পদাবলী-মাধুর্য্য/নবম পরিচ্ছেদ

৯৷ হারাই-হারাই

 চণ্ডীদাসের রাখা এক দুর্ল্লভ রত্ন পাইয়াছিলেন, সে রত্ন তিনি কোথায় রাখিবেন, এমন নিরাপদ্‌ স্থান খুঁজিয়া পান নাই। চৈতন্যদেব বার বার তাঁহাকে পাইতেন, বার বার তাঁহাকে হারাইতেন। রাধা যত দুঃখ পাইতেন, যত দূরেই যাইতেন, কৃষ্ণের মুখখানি মনে পড়িলে তাঁহার সমস্ত কষ্ট দূর হইত,

যথা তথা যাই, আমি যত দূর চাই,
চাঁদ মুখের মধুর হাসে তিলেকে ‍জুড়াই। (চ)

ননদী ও শ্বাশুড়ীর গঞ্জনা, প্রতিবাসীর বিদ্রুপ—এ সমস্তই সে চাঁদমুখ মনে পড়িলে তিনি আনন্দে সহিতেন। কিন্তু কানু যদি তাঁহার উপর বিরূপ হন, তবে তিনি কি করিবেন? রাধা বলিতেছেন,—

বঁধু, তুমি যদি মোরে নিদারুণ হও,
মরিব তোমার আগে, দাঁড়াইয়া রও। (চ)

যদি কেহ তাঁহার সম্বন্ধে ভাঙচি দেয়, তবে রাধা তাহাকে এই বলিয়া অভিসম্পাত দিতেন—

“এ হেন বঁধুরে মোর যে জন ভাঙ্গায়,
হাম নারী অবলার বধ লাগে তায়।” (চ)

কৃষ্ণ-হীনা রাধিকা ফুল-পল্লব-বিরহিত পুষ্পতরু নহে—ততোধিক পরিত্যক্তা—সূর্য্যান্তের পর চন্দ্রতারাহীন নীলাম্বর নহে, ততোধিক আঁধার—ইহা হইতে দুঃখ রাধার কল্পনাতীত, এজন্য রাধা বলিতেছেন, যে আমার এই সুখের ঘরে হানা দিবে—

“আমার হৃদয় যেমন করেছে,
    তেমতি হউক সে।” (চ)

ইহা হইতে কষ্ট আর নাই। সংসারের আধি-ব্যাধি, শোক, দুঃখ, মৃত্যু রাধা অবহেলায় সহিতে পারেন; কিন্তু কৃষ্ণপ্রেমবঞ্চিতা হইলে তিনি তিলার্দ্ধও সহিতে পারিবেন না, এইজন্য এই অভিশাপ তাঁহার অভিধানের সর্ব্বাপেক্ষা বড় অভিশাপ। কৃষ্ণকে একবার রাধা বলিয়াছিলেন, “আমার এই প্রেমের কষ্ট তুমি বুঝিবে কেমন করিয়া, কেমন করিয়াই বা তাহা তোমাকে বুঝাইব, আমি প্রার্থনা করি, যেন জন্মান্তরে আমি ‍কৃষ্ণ হই এবং তুমি রাধা হও, তোমার সঙ্গে প্রেম করিয়া আমি যেন ছাড়িয়া যাই, তখন তুমি বুঝিবে আমার কষ্ট কি?”

সাগরে যাইব কামনা করিব,
 সাধিব মনের সাধা।
মরিয়া হইব শ্রীনন্দের নন্দন,
 তোমারে করিব রাধা।

পীরিতি করিয়া ছাড়িয়া যাইব,
 দাঁড়াব কদম্ব-তলে।
ত্রিভঙ্গ হইয়া মুরলী ‍বাজাব
 যখন যাইবে জলে।
মুরলী শুনিয়া অস্থির হইবে
 সহজ কুলের বালা।
চণ্ডীদাস কহে তখন জানিবে—
 পীরিতি কেমন জ্বালা।

এই দুঃখের আর কোন উপমা নাই, কারণ তাঁহার পক্ষে কৃষ্ণ-বিচ্ছেদের মত এমন দুরন্ত অসহ্য কষ্ট আর কিছুই নাই, এ ক্ষেত্রে তাঁহার উপমা তিনি স্বয়ং। সাগর শুকাইলে মহানগরী ধ্বংস হইলে, লক্ষ্মীবন্ত লোক ভিক্ষুক হইলে যাহা হয়, কৃষ্ণত্যক্তা রাধিকার উপমা তাহা দ্বারা ব্যক্ত হয় না, “হে কৃষ্ণ আমি যে কষ্ট পাইতেছি, আমার মত হইলে তাহা বুঝিবে। আমার এই ‘সম্বুনদ হেম, সম সেই প্রেম’, এই মন বিপ্লবী বাক্যাতীত উপমার ঊর্দ্ধে যে প্রেমলোক—তাঁহাতে যে হানা দেয়, “আমার হৃদয় যেমন করেছে, তেমনি হউক সে।” এইজন্য জন্মান্তরে কৃষ্ণকে রাধা হইয়া তাহার ব্যথা বুঝিতে রাধা প্রার্থনা করিতেছেন, এই পদটিতেও কেহ কেহ চৈতন্যাবতারের পূর্ব্ব সূচনা বুঝিতেছেন, ইহা চণ্ডীদাসের মনে প্রতিবিম্বিত চৈতন্য-মূর্ত্তির আগমনী গান,—রাধাভাব বুঝিতে কৃষ্ণ চৈতন্যরূপে জন্ম পরিগ্রহ করিয়াছিলেন। চণ্ডীদাসবিদ্যাপতি, এই দুই পূর্ব্ববর্ত্তী কবির এইরূপ পদ আছে,—

“হাম সাগরে তেজঘ পরাণ,
আন জনমে হব কান,
কানু হোরব যব রাযা,
তব জানব বিরহক বাধা।” (চ)

 কৃষ্ণপ্রেমে এত আশঙ্কা কেন?

