৩১

 পরদিন প্রভাত হইতেই আকাশে ধীরে ধীরে মেঘ জমা হইতেছিল, রাত্রে ফোঁটাকয়েক জলও পড়িয়াছিল, কিন্তু আজ মধ্যাহ্নকাল হইতে বৃষ্টি এবং বাতাস চাপিয়া আসিল। কাল ভারতী সুমিত্রাকে যাইতে দেয় নাই, কথা ছিল, আজ খাওয়াদাওয়ার পরে সে বিদায় লইয়া বাসায় যাইবে। কিন্তু এমন দুর্য্যোগ শুরু হইল যে বাহিরে পা বাড়ানো শক্ত, নদী পার হওয়া ত দূরের কথা। বিরাম নাই, বিশ্রাম নাই, দিবাবসানের সঙ্গে সঙ্গে ঝড় ও জল উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিতে লাগিল। শশী হিন্দু হোটেলে থাকে, দুপুরবেলা বেড়াইতে আসিয়াছিল, এখনও ফিরিতে পারে নাই! বেলা কখন শেষ হইল, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইল, জানাও গেল না। ভারতীর উপরের ঘরে জানালা কপাট বন্ধ করিয়া আলো জ্বালিয়া বৈঠক বসিয়াছে। সুমিত্রা আপাদমস্তক চাপা দিয়া আরাম কেদারায় শুইয়া, শশী খাটের উপরে উবু হইয়া বসিয়া, নীচে কম্বলের শয্যায় অপূর্ব্ব এবং তাহারই জলযোগের আয়োজনে মেঝের উপরে বঁটি পাতিয়া বসিয়া ভারতী ফল ছাড়াইতেছে। অনতিদূরে একধারে স্টোভের উপরে মুগের ডালের খিচুড়ি টগ্‌বগ্ করিয়া ফুটিতেছে।

 অপূর্ব্ব বলিয়াছিল সংসারে তাহার আর রুচি নাই, সন্ন্যাসই তাহার একমাত্র শ্রেয়ঃ। শশী এই প্রস্তাব অনুমোদন করিতে পারে নাই, সে যুক্তি-সহযোগে খণ্ডন করিয়া বুঝাইতেছিল যে, এরূপ অভিসন্ধি ভাল নহে, কারণ সন্ন্যাসের মধ্যে আর মজা নাই; বরঞ্চ, বরিশাল কলেজে প্রফেসারির আবেদন যদি মঞ্জুর হয়ত গ্রহণ করাই কর্ত্তব্য।

 অপূর্ব্ব ক্ষুণ্ণ হইল, কিন্তু কথা কহিল না। ভারতী সমস্তই জানিত, তাই সে ইহার জবাব দিয়া বলিল, জীবনে মজা করে বেড়ান ছাড়া কি মানুষের আর বড় উদ্দেশ্য থাকতে পারে না, শশীবাবু? পৃথিবীতে সকলের চোখের দৃষ্টিই এক নয়।

 তাহার কথা বলার ধরণে শশী অপ্রতিভ হইল। ভারতী পুনশ্চ কহিল, ওঁর মনের অবস্থা এখন ভাল নয়, এ সময়ে ওঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা শুধু নিষ্ফল নয়, অবিহিত। তার চেয়ে বরঞ্চ আমাদের নিজেদের—

 আমাদের মনে ছিল না ভারতী!

 শশীর মনে না থাকা কিছু বিচিত্র নয়। ইতিমধ্যে অপূর্ব্বর আরও একটা ব্যাপার ঘটিয়াছে, যাহা ভারতী ব্যতীত অপরে জানিত না। সাংসারিক হিসাবে তাহার ফল ও পরিণাম মাতৃ-বিয়োগের অপেক্ষা বিশেষ কম নহে। জননীর মৃত্যু সংবাদে অপূর্ব্বর দাদা বিনোদবাবু দুঃখ করিয়া তার করিয়াছেন, কিন্তু ইহার অধিক আর কিছু নহে। মা রাগ করিয়া, সম্ভবতঃ অত্যন্ত অপমানিত হইয়াই অবশেষে গঙ্গা-বিহীন ম্লেচ্ছদেশে বর্ম্মায় আপনাকে নির্ব্বাসিত করিয়াছেন বুঝিতে পারিয়া অপূর্ব্ব দুঃখে ক্ষোভে আত্মহারা হইয়া পড়িয়াছিল। যে দুই দিন কলিকাতায় ছিল, বাটীতে খায় নাই, শোয় নাই এবং ফিরিবার মুখে রীতিমত কলহ করিয়াই আসিয়াছিল। তথাপি এত বড় ভয়ানক দুর্ঘটনায় সকলের কনিষ্ঠ হইয়া তাহার নিঃসন্দিগ্ধ ভরসা ছিল, তাহাকে লইয়া যাইবার জন্য কেহ-না-কেহ আসিবেই আসিবে। তেওয়ারী থাকিলে কি হইত বলা যায় না, কিন্তু সে-ও নাই, ছুটি লইয়া দেশে গিয়েছে।

 বাঙালী পুরোহিত এখানেও আছে, আজই সকালে অপূর্ব্ব ভারতীকে ডাকিয়া কহিয়াছিল, সে কলিকাতায় যাইবে না, যেমন করিয়া পারে মাতৃশ্রাদ্ধ এখানেই সম্পন্ন করিবে।

 মাতার আকস্মিক আগমনের হেতু যে ছেলেদের প্রতি দুর্জ্জয় মান-অভিমান,—এ খবর অপূর্ব্ব জানিয়া আসিয়াছিল, শুধু কতখানি যে ক্রীশ্চান-কন্যা ভারতীর কাহিনী সংশ্লিষ্ট ছিল ইহাই জানে নাই। সাংঘাতিক পীড়িতা অচৈতন্য-প্রায় জননীর বলিবার অবকাশ ঘটিল না এবং বিনোদবাবু রাগ করিয়া বলিলেন না।

 সহসা মুখের আবরণ সরাইয়া সুমিত্রা উঠিয়া বসিল, কহিল, নীচেকার দরজা খুলে কে যেন ঢুকলো ভারতী।

 বাতাস এবং বারিপাতের অবিশ্রাম ঝর ঝর শব্দের মাঝখানে আর কিছুই শুনিতে পাওয়া কঠিন। শঙ্কায় সকলেই চকিত হইয়া উঠিল, ভারতী একমুহূর্ত্ত কান খাড়া করিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, না, কেউ নয়। অপূর্ব্ববাবুর চাকরটা শুধু নীচে আছে। কিন্তু পরক্ষণেই সে সিঁড়িতে পরিচিত পদশব্দে আনন্দ কলরোলে চীৎকার করিয়া উঠিল, আরে এ যে দাদা! এক হাজার, দশ হাজার, বিশ হাজার, এক লক্ষ ওয়েলকম্। হাতের ফল এবং বঁটি ফেলিয়া সিঁড়ির মুখে ছুটিয়া গিয়া বলিল, এক ক্রোর, দশ ক্রোর বিশ ক্রোর, হাজার ক্রোর গুড ইভনিং দাদা, শীগ্‌গির এসো!

