ও ইংরেজীতে ইহার জবাব দিতেছে এবং একটা ঘোড়ার চাবুক লইয়া মাঝে মাঝে সাঁই সাঁই শব্দ করিতেছে। তেওয়ারী তাহাকে নীচে ডাকিতেছে, সে তাহাকে উপরে আহ্বান করিতেছে,—এবং এই সৌজন্যের আদান-প্রদান যে ভাষায় চলিতেছে তাহা না বলাই ভাল।

 সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়া অপূর্ব্ব তেমনি দাঁড়াইয়া রহিল। এইটুকু সময়ের মধ্যে ব্যাপারটা যে কি ঘটিল, কি উপায়ে তেওয়ারীজী এইটুকু অবসরেই প্রতিবেশী সাহেবের সহিত এতখানি ঘনিষ্ঠতা করিয়া লইল, সে তাহার কিছুই ভাবিয়া পাইল না। কিন্তু অকস্মাৎ বোধ হয় দুই পক্ষের দৃষ্টিই তাহার উপর নিপতিত হইল। তেওয়ারী মনিবকে দেখিয়া আর একবার সজোরে লাঠি ঠুকিয়া কি একটা মধুর সম্ভাষণ করিল, সাহেব তাহার জবাব দিয়া প্রচণ্ডশব্দে চাবুক আস্ফালন করিলেন, কিন্তু পুনশ্চ যুদ্ধ ঘোষণার পূর্ব্বেই অপূর্ব্ব দ্রুতপদে উঠিয়া গিয়া লাঠিসুদ্ধ তেওয়ারীর হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, তুই কি খেপে গেছিস? এই বলিয়া তাহাকে প্রতিবাদের অবসর না দিয়াই জোর করিয়া ঠেলিয়া ঘরের মধ্যে লইয়া গেল। ভিতরে গিয়া সে রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে কাঁদ কাঁদ হইয়া কহিল, এই দেখুন, হারামজাদা সাহেব কি কাণ্ড করেচে।

 বাস্তবিক, কাণ্ড দেখিয়া অপূর্ব্বর শান্তি এবং ঘুম, ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা একই কালে অন্তর্হিত হইয়া গেল। সুসিদ্ধ খেচরান্নের হাঁড়ি হইতে তখন পর্য্যন্ত উত্তাপ ও মশলার গন্ধ বিকীর্ণ হইতেছে, কিন্তু তাহার উপরে, নীচে, আসে-পাশে চতুর্দ্দিকে জল থৈ থৈ করিতেছে। এ-ঘরে আসিয়া দেখিল, তাহার সদ্যরচিত ধপধপে বিছানাটি ময়লা কালো কালো জলে ভাসিতেছে। চেয়ারে জল, টেবিলে জল, বইগুলো জলে ভিজিয়াছে, বাক্স-তোরঙ্গের উপরে জল জমা হইয়াছে, এমনকি এক কোণে রাখা কাপড়ের আলনাটি অবধি বাদ যায় নাই। তাহার দামী নূতন সুটটির গায়ে পর্য্যন্ত ময়লা জলের দাগ লাগিয়াছে।

 অপূর্ব্ব নিশ্বাস বোধ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি ক’রে হ’ল?

 তেওয়ারী আঙ্গুল দিয়া উপরের ছাদ দেখাইয়া কহিল, ও শালা সাহেবের কাজ। ঐ দেখুন—

 বস্তুতঃ কাঠের ছাদের ফাঁক দিয়া তখন পর্য্যন্ত ময়লা জলের ফোঁটা স্থানে স্থানে চুয়াইয়া পড়িতেছিল। তেওয়ারী দুর্ঘটনা যাহা বিবৃত করিল তাহা সংক্ষেপে এইরূপ—

