পথের দাবী/৪
৪
দুই-তিন দিন নিরুপদ্রবে কাটিয়া গেল, উপরতলা হইতে সাহেবের অত্যাচার আর যখন নব-রূপে প্রকাশিত হইল না, তখন অপূর্ব্ব বুঝিল ক্রীশ্চান মেয়েটা সে দিনের কথা তাহার পিতাকে জানায় নাই। এবং তাহার সেই ফল-মূল দিতে আমার ঘটনার সঙ্গে মিলাইয়া এই না-বলার ব্যাপারটা শুধু সম্ভব নয়, সত্য বলিয়াই মনে হইল। অনেক প্রকার কালো ফর্সা সাহেবের দল যায় আসে, মেয়েটির সহিতও বার দুই সিঁড়ির পথে সাক্ষাৎ হইয়াছে, সে মুখ ফিরাইয়া নামিয়া যায়, কিন্তু সেই দুঃশাসন গৃহকর্ত্তার সহিত একদিনও মুখোমুখি ঘটে নাই! কেবল, সে যে ঘরে আছে সেটা বুঝা যায় তাহার ভারি বুটের শব্দে। সেদিন সকালে ছোটবাবুকে ভাত বাড়িয়া দিয়া তেওয়ারী হাসিমুখে কহিল সাহেব দেখছি নালিশ ফরিদ আর কিছু করলে না।
অপূর্ব্ব কহিল, না। যতটা গর্জ্জায় ততটা বর্ষায় না।
তেওয়ারী বলিল, আমাদেরও কিন্তু বেশিদিন এ বাসায় থাকা চলবে না। ব্যাটা মাতাল হলেই আবার কোন দিন ফ্যাসাদ বাধাবে।
অপূর্ব্ব কহিল, নাঃ—সে ভয় বড় নেই।
তেওয়ারী কহিল, তা হোক, তবু মাথার ওপরে মেলেচ্ছ ক্রীশ্চান, যা সব খায়-দায়, মনে হলেই—
আঃ তুই নাম তেওয়ারী। সে নিজে তখন খাইতেছিল, ক্রীশ্চানের খাদ্যদ্রব্যের ইঙ্গিতে তাহার সর্ব্বাঙ্গে যেন কাঁটা দিয়া উঠিল। কহিল, এ মাসটা গেলে উঠে ত যেতেই হবে। কিন্তু একটা ভাল বাসাও ত খুঁজে পাওয়া চাই।
এ সময়ে ও উল্লেখ ভাল হয় নাই, তেওয়ারী মনে মনে লজ্জিত হইয়া চুপ করিয়া রহিল।
সেইদিন বৈকালে আফিস হইতে ফিরিয়া অপূর্ব্ব তেওয়ারীর প্রতি চাহিয়া অবাক হইয়া গেল। সে যেন এই একটা বেলার মধ্যে শুকাইয়া অর্দ্ধেক হইয়া গেছে। কিন্তু তেওয়ারী?
প্রত্যুত্তরে সে আলপিনে গাঁথা কয়েকখণ্ড ছাপানো হলদে রঙের কাগজ অপূর্ব্বর হাতে দিল। ফৌজদারী আদালতের সমন, বাদী জে ডি জোসেফ, প্রতিবাদী তিন নম্বর ঘরের অপূর্ব্ব বাঙ্গালী ও তাহার চাকর। ধারা একটা নয়, গোটা চারেক। দুপুরবেলা কোর্টের পিয়াদা জারি করিয়া গেছে, এবং কাল সকালে আর একটা জারি করিতে আসিবে। সঙ্গে সেই সাহেব ব্যাটা। হাজির হইবার দিন পরশু। অপূর্ব্ব নিঃশব্দে কাগজগুলো আদ্যোপান্ত পড়িয়া ফিরাইয়া দিয়া কহিল, তা আর হবে কি কোর্টে হাজির হলেই হবে।
তেওয়ারী কাঁদ কাঁদ গলায় কহিল, কখনও যে কাঠগড়ায় উঠিনি বাবু।
অপূর্ব্ব বিরক্ত হইয়া বলিল, আমি কি উঠেচি না কি? সব তাতেই কাঁদবি ত বিদেশে আসতে গেলি কেন?
আমি যে কিছু জানিনে ছোটবাবু!