 সব্যসাচী ঘরে ঢুকিয়া পিঠের প্রকাণ্ড বোঁচকা নামাইতে নামাইতে সহাস্যে কহিলেন, গুডইভ্‌নিং! গুডইভ্‌নিং! গুডইভ্‌নিং।

 ভারতী তাঁহার দুই হাত নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া কহিল, এই দেখ দাদা, তোমার জন্যে খিচুড়ি রাঁধচি। ওভারকোটটা আগে খোলো। ইঃ—জুতোটুতো সব ভিজে গেছে, দাঁড়াও আগে আমি খুলে দি। এই বলিয়া সে আগে কোট খুলিবে, না হেঁট হইয়া বুকের ফিতা খুলিবে ঠিক করিতে পারিল না। চেয়ারের কাছে টানিয়া আনিয়া জোর করিয়া বসাইয়া দিয়া বলিল, আমি জুতো খুলে দি। এই বৃষ্টিতে একটা গাড়ি করে আসতে নেই! হাঁ দাদা, ওবেলা কি খেয়েছিলে? পেট ভরেছিল? ভালো কথা! ঠাকুরমশায়ের হোটেলে আজ মাংস রান্না হয়েছে আমি খবর পেয়েচি, আনবো দাদা ছুটে গিয়ে এক বাটি? সত্যি বল।

 ডাক্তার হাসিমুখে কহিলেন, আরে, এ আমাকে আজ পাগল করে দেবে না কি!

 ভারতী জুতা খুলিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া মাথায় তাঁহার হাত দিয়া বলিল, যা ভেবেচি ঠিক তাই। ঠিক যেন নেয়ে উঠেচ এমনি ভিজে। এই বলিয়া সে আলনা হইতে তাড়াতাড়ি তোয়ালে আনিতে গেল।

 মিনিট-খানেকের মধ্যে ছেলেমানুষের মত এমনি কাজ করিল যে শশী হাসিয়া ফেলিল। বলিল, আপনাকে যেন ভারতী দু-দশ বছর পরে দেখতে পেয়েচেন।

 ডাক্তার কহিলেন, তার চেয়েও বেশি। এই বলিয়া ভারতীর হাত হইতে তোয়ালে টানিয়া লইয়া কহিলেন, তোর আদরের জ্বালায় আমার প্রাণটা গেল।

 প্রাণ গেল? তবে থাকো বসে। এই বলিয়া ভারতী কৃত্রিম অভিমান করে তাহার ফল ছাড়াইতে ফিরিয়া গিয়া বঁটি লইয়া বসিল। তাহার বন্ধু, সখা, সহোদরের অধিক আত্মীয় আজিকার এই দুর্য্যোগের মধ্যে তাঁহার অপ্রত্যাশিত, অভাবিত আগমনে স্নেহে, শ্রদ্ধায়, গর্ব্বে ও স্বার্থহীন নিষ্পাপ প্রীতিতে তাহার হৃদয় উপচিয়া পড়িয়াছে,—আপনাকে সে সম্বরণ করিবে কি দিয়া? আতিশয্য যদি হইয়াই থাকে তাহাকে বাধা দিবে কিসে? সুমিত্রা নিঃশব্দে দেখিতেছিল, নীরবে রহিল, কিন্তু ঘৃণা ও নিগূঢ় ঈর্ষায় রচিত যে দুর্ভেদ্য যবনিকা এতদিন তাহার চোখের দৃষ্টিকে রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল, অকস্মাৎ অপসারিত হইয়া যতদূর দেখা যায় শুধু অনাবিল সৌহৃদ্যের স্বচ্ছ স্রোতস্বতীই সে এই দুটি নর-নারীর মাঝখানে প্রবাহিত দেখিতে পাইল। মুহূর্ত্তের জন্যও কখনো যে তলায় কলুষ স্পর্শ করিয়াছে, মনে করিতে আজ তাহার মাথা হেঁট হইল। গোপন করিয়া করিবার, লজ্জা করিয়া করিবার ভারতীর কিছুই ছিল না বলিয়াই সে এমন লজ্জাহীনার মত সব্যসাচীর আপনার হইয়া উঠিতে পারিয়াছিল, এ কথা আজ সুমিত্রা বুঝিল।

 এতক্ষণ মানুষটিকে লইয়াই ভারতী ব্যস্ত ছিল, এখন বোঁচকাটির প্রতি তাহার লক্ষ্য পড়িল। উদ্বিগ্ন শঙ্কায় ত্রস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, আচ্ছা, এই ঝড়-জলের মধ্যে সহচরটিকে সঙ্গে এনেচ কেন বল ত? কোথায় চলে যাচ্চো না তো? মিথ্যে বলে ঠকাতে পারবে না তা বলে রাখচি দাদা।

 ডাক্তার হাসিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু তাঁহার মুখের চেহারায় নিজের মুখে আর হাসি আসিল না, তথাপি তামাসার ভঙ্গীতে লঘু করিয়া কহিলেন, যাবো না তো কি রামদাসের মত ধরা পড়ব নাকি?

 শশী মাথা নাড়িয়া বলিল, ঠিক তাই!

 ভারতী রাগ করিয়া কহিল, ঠিক তাই! আপনি কি জানেন শশীবাবু, যে মতামত দিচ্ছেন!

 বাঃ জানিনে?

 কিচ্ছু জানেন না!

 ডাক্তার হাসিমুখে কহিলেন, ঝগড়া করলে খিচুড়ি নষ্ট হয়ে যাবে। আচ্ছা অপূর্ব্ববাবু, কালকের জাহাজে না গেলে ত আপনি সময় মত পৌঁছতে পারবেন না।

 অপূর্ব্ব গম্ভীর হইয়া বলিল, মায়ের শ্রাদ্ধ আমি এখানেই করব ডাক্তার।

 এখানে? হেতু?

 অপূর্ব্ব মৌন হইয়া রহিল, ভারতীও জবাব দিল না।

 ডাক্তার মনে মনে বুঝিলেন কি একটা ঘটিয়াছে, যাহা প্রকাশ করিবার নয়। কহিলেন, বেশ, বেশ। তাহলে ফিরে যাবারই বা দরকার কি? চাকরিটা আপনার আছে না?

 অপূর্ব্ব ইহারও উত্তর দিল না। শশী কহিল, অপূর্ব্ববাবু সন্ন্যাস নেবেন।

 ডাক্তার হাসিয়া ফেলিলেন, সন্ন্যাস? এ আবার কি কথা!

 তাঁহার হাসিতে অপূর্ব্ব ক্ষুণ্ণ হইল। কহিল, সংসারে যার রুচি নেই, জীবন বিস্বাদ হয়ে গেছে, এ ছাড়া তার আর কি পথ আছে ডাক্তার?

 ডাক্তার কহিলেন, এ সব বড় বড় আধ্যাত্মিক ব্যাপার, অপূর্ব্ববাবু, এর মধ্যে অনধিকার চর্চ্চা করতে আমাকে আর প্রলুব্ধ করবেন না, তার চেয়ে বরঞ্চ শশীর মত নিন, ও জানে-শোনে। ইস্কুলে ফেল হয়ে একবার ও বছরখানেক ধরে এক সাধুবাবার চেলাগিরি করেছিল।

 শশী সংশোধন করিয়া বলিল, দেড় বছরের ওপর। প্রায় দু-বছর।

 সুমিত্রা ও ভারতী হাসিতে লাগিল। অপূর্ব্বর গাম্ভীর্য্য ইহাতে টলিল না, সে কহিল, মায়ের মৃত্যুর জন্যে আমার নিজেকেই যেন অপরাধী মনে হয় ডাক্তার! সেদিন থেকে আমি নিরন্তর এই কথাই ভেবে আসচি। যথার্থই সংসারে আমার প্রয়োজন নেই, এ আমার কাছে তিক্ত হয়ে এসেচে।

 ডাক্তার ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া থাকিয়া বোধ হয় তাহার হৃদয়ের সত্যকার ব্যথা উপলব্ধি করিলেন, সস্নেহে মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, মানুষের এই দিকটা কখনো আমার ভেবে দেখবার আবশ্যক হয়নি অপূর্ব্ববাবু, কিন্তু সহজ বুদ্ধিতে মনে হয়, হয়ত, এ ভুল হবে। তিক্ততার মধ্য দিয়ে সংসার ছেড়ে শুধু হতভাগ্য লক্ষ্মীছাড়া জীবন যাপন করা চলে, কিন্তু বৈরাগ্য-সাধনা হয় না। করুণার মধ্যে দিয়ে, আনন্দের মধ্যে দিয়ে না গেলে কি—কিন্তু, ঠিক ত জানিনে—