 অপূর্ব্ব যাইবার মিনিট কয়েক পরেই সাহেব বাড়ি আসেন। আজ খ্রীষ্টানদের পর্ব্বদিন। এবং খুব সম্ভব উৎসব ঘোরালো করিবার উদ্দেশেই তিনি বাহির হইতেই একেবারে ঘোর হইয়া আসেন। প্রথমে গীত ও পরে নৃত্য শুরু হয়। এবং অচিয়েই উভয় সংযোগে শাস্ত্রোক্ত ‘সংগীত’ এরূপ দুর্দ্দান্ত হইয়া উঠে যে তেওয়ারীর আশঙ্কা হয় কাঠের ছাদ হয়ত বা সাহেবের এত বড় আনন্দ বহন করিতে পারিবে না, সবশুদ্ধ তাহার মাথায় ভাঙ্গিয়া পড়িবে। ইহাও সহিয়াছিল, কিছু রান্নার অদূরেই যখন উপর হইতে জল পড়িতে লাগিল, তখন সমস্ত নষ্ট হইবার ভয়ে তেওয়ারী বাহির হইয়া প্রতিবাদ করে। কিন্তু সাহেব,— তা কালাই হৌন বা ধলাই হৌন, দেশী লোকের এই স্পর্দ্ধা সহ্য করিতে পারেন না, উত্তেজিত হইয়া উঠেন, এবং মুহূর্ত্তকালেই এই উত্তেজনা এরূপ প্রচণ্ড ক্রোধে পরিণত হয় যে, তিনি ঘরের মধ্যে গিয়া বালতি বালতি জল ঢালিয়া দেন। ইহার পরে যাহা ঘটিয়াছিল তাহা বলা বাহুল্য—অপূর্ব নিজেও কিছু কিছু স্বচক্ষে দেখিয়াছে।

 অপূর্ব্ব কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে থাকিয়া কহিল, সাহেবের ঘরে কি আর কেউ নেই?

 তেওয়ারী কহিল, কি জানি আছে হয়ত! কে একজন মাতাল ব্যাটার সঙ্গে ঝুটোপুটি লড়াই করছিল। এই বলিয়া সে খিচুড়ির হাঁড়িটার প্রতি করুণ-চক্ষে চাহিয়া রহিল। অপূর্ব্ব ইহার অর্থ বুঝিল। অর্থাৎ কে একজন প্রাণপণে বাধা দিবার চেষ্টা করিয়াছে বটে, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য একতিল কমাইতে পারে নাই।

 অপূর্ব্ব নীরবে বসিয়া রহিল। যাহা হইবার হইয়াছে, কিন্তু নূতন উপদ্রব আর ছিল না। উৎসবে-আনন্দবিহ্বল সাহেবের নব উদ্যমের কোন লক্ষণ প্রকাশ পাইল না। বোধ করি এখন তিনি জমি লইয়াছিলেন,—কেবল নিগার তেওয়ারীকে যে এখনও ক্ষমা করেন নাই, তাহারই অস্ফুট উচ্ছ্বাস মাঝে মাঝে শোনা যাইতে লাগিল।

 অপূর্ব্ব হাসিবার প্রয়াস করিয়া কহিল, তেওয়ারী ভগবান না মাপালে এখনি মুখের গ্রাস নষ্ট হয়ে যায়। আমরা মনে করি আজও জাহাজে আছি। চিঁড়ে-মুড়কি-সন্দেশ এখনো কিছু আছে—রাতটা চলে যাবে। কি বলিস।

 তেওয়ারী মাথা নাড়িয়া সায় দিল, এবং ওই হাঁড়িটার প্রতি একবার সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া চিঁড়া-মুড়কির উদ্দেশে গাত্রোত্থান করিল। সৌভাগ্য এই যে খাবারের রাক্সটা সেই যে ঢুকিয়াই রান্নাঘরের কোণে রাখা হইয়াছিল, আর স্থানান্তরিত করা হয় নাই,—খ্রীষ্টানের জল অন্ততঃ এই বস্তুটার জাত মারিতে পারে নাই।