জানিসনে ত লাঠি নিয়ে বেরুতে গেলি কেন? ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে থাকলেই ত হোতো। এই বলিয়া অপূর্ব্ব কাপড় ছাড়িতে নিজের ঘরে চলিয়া গেল। পরদিন তাহার নিজের পরওয়ানা আসিয়া পৌঁছিল এবং তাহার পরদিন তেওয়ারীকে সঙ্গে লইয়া যথাসময়ে আদালতে উপস্থিত হইল। নালিশ মকদ্দমার অভিজ্ঞতাই তাহার ছিল না, বিদেশ, কোন লোকের সহিত আলাপ-পরিচয় নাই, কাহার সাহায্য লইতে হয়, কি করিয়া তদ্বির করিতে হয় কিছুই জানে না, তবুও কোন ভয়ই হইল না। হঠাৎ কি করিয়া যে তাহার মন এমন শক্ত হইয়া গেল সে নিজেই ভাবিয়া পাইল না। এ বিষয়ে রামদাসকে কোন কথা বলিতে, কোন সাহায্য চাহিতে তাহার লজ্জা বোধ হইল। শুধু কাজের অজুহাতে সাহেবের কাছেে একটা দিনের ছুটি লইয়া আসিয়াছিল।
সময়ে ডাক পড়িল। ডেপুটি কমিশনার নিজের ফাইলেই মকদ্দমা রাখিয়াছিলেন। বাদী জোসেফ সাহেব সত্য মিথ্যা যা খুশি এজাহার দিয়া গেল, প্রতিবাদীর উকিল ছিল না, অপূর্ব্ব নিজের জবাবে একটি কথাও গোপন করিল না, একটা কথাও বাড়াইয়া বলিল না। বাদীর সাক্ষী তার মেয়ে, আদালতের মাঝখানে এই মেয়েটির নাম এবং বিবরণ শুনিয়া অপূর্ব্ব স্তব্ধ হইয়া রহিল। ইনি কোন এক স্বর্গীয় রাজকুমার ভট্টাচার্য্যের কন্যা, বাটী পূর্ব্বে ছিল বরিশাল, এখন বাঙ্গালোর। নিজের নাম মেরি-ভারতী; ভট্টাচার্য্য মহাশয়, নিজেই স্বেচ্ছায় অন্ধকার হইতে আলোকে আসেন। তাঁহার স্বর্গীয় হওয়ার পরে মা কোন এক মিশনরি দুহিতার দাসী হইয়া বাঙ্গালোরে আসেন। সেখানে জোসেফ সাহেবের রূপে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে বিবাহ করেন। ভারতী পৈতৃক ভট্টাচার্য্য নামটা কদর্য্য বলিয়া পরিত্যাগ করিয়া জোসেফ নাম গ্রহণ করিয়াছে, সেই অবধি সে মিস মেরি-ভারতী জোসেফ নামে পরিচিত। হাকিমের প্রশ্নে সে ফল-মূল উপহার দিতে যাওয়া অস্বীকার করিল, কিন্তু তাহার কণ্ঠস্বর হইতে মুখের চেহারায় মিথ্যা বলার বিড়ম্বনা এমনি ফুটিয়া উঠিল যে শুধু হাকিম নয়, তাঁহার পিয়াদাটার চক্ষুকে পর্য্যন্ত তাহা ফাঁকি দিতে পারিল না। কোন পক্ষেই উকিল ছিল না, সুতরাং জেরার প্যাচে প্যাঁচে পাক খাইয়া তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র বস্তু সুবৃহৎ হইয়া উঠিবার অবকাশ পাইল না। বিচার একদিনেই শেষ হইল, তেওয়ারী রেহাই পাইল, কিন্তু বিচারক অপূর্ব্বর কুড়ি টাকা অর্থদণ্ড করিলেন। জীবনের এই প্রভাতকালে রাজদ্বারে বিনা অপরাধে দণ্ডিত হইয়া তাহার মুখ মলিন হইয়া গেল। টাকা কয়টি গণিয়া দিয়া বাহির হইতেছে, দেখিল, দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া রামদাস। অপূর্ব্বর মুখ দিয়া প্রথমেই বাহির হইয়া গেল—কুড়ি টাকা ফাইন হ’ল রামদাস, কি করা যাবে? আপিল?
আবেগ ও উত্তেজনায় তাহার কণ্ঠস্বরের শেষ দিকটা যেন কাঁপিয়া উঠিল। রামদাস তাহার ডান হাতটা নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া আসিয়া কহিল, অর্থাৎ কুড়ি টাকার বদলে দুহাজার টাকা আপনি লোকসান করতে চান।
তা হোক—কিন্তু এ যে ফাইন! শাস্তি! রাজদণ্ড!
