পদাবলী-মাধুর্য্য/একাদশ পরিচ্ছেদ
মাথুর
কৃষ্ণ মথুরায় গিয়াছেন, মন্দির খালি, বৃন্দাবন শূন্য।
‘‘কৈছনে যাওব যমুনাতীর,
কৈহে নেহারব কুঞ্জকুটীর
সহচরি সঞে যাহা করল ফুল-খেরী।
কৈছনে জীয়ব তাহি নেহারি।’’
সে ফুল-খেলা ফুরাইয়াছে—তোমার বিলাসকুঞ্জের দিকে চাহিয়া কেমন করিয়া জীবন রাখিব? আর কাহার সহিত নীলাম্বরতলে সন্ধ্যানিলবাহিত যমুনাতীরে হাত-ধরাধরি করিয়া বেড়াইব?
বৃন্দাবনচন্দ্র চলিয়া গিয়াছেন, বৃন্দাবন আঁধার হইয়াছে, এই প্রসঙ্গের গৌর-চন্দ্রিকা।
‘‘কার ভাবে কিসের অভাবে গৌর আমার এমন হৈল
নবদ্বীপচন্দ্র বিনা নবদ্বীপ আঁধার হৈল।’’
এমন যে হইবে, কে জানিত?
“আমারে ছাড়িয়া পিয়া, মধুরায় রইল গিয়া—
এও বিধি লিখিলা করমে।”
আমার কর্ম্মে—আমার ভাগ্যে ইহাও লেখা ছিল, আমি কৃষ্ণ-হারা হইয়া বাঁচিয়া থাকিব?
বিদ্যাপতি মাথুরের প্রথম অধ্যায়ে ভগবদ্ভাবে আবিষ্ট হইয়া লিখিয়াছেন,
‘‘হরি হরি কি ইহ দৈব দুরাশা।
সিন্ধুর নিকটে যদি কণ্ঠ শুকায়ব, কো দূর করব পিপাসা?
চন্দনতরু যব সৌরভ ছোড়ব, শশধর বরখিব আগি।
চিন্তামণি যদি নিজ গুণ ছোড়ব কি মোর করম অভাগী।
শাওন মাহ ঘন, যব বিন্দু না বরখব, সুরতরু বাঁঝ কি ছাদে।
গিরিধর সেবি, ঠাম নাহি পাওব, বিদ্যাপতি রহ ধন্দে।’’
এখানে একটু ঐশ্বর্য্যের ভাব আছে—তিনি এই বিরাট্, তাঁহার কাছে আসিয়া বঞ্চিত হইতে হইবে, এমন তো কখনও ভাবি নাই। এই সুললিত শব্দে গ্রথিত কাব্যরসপূর্ণ পদটির মধ্যে যেন একটু
‘‘যাচঞা মোঘা বরমধিগুণে নাধমে লব্ধ কামা’’
গন্ধ পাওয়া যায়। যিনি সিন্ধুর মত বিরাট্ তাঁহার কাছে বিন্দু পাইব না, এই আক্ষেপে দেখা যায়, রাধা যেন কৃষ্ণ-প্রেমের কণিকা ভিখারী। শ্রাবণ মাসের ভরা বাদরের অজস্র বর্ষণশীল আকাশের কাছে কণিকামাত্র জলের প্রত্যাশা নাই, ইহাও কৃষ্ণের ঐশ্বর্য্যব্যঞ্জক। সুরতরু (কল্পবৃক্ষ) আমার কাছে বন্ধ্যা হইয়া রহিল, ধর্ম্ম-অর্থ-কাম মোক্ষের দাতা ভগবানকে কল্পতরু বলা হইয়াছে—তিনি কাম্য ফল প্রদান করেন। এখানেও রাধার প্রার্থীর বেশ, রাধা তাঁহার নিকট কাম্যবস্তুর সন্ধানে আসিয়াছেন, এখানে নিষ্কাম অহেতুক গোপী-প্রেমের আভাষ নাই। শেষ ছত্রে স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে—সর্ব্ব শক্তিমান, সর্ব্ব-ইষ্ট-প্রদায়ী ভগবানকে সেবা করিয়া কোনই ফল পাওয়া গেল না, কবি এ রহস্যের সমাধান করিতে পারিতেছেন না।
কিন্তু কৃষ্ণ যতই বড় হউন না কেন, গোপী তাঁহার বিরাট্ রূপ দেখিতে চায় না, তাহারা তাহাকে পঞ্চ রসের মধ্য দিয়া দেখিতে চায়; মাতা রূপে তিনি যেমন আমারই মা, স্ত্রীরূপে তিনি যেমন আমারই স্ত্রী, সেই রূপ তিনি আমারই হইয়া আসিলে, আমি তাঁহার নাগাল পাইতে পারি। তিনি অণুর কাছে সম্পূর্ণরূপে অণু হইয়া ধরা দেন, ব্যবধান থাকিলে গলাগলি ভাব হয় না, বৈষ্ণব প্রেমের আদর্শ ছোট ও খর্ব্ব হইয়া যায়।
চণ্ডীদাস বলিয়াছেন,
‘‘তোমারই গরবে গরবিনী হাম, রূপসী তোমার রূপে’’
এই ছত্র কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার তন্ময়ত্ব-জ্ঞাপক। তাঁহার রূপ, গুণ, সকলই কৃষ্ণ হইতে পাওয়া। অগ্নির সঙ্গে তাপের, চন্দ্রের সহিত জ্যোৎস্নার পরস্পরে যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের তাহাই; রাধা কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি।
রূপের স্পৃহা, দেহের সঙ্গ-সুখ, বাহিরের সেবা-স্তুতি, হোম, যাগ, যজ্ঞ, বৈধী ভক্তির সমস্ত আয়োজন মাথুরে লুপ্ত। জগন্নাথ বিগ্রহ অত্যাচারীরা ভাঙ্গিয়া দিয়াছে। কাশীর বিশ্বনাথ আজ অপহৃত। এখন প্রত্যুষে উঠিয়া বন্দীরা সুললিত স্বরে কাহাকে জাগাইবে, কাহার জন্য প্রভাতী গান গাহিবে? ছত্রধারিণী, তাম্বুল বাহিকা, ব্যজনকারিণীরা কাহার সেবায় নিযুক্ত হইবে? দেবভোগ রাঁধিবার জন্য সূপকারেরা আর কেন আয়োজন করিবে? মালীরা শত শত মালা হাতে লইয়া স্তব্ধ হইয়া আছে। মন্দির আর নাই—যজ্ঞকুণ্ড নাই, হোমাগ্নি নিবিয়া গিয়াছে।
তবে কি মাথুরে গোপীপ্রেমের পরিসমাপ্তি, এখন কি শুধু আক্ষেপোক্তি ও অশ্রুতেই গোপীপ্রেম পর্য্যবসিত হইল? ক্রূরতার অবতার অক্রূর আসিয়া কি এই ভাবেই বৃন্দাবনের প্রেমের হাট ভাঙ্গিয়া দিয়া গেলেন? শাস্ত্রে অবশ্যই এ কথা লিখিত আছে, মথুরা হইতে কৃষ্ণ আর ফিরিয়া আসেন নাই। কিন্তু বাঙ্গালীরা কৃষ্ণের মথুরা যাওয়া অস্বীকার করিয়াছেন। তাঁহাদের মতে কৃষ্ণ “বৃন্দাবন পরিত্যজ্য পাদমেকং ন গচ্ছতি”। “মাথুর” তাঁহাদের মতে বৃন্দাবনের নিত্যলীলায় প্রোষিত-ভর্ত্তৃকা রসাস্বাদের জন্য পরিকল্পিত। কৃষ্ণকমল লিখিয়াছেন,—
‘‘গোস্বামী-সিদ্ধান্ত মতে স্বয়ং ভগবান,
বৃন্দাবন ছাড়ি এক পদ নাহি যান।
তবে যে গোপিকার হয় এতই বিষাদ।
তার হেতু প্রোষিতভর্ত্তৃকা রসাস্বাদ।’’
মাথুরের পর শাস্ত্রানুসারে বৈষ্ণবদের সমস্ত কথা শেষ। প্রেমলীলার তাঁহাদের আর কিছু বলিবার থাকে নাই। যে ছেলেটি একটা বাঁশের আগা কাটিয়া বাঁশী বানাইত, নেংটির মত ধটি পরিত, বৃন্দাবনের মাঠে কুড়াইয়া পাওয়া ময়ুরের পালক মাথায় দিয়া গোয়াল-বালকদের মধ্যে রাজা সাজিত, বনে বনে ঘুরিয়া বনফুল ও গুঞ্জা ফলের মালা গাঁথিয়া গলায় পরিত এবং যশোদার হাতে ননী মাখন খাইত—সেই পাড়াগেঁয়ে মোড়লের ছেলে হঠাৎ আবু হোসেনের মত একদিনের মধ্যে সমস্ত মথুরামণ্ডলের রাজ্যটা পাইল। আর্য্যাবর্ত্তের মধ্যে এত বড় সাম্রাজ্য আর কোথাও ছিল না। যাহাকে বলাইদা একটা শিঙা ফুকাইয়া “কাক্কা কানাইয়া” বলিয়া ডাকিলে সে দাদার পিছনে পিছনে ছুটিত, সখাদের উচ্ছিষ্ট খাইত, সখারা দ্বন্দ্ব করিয়া যাহাকে লাথি মারিত কিংবা খেলার সময়ে ঘাড়ে চড়িয়া বসিত, যে গয়লা-মেয়েদের সঙ্গে লুকাচুরি খেলিত—সেই ছোঁড়াটা এখন রাজরাজেশ্বর—নয় মহাল পাড়ি দিয়া সপ্ততল অট্টালিকায় সে এখন বাস করে; শত শত রক্ষী সোণার লাঠী হাতে করিয়া তাহার মহালে মহালে পাহারা দেয়: ইন্দ্র, চন্দ্র, বরুণ, এমন কি ব্রহ্মাও তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিয়া এতেলা দিয়া প্রতীক্ষা করেন। বৃন্দা যখন কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল, তখন মথুরাবাসিনীরা টিটকারী দিয়া তাহাকে বলিয়াছিল—
‘‘সপ্ততল ঘর, উপরে সো বৈঠত, তাহা কাঁহে যাওব নারী’’
প্রভাস-যজ্ঞে নন্দ উপানন্দ, এমন কি স্বয়ং মা যশোদা দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া প্রহরীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হইয়া যাঁহার দরবারে প্রবেশের পথ খুঁজিয়া পান নাই, যাঁহার কথা বলিতে যাইয়া রাধিকা কাঁদিয়া বলিয়াছেন,
‘‘আমরা গ্রাম্য গোপবালিকা, সবহ পশুপালিকা,
আহিরিণী কুরূপিনী—আমরা কৃষ্ণসেবার কিবা জানি।
মথুরানগর-যোষিতা, সবহ তারা পণ্ডিতা,
তারা রূপ-গুণে বেঁধেছে গো,
এই রাজকুল সম্ভবা ষড়-রসজ্ঞা মথুরাবাসিনীদের দ্বারা তিনি বেষ্টিতা।
‘‘তাবৎ অলি গুঞ্জরে, যাই ফুল ধুতুরে,
যাবৎ মালতী নাহি ফুটে’’
এখন আর তিনি এখানে ফিরিবেন কেন?