 ফলারের যোগাড় করিতে করিতে তেওয়ারী রান্নাঘর হইতে কহিল, বাবু, এখানে ত থাকা চলবে না।

 অপূর্ব্ব অন্যমনস্কভাবে বলিল, বোধ হয় না।

 তেওয়ারী হালদার পরিবারের পুরাতন ভৃত্য, আসিবার কালে মা তাহার হাত ধরিয়া যে কথাগুলি বলিয়া দিয়াছিলেন, সেই সকল স্মরণ করিয়া সে উদ্বিগ্নকণ্ঠে কহিল, না বাবু, এ-ঘরে আর একদিনও না। রাগের মাথায় ভাল কাজ করিনি, সাহেবকে আমি অনেক গাল দিয়েছি।

 অপূর্ব্ব কহিল, হাঁ, গাল না দিয়ে তোর মারা উচিত ছিল।

 তেওয়ারীর মাথায় ক্রোধের পরিবর্ত্তে সুবুদ্ধির উদয় হইতেছিল, সে তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করিয়া কহিল, না বাবু না। ওরা হাজার হোক সাহেব। আমরা বাঙালী।

 অপূর্ব্ব চুপ করিয়া রহিল। তেওয়ারী সাহস পাইয়া প্রশ্ন করিল, আফিসের দরোয়ানজীকে বলে কাল সকালেই উঠে যাওয়া যায় না? আমার ত মনে হয় যাওয়াই ভাল।

 অপূর্ব্ব কহিল, বেশ ত, বলে দেখিস। সে মনে মনে বুঝিল সাহেবের প্রতি দেশী লোকের কর্ত্তব্যবুদ্ধি ইতিমধ্যেই তেওয়ারীর সুতীক্ষ্ণ হইয়া উঠিয়াছে। দুর্জ্জনের প্রতি আর তাহার নলিশ নাই, বরঞ্চ, কালব্যয় না করিয়া নিঃশব্দে স্থান ত্যাগই অবশ্য-কর্ত্তব্য স্থির করিয়াছে। কহিল, তাই হবে, তুই খাবার যোগার কর।

 এই যে করি বাবু, বলিয়া সে কতকটা নিশ্চিত্তচিত্তে স্বকার্য্যে মনোনিবেশ করিল, কিন্তু তাহারই কথার সূত্র ধরিয়া ওই ওপরওয়ালা ফিরিঙ্গিটার দুর্ব্ব্যবহার স্মরণ করিয়া অকস্মাৎ অপুর্ব্বর সমস্ত চিত্ত ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিল। তাহার মনে হইল, এ তো কেবল আমি এবং ওই মাতালটা শুধু নয়। সবাই মিলিয়া লাঞ্ছনা এমন নিত্যনিয়ত সহিয়া যাই বলিয়াই ত ইহাদের স্পর্দ্ধা দিনের পর দিন পুষ্ট ও পুঞ্জীভূত হইয়া আজ এমন অভ্রভেদী হইয়া উঠিয়াছে যে, আমাদের প্রতি অন্যায়ের ধিক্কার সে উচ্চ শিখরে আর পৌঁছিতে পর্য্যন্ত পারে না। নিঃশব্দে ও নির্ব্বিচারে সহ্য করাকেই কেবল নিজেদের কর্ত্তব্য করিয়া তুলিয়াছি বলিয়া অপরের আঘাত করিবার অধিকার এমন স্বতঃই সুদৃঢ় ও উগ্র হইয়া উঠিয়াছে। তাই আজ আমার চাকরটা পর্য্যন্ত আমাকে অবিলম্বে পলাইয়া আত্মরক্ষার উপদেশ দিতে পারিল, লজ্জা-সরমের প্রশ্ন পর্য্যন্ত তাহার মনে উদয় হইল না! কিন্তু সে বেচারা রান্নাঘরে বসিয়া চিঁড়া-মুড়কির ফলাহার প্রভুর জন্য সযত্নে প্রস্তুত করিতে লাগিল, জানিতেও পারিল না তাহারি পরিত্যক্ত মোটা বাঁশের লাঠিটা হাতে করিয়া অপূর্ব্ব নিঃশব্দ পদে বাহির হইয়া সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিয়া গেল।