 ভারতী অকস্মাৎ যেন এক নূতন জ্ঞান লাভ করিল। ব্যগ্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, তুমি ঠিক জানো দাদা, তোমার মুখ দিয়ে কখনো বেঠিক কিছু বার হয় না,—হতে পারে না। এই সতা।

 ডাক্তার বলিলেন, মনে ত তাই হয়। মা মারা গেলেন। কেন এসেছিলেন, কিসের জন্যে আপনি যেতে চান না, কিছুই আমি জানিনে, জানবার কৌতূহলও নেই, কিন্তু কারও আচরণে তিক্ততাই যদি পেয়ে থাকেন, সমস্ত অনাগত কালের তাই শুধু সত্য হ’ল, আর অমৃত যদি কোথায় লাভ হয়ে থাকে, জীবনে তার কোন দাম দেবেন না।

 অপূর্ব্ব কহিতে লাগিল, সংসারে দাদা যদি—

 ডাক্তার বলিলেন, সংসারে অপূর্ব্বর দাদা বিনোদবাবুই আছেন, ভারতীর দাদা সব্যসাচী কি নেই? সে গৃহে যদি স্থান আপনার নাও থাকে, কলকাতায় সেই ছোট্ট বাড়িটুকুই কি বামনের বিশ্বব্যাপী পদতলের ন্যায় পৃথিবীতে কোথাও আপনার আর ঠাঁই রাখেনি? অপূর্ব্ববাবু, হৃদয়াবেগ দুর্মূল্য বস্তু, কিন্তু চৈতন্যকে আছন্ন করতে দিলে এতবড় শত্রু আর মানুষের নেই।

 অপূর্ব্ব অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, কিন্তু ধর্ম্মসাধনা বা আত্মার মুক্তির কামনায় আমি সংসার ত্যাগ করতে চাইনি ডাক্তার, যদি করি, পরার্থেই কোরব। আমাকে আপনাদের বিশ্বাস করা কঠিন, না করলেও দোষ দেবার নেই, কিন্তু একদিন যে অপূর্ব্বকে আপনারা জানতেন, মায়ের মৃত্যুর পরে সে অপূর্ব্ব আমি আর নেই।

 ডাক্তার উঠিয়া আসিয়া তাহার গায়ে হাত দিয়া বলিলেন, তোমার এ কথাটা যেন সত্য হয় অপূর্ব্ব।

 অপূর্ব্ব গাঢ় কণ্ঠে বলিল, এখন থেকে আমি দেশের কাজে, দশের কাজে, দীনদরিদ্রের কাজেই আত্মনিয়োগ কোরব। এই বলিয়া সে ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া কহিতে লাগিল, কলকাতায় আমার বাড়ি, সহরেই আমি মানুষ, কিন্তু সহরের সঙ্গে আর আমার কিছুমাত্র সম্বন্ধ রইল না। এখন থেকেই পল্লীসেবাই হবে আমার একমাত্র ব্রত। একদিন কৃষিপ্রধান ভারতে পল্লীই ছিল প্রাণ, পল্লীই ছিল তার অস্থি-মজ্জা শোনিত। আজ সে ধ্বংসোন্মুখ। ভদ্রজাতি তাদের ত্যাগ করে সহরে এসেছে, সেখান থেকে তাদের অহর্নিশি শাসন করে এবং শোষণ করে। এ ছাড়া আর কোন সম্বন্ধ-বন্ধন তারা রাখেনি। না রাখুক, কিন্তু চিরদিন যারা এঁদের মুখের অন্ন এবং পরণের বস্ত্র যুগিয়ে দেয়, সেই কৃষককুল আজ নিরন্ন, নিরক্ষর এবং নিরুপায় হয়ে মৃত্যুপথে দ্রুতবেগে চলেচে। এখন থেকে আমি তাদের কল্যাণেই আত্মনিয়োগ কোরব এবং ভারতীও আমাকে প্রাণপণে সাহায্য করবেন প্রতিশ্রুতি হয়েচেন। গ্রামে গ্রামে পাঠশালা খুলে, আবশ্যক হলে কুটীরে কুটীরে গিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করবার ভার উনি নেবেন। আমার সন্ন্যাস দেশের জন্যে নিজের জন্যে নয় ডাক্তার

 ডাক্তার বলিলেন, সাধু প্রস্তাব।

 তাঁহার মুখ হইতে কেবল এই দুটি কথাই কেহ প্রত্যাশা করে নাই। ভারতী ম্লান হইয়া কহিল, আর একদিক দিয়ে ধরলে এ তো তোমারই কাজ দাদা। এই কৃষিপ্রধান দেশে কৃষক বড় হয়ে না উঠলে ত কোন কিছুই হবে না!

 ডাক্তার কহিলেন, আমি ত প্রতিবাদ করিনি ভারতী।

 কিন্তু তোমার উৎসাহও ত নেই দাদা।

 ডাক্তার মাথা নাড়িয়া বলিলেন, দরিদ্র কৃষকের ভালো করতে চাও, তোমাদের আমি আশীর্ব্বাদ করি। কিন্তু আমার কাজে সাহায্য কোরচ মনে করবার প্রয়োজন নেই। চাষারা রাজা হোক, তাদের ধনে-পুত্রে লক্ষ্মীলাভ হোক, কিন্তু সাহায্য তাদের কাছ থেকে আমি আশা করিনে।

 অপূর্ব্বর প্রতি চাহিয়া কহিলেন, কারও ভালো করতে হবে বলে আর কারও গায়ে কালি ছড়াতে হবে, তার মানে নেই অপূর্ব্ববাবু। এদের দুঃখ-দৈন্যের মূলে শিক্ষিত ভদ্রজাতি নয়, সে মূল বার করতে হলে তোমাকে আর একদিকে খুঁড়ে দেখতে হবে।

 অপুর্ব্ব কুণ্ঠিত হইয়া পড়িল। কহিল, কিন্তু এই কি সকলে আজ বলে না?

 বলুক। যা ভুল তা তেত্রিশ কোটী লোকে মিথ্যে বললেও ভুল। বরঞ্চ, এই শিক্ষিত ভদ্রজাতির চেয়ে লাঞ্ছিত, অপমানিত, দুর্দ্দশাগ্রস্ত সমাজ বাংলা দেশে আর নেই। তার উপরে মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে তাদের ভরাডুবি করাতে চাও কেন? পরদেশের সকল যুক্তি এবং সকল সমস্যাই কি নিজের দেশে খাটে ভেবেচ? বাইরের অনাচার যখন পলে পলে সর্ব্বনাশ নিয়ে আসচে, তখন আবার অন্তর্বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে চাও কিসের জন্যে? অসন্তোষে দেশ ভরে গেল,—স্নেহের বাঁধন শ্রদ্ধার বাঁধন চূর্ণ হয়ে এলো কিসের জন্যে জানো? তোমাদের দু-দশজনের দোষে—শিক্ষিতের বিরুদ্ধে শিক্ষিতের অভিযানে। শশী, একদিন তোমাকে আমি এ কাজ করতে নিষেধ করেছিলাম মনে আছে। নিজেদের বিপক্ষে নিজেদের দুর্নাম ঘোষণার মধ্যে একটা নিরপেক্ষ স্পষ্টবাদিতার দম্ভ আছে, এক প্রকার সস্তা খ্যাতিও মুখে মুখে প্রচারিত হয়, কিন্তু এ শুধু ভুল নয়, মিথ্যা। মঙ্গল তাদের তোমরা করগে, কিন্তু অপরের কলঙ্ক রটনা করে নয়, একের প্রতিকূলে অপরকে উত্তেজিত করে নয়—বিশ্বের কাছে তাদের হাস্যাস্পদ করে নয়! সুদূর ভবিষ্যতে হয়ত সে একদিন এসে পৌঁছবে; কিন্তু আজও তার বিলম্ব আছে ৷

 সকলেই নীরব হইয়া রহিল, শুধু ভারতী ধীরে ধীরে কহিল, কিছু মনে কোরো না দাদা; কিন্তু বরাবরই আমি দেখে এসেচি পল্লীর প্রতি তোমার সহানুভূতি কম, তোমার দৃষ্টি শুধু সহরের উপরে। কৃষকদের প্রতি তুমি সদয় নয়, তোমার দু’চক্ষু আছে কেবল কারখানার কুলি-মজুর-কারিকরদের দিকে। তাই তোমার পথের দাবী খুলেছিলে এদেরই মাঝখানে। আর হৃদয় বলে যদি কোন বালাই তোমার থাকে, সে শুধু ছেয়ে পড়ে আছে মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত ভদ্র জাতি নিয়ে। এরাই তোমার আশা-ভরসা, এরাই তোমার আপনার জন। বল এ কি মিথ্যা কথা?