সুতরাং মাথুর পালার পরে রাধাকৃষ্ণ লীলার সম্পূর্ণ ছেদ হইবার কথা।
কিন্তু এদেশে মহাপ্রভু লীলা করিয়া গিয়াছেন। তৎপূর্ব্বে মাধবেন্দ্র পুরী প্রেমের সেই রাজরাজেশ্বরের মধুকর ডিঙ্গার জন্য খাত কাটিয়া গিয়াছিলেন। এখানে ব্রজের নাম “নিত্য বৃন্দাবন,” কৃষ্ণলীলার এখানে অন্ত স্বীকৃত হয় নাই। শাস্ত্র মানিয়া যেখানে অন্যান্য দেশের বৈষ্ণবেরা সম্পূর্ণ বিরাম-চিহ্ন দিয়াছিলেন, বাঙ্গালী তাহা মানিয়া লইল না।
এখানে বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস “ভাব-সম্মেলন” নামক মাথুরের পরে আর একটা অধ্যায়ের সৃষ্টি করিয়া পূজার ঘরের হোমানল জ্বালাইয়া রাখিলেন। এই আহিতাগ্নিকদের পবিত্র অগ্নির নির্ব্বাণ নাই। রাধিকা দেহ-সম্বন্ধ-বিচ্যূত হইয়া চিন্ময় রূপে ভগবানকে ফিরিয়া পাইলেন, ইহাই “ভাবসম্মেলন”। পূর্ব্বে শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ড ও মদনকুঞ্জের নিকটে গেলে কৃষ্ণকে পাওয়া যাইত, “যাঁহা ধেনু সব করতহি রব” সেই গোষ্ঠের পথে নীপতরুমূলে সখাদের মধ্যে তাহাকে পাওয়া যাইত, দ্বাদশ বনের উপান্তে যমুনাতীরের পুষ্পকুঞ্জে তাঁহার বিলাস হইত, আজ সে দিন ফুরাইয়াছে,
আজ “ব্রজকুল আকুল, দুকুল কলরব,
কানু কানু করি ঝুর।
আজ যশোবতী নন্দ, অন্ধসম বৈঠত,
কোকিলা না করতহি গান।
কুসুম ত্যজিয়া অলি ক্ষিতিতলে লুটই–
তরুগণ মলিন সমান।”
আজ সখাগণ, ধেনুগণ বেণুরব ভুলিতে চলিয়াছে; কারণ তাহাদের অকস্মাৎ বিপদে মূহ্যমান বিমূঢ় চিত্ত হইতে সেই সুখস্বপ্নের স্মৃতিটুকুও মুছিয়া যাইতেছে। আজ,—
“শীতল যমুনা জল, অনল সমান ভেল”
এবং গোপীরা সর্ব্বস্বহারা হইয়া যেথা সেথা পড়িয়া আছে—
“বিপথে পড়ল বৈছে মালতী মালা”
আজ,—
“অতি শীতল মলয়ানিল মন্দ মধুর-বহনা”
তাহাদের স্পর্শ করিয়া প্রদাহের উৎপত্তি করিতেছে। আজ রাধা কৃষ্ণ-রঙ্গ-রস-জনিত নূতন আনন্দ সবে আস্বাদ করিতে যাইতেছিলেন,—প্রতিপদের চাঁদের রেখা যেরূপ বহু আশা দিয়া তিরোহিত হয়, সেইরূপ তাঁহার সমস্ত সুখ সম্ভাবনার স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া গিয়াছে,—
“প্রতিপদ চাঁদ উদয় যৈছে যামিনী, সুখ নব ভৈগেল নিরাশা”
তখন রাধা বলিতেছেন—
“আমি হরি-লালসে পরাণ ত্যজব, তায়ে পাওব আন জনমে।”
এ জনমে তো পাইলাম না, তাঁকে কামনা করিয়া মরিব, হয়ত অন্য জন্মে তাঁহার সঙ্গে মিলন হইবে।
মাথুরের অনেক গানের উপর পরবর্ত্তী কবিরা তুলি ধরিয়া, রং ফলাইয়া, মাথুর লীলায় অপূর্ব্ব কারুণ্য ঢালিয়া দিয়াছেন। শ্রোতারা মাথুর গানে কাঁদিয়া বিভোর হন; কারণ ভগবানের সঙ্গে বিচ্ছেদ—শিবের সঙ্গে জীবের বিরহ, ইহা হইতে মর্ম্মান্তিক আর কি হইতে পারে? যাঁহাকে খুঁজিতে যাইয়া জন্মে জন্মে কেবলই ভুল করিয়াছি, বিশ্বতরু-ভ্রমে সেওড়া গাছের তলায় নৈবেদ্য সাজাইয়া ভূত-প্রেতের অত্যাচার সহ্য করিয়াছি, কাঞ্চন-ভ্রমে কাচের সন্ধান করিয়া মরিয়াছি, চন্দন-তরু-ভ্রমে কণ্টক-লতা আলিঙ্গন করিয়া জর্জ্জরিত হইয়াছি—সেই সার্ব্বকালীন লক্ষ্যের একতম লক্ষ্য, সকল আনন্দের সেরা আনন্দ, সকল আশ্রয়ের শেষ আশ্রয় ভগবানকে পাইয়া, তাঁহাকে হারানো, এ যে কত বড় কষ্ট,তাহা বৈষ্ণব কবিরা অশ্রুর অক্ষরে লিখিয়া রাখিয়াছেন।
মাথুরের আর একটি গান, এখানে উদ্ধৃত করিব—
‘‘শীতল তছু অঙ্গ পরশ-রস-লালসে,
করিলু ধরম-গুণ নাশে।
সে যদি মোহে তেজল, কি কাজ ছায় জীবনে
আনহ সখি গরল করু গ্রাসে।
প্রাণাধিকা লো সজনি কাঁহে তোরা রোয়সি,
মরিলে তোরা করবি এক কাজে।
আমায় নীরে নাহি ডারবি, অনলে নাহি দাহবি,
রাখবি তনু এই ব্রজমাঝে।
হামারি দুন বাহু ধরি, সুদৃঢ় করি বাঁধবি,
শ্যাম-রুচি-তরু-তমাল-ডালে।
প্রতি দিবস শর্ব্বরী, অবশি সেথা আসবি,
সময় বুঝি তোরা সকলে মিলে।
(হামারি) ললাট-হৃদি-বাহুমুলে শ্যাম-নাম লিখবি,
তুলসী-দাম দেওবি গলে।
(হামারি) শ্রবণ মূলে শ্যাম নাম কহবি।” ইত্যাদি,
এই সকল গানে সাধারণ নায়ক-নায়িকার রাজ্য ছাড়িয়া প্রেম অধ্যাত্ম জগৎ ছুঁইয়াছে এবং বৈষ্ণবের ঈপ্সিত মৃত্যুর দিকে স্পষ্ট করিয়া ইশারা করিতেছে। ললাট, হৃদি, বাহুমূলে কৃষ্ণ-নামের ছাপ, গলায় তুলসীমালা দেওয়া ও মৃত্যুকালে কৃষ্ণনাম শোনা, ইহা তো মুমূর্ষ বৈষ্ণবেরই শেষ ইচ্ছা। কিন্তু অধ্যাত্মতত্ত্ব এখানে ধর্ম্মের জটিল রূপ ধরিয়া দেখা দেয় নাই, অতি শ্রুতিমধুর মর্ম্মস্পর্শী কবিত্বের অক্ষরে ইহার প্রকাশ। এজন্য একদিকে সাধক, অপর দিকে সাধারণ পাঠক তুল্যরূপে ইহা উপভোগ করিয়া থাকেন। মনোহর-সাই রাগিণীতে এই সকল গীতি যে কিরূপ হৃদয়গ্রাহী হয়, তাহার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে।
বৈষ্ণব কবিরা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের লোক, তথাপি জনসাধারণই তাঁহাদের লক্ষ্য। খুব উচ্চ স্থান হইতে যেরূপ নিম্ন স্থান দেখা যায়, তাঁহারা সেইরূপ পরমার্থ-প্রেমের উর্দ্ধলোক হইতে জগতের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াছেন। এই উদার দৃষ্টির গুণে অজ্ঞ জনসাধারণ তাঁহাদের কাব্যরসের উপভোগ হইতে বঞ্চিত হয় নাই। অথচ ইহা খুব আশ্চর্য্যের বিষয় যে, যুগযুগান্তর ব্যাপক দর্শন ও অপরাপর শাস্ত্র-চর্চ্চার গুণেই হউক, কিংবা চৈতন্য প্রভুর অপূর্ব্ব প্রেমোম্মাদনার প্রেরণার দরুণই হউক, অথবা ফকির, দরবেশ, বাউল, সহজিয়া গুরু, কথকঠাকুর প্রভৃতি লোক-শিক্ষকদের সহিত অবিরত সংস্পর্শের ফলেই হউক, বঙ্গের সমস্ত বায়ুস্তরে একটা উচ্চ চিন্তার প্রবাহ বিদ্যমান,—বাঙালার মূর্খ চাষার হৃদয়েও ফল্গু নদীর মত একটা প্রগাঢ় মর্ম্মানুভূতি ও রসধারা খেলা করে, তাহা অপর দেশের শিক্ষিতদের মধ্যেও দুর্ল্লভ। এখানে এই নিম্নশ্রেণীর লোকদিগকে আমরা এক হিসাবে শিক্ষিতই বলিব। তাহারা অনেক সময় নিরক্ষর হইলেও, অশিক্ষিত বলিয়া উপেক্ষিত হইবার যোগ্য নহে। যুগ-যুগের শিক্ষা তাহাদিগকে শিখাইয়াছে—কানুপাদ প্রভৃতি সহজিয়ারা তাহাদিগকে গুহ্য তত্ত্ব শিখাইয়াছেন, বঙ্গের নৈয়ায়িকেরা তাহাদিগকে শিখাইয়েছেন; এমন কি হটযোগী তান্ত্রিকেরা তাহাদিগকে যতটা শিখাইয়াছে, এখনকার উচ্চ-শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনেকে তাহা শিখেন নাই।