 দ্বিতলে সাহেবের দরজা বন্ধ ছিল, সেই রুদ্ধ দ্বারে গিয়া সে বারংবার আঘাত করিতে লাগিল। কয়েক মুহূর্ত্ত পরে ভীত নারীকণ্ঠে ইংরাজীতে সাড়া আসিল, কে?

 অপূর্ব্ব কহিল, আমি নীচে থাকি। সেই লোকটাকে একবার চাই।

 কেন?

 তাকে দেখাতে চাই সে আমার কত ক্ষতি করেচে। তার ভাগ্য ভাল যে আমি ছিলাম না।

 তিনি শুয়েচেন।

 অপূর্ব্ব অত্যন্ত পুরুষকণ্ঠে কহিল, তুলে দিন, এ শোবার সময় নয়। রাত্রে শুলে আমি বিরক্ত করতে আসব না। কিন্তু এখন তার মুখের জবাব না নিয়ে আমি এক পা নড়ব না। এবং ইচ্ছা না করিলেও তাহার হাতের মোটা লাঠিটা কাঠের সিঁড়ির উপরে ঠকাস্ করিয়া একটা মস্ত শব্দ করিয়া বসিল।

 কিন্তু দ্বারও খুলিল না কোন জবাবও আসিল না। মিনিট-দুই অপেক্ষা করিয়া অপূর্ব্ব পুনশ্চ চীৎকার করিল, আমি কিছুতেই যাব না,—বলুন তাকে বাইরে আসতে।

 ভিতরে যে কথা কহিতেছিল এবার সে রুদ্ধদ্বারের একান্ত সন্নিকটে আসিয়া নম্র ও অতিশয় মৃদুকণ্ঠে কহিল, আমি তাঁর মেয়ে। বাবার হয়ে আপনার কাছে আমি ক্ষমা চাইচি। তিনি যা কিছু করেচেন সজ্ঞানে করেননি। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, আপনার যত ক্ষতি হয়েচে কাল আমরা তার যথাসাধ্য ক্ষতিপূরণ কোরব।

 মেয়েটির কোমল স্বরে অপূর্ব্ব নরম হইল, কিন্তু তাহার রাগ পড়িল না। কহিল, তিনি বর্ব্বরের মত আমার যথেষ্ট লোকসান এবং ততোধিক উৎপাত করেচেন। আমি বিদেশী লোক বটে, কিন্তু আশা করি কাল সকালে নিজে দেখা করে আমার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করবার চেষ্টা করবেন।

 মেয়েটি কহিল, আচ্ছা। ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, আপনার মত আমরাও এখানে সম্পূর্ণ নতুন। মাত্র কাল বৈকালে আমরা মৌলমিন থেকে এসেচি।

 অপূর্ব্ব আর কোন কথা না কহিয়া আস্তে আস্তে নীচে নামিরা গেল। ঘরে গিয়া দেখিল তখন পর্য্যন্ত তেওয়ারি ভোজনের উদ্যোগেই ব্যাপৃত আছে, এত কাণ্ড সে টেরও পায় নাই।