 ডাক্তার বলিলেন, মিথ্যা নয় বোন, অত্যন্ত সত্য। কতবার ত বলেছি তোমাকে, পথের দাবী চাষা-হিতকারিণী প্রতিষ্ঠান নয়, এ আমার স্বাধীনতা অর্জ্জনের অস্ত্র। শ্রমিক এবং কৃষক এক নয় ভারতী। তাই, পাবে আমাকে কুলি-মজুর-কারিকরের মাঝখানে, কারখানার ব্যারাকে, কিন্তু পাবে না খুঁজে পাড়াগাঁয়ের চাষার কুটীরে। কিন্তু কথায় কথায় শ্রেষ্ঠ কর্ত্তব্যটি যেন ভুলে যেয়ো না দিদি। এই বলিয়া স্টোভের প্রতি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া কহিলেন, দেশোদ্ধার দুদিন দেরি হলে সইবে, কিন্তু তৈরি খিচুড়ি পুড়ে গেলে সইবে না?

 ভারতী ছুটিয়া গিয়া হাঁড়ির ঢাকা খুলিয়া পরীক্ষা করিয়া হাসিমুখে কহিল, ভয় নেই দাদা, বাদল রাতের খিচুড়িভোগ তোমার মারা যাবে না।

 কিন্তু বিলম্ব কত?

 ভারতী বলিল, মিনিট পনেরো-কুড়ি। কিন্তু তাড়া কিসের বল ত?

 ডাক্তার হাসিয়া কহিলেন, আজ যে তোমাদের কাছে আমি বিদায় নিতে এলাম।

 কথা যেমন হৌক, তাঁহার হাসিমুখের দিকে চাহিয়া কেহই তাহা বিশ্বাস করিল না। বাহিরে ঝড়-জলের বিরাম নাই, ভারতী ক্ষণিকের জন্য জানালা খুলিয়া নিরীক্ষণ করিয়া ফিরিয়া আসিয়া কহিল, বাপ্‌রে বাপ্। পৃথিবী বোধ হয় ওলট-পালট হয়ে যাবে। বিদায় নেবারই সময় বটে, দাদা! চোখের পলকে তাহার অন্য কথা মনে পড়িল, কহিল, আজ কিন্তু তোমাকে ও ছোট্ট ঘরটিতে শুতে হবে। নিজের হাতে আমি চমৎকার করে বিছানা করে দেব, কেমন? এই বলিয়া সে হৃদয়ের নিগূঢ় আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া রান্নার কাজে লাগিল। ডাক্তারের নিকট হইতে যে কোন উত্তরই আসিল না তা তাহা সে লক্ষ্যও করিল না।

 যথাসময়ে আহার্য্য প্রস্তুত হইলে, ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না, সে হবে না ভারতী, পরিবেশনের অছিলায় তুমি বাকী থাকলে চলবে না। আজ আমরা সকলে একসঙ্গে খেতে বসব।

 ভারতী সম্মত হইয়া বলিল, তাই হবে দাদা, চারজনে আমরা গোল হয়ে খেতে বসব।

 ডাক্তার কহিলেন, গোল হয়ে খেতে পারি, কিন্তু বুভুক্ষু অপূর্ব্ববাবু না নজর দিয়ে আমাদের হজমে গোল বাধান। সেটা ওঁকে বল।

 অপূর্ব্ব হাসিল, ভারতীও হাসিমুখে কহিল, সে ভয় আমাদের থাকতে পারে, কিন্তু তোমার হজমে গোল বাধাবে কে দাদা? ও আগুনে পাহাড়-পর্ব্বত গুঁড়িয়ে দিলেও তা ভস্ম হয়ে যাবে। যে খাওয়া খেতে দেখেছি! এই বলিয়া ভারতী আর একদিনের খাওয়া স্মরণ করিয়া মনে মনে যেন শিহরিয়া উঠিল।

 ভোজন-পর্ব্ব আরম্ভ হইল। অন্ন-ব্যঞ্জনের সুখ্যাতিতে এবং লঘু হাস্য-পরিহাসে ঘরের আবহাওয়া যেন মুহূর্ত্তের মধ্যে পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল। খাওয়া যখন পূর্ণ উদ্যমে চলিতেছে, সহসা রসভঙ্গ করিয়া ফেলিল অপূর্ব্ব। সে কহিল, দিন-দুই পূর্ব্বে খবরের কাগজে একটা সুসংবাদ পড়েছিলাম, ডাক্তার। যদি সত্যি হয় আপনার বিপ্লবের প্রয়াস একেবারে নিরর্থক হয়ে যাবে। ভারত-গভর্ণমেণ্ট তাঁদের শাসনযন্ত্রের আমূল সংস্কার করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

 শশী চক্ষের পলকে রায় দিল, মিছে কথা! ছল!

 ভারতী ঠিক যে বিশ্বাস করিল তাহা নয়, কিন্তু অকৃত্রিম উদ্বেগের সহিত কহিল, ছলনা নাও ত হতে পারে শশীবাবু। যাঁরা নেতা, যাঁরা এই অর্দ্ধশতাব্দকাল ধরে,—না দাদা, তুমি হাসতে পারবে না বলচি!—তাঁদের প্রাণপণ আন্দোলনের কি কোন ফল নেই ভাবো? বিদেশী শাসক হলেও ত তাঁরা মানুষ, ধর্মজ্ঞান এবং নৈতিক বুদ্ধি ফিরে আসা ত একেবারে অসম্ভব নয়!

 শশী তেমনি অসঙ্কোচে অভিমত প্রকাশ করিল, অসম্ভব! মিছে কথা! ধাপ্পাবাজী!

 অপূর্ব্ব কহিল, অনেকে এই সন্দেহই করেন সত্য।

 ভারতী বলিল, সন্দেহ তাঁদের মিথ্যে। ভগবান কি নেই নাকি? এবং পরক্ষণেই অপরিসীম আগ্রহভরে বলিয়া উঠিল, শাসন-পদ্ধতির পরিবর্ত্তন, অত্যাচার-অনাচারের সংস্কার,—এ সব যদি সত্যই হয়, তোমার বিপ্লবের আয়োজন, বিদ্রোহের সৃষ্টি,—তখন ত একেবারেই অর্থহীন হয়ে যাবে দাদা!

 শশী কহিল, নিশ্চয়।

 অপূর্ব্ব কহিল, নিঃসন্দেহ!

 ভারতী তাহার মুখপানে চাহিয়া কহিল, দাদা, তখন এই ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি ছেড়ে, আবার শান্ত মূর্ত্তি নেবে বল?