এই সুচিরাগত সংষ্কার ও ভাবপ্রবণতার গুণে বাঙালার জনসাধারণ কীর্ত্তনগুলিকে সমন্ত হৃদয় দিয়া গ্রহণ করিয়াছে। ইহা এক অভাবনীয় কাণ্ড। তাহারা গানগুলির মধ্যে সময়ে সময়ে এরূপ সকল ‘আখর’ দিয়া থাকে, যাহাতে সেগুলি অপূর্ব্বভাবে রূপায়িত হইয়া মর্ম্মান্তিক কারুণ্য-পূর্ণ হইয়া উঠে। যেখানে রাধিকা বলিতেছেন (পূর্ব্বোদ্ধৃত গানটি দেখুন) “রাখবি তনু এই ব্রজ মাঝে”, মূর্খ গায়েণ আখর দিয়া গাইল “আমার ব্রজ ছাড়া করিস্ নারে—আমি ব্রজ বড় ভালবাসি, ব্রজে পদরজঃ আছে”—এইরূপ “নীরে নাহি ডারবি” ও “অনলে নাহি দাহবি”, এই দুই পদের পরে আখর দিয়া গায়, “আমার আর জলে ভাসাস্ না, আমি সদা নয়ন-জলে ভাসি সখি,—আমায় আর পোড়াস্ নাগো সই—আমি বিরহ-আগুনে পোড়া” ইত্যাদি।
যেখানে তমাল-ডালে বাঁধিয়া রাখার কথা আছে, সেখানে গায়েন আখর দিয়া দস্তুর-মত একটি পদ রচনা করিয়া উহার ব্যাখ্যা করিয়াছে—
‘‘যদি আসিয়া সই, বঁধু শুধায় রাই কই,
তখন তোরা বলিস্ তারে—তোমার বিরহে রাই মরেছে,—
আমরা ফেলি নাই, ওই তমাল-ডালে বাঁধা আছে—
সে যে তোমারে দেখাবার লাগি।
যদি হা-রাধে, হা-রাধে করি’, বধুঁ উঠে ফুকরি’,
তবে আমার সেই মৃত তনু বঁধুর চরণেতে দিও ডালি।’’
রায়-শেখরের পদটির এই ভাষ্য মূর্খ গায়েন করিয়াছে। তাহাকে অবশ্য কবির কাব্যের উৎকৃষ্ট বোদ্ধা বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। অবশ্য এই পদ ও আখর কীর্ত্তনিয়ার মুখে না শুনিলে, ইহার সৌন্দর্য্য সমগ্রভাবে ধরা পড়িবে না।
কৃষ্ণ মথুরায় যাইয়া সব ভুলিয়াছেন। কিন্তু গোপীকে যত বড় ঐশ্বর্য্যের কথাই শুনাও না কেন, সে ভুলিবার পাত্র নহে। সে শুধু প্রাণকেই বড় বলিয়া জানে, ধন-মান তাহার কাছে নগণ্য। ঐশ্বর্য্যের সঙ্গে মাধুর্য্যের প্রভেদ দেখাইবার জন্যই বৈষ্ণব কবির মাথুরের পরিকল্পনা। মথুরাবাসিনীর দর্পের উত্তর গোপী ঝঙ্কার দিয়া বলিতেছে “কিসের বড়াই করিস্ মথুরাবাসিনি! তোদের মণি মুক্ত-জহরৎ–—এসকলের মধ্যে ব্রজের একটা ধূলি-রেণুরও দাম নাই।”
এইজন্যই সেই ধূলির জন্য সমন্ত ভারতবর্ষ বৃন্দাবনের দিকে ছুটিয়াছে, তাহারা মথুরার ঐশ্বর্য্য দেখিতে চায় না। এই রেণুর উপর শত শত মঠ, অট্টালিকা—(তাহাদের শীর্ষে সোণার কলস) উঠিয়াছে। আরও কতকাল ধরিয়া উঠিবে কে জানে! সেখানে যে প্রাণ-বঁধুর পদরজঃ আছে, তার চেয়ে মূল্য কাহার বেশী? কৃষ্ণ যখন তাঁহার সপ্ততল মন্দিরের চূড় হইতে গোপীমুখারবিন্দনিঃসৃত “জয় রাধে, শ্রীরাধে” বাণী শুনিলেন, তখন তিনি দ্রুতগতিতে নীচে ছুটিয়া আসিলেন—তাঁহার রাজদণ্ড, রাজপরিচ্ছদ, রাজমুকুট কোথায় পড়িয়া রহিল? তিনি পাগলের মত ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া বলিলেন “এ নাম কে শুনালে? মথুরার লোক তো সে নাম জানে না, তাহারা তো যশ-মান-ধনের কাঙ্গাল, তাহারা তো ও নাম জানে না! কে এই উষর মরুভূমির মধ্যে আমার কাণে অমৃত-তুল্য নাম শুনালে?” তখন তাঁহার ধড়া পরিবার অবকাশ হ’ল না, এক পায়ে পায়জামা অপর পায়ে ধড়ার অংশ, এক হাতে রাজদণ্ড, অপর হাত বাঁশী খুজিতেছে। উম্মত্ত বেশে তিনি রাধার কাছে যাইতে ছুটিয়াছেন।
রাধা সখীদের মধ্যে কৃষ্ণ জয়ন্ময় ‘রাধা’ দেখিতেছেন, রাধাভাবে তিনি উদভ্রান্ত। পুরাণে কথিত আছে, এইরূপ ভাবাবেশে প্রহ্লাদ ব্যাঘ্রের গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিয়াছিলেন, “তুমি কি আমার পদ্ম-পলাশ-লোচন হরি?” কৃষ্ণ ললিতা সখীকে ধরিয়া উন্মত্ত ভাবে বলিলেন, “কই কই, প্রেমময়ি! পরশিয়ে অঙ্গ শীতল হই—আমি জ্বলে যে আছি, বহুদিন না দেখিয়ে আমি জ্বলে যে আছি”। ললিতা হাসিয়া, সরিয়া গিয়া বলিল, “এ কি কহে বঁধু, তুমি কারে বলি’ কারে ধরহে বঁধু! আমি তোমার রাই নই, আমি ললিতা, তোমার প্রেমময়ী রাই দাঁড়িয়ে ওই,—বঁধু, চোখে লেগেছে কি রাই-রূপের ধাঁধা, তাই জগৎ ভরে’ দেখছ রাধা-রাধা!” কৃষ্ণ পাগলের মত “কই কই প্রেমময়ী” বলিতে বলিতে পুনরায় সুদেবীকে ধরিলেন, সে হাসিয়া সরিয়া যাইতে যাইতে বলিল, “এ কি করহে বঁধূ, তুমি কারে বলি’ কারে ধর হে বঁধু! আমি রাই নই, আমি সুদেবী, তোমার প্রেমময়ী রাই দাঁড়িয়ে ওই—বঁধু সবে ঘোরে তেমার চক্রে, তুমি ঘোর বঁধু রাধা-চক্রে।”
এই সকল ভাব কৃষ্ণকমল মহাপ্রভুর বিভ্রান্ত প্রেমলীলা হইতে সঙ্কলন করিয়াছিলেন। পূর্ব্বোক্ত পদে সত্যই কৃষ্ণ জগন্ময় রাধা দেখিয়া ছিলেন—সে কথা ললিতা বলিয়াছিল। সত্যই তিনি উন্মত্তবৎ রাধাচক্রে পড়িয়া দিশেহারা হইয়াছিলেন—সে কথা সুদেবী বলিয়াছিল। তাহারা কৃষ্ণের এই প্রেম-তন্ময়তা বুঝিতে পারিয়াছিল; কিন্তু এখনকার রুচিবিদ্গণ এই পদে শ্লীলতার অভাব দেখিয়া লজ্জিত। এইরূপে সম্পূর্ণ বিদেশী ভাবের আয়ত্ত হওয়াতে যাঁহাদের স্বরূপ নিলাম হইয়া গিয়াছে, তাঁহারা বৈষ্ণবপদতীর্থে প্রবেশের অনধিকারী, “পড়িলে ভেড়ার শৃঙ্গে, ভাঙ্গে হীরার ধার”।