 দু’টি খাইয়া লইয়া অপূর্ব্ব তাহার শোবার ঘরে আসিয়া ভিজা তোষক বালিশ প্রভৃতি নীচে ফেলিয়া দিয়া রাত্রিটার মত কোনমতে একটা শয্যা পাতিয়া লইয়া শুইয়া পড়িল। প্রবাসের মাটিতে পা দিয়া পর্য্যন্ত তাহার ক্ষতি, বিরক্তি, ও হয়রানির অবধি নাই; কি জানি এ যাত্রা তাহার কি ভাবে কাটিবে, কোথায় গিয়া ইহার কি পরিণাম ঘটিবে,—এই স্বস্তি-শান্তিহীন উদ্বিগ্ন চিন্তার সহিত মিশিয়া আরও একটা কথা তাহার মনে হইতেছিল, ওই অপরিচিত খ্রীষ্টান মেয়েটিকে। সে সম্মুখে বাহির হয় নাই, কেমন দেখিতে, কত বয়স, কিরূপ স্বভাব কিছুই অনুমান করিতে পারে নাই—শুধু এইটুকু মাত্র জানা গিয়াছে তাহার ইংরাজী উচ্চারণ ইংরাজের মত নয়। হয়ত, মাদ্রাজী হইবে, না হয়ত গোয়ানীজ কিম্বা আর কিছু হইবে,—কিন্তু আর যাহাই হৌক, সে যে আপনাকে উদ্ধত খ্রীষ্টান ধর্ম্মাবলম্বী রাজার জাতি মনে করিয়া তাহার পিতার মত অত্যন্ত দর্পিত নয়, সে যে তাঁহার অত্যাচারের জন্য লজ্জা অনুভব করিয়াছে,—তাহার সেই ভীত, বিনীত কণ্ঠের ক্ষমাভিক্ষা নিজের পরুষতীব্র অভিযোগের সহিত এখন যেন বেশুরা বাজিতে লাগিল। স্বভাবতঃ সে উগ্র প্রকৃতির নহে, কাহাকেও কঠিন কথা বলিতে তাহার বাধে, বিশেষতঃ তেওয়ারীর বর্ণনার সহিত মিলিয়া যখন মনে হইল, হয়ত, এই মেয়েটিই তাহার মাতাল ও দুর্ব্বত্ত পিতাকে নিবারণ করিতে নীরবে প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছে, তখন তাহার অনুতাপের সহিত মনে হইতে লাগিল, আজিকার মত চুপ করিয়া গেলেই ভাল হইত। যাহা ঘটবার তাহা ত ঘটিয়াই ছিল, ক্রোধের উপর উপরে গিয়া কথাগুলা না বলিয়া আসিলেই চলিত।

 ও ঘরে তেওয়ারীর ঘষা-মাজার কর্কশ শব্দ অবিরাম শুনা যাইতেছিল, হঠাৎ সেটা থামিল। এবং পরক্ষণেই তাহার গলা শোনা গেল, কে?

 অপূর্ব্ব চকিত হইয়া উঠিল, কিন্তু জবাব শুনিতে পাইল না। কিন্তু তৎপরিবর্ত্তে তেওয়ারীর প্রবল কণ্ঠস্বরই তাহার কানে আসিয়া পৌঁছিল। সে তাহার হিন্দুস্থানী ভাষায় বলিল, না না, মেমসাহেব, ও-সব তুমি নিয়ে যাও। বাবুর খাওয়া হয়ে গেছে—ও-সব আমরা ছুঁইনে।

 অপুর্ব্ব উঠিয়া বসিয়া কান খাড়া করিয়া সেই খ্রীষ্টান মেয়েটির কণ্ঠস্বর চিনিতে পারিল, কিন্তু কথা বুঝিতে পারিল না, বুঝাইয়া দিল তেওয়ারী। কহিল, কে বললে আমাদের খাওয়া হয়নি। হয়ে গেছে, ও-সব তুমি নিয়ে যাও, বাবু শুনলে ভারি রাগ করবেন বলচি।

 অপূর্ব্ব নিঃশব্দে উঠিয়া আসিয়া দাঁড়াইল, কহিল, কি হয়েচে তেওয়ারী?

