পথের পাঁচালী/অষ্টম পরিচ্ছেদ


পথের পাঁচালী
অষ্টম পরিচ্ছেদ

সকাল বেলা। আটটা কি নয়টা। হরিহরের পুত্র আপন মনে রোয়াকে বসিয়া খেলা করিতেছে, তাহার একটা ছোট টিনের বাক্স আছে, সেটার ডালা ভাঙা। বাক্সের সমুদয় সম্পত্তি সে উপুড় করিয়া মেঝেতে ঢালিয়াছে,—একটা রং-ওঠা কাঠের ঘোড়া, চার পয়সা দামের, একটা টোল্-খাওয়া টিনের ভেঁপু-বাঁশী, গোটাকতক কড়ি—এগুলি সে মায়ের অজ্ঞাতসারে লক্ষ্মীপূজার কড়ির চুপড়ী হইতে খুলিয়া লইয়াছিল ও পাছে কেহ টের পায় এই ভয়ে সর্ব্বদা লুকাইয়া রাখে—একটা দু’পয়সা দামের পিস্তল, কতকগুলো শুক্‌নো নাটা ফল। দেখিতে ভাল বলিয়া তাহার দিদি কোথা হইতে অনেকগুলি কুড়াইয়া আনিয়াছিল, কিছু তাহাকে দিয়াছে, কিছু সে নিজের পুতুলের বাক্সে রাখিয়া দিয়াছে। খানকতক খাপরার কুচি। গঙ্গাযমুনা খেলিতে এই খাপরাগুলির লক্ষ্য অব্যর্থ বলিয়া বিশ্বাস হওয়ায় সে এগুলি সযত্নে বাক্সে রাখিয়া দিয়াছে, এগুলি তাহার মহা মূল্যবান সম্পত্তি। এতগুলি জিনিসের মধ্যে সবে সে টিনের বাঁশীটা কয়েকবার বাজাইয়া সেটির সম্বন্ধে বিগতকৌতূহল হইয়া তাহাকে এক পাশে রাখিয়া দিয়াছে। কাঠের ঘোড়া নাড়াচাড়া করা হইয়া গিয়াছে। সেটিও একপাশে পিঁজরাপোলের আসামীর ন্যায় পড়িয়া আছে। বর্ত্তমানে সে গঙ্গা-যমুনা খেলিবার খাপরাগুলিকে হাতে লইয়া মনে মনে দাওয়ার উপর গঙ্গা-যমুনার ঘর আঁকা কল্পনা করিয়া চোখ বুজিয়া খাপরা ছুঁড়িয়া দেখিতেছে, তাক্ ঠিক হইতেছে কিনা!

 এমন সময়ে তাহার দিদি দুর্গা উঠানের কাঁঠালতলা হইতে ডাকিল—অপু—ও—অপু—। সে এতক্ষণ বাড়ী ছিল না, কোথা হইতে এইমাত্র আসিল। তাহার স্বর একটু সতর্কতামিশ্রিত। মানুষের গলার আওয়াজ পাইয়া অপু কলের পুতুলের মতো লক্ষ্মীর চুপড়ীর কড়িগুলি তাড়াতাড়ি লুকাইয়া ফেলিল। পরে বলিল—কি রে দিদি?

 দুর্গা হাত নাড়িয়া ডাকিল—আয় এদিকে—শোন্—

 দুর্গার বয়স দশ-এগার বৎসর হইল। গড়ন পাতলা পাতলা, রং অপুর মতো অতটা ফর্সা নয়, একটু চাপা। হাতে কাচের চুড়ি, পরনে ময়লা কাপড়, মাথার চুল রুক্ষ— বাতাসে উড়িতেছে, মুখের গড়ন মন্দ নয়, অপুর মতো চোখগুলি বেশ ডাগর ডাগর। অপু রোয়াক হইতে নামিয়া কাছে গেল, বলিল,—কি রে?

 দুর্গার হাতে একটা নারিকেলের মালা। সেটা সে নিচু করিয়া দেখাইল, কতকগুলি কচি আম কাটা। সুর নিচু করিয়া বলিল—মা ঘাট থেকে আসে নি তো?

 অপু ঘাড় নাড়িয়া বলিল—উঁহু—

 দুর্গা চুপি চুপি বলিল—একটু তেল আর একটু নুন নিয়ে আসতে পারিস? আমের কুসী জারাবো।—

 অপু আহ্লাদের সহিত বলিয়া উঠিল—কোথায় পেলি রে দিদি?