 ডাক্তার দেওয়ালের ঘড়ির দিকে চাহিয়া মনে মনে হিসাব করিয়া কতকটা যেন নিজেকেই কহিলেন, বেশি দেরি নেই আর। তাহার পরে ভারতীকে উদ্দেশ করিয়া অকস্মাৎ অত্যন্ত স্নিগ্ধভাব ধারণ করিয়া বলিলেন, ভারতী, এ আমার ভয়ঙ্কর কিংবা শান্ত মূর্ত্তি আমি আপনিই জানিনে, শুধু জানি এ জীবনে এ রূপ আমার আর পরিবর্ত্তন হবার নয়। আর তোমার নমস্য নেতাদের ভয় নেই দিদি, আজ তাঁদের নিয়ে আমোদ করবার আমার সময়ও নেই, অবস্থাও নয়। বিদেশী শাসনের সংস্কার যে কি, প্রাণপণ আন্দোলনের ফলে কি তারা চান, তার কতটুকু আসল, কতটুকু মেকি,—কি পেলে শশীর ধাপ্পাবাজী হয় না এবং নমস্যগণের কান্না থামে, তার কিছুই আছি জানিনে। বিদেশী গভর্ণমেণ্টের বিরুদ্ধে চোখ রাঙিয়ে যখন তাঁরা চরম বাণী প্রচার করে বলেন, আমরা আর ঘুমিয়ে নেই, আমরা জেগেচি। আমাদের আত্মসম্মানে ভয়ানক আঘাত লেগেছে। হয় আমাদের কথা শোন, নইলে বন্দে মাতরমের দিব্বি করে বলচি তোমাদের অধীনে আমরা স্বাধীন হবই হব। দেখি, কার সাধ্য বাধা দেয়!—এ যে কি প্রার্থনা, এবং কি এর স্বরূপ সে আমার বুদ্ধির অতীত। শুধু জানি, তাঁদের এই চাওয়া এবং পাওয়ার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ নেই।

 একটুখানি থামিয়া বলিলেন, সংস্কার মানে মেরামত—উচ্ছেদ নয়। গুরুভার যে অপরাধ আজ মানুষের অসহ্য হয়ে উঠেচে তাকেই সুসহ্য করা; যে যন্ত্র বিকল হয়ে আসচে মেরামত করে তাকেই সুপ্রতিষ্ঠিত করার যে কৌশল বোধ হয় তারই নাম শাসন-সংস্কার। একটা দিনের জন্যও ফাঁকি আমি চাইনি, একটা দিনের জন্যও বলিনি কারাগারের পরিসর আমার আর একটুখানি বাড়িয়ে দিয়ে আমাকে ধন্য কর। ভারতী, আমার কামনায়, আমার তপস্যায় আত্ম-বঞ্চনার অবসর নেই! এ তপস্যা সাঙ্গ হবার শুধু দুটি মাত্র পথ খোলা আছে—এক মৃত্যু, দ্বিতীয় ভারতের স্বাধীনতা।

 তাঁহার এই কথাগুলির মধ্যে নূতন কিছুই ছিল না, তথাপি মৃত্যু ও এই ভয়াবহ সঙ্কল্পের পুনরুল্লেখে ভারতীর বুকের মধ্যে অশ্রু আলোড়িত হইয়া চক্ষু জলে ভরিয়া গেল। কহিল, কিন্তু একাকী কি করবে দাদা, একে একে সবাই যে তোমাকে ছেড়ে দূরে সরে গেল?

 ডাক্তার বলিলেন, যাবেই ত। আমার দেবতা যে ফাঁকি সইতে পারেন না বোন।

 ভারতীর মুখে আসিল, সংসারে সবাই ফাঁকি নয় দাদা, হৃদয় পাথর না হয়ে গেলে তা টের পেতে। কিন্তু এ কথা আজ সে উচ্চারণ করিল না।

 আহার শেষ হইলে ডাক্তার হাত-মুখ ধুইয়া চেয়ারে আসিয়া বরিলেন। কেহই লক্ষ্য করিল না যে, তাঁহার চোখের দৃষ্টি কিসের উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষায় ধীরে ধীরে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিতেছে। এবং একটা কান যে বহুক্ষণ হইতেই সদর দরজায় সজাগ হইয়াছিল তাহা কেহই জানিত না। পথের ধারে কি একটা শব্দ হইল, তাহা আর কেহ প্রায় গ্রাহ্য করিল না, কিন্তু ডাক্তার সচকিতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, নীচে অপূর্ব্ববাবুর চাকর আছেন না? জেগে আছে? ওতে হনুমন্ত, দোরটা একবার খুলে দাও।

 কোথায় কাহার কিরূপ শয্যা প্রস্তুত হইবে তাহাই ভারতী সুমিত্রাকে জিজ্ঞাসা করিতেছিল, সবিস্ময়ে মুখ ফিরাইয়া কহিল, কাকে দাদা? কে এসেচেন?

 ডাক্তার বলিলেন, হীরা সিং। তার আসার আশায় পথ চেয়ে বসে আছি। বল কবি, কতকটা কাব্যের মত শোনাল না? এই বলিয়া তিনি হাসিলেন।

 ভারতী বলিল, এই দুর্য্যোগে তোমার একার কাব্যের জ্বালাতেই আমরা সন্ত্রস্ত হয়ে আছি। আবার ভগ্নদূত কিসের জন্যে?

 শশী কহিল, ভগ্নদূত তুচ্ছ নয় ভারতী, সে না হলে অতবড় মেঘনাদবধ কাব্য রচনাই হোত না।

 দেখি, ইনি কোন্ কাব্য রচনা করেন! এই বলিয়া ভারতী উঁকি মারিয়া দেখিল অপূর্ব্বর ভৃত্য বাহিরের কবাট খুলিতে যে ব্যক্তি প্রবেশ করিল সে সত্যই হীরা সিং। ক্ষণেক পরে আগন্তুক উপরে আসিয়া সকলকে অভিবাদন করিল এবং হাতজোড় করিয়া সব্যসাচীকে প্রণাম করিল! পরণে তাহার সেই অতি সুপরিচিত সরকারী উর্দ্দি, সরকারী চাপরাশ, সরকারী মুরাঠা, কোমরে টেলিগ্রাফ পিয়নের চামড়ার ব্যাগ,—এ সমস্তই ভিজিয়া ভারি হইয়া উঠিয়াছে। বিপুল দাড়ি-গোঁপ বহিয়া জল ঝরিতেছে বাঁ হাত দিয়া নিঙড়াইয়া বোধ হয় নিজকে কিঞ্চিৎ হাল্কা করিবার চেষ্টা করিল এবং তাহারই ফাঁক দিয়া অস্ফুটধ্বনি শুনা গেল, রেডি।

 ডাক্তার লাফাইয়া উঠিলেন, থ্যাঙ্ক ইউ? থ্যাঙ্ক উই সরদারজী! কখন?

 নাউ। এই বলিয়া সে সকলকে পুনশ্চ অভিবাদন করিয়া নীচে যাইতেছিল, কিন্তু সকলেই সমস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিলেন, কি হয়েচে সরদারজী? কি নাউ?