 মেয়েটি চৌকাঠের এদিকে ছিল তৎক্ষণাৎ সরিয়া গেল! তখন সেইমাত্র সন্ধ্যা হইয়াছে, আলো জ্বালা হয় নাই, সিঁড়ির দিক হইতে একটা অন্ধকার ছায়া ভিতরে আসিয়া পড়িয়াছে, তাহাতে মেয়েটিকে বেশ স্পষ্ট দেখা না গেলেও বুঝা গেল। তাহার রঙ ইংরাজদের মত সাদা নয়, কিন্তু খুব ফর্সা। বয়স উনিশ-কুড়ি কিম্বা কিছু বেশীও হইতে পারে, এবং একটু লম্বা বলিয়াই বোধ হয় কিছু রোগা দেখাইল। উপরের ঠোঁটের নীচে সুমুখের দাত দুটি একটু উঁচু মনে না হইলে মুখখানি বোধকরি ভালই। পায়ে চটি জুতা, পরণে চমৎকার একখানি মাদ্রাজী শাড়ি,—সম্ভবতঃ উৎসব বলিয়া,—কিন্তু ধরণটা কতক বাঙালী, কতক পার্শিদের মত। একটি জাপানী সাজিতে করিয়া কয়েকটি আপেল, নাসপাতি, গুটি-দুই বেদানা এবং এক গোছা আঙ্গুর সুমুখে মেজের উপর রহিয়াছে।

 অপূর্ব্ব কহিল, এ সব কেন?

 মেয়েটি বাহির হইতে ইংরাজিতে আস্তে আস্তে জবাব দিল, আজ আমাদের পর্ব্বদিন, মা পাঠিয়ে দিলেন। তা ছাড়া, আজ ত আপনাদের খাওয়া হয়নি।

 অপূর্ব্ব কহিল, আপনার মাকে ধন্যবাদ জানাবেন, কিন্তু আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে।

 মেয়েটি চুপ করিয়া রহিল। অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করিল, আমাদের খাওয়া হয়নি তাঁকে কে বললে?

 মেয়েটি লজ্জিতস্বরে কহিল, এই নিয়েই প্রথমে ঝগড়া হয়। তা ছাড়া আমরা জানি।

 অপূর্ব্ব মাথা নাড়িয়া কহিল, তাঁকে সহস্র ধন্যবাদ, কিন্তু সত্যই আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে।

 মেয়েটি এক মুহূর্ত্ত মৌন থাকিয়া বলিল, তা বটে, কিন্তু সে ভাল হয়নি। আর এসব ত বাজারের ফল—এতে ত কোন দোষ নেই।

 অপূর্ব্ব বুঝিল তাহাকে কোনমতে শান্ত করিবার জন্য অপরিচিত এই রমণীর উদ্বেগের অবধি নাই। অল্পক্ষণ পূর্ব্বে সে লাঠি ও গলার শব্দে তাহার মেজাজের যে পরিচয় দিয়া আসিয়াছে, তাহাতে কাল সকালে যে কি হইবে এই ভাবিয়াই তাহাকে প্রসন্ন করিতেই ইহারা এই ভেট লইয়া উপস্থিত হইয়াছে। তাই সদয়কণ্ঠে কহিল, না কোন দোষ নেই। তেওয়ারীকে কহিল, বাজারের ফল, এ নিতে আর দোষ কি ঠাকুর?

 তেওয়ারী ঠাকুর খুশী হইল না, কহিল, বাজারের ফল ত বাজার থেকে আনলেই চলবে। আজ রাত্রে আমাদের দরকারও নেই, আর মা আমাকে এ-সব করতে বার বার নিষেধ করেছেন। মেমসাহেব, এসব তুমি নিয়ে যাও,—আমাদের চাইনে।