 দুর্গা বলিল—পট্‌লিদের বাগানে সিঁদুরকোটোর তলায় পড়ে ছিল—আন্ দিকি একটু নুন তার তেল?

 অপু দিদির দিকে চাহিয়া বলিল—তেলের ভাঁড় ছুঁলে মা মার্‌বে যে? আমার কাপড় যে বাসি?

 তুই যা না শিগ্‌গির করে, মা'র আসতে এখন ঢের দেরি—ক্ষার কাচতে গিয়েচে— শিগ্‌গির যা—

 অপু বলিল—নারকোলের মালাটা আমায় দে। ওতে ঢেলে নিয়ে আস্‌বো।—তুই খিড়কী দোরে গিয়ে দ্যাখ্ মা আসচে কিনা। দুর্গ নিম্নস্বরে বলিল—তেল টেল যেন মেঝেতে ঢালিস্‌নে, সাবধানে নিবি, নইলে মা টের পেয়ে যাবে।—তুই তো একটা হাবা ছেলে—

 অপু বাড়ীর মধ্য হইতে বাহির হইয়া আসিলে দুর্গা তাহার হাত হইতে মালা লইয়া আমগুলি বেশ করিয়া মাখিল,—বলিল, নে হাত পাত।

 —তুই অতগুলো খাবি দিদি?

 —অতগুলি বুঝি হল? এই তো—ভারি বেশি।—যা, আচ্ছা নে আর দুখানা—বাঃ, দেখতে বেশ হয়েচে রে, একটা লঙ্কা আন্‌তে পারিস্? আর একখানা দেবো তা'হলে—

 —লঙ্কা কি করে পাড়বো দিদি? মা যে তক্তার ওপর রেখে দ্যায়, আমি যে নাগাল পাইনে?

 —তবে থাক্‌গে যাক্—আবার ওবেলা আনবো এখন—পট্‌লিদের ডোবার ধারের আমগাছটায় গুটী যা ধরেচে—দুপুরের রোদে তলায় ঝরে পড়ে—

 দুর্গাদের বাড়ীর চারিদিকেই জঙ্গল। হরিহর রায়ের জ্ঞাতি-ভ্রাতা নীলমণি রায় সম্প্রতি গত বৎসর মারা গিয়াছেন, তাঁহার স্ত্রী পুত্রকন্যা লইয়া নিজ পিত্রালয়ে বাস করিতেছেন। কাজেই পাশের এ ভিটাও জঙ্গলাবৃত হইয়া পড়িয়া আছে। নিকটে আর কোন লোকের বাড়ী নাই। পাঁচ মিনিটের পথ গেলে তবে ভুবন মুখুয্যের বাড়ী।

 হরিহরের বাড়ীটাও অনেক দিন হইয়া গেল মেরামত হয় নাই, সামনের দিকের রোয়াক ভাঙা, ফাটলে বন-বিছুটির ও কালমেঘ গাছের বন গজাইয়াছে—ঘরের দোর-জানালার কপাট সব ভাঙা, নারিকেলের দড়ি দিয়া গরাদের সঙ্গে বাঁধা আছে।

 খিড়কী দোর ঝনাৎ করিয়া খুলিবার শব্দ হইল এবং একটু পরেই সর্ব্বজয়ার গলা শুনা গেল—দুগ্‌গা ও দুগ্‌গা—

 দুর্গা বলিল—মা ডাকচে, যা দেখে আয়—ওখানা খেয়ে যা—মুখে যে নুনের গুঁড়ো লেগে আছে, মুছে ফ্যাল—

 মায়ের ডাক আর একবার কানে গেলেও দুর্গার এখন উত্তর দিবার সুযোগ নাই, মুখ ভর্তি। সে তাড়াতাড়ি জারানো আমের চাক্‌লাগুলি খাইতে লাগিল। পরে এখনও অনেক অবশিষ্ট আছে দেখিয়া কাঁঠালগাছটার কাছে সরিয়া গিয়া গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়াইয়া সেগুলি গোগ্রাসে গিলিতে লাগিল। অপু তাহার পাশে দাঁড়াইয়া নিজের অংশ প্রাণপণে গিলিতেছিল, কারণ চিবাইয়া খাওয়ার আর সময় নাই। খাইতে খাইতে দিদির দিকে চাহিয়া সে দোষ সম্বন্ধে সচেতনতা-সূচক হাসি হাসিল। দুর্গা খালি মালাটা এক টান মারিয়া ভেরেণ্ডা-কচার বেড়া পার করিয়া নীলমণি রায়ের ভিটার দিকে জঙ্গলের মধ্যে ছুঁড়িয়া দিল। ভাইয়ের দিকে চাহিয়া বলিল—মুখটা মুছে ফ্যাল্ না বাঁদর—নুন লেগে রয়েছে যে···

 পরে দুর্গা নিরীহমুখে বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া বলিল—কি মা?