 অথচ সবাই জানিত এই মানুষটির গলায় ছুরি দিলে রক্ত ছুটিবে, কিন্তু বিনা হুকুমে কথা ফুটিবে না। সুতরাং উত্তরের পরিবর্ত্তে তাহার ঘন কৃষ্ণ শ্মশ্রু-গুম্ফ ভেদ করিয়া গুটিকয়েক দাঁত ছাড়া আর যখন কিছু বাহির হইল না, তখন বিস্ময়াপন্ন কেহই হইল না। সবাই জানিত, ইহার নিন্দা-খ্যাতি, মান-অপমান, শত্রু-মিত্র নাই; দেশের কাজে সব্যসাচীকে সে সর্দ্দার মানিয়া এ জীবনের সমস্ত ভালমন্দ, সমস্ত সুখদুঃখ বিসর্জ্জন দিয়া কঠোর সৈনিক-বৃত্তি মাথায় তুলিয়া লইয়াছে। আর তাহার তর্ক নাই, আলোচনা নাই, সময়-অসময়ের হিসাব নাই, কিছু একটা কঠিন কাজের ভার ছিল; কর্ত্তব্য পালন করিয়া নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল। ইহাদের কৌতূহল নিবৃত্তি করিয়া ডাক্তার নিজে যাহা বলিলেন তাহা সংক্ষেপে এইরূপ—

 ক্ষতি এবং অনিষ্ট কত যে হইয়াছে দূর হইতে নিরুপণ করা শক্ত! সম্ভবতঃ, যথেষ্ট হইয়াছে। কিন্তু যতই হৌক দুটা কাজ তাঁহাকে করিতেই হইবে। তাঁহাদের জ্যামেকা ক্লাবের যে অংশটা সিঙ্গাপুরে আছে তাহাকে বাঁচাইতেই হইবে। এবং যেখানে হৌক এবং যেমন করিয়া হৌক, ব্রজেন্দ্রকে তাঁহার খুঁজিয়া বাহির করিতেই হইবে। নদীর দক্ষিণে সিরিয়মের সন্নিকটে একখানা চীনা জাহাজ মাল বোঝাই করিয়া দেশে চলিয়াছে, কাল অতি প্রত্যুষেই তাহা ছাড়িয়া যাইবে, ইহাতেই কোনমতে একটা স্থান পাওয়া গিয়াছে। ষেই সংবাদই হীরা সিং এইমাত্র দিয়া গেল।

 শুনিয়া সুমিত্রার মুখ ফ্যাকাশে হইয়া গেল। খুব সম্ভব, ব্রজেন্দ্র এখন সিঙ্গাপুরে এবং যে ব্যক্তি তাহার সন্ধানে চলিল, তাহার দৃষ্টি হইতে স্বর্গে মর্ত্ত্যে কোথাও তাহার পরিত্রাণ নাই। তখন বিশ্বাসঘাতকতার শেষ বিচারের সময় আসিবে। ইহার দণ্ড যে কি তাহা দলের মধ্যে কাহারও অবিদিত নহে, সুমিত্রাও জানে। ব্রজেন্দ্র তাহার কিছুই নহে এবং অপরাধ যদি সে করিয়াই থাকে শাস্তি তাহার হৌক, কিন্তু যে কারণে সুমিত্রা অকস্মাৎ এমন হইয়া গেল, তাহা ব্রজেন্দ্রের দণ্ডের কথা স্মরণ করিয়া নহে, তাহা এই যে, ব্রজেন্দ্র পতঙ্গ নহে। সে আত্মরক্ষা করিতে জানে। শুধু তাহার পকেটের সুগুপ্ত পিস্তল নহে, তাহার মত ধুর্ত্ত, কৌশলী ও একান্ত সতর্ক ব্যক্তি সংসারে বিরল। তাহার মস্ত ভুল এই হইয়াছে যে, ডাক্তার হাঁটা-পথে বর্ম্মা ত্যাগ করিয়া গেছেন এই কথা সে যাবার পূর্ব্বে নিশ্চয় বিশ্বাস করিয়া গেছে। এখন কোন মতে যদি সে ডাক্তারের খোঁজ পায় ত বধ করিবার যত কিছু অস্ত্র তাহার তুণে আছে প্রয়োগ করিতে মুহূর্ত্তের দ্বিধাও করিবে না। বস্তুতঃ জীবন-মরণ সমস্যায় অপরের বলিবারই বা কি আছে!

 কিছুই নাই। শুধু হীরা সিং-এর শান্ত মৃদু দুটি শব্দ ‘নাউ’ এবং ‘রেডি’ তাহাদের সকলের কানের মধ্যেই সহস্রগুণ ভীষণ হইয়া সহস্র দিক দিয়া আঘাত প্রতিঘাত করিয়া ফিরিতে লাগিল। ভারতীর মনে পড়িল তাহাদের মৌলমিনের বাটীতে একদিন জন্মতিথি উৎসবের পরিপূর্ণ আনন্দের মাঝখানে অতিথি এবং সর্ব্বোত্তম বন্ধু রেভারেণ্ড লরেন্স আহারের টেবিলে হৃদরোগে মারা গিয়েছিলেন। আজিও ঠিক তেমনি অকস্মাৎ হীরা সিং ঘরে ঢুকিয়া মৃত্যুদূতের ন্যায় একমুহূর্ত্তে সমস্ত লণ্ডভণ্ড করিয়া দিয়া বাহির হইয়া গেল।

 হঠাৎ শশী কথা বলিয়া উঠিল। মুখ দিয়া ফোঁস করিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, সব যেন ফাঁকা হয়ে যাচ্চে ডাক্তার।

 কথাটা সাদা এবং নিতান্তই মোটা। কিন্তু সকলের বুকের উপর যেন মুগুরের ঘা মারিল।

 ডাক্তার হাসিলেন। শশী কহিল, হাসুন আর যাই করুন, সত্যি কথা! আপনি কাছে নেই মনে হলে সমস্ত যেন ব্ল্যাঙ্ক,—ফাঁকা ঝাপসা হয়ে আসে। কিন্তু আপনার প্রত্যেকটি হুকুম আমি মেনে চলবো।

 যথা?

 যথা, মদ খাবো না, পলিটিক্সে মিশবো না, ভারতীর কাছে থাকবো এবং কবিতা লিখবো।

 ডাক্তার ভারতীয় মুখের দিকে একবার চাহিলেন, কিন্তু দেখিতে পাইলেন না। তখন রহস্যভরে প্রশ্ন করিলেন, চাষাড়ে কবিতা লিখিবে না কবি?

 শশী কহিল, না। তাদের কাব্য তারা লিখতে পারে লিখুক, আমি লিখচিনে। আপনার সে-কথা আমি অনেক ভেবে দেখেচি। এবং এ উপদেশও কখনো ভুলব না যে, আইডিয়ার জন্য সর্ব্বস্ব বিসর্জ্জন দিতে পারে শুধু শিক্ষিত ভদ্র সন্তান, অশিক্ষিত কৃষকে পারে না। আমি হব তাদেরই কবি।—

 ডাক্তার বলিলেন, তাই হোয়ো! কিন্তু এইটেই শেষ কথা নয়, কবি, মানবের গতি এইখানেই নিশ্চল হয় থাকবে না। কৃষকের দিনও একদিন আসবে, যখন তাদের হাতেই জাতির সকল কল্যাণ-অকল্যাণের ভার সমর্পণ করতে হবে।

 শশী বলিল, আসুক সেদিন। তখন, স্বচ্ছন্দ, শান্ত চিত্তে সব দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দিয়েই আমরা ছুটি নেব। কিন্তু আজ না। আজ আত্ম-বলিদানের গুরুভার তারা বইতে পারবে না।

 ডাক্তার উঠিয়া আসিয়া তাহার কাঁধের উপর ডান হাত রাখিয়া চুপ করিয়া রহিলেন, কিছু বলিলেন না।

 অপূর্ব্ব এতক্ষণ নিঃশব্দে স্থির হইয়া শুনিতেছিল, ইহাদের কোন আলোচনাতেই কথা কহে নাই। কিন্তু শশীর শেষের দিকের মন্তব্য তাহার ভারি খারাপ ঠেকিল। যে কৃষকের মঙ্গলোদ্দেশে আত্মনিয়োগের সংকল্প সে স্থির করিয়াছে, তাহাদের বিরুদ্ধে এই সকল অভিমতে ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হইয়া বলিয়া উঠিল, মদ খাওয়া খারাপ, বেশ উনি ছেড়ে দিন, কাব্য-চর্চ্চা ভালো তাই করুন; কিন্তু কৃষি-প্রধান ভারতবর্ষের কৃষককূল কি এমনি তুচ্ছ, এতই অবহেলার বস্তু? এবং এরাই যদি বড় হয়ে না ওঠে, আপনাদের বিপ্লবই বা করবে কে? এবং করবেই বা কেন? আর পলিটিক্স! যথার্থ বলচি ডাক্তার, কৃষকের কল্যাণে সন্ন্যাস-ব্রত যদি আমি না নিতাম, আজ স্বদেশের রাজনীতিই হোতো আমার জীবনের একমাত্র কর্ত্তব্য।