আমি পূর্ব্বে যে প্রশ্নের উত্থাপন করিয়াছি, এখন পর্য্যন্ত তাহার উত্তর দেওয়া হয় নাই। কৃষ্ণ তো মথুরায় গেলেন, এইখানে কি মাথুর-লীলার পরিসমাপ্তি? তিনি কি সত্যই চিরদিনের জন্য প্রেমের হাঠ ভাঙ্গিয়া গেলেন? আমি বলিয়াছি, বৈষ্ণবেরা কৃষ্ণ-লীলার শেষ স্বীকার করেন নাই। মন্দিরের ভিত্ ধ্বসিয়া পড়িল, বিগ্রহ অপহৃত, সিংহাসন শূন্য হইয়া রহিল। কিন্তু যাহা বাহিরে ছিল, সেই অন্তরের ধনকে ভক্ত অন্তরে কুড়াইয়া পাইল। তাঁহার রূপ তাহারা নয়নে গাথিয়া রাখিল, হৃদয়নাথকে হৃদয়ের অন্তঃপুরে শত দ্বার দিয়া আমন্ত্রণ করিয়া আনিল। তাহারা একথা বলিল না যে, কৃষ্ণ চিরদিনের জন্য বৃন্দাবন ছাড়িয়া গিয়াছেন, বিদ্যাপতির রাধা বলিলেন,
‘‘যব হরি আওব গোকুল-পুর
ঘরে ঘরে নগরে বাজব জয়-তুর।’’
বৃন্দাবনে তিনি ফিরিয়া আসিবেন, রাধা নিজের হৃদয়ে তাহার পূর্ব্বাভাস উপলব্ধি করিয়াছেন। এবার বিজয়-বাজনা (জয়-তুর) বাজাইয়া তাঁহাকে বরণ করিবার সময় হইয়াছে। কিন্তু এবার সমস্ত আয়োজনসম্ভার মানসীপূজার উপকরণ।
‘‘পিয়া যব আয়ব এ মঝু-গেহে,
মঙ্গল আচার করব নিজ দেহে।’’
তিনি আসিবেন, কিন্তু বর্হিদ্বার দিয়া আসিবেন না,—এই দেহই শ্রীমন্দির হইবে, “human body is the highest temple of God”. মঙ্গলাচরণ সমস্তই দেহে করিতে হইবে। বিদেহী, চিন্ময় কৃষ্ণ হৃদয়ে আসিতেছন,
‘‘বেদী করব হাম আপন অঙ্গমে।
ঝাড়ু করব তাহে চিকুর বিছানে।’’
আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়া তাঁহার বেদী রচনা করিব এবং আমার আলুলায়িত কুন্তল দিয়া সম্মার্জ্জনী তৈরী করিয়া তাঁহার পথ পরিষ্কার করিব। আর,
‘‘আলিপনা দেয়ব মতিম হার,
মঙ্গল-কলস করব কুচভার।’’
আমার কণ্ঠ-বিলম্বিত সুদীর্ঘ মুক্তার হারই আলিপনা-স্বরূপ হইবে, বাহিরের আঙ্গিনায় আলিপনা দেওয়ার প্রয়োজন নাই। বহির্দ্বারে তাঁহার সম্বর্দ্ধনার্থ মঙ্গল-ঘট স্থাপন করার দরকার নাই, আমার স্তন-যুগ্মই মঙ্গল-ঘট স্বরূপ হইবে।
যাঁহাকে রাধা বাহিরে পাইয়াছিলেন, চক্ষু বুজিলে তো তাঁহাকে দেখা যাইত না, তিনি না আসিলে তো তাঁহাকে পাওয়া যাইত না; সুতরাং একবার মনে হইত, তিনি মুঠার মধ্যে, পুনরায় তাঁহার সঙ্গে বিরহ হইত, পাছে প্রেম ভাঙ্গে, এই ভয়ে মান হইত। কিন্তু আজ যাঁহাকে তিনি পাইলেন, তিনি যেমনই বাহিরে, তেমনই ভিতরে; তাঁহাকে চক্ষু মেলিয়া বিশ্বে স্বপ্রকাশরূপে দেখা যায় এবং চক্ষু বুজিয়া ধ্যান-ধারণার মধ্যেও তেমন পাওয়া যায়। আজ খণ্ডিতা-বিপ্রলব্ধা ও কলহারিন্তরাতার পালা শেষ, আজ মাথুরের মম্মান্তিক কষ্ট আর নাই। এই ভাঙ্গা-গড়ার অতীত, সর্ব্বপ্রকার চাঞ্চল্যমুক্ত পূর্ণানন্দস্বরূপকে তিনি অখণ্ডভাবে পাইলেন, তাই বিদ্যাপতির রাধা হর্ষোচ্ছ্বাসে গাহিলেন,
‘‘আজ রজনী হাম ভাগে পোহাইনু,
পেখুন পিয়া-মুখ-চন্দ—”
“আজ মঝু দেহ, দেহ করি মানিনু,
আজ মন্তু দেহ ভেল দেহ।’’
আজ সমস্ত সন্দেহ দূর হইল, মান-অভিমানের পালার উপর যবনিকাপাত, আজ নির্দ্বন্দ্বভাবে তাঁহাকে পাইয়াছি,
‘‘আজ বিহি মোহে, অনুকূল হোয়ল টুটল সবহি সন্দেহ’’
সুতরাং
‘‘সোহি কোকিল অব লাখ ডাকয়ু, লাখ উদর করু চন্দ,
পাঁচ বাণ অব লাখবান হউ, মলয় পবন বহু মন্দ।’’
তখন একটা কোকিল ডাকিলে রাধিকা অস্থির হইয়া পড়িতেন, আজ এই শুভ মিলনরাত্রে লাখ বার কোকিল ডাকুক; পূর্ব্বে কামদেবের একটি সায়ক, আকাশে একটি চন্দ্রের আবির্ভাব হইলে “তব কুসুম শরত্বং শীতরশ্মিত্বমিন্দোঃ” রাধার পক্ষে অযথার্থ হইত, ইন্দুময়ুখে অগ্নির জ্বালা উৎপন্ন করিত, পঞ্চবাণ বজ্রসারের মত ঠেকিত, আজ পাঁচবাণ স্থলে লক্ষবাণ পড়ুক, এক চন্দ্রের স্থলে লক্ষ চন্দ্র উদিত হউক, আজ যে শুভ মিলন-রাত্রি। কিছু পূর্ব্বে চণ্ডীদাস এইরূপ উপলক্ষে লিখিয়াছিলেন,
‘‘এখন গগনে উদয় করুক চন্দ,
মলয় পবন বহুক মন্দ,
কোকিলা আসিয়া করুক গান,
ভ্রমরা ধরুক মধুর তান।’’
চণ্ডীদারে এই সরল সুন্দর পদটি লইয়া বিদ্যাপতি তার উপর রং ফলাইতে চেষ্টা করিয়াছেন।
রাধার অবস্থা কৃষ্ণ-বিচ্ছেদে বর্ণনা করিতে যাইয়া কবি লিখিয়াছেন, “নয়নক সিঁদ গেও, বয়ানক হাস”—“ধরণী ধরিয়া ধনী কত বেরি বৈঠত, পুনতহি উঠই না পারা। কাতর দিঠি করি, চৌদিশ হেরি হেরি, নয়নে গলতি জল ধারা”—এই আসন্ন-মৃত্যু রাধা বিরহের নানা চক্রে, নানা দশায় পড়িয়া ‘আধতনু কালিন্দী-নীরে,’ অবস্থায় পৌছিয়াছিলেন–এইখানেই মাথুর ভাবের শেষ; কিন্তু বিরহে পুড়িয়া যে ছাই রহিল, গল্প-কথিত ফিনিক্সের মত তাহা হইতে রাধার হৃদয়ে কৃষ্ণপ্রেম নূতন অবয়ব ধরিয়া জন্ম পাইল। বাহিরে হারাইয়া তিনি তাহাকে মনের মধ্যে পাইলেন—ইহাই “ভাব-সম্মেলন”—বঙ্গীয় প্রেম-বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ কথা—নূতন আবিষ্কার।
কৃষ্ণ এইরূপে নূতনভাবে তাহার মনের বৃন্দাবনে আসিবেন, সেখানকার রাধাকুণ্ড, কামকুণ্ড, দ্বাদশবন ও শ্যামকুণ্ড, সকলই মনের, সে বৃন্দাবনের নাম নিত্য বৃন্দাবন—সেখানে কিছু হারায় না, তাহা পাওয়ার দেশ। সখীরা বিলাপ করিতেছিল, কিন্তু অকস্মাৎ রাধা মনে পুলক অনুভব করিলেন, হঠাৎ দূরাগত বংশী-রবের মত কে যেন মনের কাণে কাণে একটা শুভ সংবাদ দিয়া গেল। সে সংবাদ-বাহককে রাধা চিনেন না, তথাপি তাহা বিশ্বাস করিলেন। রাধা সখীদেরে ডাকিয়া বলিলেন,
‘‘আজ কুদিন সুদিন ভেল,
আজ মাধব মন্দিরে আওব তুরিতে, কপাল কহিয়া গেল।’’
রাধার চিত্ত হর্ষে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল—কৃষ্ণ আসিবেন, কে বলিল! রাধা বলিলেন “কপাল কহিয়া গেল”—আমার কপাল, আমার ভাগ্যলক্ষ্মী বলিয়া গেলেন। আমি অভ্রান্ত ভাবে আমার সে সৌভাগ্য বুঝিয়াছি। বহুদিন পরে
‘‘আমার চিকুর ফুরিছে, বসন খসিছে, পুলক যৌবন-ভার।
বাম অঙ্গ আঁখি, সঘনে নাচিছে, দুলিছে হিয়ার হার।’’