 —কোথায় বেরুনো হয়েছিল শুনি? একলা নিজে কতদিকে যাবো? সকাল থেকে ক্ষার কেচে গা-গতর ব্যথা হয়ে গেল, একটুখানি যদি কোন দিক থেকে আসান আছে তোমাদের দিয়ে—অত বড় মেয়ে, সংসারের কুটোগাছটা ভেঙে দু'খানা করা নেই, কেবল পাড়ায় পাড়ায় টো টো টোক্‌লা সোধে বেড়াচ্ছেন—সে বাঁদর কোথায় গেল?

 অপু আসিয়া বলিল, মা, খিদে পেয়েচে!

 রোসো রোসো, একটুখানি দাঁড়াও বাপু·· একটুখানি হাঁপ জিরোতে দাও! তোমাদের রাতদিন খিদে, আর রাতদিন ফাই-ফরমাজ। ও দুগ্‌গা, দ্যাখ্‌তো বাছুরটা হাক পাড়ছে কেন?

 খানিকটা পরে সর্ব্বজয়া রান্নাঘরের দাওয়ায় বঁটি পাতিয়া শসা কাটিতে বসিল। অপু কাছে বসিয়া পড়িয়া বলিল–আর এট্ট আটা বের করো না মা, মুখে বড্ড লাগে।

 দুৰ্গা নিজের ভাগ হাত পাতিয়া লইয়া সঙ্কুচিত সুরে বলিল—চাল ভাজা আর নেই মা?

 অপু খাইতে খাইতে বলিল—উঃ, চিবানো যায় না, আম খেয়ে যা দাঁত টকে—

 দুর্গার ভ্রূকুটিমিশ্ৰিত চোখ-টেপায় বাধা পাইয়া তাহার কথা অর্দ্ধপথেই বন্ধ হইয়া গেল। তাহার মা জিজ্ঞাসা করিল—আম কোথায় পেলি?

 সত্য কথা প্রকাশ করিতে সাহসী না হইয়া অপু দিদির দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে চাহিল। সর্ব্বজয়া মেয়ের দিকে চাহিয়া বলিল—তুই ফের এখন বেরিয়েছিলি বুঝি?

 দুৰ্গা বিপন্নমুখে বলিল—ওকে জিজ্ঞেস করো না? আমি—এই তো এখন কাঁঠালতলায় দাঁড়িয়ে—তুমি যখন ডাক্‌লে তখন তো—

 স্বর্ণ গোয়ালিনী গাই দুহিতে আসায় কথাটা চাপা পড়িয়া গেল। তাহার মা বলিল—যা বাছুরটা ধরগে যা—ডেকে ডেকে সারা হল—কমলে বাছুর, ও সন্ন, এত বেলা ক'রে এলে কি বাঁচে? একটু সকাল করে না এলে এই তেতপ্পর পজ্জন্ত বাছুর বাঁধা—

 দিদির পিছনে পিছনে অপুও দুধ দোয়া দেখিতে গেল। সে বাহির উঠানে পা দিতেই দুৰ্গা তাহার পিঠে দুম্ করিয়া নিৰ্ঘাত এক কিল বসাইয়া দিয়া কহিল—লক্ষ্মীছাড়া বাঁদর! পরে মুখে ভ্যাঙাইয়া কহিল—আম খেয়ে দাঁত টিকে গিয়েছে—আবার কোনো দিন আম দেবো খেও—ছাই দেবো।–এই ওবেলাই পটলিদের কাঁকুড়তলির আম কুড়িয়ে এনে জারাবো, এত বড় বড় গুটি হয়েছে, মিষ্টি যেন গুড়—দেবো তোমায়? খেও এখন? হাবা একটা কোথাকার—যদি এতটুকু বুদ্ধি থাকে!