 ডাক্তার ক্ষণকাল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিলেন। সহসা প্রসন্ন স্নিগ্ধাজ্জ্বল হাস্যে তাহার মুখ প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। কহিলেন, আমি কায়মনে প্রার্থনা করি তোমার সদুদ্দেশ্য যেন সফল হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রও তাচ্ছিল্যের সামগ্রী নয়। দেশের ও দশের কল্যাণে বৈরাগ্যই যদি গ্রহণ করে থাকো, কারো সঙ্গেই তোমার বিরোধ বাধবে না। আমি শুধু এই কথাই বলি, অপূর্ব্ববাবু, সকলে কিন্তু সকল কাজের যোগ্য হয় না!

 অপূর্ব্ব স্বীকার করিয়া বলিল, আমার চেয়ে এ শিক্ষা আর কার বেশি হয়েছে ডাক্তার, আপনি দয়া না করলে বহুদিন পূর্ব্বেই ত এই ভ্রমের চরম দণ্ড আমার হয়ে যেতো। এই বলিয়া পূর্ব্ব স্মৃতির আঘাতে তাহার সর্ব্বদেহ কণ্টকিত হইয়া উঠল।

 শশী এ ঘটনা জানিত না, জানানো কেহ আবশ্যক বিবেচনাও করে নাই। অপূর্ব্বর কথাটাকে সে প্রচলিত বিনয় ও শ্রদ্ধাভক্তির নিদর্শনের অতিরিক্ত কিছুই মনে করিল না। কহিল, ভ্রম ত করে অনেকেই, কিন্তু দণ্ডভোগ করে চলে যে নিজের জন্মভূমি। আমি ভাবি, ডাক্তার, আপনার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তি কে আছে? কার এতখানি জ্ঞান? জাতি ও দেশ নির্ব্বিশেষে কার এতখানি রাষ্ট্রতন্ত্রের অভিজ্ঞতা? কার এতখানি ব্যথা? অথচ, কিছুই কাজে এলো না! চায়নার আয়োজন নষ্ট হয়ে গেল, পিনাঙের গেল, বর্ম্মার কিছুই রইল না, সিঙ্গাপুরেরও যাবে নিশ্চয়,—এক কথায়, আপনার এতকালের সমস্ত চেষ্টাই ধ্বংস হবার উপক্রম হয়েছে। শুধু প্রাণটাই বাকী, সেও কোন দিন যায়!

 ডাক্তার মুখ টিপিয়া একটুখানি হাসিলেন। শশী কহিল, হাসুন আর যাই করুন, এ আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্চি।

 ডাক্তার তেমনি হাসিমুখে প্রশ্ন করিলেন, দিব্যচক্ষে আর কিছু দেখতে পাও না কবি?

 শশী বলিল, তাও পাই। তাই ত আপনাকে দেখলেই মনে হয়, নিরুপদ্রব, শান্তিময় পথে যদি আমাদের সত্যকার পথের দাবী সূচ্যগ্র মাত্রও খোলা থাকতো!

 অপূর্ব্ব বলিয়া উঠিল, বাঃ। একই সঙ্গে একেবারে দুই উল্টো কথা।

 সুমিত্রা হাসি গোপন করিতে মুখ ফিরাইল, ডাক্তার নিজেও হাসিয়া বলিলেন, তার কারণ, ওঁর মধ্যে দুটো সত্তা আছে অপূর্ব্ববাবু। একজন শশী, আর একজন কবি। এই জন্যই একের মুখের কথা অপরের মনের কথায় গিয়ে ধাক্কা দিয়ে এমন বেসুরার সৃষ্টি করে। একটু থামিয়া বলিলেন, বহু মানবের মধ্যেই এমনি আর একজন নিভৃতে বাস করে। সহজে তাকে ধরা যায় না। তাই মানুষের কথার ও কাজের মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব মাত্রই তার কঠোর বিচার করলে অবিচারের সম্ভাবনাই থাকে বেশি। অপুর্ব্ববাবু, আমি তোমাকে চিনতে পেরেছিলাম, কিন্তু পারেননি সুমিত্রা। ভারতী, জীবনযাত্রার মাঝখানে যদি এমন আঘাত কখনো পাও দিদি, পরলোকগত দাদার এই কথাটি তখন ভুলো না। কিন্তু এইবার আমি উঠি। ঘাটে আমার নৌকা বাঁধা আছে, ভাঁটার মুখে অনেকখানি দাঁড় না টানলে আর ভোর রাত্রে জাহাজ ধরতে পারব না।

 ভারতী শঙ্কায় আকুল হইয়া উঠিল, কহিল, এই ভয়ঙ্কর নদীতে? এই ভীষণ ঝড়ের রাত্রে?

 তাহার ব্যাকুল কণ্ঠস্বরে সুমিত্রার আত্মসংযমের কঠিন বাঁধ ভাঙ্গিয়া পড়িল। সে পাংশুমুখে প্রশ্ন করিল, সত্যিসত্যিই কি তুমি সিঙ্গাপুরে নামবে নাকি? এ কাজ তুমি কখ্‌খনো করো না ডাক্তার, সেখানকার পুলিশে তোমাকে ভাল করেই চেনে। এবার তাদের হাত থেকে তুমি কিছুতেই—

 কথা তাহার শেষ হইল না, উত্তর আসিল, তারা কি এখানেই আমাকে চেনে না সুমিত্রা?

 কিন্তু এই লইয়া তর্ক করিয়া ফল নাই, যুক্তি দেখাইবার অবসর নাই,—হয়ত বা, প্রশ্নটা সুমিত্রা শুনেও নাই; যে কথা বাহিরে আসিবার ব্যাকুলতায় এতদিন মাথা কুটিয়া মরিতেছিল তাহাই অন্ধবেগে নিষ্ক্রান্ত হইয়া আসিল,—কেবল একটিবার ডাক্তার, শুধু এইবারটির মত আমার উপরে নির্ভর করে দেখ, তোমাকে আমি সুরাভায়ায় নিয়ে যেতে পারি কিনা! তারপরে টাকায় কি না হয় বল!

 ডাক্তার হেঁট হইয়া জুতার ফিতা বাঁধিতেছিল, বাঁধা শেষ করিয়া মুখ তুলিয়া কহিলেন, টাকায় অনেক কাজ হয় সুমিত্রা, তার অপচয় করতে নেই।

 সকলেই বুঝিল, এ আলোচনা বৃথা। উপায়হীন বেদনায় হৃদয় পূর্ণ করিয়া সুমিত্রা অশ্রুপ্লাবিত চক্ষে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া রহিল। ভারতী কহিল, আমাকে আকুল সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে চললে দাদা, অথচ, বারবার বলতে আমাকে,—আর শুধু আমাকে কেন, আমাদের মত বয়সের যেখানে যত মেয়ে আছে তাদের প্রতি তোমার বড় লোভ, সকলকেই তুমি অত্যন্ত ভালোবাসো, সে কি এই?