কোন দূত বা সংবাদবাহক বলিয়া যায় নাই; বাঁশী আমাকে ‘রাধা’ বলিয়া ডাকে নাই, এই কথা কোন বাহিরের সূত্র হইতে পাই নাই, আমি তাঁহার পদের নূপুর-সিঞ্জনের মধুর শব্দ শুনি নাই—কিন্তু তথাপি বুঝিয়াছি তিনি আসিতেছেন; নতুবা আমার বেণী-মুক্ত কুন্তল হঠাৎ মহাহ্লাদের সাড়া দিয়া উঠিবে কেন? আমার সুখ-রোমাঞ্চিত দেহ হইতে অঞ্চল বারংবার স্খলিত হইয়া পড়িতেছে কেন? আমার বিরহ-খিন্ন উপবাস ও জাগরণ-ক্লিষ্ট শরীর নব যৌবনের পুলকে অধীর হইয়া উঠিবে কেন? বাম অঙ্গ ও আঁখির নর্ত্তনেও সেই কথা বুঝাইতেছে। আজ সেই আনন্দের ঢেউ লাগিয়া হৃদয়ের স্পন্দনের সহিত বক্ষবিলম্বিত মুক্তাহার দুলিয়া উঠিতেছে।
নিত্যই তো প্রাতঃকালে গাছে গাছে কাকগণ কোলাহল করিয়া আহার বাঁটিয়া খায়; বিদ্যাপতি লিখিয়াছেন “কান্ত কাক-মুখে নাহি সংবাদই।” পুরাকালে দূরগত স্বামীর বিরহে কাতরা রমণীরা হাত জোড় করিয়া কাকের কাছে শত শত বার স্বামীর শুভাশুভ-বার্ত্তা জিজ্ঞাসা করিতেন। কাকের কি রবের কি অর্থ, তাহা কাক-চরিত্রে লিখিত আছে। রাধাও প্রতিদিন কত কি জিজ্ঞাসা করিতেন। কিন্তু আজ “পিয়া আসিবার নাম শুনাইতে, উড়িয়া বসিল তায়” কাক শুভস্বর করিয়া আমার নিকটে উড়িয়া আসিল।
আজ “মুখের তাম্বুল খসিয়া পড়িছে, দেবের মাথার ফুল”—অহেতুক আনন্দে কার সোহাগে মুখের চর্ব্বিত তাম্বুল খসিয়া পড়িয়াছে? শিবমন্দিরে প্রণাম করিতে যাইয়া, হঠাৎ শিবের মাথার আশীর্ব্বাদী ফুল আমার হাতে আসিয়া পড়িল।
এই সুলক্ষণগুলি বহুদিনের অনাস্বাদিত-সুখের, অপূর্ব্ব-প্রাপ্তির আনন্দের নিশ্চিত সূচক। রাধার অন্তরের দেবতা তাঁহাকে এইভাবে সে সুখ সংবাদ দিলেন, কৃষ্ণ সত্যই আসিবেন।
কত বার তিনি তমাল-তরুকে কৃষ্ণ-ভ্রমে শিহরিত রোমাঞ্চিত দেহে দাঁড়াইয়া সখীকে বলিয়াছিলেন,
‘‘আমার কেন অঙ্গ হৈল ভারি।
আমি যে আর চল্তে নারি।’’
রাধাকে আশ্বাস দিতে যাইয়া সখীরা বলিয়াছেন, কৃষ্ণ সত্যই আসিয়াছেন। সে ভ্রম ঘুচিলে, রাধা “পেয়ে নিধি হারাইলাম” বলিয়া কাঁদিয়াছেন এবং বলিয়াছেন, “তোরা তো ঠিকই বলেছিলি কৃষ্ণ এসেছিলেন, কিন্তু “আমার ভাগ্যে তমাল হ’ল।” কত দিন মেঘকে কৃষ্ণ ভ্রম করিয়া অহেতুক পুলকে তিনি হৃষ্টা হইয়াছেন, কত প্রলাপোক্তি করিয়াছেন, আজ কৃষ্ণকে দেখিয়াও বিশ্বাস করিতে পারিতেছেন না। কি জানি, আবার যদি তমাল বা মেঘ হইয়া যান!
উৎকট কুণ্ঠার সহিত দ্বিধাযুক্ত ভাবে রাধা সখীকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, কত বার তো তিনি ছলনা করিয়া নব মেঘ হইয়া গিয়াছেন—
কুঞ্জের দ্বারে ঐ কে দাঁড়ায়ে!
দেখ দেখ গো ও বিশাখে,
ওকি বারিধর কি গিরিধর, ওকি
নবীন মেঘের উদয় হ’ল।
নাকি মদন মোহন ঘরে এল!
ওকি ইন্দ্রধনু যায় দেখা—নব জলদের মাঝে,
নাকি চুড়ার উপর ময়ূর পাখা!
“ও কি বক শ্রেণী যায় চলে, নাকি মুক্তমালা দোলে গলে!
ওকি সৌদামিনী মেঘের গায়, নাকি পীত বসন দেখা যায়!
ওকি মেঘের গর্জ্জন শুনি, নাকি প্রাণনাথের বংশীধ্বনি।’’
আকাশে উড্ডীন বলাকা-পংক্তি দেখিয়া তিনি কত বার ভুল করিয়াছেন, উহা তাঁহার প্রাণনাথের গলার মুক্তামালা; মেঘের অঙ্গে স্ফূরিত বিদ্যুদ্দাম দেখিয়া মনে করিয়াছেন, উহা তাঁহার বঁধুর অঙ্গের পীতবসন। “সখীরা আজ তোরা ভাল করিয়া দেখিয়া আয়,—সত্যই কি তিনি আসিয়াছেন?”
ভাব-প্রবণতার প্রবল উচ্ছ্বাসে কাব্য উচ্ছৃঙ্খল হইয়া যায়, কবি উন্মত্ততার সম্মুখীন হন। রাধা আজ আনন্দ ও নিরানন্দের দ্বন্দ্বে সেই সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়াছেন, এই ভ্রান্তি মধুর ও কবিত্ব পূর্ণ।
কৃষ্ণকমল এই যে চিত্র আঁকিয়াছেন, তাহা তাঁহার শুধু কল্পনা-জাত নহে। আশ্চর্য্যের বিষয়, এই ভ্রান্তির সমন্তই বাস্তব হইতে পাওয়া। চৈতন্য “বিজনে আলিঙ্গই তরুণ তমাল”’—(“তমালের বৃক্ষ এক নিকটে দেখিয়া, কৃষ্ণ বলি’ তারে যেয়ে ধরে জড়াইয়া”)—এবং মেঘকে কৃষ্ণভ্রমে যে সকল কাতরোক্তি করিয়াছেন, তাহা চৈতন্যচরিতামৃতাদি পুস্তকে পাওয়া যায়। সেই চৈতন্যচরিতামৃতের শেষ অঙ্কের পাগল গোরাকে কৃষ্ণকমল এইভাবে কাব্যপটে ধরিয়া রাখিয়াছেন; এই চিত্র স্বপ্ন ও জাগরণের সন্ধিস্থলে; যাঁহারা ইহার আভাষ পাইয়াছেন, তাঁহারা সেই স্বপ্নই চাহিবেন, জাগরণ চাহিবেন না।
সমস্ত সন্দেহের নিরসন হইয়াছে, কৃষ্ণ সত্যই আসিয়াছেন, তখন রাধা বলিতেছেন:—
‘‘বহুদিন পরে বঁধুয়া আইলে। দেখা না হইত মরণ হ’লে।’’
চণ্ডীদাসের এই পদ বুঝাইতে যাইয়া কৃষ্ণকমল বলিয়াছেন:—
‘‘একবার আসিয়া সমক্ষে, দেখিলে স্বচক্ষে,
(জান্তে) কত দুঃখে রক্ষে করেছি জীবন।
ভাল ভাল বঁধু, ভাল তে আছিলে,
ভাল সময় এসে ভালই দেখা দিলে—
আর ক্ষণেক পরে এলে,—দেখা হ’ত না,
তোমার বিরহে সবার হ’ত যে মরণ।’’
চণ্ডীদাসের রাধা বলিতেছেন:—
‘‘দুঃখিনীর দিন দুঃখেতে গেল,
তুমি তো মথুরায় ছিলে হে ভাল।
আমার এতেক সহিল অবলা ব’লে,
ফাটিয়া যাইত পাষাণ হ’লে।’’
কোমল জিনিষ অনেক সহিতে পারে, আঘাতে ভাঙ্গে না, যেমন কাদা। যে প্রতিরোধ করিতে চায়, সে না পারিলে ভাঙ্গিয়া যায়, যেরূপ পাষাণ। আমি অবলা বলিয়াই, এত দুঃখ সহিয়া বাঁচিয়া আছি।
‘‘সে সকল কথা রহুক দূরে,
আজ মদনমোহনে পেয়েছি ঘরে।’’
যত দুঃখ পাইয়াছি, তাহা বলিবার দরকার নাই; বলিতে গেলে আনন্দের দিনে, উৎসবের গৃহে বঁধুর নিষ্ঠুরতার কথা ইঙ্গিতে আসিবে—এজন্য রাধা বলিতেছেন, সে প্রসঙ্গ এখন থাকুক। “দুঃখিনীর দিন দুঃখেতে গেল, মথুরা নগরে ছিলে তো ভাল।”
যিনি চক্ষুর পলকে আমায় হারাইতেন, তিনি এই যুগ-যুগ-ব্যাপী কাল আমাকে কিরূপে ভুলিয়া রহিলেন? তাঁহার ভালবাসা যেমন অসীম, নিষ্ঠুরতাও তেমনই অসীম। আজ আনন্দের দিনে সেই কথার উল্লেখের অবকাশ নাই। যেটুকু পাওয়া গিয়াছে, তাহার তিলমাত্র রসবিঘ্নকর কথার এখন অবকাশ নাই।
‘‘নেত্রপলকে যে নিন্দে বিধাতাকে,
এত ব্যাজে দেখা সাজে কি তাহাকে?