 দুপুরের কিছু পরে হরিহর কাজ সারিয়া বাড়ি ফিরিল। সে আজকাল গ্রামের অন্নদা রায়ের বাটীতে গোমস্তার কাজ করে। জিজ্ঞাসা করিল–অপুকে দেখচিনে? সর্ব্বজয়া বলিল–অপু তো ঘরে ঘুমুচ্চে।

 দুগ্‌গা বুঝি—

 সে সেই খেয়ে বেরিয়েচে—সে বাড়ী থাকে কখন? দুটো খাওয়ার সঙ্গে যা সম্পর্ক! আবার সেই খিদে পেলে তবে আস্‌বে—কোথায় কার বাগানে কার আমতলায় জামতলায় ঘুরছে–এই চত্তির্ মাসের রোদুরে, ফের দ্যাখোনা এই জ্বরে পড়লো বলে—অত বড় মেয়ে, বলে বোঝাবো কত? কথা শোনে, না কানে নেয়?

 একটু পরে হরিহর খাইতে বসিয়া বলিল—আজ দশঘরায় তাগাদার জন্যে গেছলাম, বুঝলে? একজন লোক, খুব মাতব্বর, পাঁচটা ছয়টা গোলা বাড়ীতে, বেশ পয়সাওলা লোক—আমায় দেখে দণ্ডবৎ করে বল্লে—দাদাঠাকুর আমায় চিনতে পাচ্চেন? আমি বল্লাম—না বাপু, আমি তো কৈ—? বল্লে—আপনার কর্ত্তা থাকতে তখন তখন পূজা আচ্চায় সব সময়ই তিনি আসতেন, পায়ের ধূলো দিতেন। আপনারা আমাদের গুরুতুল্য লোক, এবার আমরা বাড়িসুদ্ধ মন্তর নেবো ভাবচি—তা আপনি যদি আজ্ঞে করেন, তবে ভরসা করে বলি—আপনিই কেন মন্তরটা দেন্ না? তা আমি তাদের বলেচি, আজ আর কোনো কথা বল্‌বো না, ঘুরে এসে দু-এক দিনে—বুঝলে?

 সর্ব্বজয়া ডালের বাটি হাতে দাঁড়াইয়া ছিল, বাটি মেঝেতে নামাইয়া সামনে বসিয়া পড়িল। বলিল—হ্যাঁগো, তা মন্দ কি? দাও না ওদের মন্তর? কি জাত? হরিহর সুর নামাইয়া বলিল—ব'লো না কাউকে—সদ্গোপ। তোমার তো আবার গল্প করে বেড়ানো স্বভাব–—

 আমি আবার কাকে বল্‌তে যাবো? তা হোক গে সদ্গোপ, দাও গিয়ে দিয়ে, এই কষ্ট যাচ্ছে—ঐ রায়বাড়ীর আটটা টাকা ভরসা, তাও দু তিন মাস অন্তর তবে দ্যায়—আর এদিকে রাজ্যির দেনা। কাল ঘাটের পথে সেজ ঠাকরুণ বল্লে—বৌমা, আমি বন্দক ছাড়া টাকা ধার দিই নে—তবে তুমি অনেক করে বল্লে বলে দিলাম—আজ পাঁচ পাঁচ মাস হয়ে গেল, টাকা আর রাখতে পারবো না। এদিকে রাধা বোষ্টমের বৌ তো ছিঁড়ে খাচ্চে, দুবেলা তাগাদা আরম্ভ করেচে! ছেলেটার কাপড় নেই—দু তিন জায়গায় সেলাই, বাছা আমার তাই পরে হাসিমুখে নেচে নেচে বেড়ায়—আমার এমন হয়েচে যে ইচ্ছে করে একদিকে বেরিয়ে যাই—

 আর একটা কথা ওরা বলছিল, বুঝলে? বলছিল গাঁয়ে তো বামুন নেই আপনি যদি এই গাঁয়ে উঠে আসেন, তবে জায়গা জমি দিয়ে বাস করাই—গাঁয়ে একঘর বামুন বাস করানো আমাদের বড্ড ইচ্ছে। তা কিছু ধানের জমি-টমি দিতেও রাজী—পয়সার তো অভাব নেই। আজকাল চাষাদের ঘরেই লক্ষ্মী বাঁধা—ভদ্দর লোকেরই হয়ে পড়েচে হা ভাত যো ভাত—