 ডাক্তার সায় দিয়া বলিলেন, সত্যই ভালবাসি ভারতী। মেয়েদের ’পরে যে আমার কত লোভ, কত ভরসা, সে কথা নিজে তোমাদের জানাবার সুযোগ হল না, কিন্তু পারো যদি দাদার হয়ে এই কথাটা তাদের জানিয়ে দিয়ো বোন।

 ভারতী সহসা কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, জানাবো এই যে, আমাদের শুধু তুমি বলি দিতে চাও।

 ডাক্তার মুহূর্ত্তকাল তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিলেন, বেশ তাই বোলো। বাঙলাদেশের একটি মেয়েও যদি তার অর্থ বোঝে, আমি তাতেই ধন্য হব। এই বলিয়া তাঁহার সুবৃহৎ বোঁচকাটা কাঁধে তুলিয়া লইলেন। তাঁহার পিছনে পিছনে সকলেই নীচে নামিয়া আসিল। ভারতী শেষ চেষ্টা করিয়া কহিল, দেশের আয়োজন যার নিষ্ফল হয়ে যায়, বিদেশের আয়োজনে তার কি হয় দাদা? যারা অন্তরঙ্গ সুহৃৎ একে একে সবাই ছেড়ে গেল, এখন তুমি একেবারে নিঃসঙ্গ,—একেবারে একা!

 ডাক্তার স্বীকার করিয়া কহিলেন, ঠিক তাই। কিন্তু, একাই আরম্ভ করেছিলাম ভারতী! আর বিদেশ? কিন্তু ভগবান এইটুকু দয়া করেচেন, মানুষের মর্জ্জিমত ছোট বড় প্রাচীরের বেড়া তুলে তাঁর পৃথিবীকে আর সহস্র কারাকক্ষে পৃথক করে রাখবার তিনি জো রাখেননি। উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব্ব থেকে পশ্চিমে যতদূর দৃষ্টি যায় বিধাতার রাজপথ একেবারে উন্মুক্ত হয়ে গেছে। একে রুদ্ধ করে রাখবার চক্রান্ত মানুষের হাতের নাগাল ডিঙ্গিয়ে গেছে। এখন এক প্রান্তের অগ্নুৎপাত অপর প্রান্তে স্ফুলিঙ্গ উড়িয়ে আনবেই আনবে ভারতী, সে তাণ্ডব দেশ-বিদেশের গণ্ডী মানবে না!

 কিন্তু এদিকে যে রুদ্রের সত্যকার তাণ্ডব ঘরের বাহিরে তখন কি উন্মাদ মূর্ত্তিই ধারণ করিয়াছিল, ভিতর হইতে তাহা কেহই উপলব্ধি করে নাই। বিদ্যুতে, ঝঞ্ঝায়, প্লাবনে ও বজ্রাঘাতে সে যেন একেবারে প্রলয় শুরু হইয়া গিয়াছিল, এবং ডাক্তার অর্গল মুক্ত করিতেই এক ঝলক সুতীক্ষ্ণ বৃষ্টির ছাট ভিতরে ঢুকিয়া সকলকে ভিজাইয়া আলো নিবাইয়া সমস্ত ওলট-পালট করিয়া ঘর ও বাহির চক্ষের পলকে অন্ধকারে একাকার করিয়া দিল।

 ডাক্তার ডাকিলেন, সরদারজী!

 বাহির হইতে সাড়া আসিল, ইয়েস ডক্টর, রেডি।

 সকলে চমকিত হইল। এই দুঃসহ বায়ু ও মুষলধারে বৃষ্টি মাথায় পাতিয়া কেহ যে এই সূচীভেদ্য আঁধারে দাঁড়াইয়া নিশ্চল নিঃশব্দ প্রহরায় নিযুক্ত থাকিতে পারে এ কথা সহসা যেন কেহ ভাবিতেই পারিল না।

 ডাক্তার রহস্যভরে কহিলেন, তাহলে আমি এখন! এই বলিয়া বাহিরে পা বাড়াইবার সঙ্গে সঙ্গেই অপূর্ব্ব ব্যাকুল কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, একদিন যে আমি প্রাণ পেয়েছিলাম একথা চিরদিন মনে রাখবো ডাক্তার।

 অন্ধকার হইতে জবাব আসিল, তুচ্ছ পাওয়ার ব্যাপারটাকেই কেবল বড় করে দেখলে, অপূর্ব্ববাবু, যে দিলে তাকে মনে রাখলে না?

 অপূর্ব্ব চীৎকার করিয়া কহিল, মনে? এ-জীবনে ভুলব না। এ ঋণ মরণ পর্য্যন্ত আমি—

 দূরে আঁধারের মধ্য হইতে প্রত্যুত্তর আসিল, তাই যেন হয়। প্রার্থনা করি, সত্যকার দাতাকে যেন একদিন তুমি চিনতে পারো অপূর্ব্ববাবু! সেদিন সব্যসাচীর ঋণ—

 কথার শেষটা আর শুনা গেল না, অস্ফুটধ্বনি বায়ুবেগে শূন্যে ভাসিয়া গেল। তাহার পরে ক্ষণকালের জন্য যেন কাহাহারও সংজ্ঞা রহিল না। অচেতন জড়মূর্ত্তির ন্যায় কয়েক মুহূর্ত্ত নিশ্চল থাকিয়া ভারতী অকস্মাৎ চকিত হইয়া উঠিল এবং দ্রুতবেগে উপরে উঠিয়া আসিতেই সবাই তাহার পিছনে ছুটিয়া আসিল। সে ক্ষিপ্রহস্তে জানালা উন্মুক্ত করিয়া দিয়া যতদূর দৃষ্টি যায় নিষ্পলক চক্ষু দুটি অন্ধকারে একাগ্র করিয়া পাথরের মত দাঁড়াইয়া রহিল। এমন কতক্ষণ কাটিল। সহসা ভীষণ শব্দে হয়ত কাছে কোথাও বাজ পড়িল এবং তাহারই সুতীব্র বিদ্যুৎ শিখা শুধু পলকের জন্যই আকাশ ও ধরাতল উদ্ভাসিত করিয়া একবার শেষ দেখা দেখাইয়া দিল।

 এই ভয়ানক দুর্য্যোগে বাটীর বাহিরে আসিয়া ইহাদের গতিবিধি লক্ষ্য করিবার মত উন্মাদ বোধ হয় পুলিশের মধ্যে কেহ ছিল না, তথাপি রাজপথ এড়াইয়া উভয়ে মাঠের দক্ষিণ প্রান্ত ঘুরিয়া ধীরে ধীরে চলিয়াছে। মাঝে মাঝে ঝোপ-ঝাড় ও কাঁটগাছের বেড়া; এই সূচীভেদ্য আঁধারে পিচ্ছিল পথ-হীন পথে বিপুল বোঝার ভারে একজন আনতদেহে সাবধানে অগ্রসর হইয়াছে এবং অপরের বিরাট পাগড়ির নীচে প্রচণ্ড বারিপাত হইতে যথাসম্ভব নিজের মাথাটা বাঁচাইয়া তাঁহার অনুসরণ করিয়াছে।

 নিমিষমাত্র। নিমিষমাত্র পরেই সমস্ত বিলুপ্ত করিয়া দিয়া রহিল শুধু নিবিড় অন্ধকার।

 হঠাৎ গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া শশী বলিয়া উঠিল, দুর্দ্দিনের বন্ধু! নমস্কার সরদারজী!

 সঙ্গে সঙ্গে অপূর্ব্বও তাহার দুই হাত কপালে ঠেকাইয়া তাঁহারই উদ্দেশ্যে নিঃশব্দে নমস্কার করিল। তাহার মনের মধ্যে হইতে যেন একটা ভার নামিয়া গেল।

 ভারতী তেমনি পাষাণ মূর্ত্তির মতই অন্ধকারে চাহিয়া দাঁড়াইয়াছিল। শশীর কথাও যেমন তাহার কানে গেল না, তেমনি জানিতেও পারিল না ঠিক তাহারই মত আর একজন নারীর দুই চক্ষু প্লাবিয়া তখন এমনি অশ্রুপ্রবাহই বহিয়া যাইতেছিল।