যাহৌক দেখা হ’ল, দুঃখ দূরে গেল,
এখন গত কথার আর নাই প্রয়োজন।”
এই ‘ভাব-সম্মেলনে’ কৃষ্ণের নিকট রাধা সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন। হৃদয়ের অর্গল বন্ধ করিয়া, তিনি মনোমন্দিরে একান্তে তাঁহাকে পাইয়া, যে-সকল মধুর কথা তাঁহাকে বলিয়াছেন, তাহা বৈদিক যাজ্ঞিকের হোমকুণ্ডের পার্শ্বে উচ্চারিত উপনিষদের মন্ত্র। “বধূ, তুমি আমার প্রাণ-স্বরূপ। আমি শুধু দেহ-মন নহি, আমার সমন্ত কুলশীল, অভিমান ও সংস্কার আজ তোমাকে সঁপিয়া দিলাম। তুমি অখিল ব্রাহ্মাণ্ডের অধিপতি, তা’ কি আমি জানি না। আমি তুচ্ছ গয়লার মেয়ে—“আহিয়িনী, কুরূপিণী, গ্রাম্য গোপবালিকা।” এই ইন্দ্রিয়-রূপ পশুগুলিকে পরিচর্য্যা করাই আমার কাজ, “আমরা সকলেই পশুপালিকা” “আমরা কৃষ্ণসেবার কিবা জানি?” তুমি যোগী ঋষির আরাধ্য—“যোগীজনাঃ জানন্তি”, আমি ভজন পূজনের কিবা জানি? কিন্তু আমার দেহ-মন সমস্তই তোমার প্রেম গঙ্গায় ভাসাইয়া দিয়াছি। তোমার পদচ্যুতা গঙ্গার ধারাটি শ্মশান সমান উষর মরুভূমিতে পথ হারাইয়া তোমার পদাশ্রয়ে ফিরিয়া আসিয়াছে। পড়শীরা আমাকে নাম ধরিয়া ডাকিতে ঘৃণা করে। তারা আমাকে ‘কলঙ্কিনী’ বলিয়া ডাকে। কিন্তু তাহাতে আমার দুঃখ নাই। তোমার নামের সঙ্গে আমার কলঙ্ক-কথার যোগে আমি গৌরব অনুভব করি। আমি সতী হই বা অসতী হই, তুমিই জান, আমি লোক-চর্চ্চা গ্রাহ্য করি না। আমি কি মন্দ, কি ভাল তাহা জানি না; আমার পাপ পুণ্য, ধর্ম্মাধর্ম্ম সকলই তোমার যুগল পাদপদ্ম।” পরমহংস দেবও ইহার উপরে কিছু বলেন নাই:—
বঁধু, তুমি সে আমার প্রাণ,
দেহ মন আদি, তোহারে সঁপেছি, জাতি-কুল-শীল-মান,
অখিলের নাথ, তুমি হে কালিয়া, যোগীর আরাধ্য ধন,
গোপ-গোয়ালিনী, হাম অতি দীনা, না জানি ভজন-পূজন।
কলঙ্কী বলিয়া ডাকে সব লোকে, তাহাতে নাহিক দুখ,
বঁধু, তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার গলায় পরিতে সুখ।
পীরিতি রসেতে ঢালি’ তনু মন, দিয়াছি তোমার পায়।
তুমি মোর গতি, তুমি মোর পতি, মন নাহি আন ভার।
সতী বা অসতী তোমাতে বিদিত, ভাল মন্দ নাহি জানি,
কহে চণ্ডীদাস পাপপুণ্য মম তোমার চরণ মানি।”
নিরিবিলি কৃষ্ণকে পাইয়া তিনি কত কথাই না বলিতেছেন,—তাহার প্রতিটি শব্দ, জীবনের অনন্ত দুঃখ, সখা-সঙ্গের অনন্ত আনন্দ কত মধুরাক্ষরা কথায়, কত মর্ম্মান্তিক কারুণ্যপূর্ণ অশ্রুধারায় ব্যক্ত হইতেছে। তিনি বলিতেছেন: “বঁধু, তোমায় আমি আর কি বলিব, তোমাকে আজ যেমন করিয়া পাইয়াছি, সেই প্রাণপতিরূপে যেন তোমার এই মহা অবদান—এই মানবজন্ম ফুরাইয়া না যায়। জীবনের প্রতি অঙ্কে, রস-রূপে, আনন্দময়-রূপে, বিধানকর্ত্তা-রূপে, স্নেহে-প্রেমে-সখ্যে—রক্ষক-রূপে—পালক-রূপে যেন সর্ব্বদা তোমাকে পাই, জীবনের সঙ্গি-স্বরূপ যেন তুমি প্রতি মুহূর্ত্ত আমার কাছে থে’ক এবং মৃত্যুকালে যেন তোমার মূর্ত্তি আমার ঊর্দ্ধগত নেত্র কণীনিকায় উজ্জ্বল হইয়া উঠে। জীবনে-মরণে তুমি আমার হইয়া আমার কাছে থে’ক। শুধু জীবনে-মরণে নহে, “জনমে-জনমে প্রাণনাথ হৈও তুমি।” তোমার সঙ্গে তো আমার এক জন্মের সম্বন্ধ নহে—এ সম্বন্ধ জন্ম জন্মের—কোন জন্মে যেন তোমার কাছ হইতে সংসার আমাকে ভুলাইয়া না লইয়া যায়। এই মরীচিকা-সঙ্কুল, প্রতারণার রাজ্যে অনেকেই আমাকে পথ ভুলাইতে আসিবে—রূপ, যশঃ, মান, ঐশ্বর্য্য তুমি ঘাটে ঘাটে রাখিয়াছ— আমার মনের বল ও অনুরাগ পরীক্ষা করিতে। কোন অশুভ মুহূর্ত্তে যেন তাহারা তোমাকে আড়াল করিয়া না দাঁড়ায়। রাধিকা বলিতেছেন—“হে জীবনধন, তুমি জীবনে আমার হইও, মরণে আমার হইও—জন্মে জন্মে আমার হইও। তোমার চরণ-পদ্মের সঙ্গে আমার প্রাণের একটা ফাঁসি লাগিয়া গিয়াছে,—যদি মুহূর্ত্তের জন্য চরণ সরাইয়া লইয়া যাও, তবে সেই প্রেমের ফাঁসীতে আমার প্রাণ যাইবে। তাই আমার সমস্ত তোমাকে নিবেদন করিয়া, এমন হইয়া আমি তোমার চরণের দাসী হইয়াছি। আমার একুলে—স্বামীর কুলে, ওকুলে পিতৃকুলে বৃষভানুর পুরীতে, দুকুলে—বৃন্দাবনে অবস্থিত এই দুকুলে আমার আর কে আছে? বিপথে গেলে কে আমায় উদ্ধার করিবে? বরং মায়ায় আবদ্ধ করিয়া তাহারা তোমার কাছ হইতে আমাকে দূরে লইয়া যায়। এই বিভ্রান্ত মায়াপুরী হইতে আমাকে কে রক্ষা করিবে?