 আগ্রহে সর্ব্বজয়ার কথা বন্ধ হইবার উপক্রম হইল—এখ খুনি। তা তুমি রাজী হ'লে না কেন? বল্লেই হোত যে আচ্ছা আমরা আস্‌বো। ও রকম একটা বড় মানুষের আশ্রয়—এ গাঁয়ে তোমার আছে কি? শুধু ভিটে কামড়ে' পড়ে থাকা—

 হরিহর হাসিয়া বলিল—পাগল! তখুনি কি রাজী হ'তে আছে? ছোটলোক, ভাববে ঠাকুরের হাঁড়ি দেখচি শিকেয় উঠেচে—উঁহু, ওতে খেলো হয়ে যেতে হয়—তা নয়, দেখি একবার চুপি চুপি মজুমদার মহাশয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে—আর এখন ওঠ্ বল্লেই কি ওঠা চলে? সব ব্যাটা এসে বল্‌বে টাকা দাও, নৈলে যেতে দেবো না—দেখি পরামর্শ করে কি রকম দাঁড়ায়—

 এই সময়ে মেয়ে দুৰ্গা কোথা হইতে পা টিপিয়া টিপিয়া আসিয়া বাহিরের দুয়ারের আড়াল হইতে সতর্কতার সহিত একবার উঁকি মারিল এবং অপর পক্ষ সম্পূর্ণ সজাগ দেখিয়া ও-ধারে পাঁচিলের পাশ বাহিয়া বাহির-বাটীর রোয়াকে উঠিল। দালানের দুয়ার আস্তে আস্তে ঠেলিয়া দেখিল উহা বন্ধ আছে। এদিকে রোয়াকে দাঁড়ানো অসম্ভব, রৌদ্রের তাপে পা পুড়িয়া যায়, কাজেই সে-স্থান হইতে নামিয়া গিয়া উঠানের কাঁঠালতলায় দাঁড়াইল। রৌদ্রে বেড়াইয়া তাহার মুখ রাঙা হইয়া উঠিয়াছে, আঁচলের খুঁটে কী-কতকগুলা যত্ন করিয়া বাঁধা। সে আসিয়াছিল এই জন্য যে, যদি বাহিরের দুয়ার খোলা পায় এবং মা ঘুমাইয়া থাকে, তবে ঘরের মধ্যে চুপি চুপি ঢুকিয়া একটু শুইয়া লইবে। কিন্তু বাবার, বিশেষত মার সামনে সম্মুখ দুয়ার দিয়া বাড়ী ঢুকিতে তাহার সাহসী হইল না।

 উঠানে নামিয়া সে কাঁঠালতলায় দাঁড়াইয়া কি করিবে ঠিক করিতে না পারিয়া নিরুৎসাহভাবে এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল। পরে সেখানেই বসিয়া পড়িয়া আঁচলের খুঁট খুলিয়া কতকগুলি শুক্‌নো রড়া ফলের বীচি বাহির করিল। খানিকক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া সে আপন মনে সেগুলি গুনিতে আরম্ভ করিল, এক—দুই—তিন—চার—ছাব্বিশটা হইল। পরে সে দুই তিনটা করিয়া বীচি হাতের উল্টা পিঠে বসাইয়া উঁচু করিয়া ছুঁড়িয়া দিয়া পরে হাতের সোজা পিঠ পাতিয়া পাতিয়া ধরিতে লাগিল। মনে মনে বলিতে লাগিল—অপুকে এইগুলো দেবো—আর এইগুলো পুতুলের বাক্সে রেখে দেবো—কেমন বীচিগুলো তেল চুকচুক কচ্ছে—আজই গাছ থেকে পড়েচে, ভাগ্যিস্ আগে গেলাম, নৈলে সব গরুতে খেয়ে ফেলে দিত, ওদের রাঙী গাইটা একেবারে রাক্কস, সব জায়গায় যাবে, সেবার কতকগুলো এনেছিলাম। আর এইগুলো নিয়ে অনেকগুলো হোল।

 সে খেলা বন্ধ করিয়া সমস্ত বীচি আবার সযত্নে আঁচলের খুঁটে বাঁধিল। পরে হঠাৎ কি ভাবিয়া রুক্ষ চুলগুলি বাতাসে উড়াইতে উড়াইতে মহাখুশির সহিত পুনরায় সোজা বাটীর বাহির হইয়া গেল।