রামদাস হাসিয়া কহিল, কিসের দণ্ড? যে মিথ্যে মামলা আনলে, মিথ্যে সাক্ষী দেওয়ালে,—আর যে তাকে প্রশ্রয় দিলে তাহাদের দণ্ড ত? কিন্তু এর উপরেও একটা আদালত আছে যার বিচারক ভুল করেন না,—সেখানে আপনি বেকসুর খালাস পেয়েচেন বলে দিচ্চি।
অপূর্ব্ব বলিল, কিন্তু লোকে ত বুঝবে না রামদাস। তাদের কাছে এ দুর্নাম যে আমার চিরকালের সঙ্গী হয়ে রইল।
রামদাস সস্নেহে তাহার হাতের উপর একটা চাপ দিয়া বলিল, চলুন, আমরা নদীর ধারে একটু বেড়িয়ে আসিগে।
পথে চলিতে চলিতে কহিল, অপুর্ব্ববাবু, আমি অফিসের কাজে আপনার ছোট হলেও বয়সে বড়। যদি দুটো কথা বলি কিছু মনে করবেন না। অপূর্ব্ব চুপ করিয়া রহিল। রামদাস বলিতে লাগিল, এ মকদ্দমার কথা আমি আগেই জানতাম, কি হবে তাতেও আমার সন্দেহ ছিল না। লোকের কথা আপনি বলছিলেন, যে লোক, সে জানবে হালদারের সঙ্গে জোসেফের মামলা বাধলে ইংরাজের আদালতে কি হয়! আর কুড়ি টাকার জরিমানার দুর্নাম—
কিন্তু বিনা দোষে যে রামদাস?
রামদাস কহিল, হা ঁহাঁ, বিনা দোষেই বটে। এমনি বিনা দোষেই আমি দু’বৎসর জেল খেটেছি।
জেল খেটেছ? দু’বৎসর?
হাঁ, দু’বৎসর, এবং—এই, বলিয়া সে পুনশ্চ একটু হাসিয়া অপূর্ব্বর হাতখানা তাহার পিঠের নীচে টানিয়া লইয়া কহিল, এই জামাটা যদি সরাতে পারতাম ত দেখতে পেতেন এখানে বেতের দাগে দাগে আর জায়গা নেই।
বেত খেয়েচ রামদাস?
রামদাস সহাস্যে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ, এবং এমনই বিনা দোষে। তবু এত নির্লজ্জ আমি যে আজও লোকের কাছে মুখ দেখাচ্ছি। আর আপনি কুড়ি টাকার আঘাত সইতে পারবেন না বাবুজি?
অপূর্ব্ব তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল। যে ল্যাম্প পোস্ট আশ্রয় করিয়া তাহারা দাঁড়াইয়াছিল তাহাতে আলো জ্বালিতে আসিল। সন্ধ্যা হইয়াছে দেখিয়া রামদাস চকিত হইয়া কহিল, আর না, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আমি বাড়ি যাই।
অপূর্ব্ব আবেগের সহিত বলিল, এখনি চলে যাবে? অনেক কথা যে আমার জানবার রইল?
রামদাস হাসিমুখে কহিল, সব আজই জেনে নেবেন? সে হবে না। হয়ত অনেক দিন ধরে আমাকে বলতে হবে। এই অনেকদিন কথাটার উপর সে এমনি কি একটা জোর দিল যে অপূর্ব্ব সবিস্ময়ে তাহার মুখের প্রতি না চাহিয়া পারিল না। কিন্তু সেই সহাস্য প্রশান্ত মুখে কোন রহস্য প্রকাশ পাইল না। রামদাস গলির ভিতরে আর প্রবেশ করিল না, বড় রাস্তা হইতেই বিদায় লইয়া সোজা স্টেশনের দিকে চলিয়া গেল।
অপূর্ব্ব তাহার বাসার দরজায় আসিয়া রুদ্ধ দ্বারে ঘা দিতেই তেওয়ারী প্রভুর সাড়া পাইয়া দ্বার খুলিয়া দিল। সে পূর্ব্বাহ্নে আসিয়া গৃহকর্ম্মে রত হইয়াছে, মুখ তাহার যেমন গম্ভীর তেমনি বিষণ্ণ। কহিল, তখন তাড়াতাড়িতে দু’খানা নোট ফেলে গিয়েছিলেন?
অপূর্ব্ব আশ্চর্য্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় ফেলে গিয়েছিলাম রে?
এই যে এখানে, বলিয়া সে পা দিয়া দ্বারের কাছে মেঝের উপর একটা জায়গা নির্দ্দেশ করিয়া দেখাইল। কহিল, আপনার বালিশের তলায় রেখে দিয়েচি। পকেট থেকে বাইরে পড়ে যায়নি এই ভাগ্যি।
কি করিয়া যে পড়িয়া গিয়াছিল এই কথা ভাবিতে ভাবিতে অপূর্ব্ব তাহার ঘরে চলিয়া গেল।