“বঁধু! কি আর বলিব আমি
আমার জীবনে-মরণে মরণে-জীবনে প্রাণনাথ হৈও তুমি।
তোমার চরণে আমার পরাণে বাধিল প্রেমের ফাঁসি,
সব সমপিয়া, একমন হইয়া নিশ্চয় হইলাম দাসী।
আমার একুলে, ওকুলে, দু’কুলে গোকুলে, আর মোর কেবা আছে।
রাধা বলি কেহ শুধাইতে নাই, জানাব কাহার কাছে।”
এই ভাবে রাধা একেবারে নিঃস্ব ও নিরাশ্রয় হইয়া তাঁহার আশ্রয় লইয়াছেন। যে আশ্রয়ের পূর্ব্বসংস্কার তাঁহার ছিল, তাঁহার স্বামিকুল, পিতৃকুল—তাহা অস্বীকার করিয়া তিনি তাহা ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছেন। নিরাশ্রম নিরবলম্ব হইয়া, তিনি একমাত্র ভগবানকে আঁকড়াইয়া ধরিয়াছেন।
এ যেন পুষ্পতরু, মাটীকেই একমাত্র আশ্রয় মনে করিয়া, বহু শিকড় দ্বারা তাহাকে আকঁড়াইয়া ধরিয়াছে। তাহার উর্দ্ধে নীলাকাশ, শত শত পাখী কলবর করিয়া তথায় উড়িয়া যাইতেছে, কিন্তু তরু উড়িতে চাহিয়া জল ভিক্ষা করে না, তাহার দশদিকে কত পশু, জীব, মানব নান কাম্যবস্তুর লোভে ছুটাছুটি করিতেছে,—সেই দশ দিকের দশপথ সে দেখে না। সে যাহা আরাধনা করে, তাহা সমস্তই মাতৃক্রোড়ে বসিয়া, মাতার নিকট। এইভাবে সকল দিক্ হইতে মন সরাইয়া আনিয়া তাঁহাকে সমর্পণ করিলে এবং যোগীর মত আত্মস্থ, ধ্যানস্থ হইয়া তপস্য করিতে পারিলে, সর্ব্বসিদ্ধি-লাভ হয়। কাম্যের অধিক ফল অযাচিতভাবে আসিয়া হাতে পড়ে। যে মাটীর আপাত দৃষ্টিতে কোন বর্ণসম্পদই নাই—যাহা ঘ্রাণহীন ও নীরস, সেই মাটী হইতে বর্ণের সম্রাজ্ঞী পদ্মিনী ফুটিয়া উঠে কিরূপে? কোথা হইতে গোলাপ, মল্লিকা, বেলা, কুন্দ এত শোভা এত গন্ধ পায়? কোথা হইতে ফজলী ও নেংড়া আমের গাছ এবং খর্জ্জর তরু ও ইক্ষুলতা অফুরন্ত অমৃতরসে সমৃদ্ধ হয়? কোথা হইতে চন্দন তাহার সুবাস সংগ্রহ করে?—এই আত্মস্থ তপস্যার বলে। উহারা সংসারের নানাদিকের নানা প্রলোবনে আকৃষ্ট হয় নাই; উহারা বুঝিয়াছে জীব-মানবের গতিশীলতা ভুল পথে লইয়া যায়। তাহারা বুঝিয়াছে, যিনি চারিদিকে এত সম্পদের সৃষ্টি করিয়া বিশ্ব-চরাচরে ঝলমল করিয়া প্রকাশ পাইয়াছেন, তিনি এই মূহূর্ত্তে এইখানেই আছেন। যিনি জীবের নিকট হইতেও নিকট, তাঁহাকে খুঁজিতে অন্যত্র যাইয়া লাভ নাই—বরং তাহাতে লোকসান আছে। বাহিরের ছবি ছায়াবাজির মত, তাহারা খাঁটী জিনিস দেখায় না। এইজন্য তরু যেখানে জন্মিয়াছে, সেইখানেই আসন পাতিয়া বসিয়া তপস্যা করিতেছে। সে বুঝিয়াছে, বাড়ী-ঘর নিরাপদ্ নহে, উহা মাথায় ভাঙ্গিয়া পড়িতে পারে, বজ্রপাতে ছাদ ভাঙ্গিয়া যায়। গৃহের মধ্যেও সর্পে দংশন করে, আবৃত স্থানে থাকিলেও পীড়া হয়—ইহা সংস্কার ও অভ্যাস মাত্র, বরং পশু-পক্ষীর জীবনই স্বাভাবিক জীবন। ভগবানের চরণপদ্ম ছাড়া আর কোন আশ্রয়ই আশ্রয় নহে। এজন্য তরু আশ্রয়ের জন্য চতুর্দ্দিকে ধাবমান হয় না, সে শুধু লতার মত তাঁহাকেই জড়াইয়া থাকিতে চায়; ভগবানের চরণপদ্মই তাহার সর্ব্ব আশ্রয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। আকাশ যখন ঘনঘটাচ্ছন্ন হয়, বিদ্যুৎস্ফূরণে দিক্ প্রকম্পিত হয়, ভীষণ অজগর যখন ফোঁস-ফোঁস করিতে করিতে নেত্রে অগ্নিবর্ষণ করিয়া ছুটিয়া আসে, তখন হয়ত সে তাঁহার কৃপালাভ করিতে পারিলে নিরাপদে থাকে, ঘন-বর্ষণে তাহার পত্র-পল্লব আরও সবুজ হয়, তাহার শিব-তুল্য দেহ জড়াইয়া ধরিয়া সর্প নিজের বিষের জ্বালা তুলিয়া যায়—কারণ সে অমৃতময়কে আশ্রয় করিয়া অমৃতময় হইয়া উঠিয়াছে।
বৈষ্ণবের জ্ঞানকর্ম্ম ছাড়িয়া এজন্যই তাঁহাকে আশ্রয় করাই প্রেমিকের শেষ লক্ষ্য বলিয়া নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন এবং গীতা বলিয়াছেন “সর্ব্বসর্ম্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।”
চণ্ডীদাসের রাধা এইভাবে সমস্ত আশ্রয় ত্যাগ করিয়াছেন। একুল-ওকুল, এই দুই কুল ত্যাগ করিয়া তিনি একেবারে কৃষ্ণপ্রেমের মাঝ-দরিয়ায় ঝাঁপ দিয়াছেন। তিনি ধনিশ্রেষ্ঠ আয়াণ ঘোষের অট্টালিকা ও বৃষভানুর প্রাসাদ ছাড়িয়া দিয়া, বসনভূষণ পরিত্যাগপূর্ব্বক একেবারে রিক্তা হইয়া পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন—তখন কানু-অনুরাগই তাঁহার একমাত্র রাজাবাস, কানুর কলঙ্কই এই দিগম্বরী সন্ন্যাসিনীর অঙ্গভষ্ম, কানুর নাম শ্রবণই তাঁহার শ্রুতির মহার্ঘ অলঙ্কার—যোগিনীর কুণ্ডল; ভিতরে ও বাহিরে তিনি সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণের হইয়া বলিতেছেন:—
‘‘সবে বলে মোরে শ্যাম-সোহাগিনী, গৌরবে ভরল দে।
হামারি গরব তুহুঁ বাড়ায়লি, অব টুটায়ব কে?’’
আর একটি পদে গৃহে থাকাকালীন তিনি যে কষ্ট পাইয়াছেন—তাহার ইতিহাস দিতেছেন—হে কৃষ্ণ, আমি স্ত্রীলোক, কি করিয়া তোমায় মনের দুঃখ বুঝাইব? আমার পা আছে, কিন্তু চলিবার সাধ্য নাই, কোন ছলে তোমার শ্রীমন্দিরের দিকে পা বাড়াইলে লোকে টিট্কারী দেয়; আমার মুখ আছে, কিন্তু কিছু বলিবার সাধ্য নাই, এজন্যই লোকে স্ত্রীলোককে “অবোলা” বলে। এক স্থানে চণ্ডীদাস রাধিকার মুখে বলিয়াছেন—চোরের মা যেমন ফুকারিয়া কাঁদিতে পারে না, তাঁহার সেই অবস্থা। আমার চোখ আছে, কিন্তু নয়নাভিরাম মূর্ত্তি আমার দেখিবার সাধ্য নাই। (“নিশ্বাস ফেলিতে না দেয় ঘরে ননদিনী”) চোখ মেলিলে বলে—‘কি দেখ্ছ’; চোখের জল ফেলিলে বলে—‘কেন কাঁদ্ছ’। বঁধু, স্ত্রীলোকের মনের দুঃখ মনেই থাকে।
‘‘শুনহে চিকন কালা,
বলিব কি আর, চরণে তোমার,
অবলার যত জ্বালা!,
চরণ থাকিতে না পারি চলিতে
সদা যে পরের বশ,
কোন ছলবলে তব কাছে এলে
লোকে করে অপযশ!
বদন থাকিতে না পারি বলিতে
তেঁই সে ‘অবোলা’ নাম,
নয়ন থাকিতে সদা দরশন
না পেলেম নবীন শ্যম।
অবলার যত দুঃখ প্রাণনাথ,
সব থাকে মনে মনে।’’
‘‘আমি পরাণনাথেরে স্বপনে দেখিলাম
সে যে বসিয়া শিয়র পাশে।
নাসার বেশর পরশ করিয়া
ঈষৎ মধুর হাসে।
আমার মরমে পশিল লেহ, হৃদয়ে লাগিল দেহ,
শ্রবণে ভরল সেই বাণী,
দেখিয়ে তাহার রীত, যে করে আমার চিত,
আমি কি করিব কুলের কামিনী!