 মা যে নিষেধ করিয়াছেন, বা করিতে পারেন ইহাতে অসম্ভব কিছু নাই, এবং বহুদিনের পুরাতন ও বিশ্বাসী তেওয়ারী ঠাকুরকে যে এ সকল ব্যাপারে প্রবাসে তাহার অভিভাবক নিযুক্ত করিয়া দিতেও পারেন তাহাও সম্ভব। এই সেদিন সে জননীর কাছে কি প্রতিশ্রুতি দিয়া আসিয়াছে তাহা স্মরণ করিয়া মনে মনে কহিল, শুধু ত কেবল মাতৃআজ্ঞা নয়, আমি সত্য দিয়া আসিয়াছি। কিন্তু তথাপি ওই সঙ্কুচিত, লজ্জিত, অপরিচিত মেয়েটি—যে তাহাকে প্রসন্ন করিতে ভয়ে ভয়ে তাহার দ্বারে আসিয়াছে—তার উপহারের সামান্য দ্রব্যগুলিকে অস্পৃশ্য বলিয়া অপমান করাকেও তাহার সত্য বলিয়া মনে হইল না। কিন্তু এ কথা সে মুখ ফুটিয়া বলিতে পারিল না, মৌন হইয়া রহিল। তেওয়ায়ী বলিল, ও সব আমরা ছোঁব না মেমসাহেব, তুমি তুলে নিয়ে যাও, আমি জায়গাটা ধুয়ে ফেলি।

 মেয়েটি চুপ করিয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া হাত বাড়াইয়া ডালাটি তুলিয়া লইয়া ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল।

 অপূর্ব্ব চাপা রুক্ষস্বরে কহিল, না হয় না-ই খেতিস, নিয়ে চুপি চুপি ফেলে দিতেও ত পারতিস্!

 তেওয়ারী আশ্চর্য্য হইয়া বলিল, নিয়ে ফেলে দেব? মিছামিছি নষ্ট করে লাভ কি বাবু!

 লাভ কি বাবু! মুখ্যু, গোঁয়ার কোথাকার! এই বলিয়া অপূর্ব্ব শুইতে চলিয়া গেল। বিছানায় শুইয়া প্রথমটা তাহার তেওয়ারীর প্রতি ক্রোধে সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিতে লাগিল, কিন্তু যতই সে ব্যাপারটা তন্ন তন্ন করিয়া আলোচনা করিতে লাগিল ততই মনে হইতে লাগিল, এ আমি পারিতাম না, কিন্তু হয়ত এ ভালই হইয়াছে, সে স্পষ্ট করিয়া ফিরাইয়া দিয়াছে। হঠাৎ তাহার বড় মাতুলকে মনে পড়িল। সেই সদাচারী, নিষ্ঠাবান, পণ্ডিত ব্রাহ্মণ একদিন তাহাদের বাটীতে অন্নাহার করিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন। স্বীকার করিবার জো নাই করুণাময়ী তাহা জানিতেন, তথাপি স্বামীর সহিত ভ্রাতার মনোমালিন্য বাঁচাইতে কি একটা কৌশল অবলম্বন করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাহাতে মৃদু হাসিয়া কহিয়াছিলেন, না দিদি, সে হতে পারে না। হালদার মহাশয় রাগী লোক, এ অপমান তিনি সইবেন না। হয়ত বা তোমাকেও কিছু ভাগ নিতে হবে,—কিন্তু আমার স্বর্গীয় গুরুদেব বলতেন, মুরারী, সত্য-পালনের দুঃখ আছে, তাকে আঘাতের মধ্যে দিয়ে বরঞ্চ একদিন পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু বঞ্চনা-প্রতারণার মিষ্ট পথ দিয়ে সে কোনদিন আনাগোনা করে না। এই ভাল, যে আমি না খেয়েই চলে গেলাম বোন।

 এই লইয়া করুণাময়ীর অনেকদিন অনেক দুঃখ গিয়াছে, কিন্তু কোনদিন দাদাকে তিনি দোষ দেন নাই। সেই কথা স্মরণ করিয়া অপূর্ব্ব মনে মনে বার বার কহিতে লাগিল,— এ ভালই হয়েচে,—তেওয়ারী ঠিক কাজই করেচে।