(তাহে) অঙ্গ পরিমল, সুগন্ধি চন্দন,
কুঙ্কুম-কস্তুরী পারা।
পরশ করিতে রস উপজিল,
জাগিয়া হইনু হারা।
(তখন) চাতক পাখীরে চকিতে বাটুল
মারিলে যেমত হয়,
স্বপন ভাঙ্গিয়া তেমতি হইল,
দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়।’’
এই চিত্রে স্বপ্নে-পাওয়া কৃষ্ণসঙ্গের সুখোপলব্ধির প্রগাঢ়ত্ব ও তাঁহাকে হারাইবার মর্ম্মস্তুদ ক্ষোভ প্রদর্শিত হইয়াছে।
এই কবিতাটির রসাস্বাদ করিতে করিতে চণ্ডীদাসের সম্মোহন সুরে জ্ঞানদাসের হৃদ্তন্ত্রী বাজিয়া উঠিয়াছিল। তিনি পদটি বাড়াইয়া নিজের ভণিতা দিয়া চালাইয়াছেন—চোরের মত নহে, শিষ্যের মত, আখরিয়ার মত, টীকাকারের মত—তাহাতে পদটির ভাবের মর্য্যাদা একটুকুও খর্ব্ব হয় নাই, কিন্তু কবিত্বের সৌন্দর্য্য বাড়িয়াছে। এই কবিত্ব চণ্ডীদাসের পদ তাঁহার মনে জাগাইয়া তুলিয়াছিল, উহা তিনি অপর কোন স্থান হইতে কুড়াইয়া পান নাই। এ যেমন গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মত। চণ্ডীদাসের ভাবধারা অনুসরণ করিয়া, সেই ধারায় উদ্ভূত হৃদয়োচ্ছ্বাস দিয়া তিনি চণ্ডীদাসের কবিতাটি সাজাইয়াছেন।
আমি তৎকৃত যোজনাসহ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করিতেছি।
“আমি পরাণনাথেরে স্বপনে দেখিলাম, সে যে বসিয়া শিয়র পাশে,
নাসার বেশর পরশ করিয়া ঈষৎ মধুর হাসে।
কিবা রজনী শাওণ, ঘন দেয়া গরজন,
রিমি ঝিমি শবদে বরিবে,
পালঙ্কশয়ন রঙ্গে, বিগলিত চীর অঙ্গে,
আমি নিঁদ যাই মনের হরিষে।
শিখরে শিখণ্ডী রোল, মত্ত দাদুরী বোল,
কোকিলা ডাকিছে কুতূহলে,
ঝিঁ ঝিঁ ঝিমকি ঝাঁজে, ডাহকী সে গরজে,
আমি স্বপন দেখিলাম হেন কালে।
আখরিয়া কৃষ্ণের হাসিটির ব্যাখ্যা করিয়া বলিবে—সে হাসি ছুরির মত, হৃদয় কাটিয়া যায়; মিষ্টত্বের এই তীক্ষ্ম আঘাত যিনি বুঝিয়াছেন, তিনিই এই কথার অর্থ বুঝিবেন। কোন সময়ে হাসি যে ধারাল ছুরির মত হৃদয় কাটিয়া যায়, তাহা কেহ কেহ হয়ত অনুভব করিয়া থাকিবেন।
পরবর্ত্তী অংশে জ্ঞানদাস যে কয়েকটি ছত্র (কিবা রজনী শাওণ… আমি স্বপন দেখিলাম হেন কালে) যোগ করিয়াছেন, তাহাতে মনের অবস্থার উপর রং ফলাইয়া তিনি বর্ষারাত্রের এই মিলনের রস প্রগাঢ় করিয়াছেন।
যদিও কোন কোন সংগ্রহ-পুস্তকে সমস্ত পদটিই চণ্ডীদাসের ভণিতায় পাওয়া যায়, এই প্রকৃতি-বর্ণনার সুরটি কখনই চণ্ডীদাসের নহে, ইহা শব্দ-কুশলী পরবর্ত্তী কোন কবির রচনা। সে কবি কে, তাহা আবিস্কার করাও কষ্টসাধ্য নহে। বহু সংগ্রহ গ্রন্থে—বিশেষ ময়নাডলার মিত্র-ঠাকুরদের সংগৃহীত কোন কোন খাতায় এই গানটির ভণিতায় জ্ঞানদাসের নাম পাওয়া যায়। প্রধানতম পুঁথিগুলিতে এই প্রকৃতির বর্ণনার অংশটুকু বাদে বাকী চণ্ডীদাসের ভণিতায় দেওয়া হইয়াছে। সুতরাং স্বীকার করিতে হইবে, নিরাভরণা সুন্দরীর গলায় কেহ মতির মালা পরাইয়া দিলে যেরূপ হয়, জ্ঞানদাস সেইভাবে চণ্ডীদাসের পদটির অঙ্গসৌষ্ঠব সাধন করিয়াছেন।
এই যোজনায় মেঘাগমে বিরহের চিত্র অতি স্পষ্ট হইয়াছে রাধিকার ঘুমস্ত অবস্থায় দৃশ্যপটে কোন রূপের বর্ণনা সঙ্গত বা শোভন হইত না। এজন্য কবি কেবল শ্রুতির দিকে লক্ষ্য রাখিয়া এরূপ বর্ণনা দিয়াছেন—যাহাতে ঘুমের আবেশ বৃদ্ধি হয়। কেবল সুরই তাঁহার লক্ষ্য। কর্ণ যদিও কতকটা নিষ্ক্রিয়, তথাপি যেটুক সজাগ, তাহাতে সুরের মোহ নিদ্রিতের মনে পৌঁছিতে পারে। শিশুর ঘুমন্ত অবস্থায়ও কিছুকাল জননী ঘুমপাড়ানিয়া গান আবৃত্তি করিতে থাকেন, চক্ষু যখন একেবারে মুদিত, তখনও ঘুমের অবস্থায় শ্রুতি কিছুকাল সজাগ থাকে। “রজনী শাওণ (শ্রাবণ), ঘনঘন (বারংবার) দেয়া (মেঘ) গরজন”—এখানে মেঘের সম্পদ্ বা আকৃতি সম্বন্ধে একটি অক্ষরও নাই,—মেঘের “রিমিঝিমি” শব্দে ঘুমের আবেশ বৃদ্ধি করে। বৃষ্টি-বিন্দুর রূপ হীরার মত কি মুক্তার মত, কবি তাহা বলেন নাই; কারণ শব্দই কবির লক্ষ্য। “ঝিঁ ঝিঁ ঝিমকি ঝাঁকে—ডাহকী সে গরজে” প্রভৃতিও শব্দমন্ত্র; ইহা দিয়া কবি আমাদিগকে এক ঘুমন্ত পুরীতে লইয়া গিয়াছেন। সেই মোহনিদ্রাতুর রজনীর আবেশ-বর্দ্ধক বিচিত্র সুরের রাজ্যে কৃষ্ণের স্বপ্ন-শ্রুত মধুরাক্ষরা বাণী রাধাকে অপর কোন জগতের আকস্মিক প্রিয়-জনের আহবানের মত আবিষ্ট করিয়া ফেলিল। চণ্ডীদাসের কবিতায় এই যোজনা তাঁহার প্রিয় শিষ্য জ্ঞানদাস ভাবের সঙ্গতি রাখিয়া করিয়াছেন, এজন্য ইহাতে নিন্দার কিছু নাই।
আর একটি পদ, যাহা কোন কোন প্রাচীন পুঁথিতে চণ্ডীদাসের কোন কোনটিতে জ্ঞানদাসের ভণিতায় পাওয়া যায়, তৎসম্বন্ধেও আমার কিছু বক্তব্য আছে। সে পদাটি বিখ্যাত—
‘‘সুখের লাগিয়া এঘর করিনু, আগুণে পুড়িয়া গেল,
অমিয়-সাগরে সিনান করিতে সকলই গরল ভেল।
উচল ভাবিয়া অচলে চড়িনু, পড়িনু অগাধ জলে,
লছমী চাহিতে দারিদ্র্য বাড়ল, মাণিক হারালাম হেলে।
সাগর সেচিলাম, নগর বাঁধিলাম, বসতি করিবার আশে।
সাগর শুকাল, নগর ভাঙ্গিল, অভাগীর করম দোষে।’’
সকলেই অবগত আছেন। জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের অনেক পদই নূতন করিয়া ঢালাই করিয়াছেন। এই গানে চণ্ডীদাসের সুরটী পাওয়া গেলেও ইহার মালিকানা সাব্যস্ত করা সহজ হইবে না। এখনও অনেক তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের ভাবের প্রতিধ্বনি তুলিয়াই ক্ষান্ত হন না, তাঁহার হস্তাক্ষরেরও অবিকল অনুকরণ করিয়া—কোন্টি গুরুর পদ, কোন্টি শিষ্যের, এই প্রশ্ন সময়ে সময়ে জটিল করিয়া তোলেন। জ্ঞানদাসেরও মৌলিকতা ও কবিত্বশক্তি যথেষ্ট ছিল; সুতরাং তিনি যে উদ্ধৃত পদটির মত একটি সুন্দর পদ নিজেই রচনা করিতে পারিতেন না, তাহা বলা যায় না। তবে প্রাচীনতম পুঁথির পাঠগুলি ও ভণিতাই এক্ষেত্রে প্রামান্য। অপেক্ষাকৃত আধুনিক পুঁথিতে এবং মুদ্রিত পুস্তকগুলিতে দেখা যায়, কোন কোনটিতে পদটী চণ্ডীদাসের এবং কোন কোনটিতে জ্ঞানদাসের ভণিতায় পাওয়া যায়, একথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। খুব প্রাচীন পুঁথিতে ইহা চণ্ডীদাসের ভণিতায়ই পাওয়া যায়। কিন্তু যে ভাবে পাওয়া যায়, তাহা ঠিক উদ্ধৃত পাঠের মত নহে, কাঠামোটা ঠিক রাখিয়া পরবর্ত্তী কবি চাল-চিত্রটা অনেকখানি বদলাইয়াছেন।
সুতরাং বলা যাইতে পারে “আমি পরাণনাথেরে স্বপনে দেখিনু” পদটিতে জ্ঞানদাস যেরূপ কতকটা যোগ করিয়া সৌষ্ঠব সাধন করিয়াছেন, এই পদেও তিনি তাহাই করিয়াছেন। পদগুলিতে তিনি নিজের ভণিতা দিতে গেলেন কেন?—এই প্রশ্ন হইতে পারে। সমালোচনার আদালতে মোকদ্দমাটি উপস্থিত করিলে, জ্ঞানদাস দোষী কি না নির্ণীত হইবে; আমি শুধু এই বলিব, যে প্রাচীন ছাঁচে ঢালাই করিয়া নূতন কবির নামের ছাপ দেওয়া হয়ত সেকালের রীতি ছিল। একথাও বলা চলে যে, গায়েনেরাই এই ভাবের ভণিতা দিয়াছেন, তজ্জন্য কবি দোষী নহেন। তাঁহারা তো ভণিতা লইয়া এরূপ খামখেয়ালী অনেক সময়েই করিয়া থাকেন। সেদিনও কবিওয়ালা এণ্টোনির গানে ইঁহারা “দ্বিজ এণ্টোনী বলে” এইরূপ ভণিতা দিয়া ফিরিঙ্গী কবিকে জাতে তুলিয়া লইয়াছেন।
এখনও কবিরা পূর্ব্ববর্ত্তী কবিদের রচনার উপর অধিকার স্থাপন না করেন, তাহা নহে। টেনিসনের রাউণ্ড-টেবিলের গল্পগুলি মোবিনিজিন গাথার অনেকটা পুনরাবৃত্তি।