 যে কৃষ্ণ “জপিতে তোমার নাম, বংশী ধরি অনুপাম—তোমার বরণের পরি বাস” (চ) প্রভৃতি কত মিষ্ট কথায় রাধাকে সোহাগ করেন, রাধা মান করিলে যিনি চক্ষে সরিষার ফুল দেখিয়া পায় ধরিয়া মান ভাঙ্গান, তাতেও মান না ভাঙ্গিলে রাধাকুণ্ডে পড়িয়া মরিতে যান,—যাঁহার প্রেমের অভাব দেখিলে তিনি জগৎ আঁধার দেখেন এবং “রাধা তুমি সে আমার গতি, তোমার কারণে, বৈকুণ্ঠ ছাড়িয়া গোকুলে আমার স্থিতি” (চ) প্রভৃতি পদে তাঁহার রাধাগত প্রাণের গৌরব করেন, কখনও বা “যমুনা তীরে, নীপহি মূলে” রাধা পরিত্যক্ত “লুটত বনওয়ারী, চূড়া এই ঠাঁই, বাঁশী এক ঠাঁই”—“ধূলি ধূসর কহত প্যারী প্যারী” (রায়)—এত কষ্টেও রাধা নামটি ছাড়িতে পারেন না, সে রাধার এই আশঙ্কা কেন? কেন রাধিকা কৃষ্ণের ভাবান্তর কল্পনা করিয়া “তুমি বঁধু মোরে যদি নিদারুণ হও, মরিব তোমার আগে, দাঁড়াইয়া রও” এইরূপ প্রলাপোক্তি করেন?

 চণ্ডীদাসের রাধা ভগবৎপ্রেমের প্রতীক। তিনি সময়ে সময়ে কৃষ্ণ-সঙ্গ লাভ করিয়া ধন্য হন, কিন্তু সে প্রেমের মধ্যে একটা না পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। যোগীর হৃদয়ে সেই অবাঙ্‌মনসাগোচর ভগবান বিদ্যুতের মত ক্ষণিক প্রভা দিয়া অন্তর্হিত হন। বৈষ্ণব প্রেমিকের মত তাঁহাকে বাঁধিয়া রাখিবার গৌরব যোগী কোথায় পাইবেন? রাধা-সাহিত্য মিথ্যা ইহয়া যাইত, যদি চৈতন্য প্রভু নিজের মধ্যে রাধা-ভাব না দেখাইতেন; তিনি অনেক সময়ে তাঁহার চোখের ইঙ্গিতে কৃষ্ণসঙ্গের অপ্রমেয় অথচ জটিল, নিগূঢ় অথচ ঈষৎপ্রকাশিত আনন্দ আভাষে ব্যক্ত করিয়া দেখাইতেন। তাঁহারই সঙ্গে লীলা-মাধুরী—কোপ, মান, অভিমান, খণ্ডিতার নিদারুণ কষ্ট, বিরহের অসীম-কারুণ্যমথিত মাথুর-ভাব, এ সমন্তই ক্ষণে ক্ষণে চৈতন্যের নয়ন-কোণে ফুটিয়া উঠিত। রূপ-গোস্বামী তাঁহার দান-লীলা-কৌমুদীর মুখবন্ধে নয়টি রস-মিশ্র কিলকিঞ্চিৎ ভাবের যে চিত্র আভাষে আঁকিয়াছেন, তাহা চৈতন্যের ভাবাবিষ্ট অবস্থায় চোখের চাহনী হইতে পাওয়া। কৃষ্ণসঙ্গ পাইয়া যিনি অকুল আনন্দ-সায়রে ঝাঁপ দিয়াছেন, সেই ভাবের অবসানে তিনি যে অসীম কষ্ট পাইয়াছেন, তাহার চিত্র চৈতন্যচরিতামৃতে আছে। তিনি গাম্ভীরায় মুখ ঘষিয়া রক্তাক্ত করিয়া ফেলিতেন এবং সারারাত্রি স্বরূপ দামোদর ও রাম রায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের বিলাপগীতি গাহিয়া কাটাইতেন।

 যিনি অবাঙ্‌মনসাগোচর, অসীম—অনন্ত, তাঁহাকে জীব কতক্ষণ নিজের কাছে বাঁধিয়া রাখিবার স্পর্দ্ধা করিতে পারে? তাই সিড়ি ভাঙ্গীয়া উর্দ্ধলোকে উঠিয়া পতনের আশঙ্কা একবারে যায় না। জীবের পক্ষে স্থায়ী ভাবে শিবলোকে বাস করা সম্ভব নহে—

“কৃষ্ণরূপে মূর্ত্তি যখন দেখেন নয়নে,
তখন ভাবেন কৃষ্ণ আছেন বৃন্দাবনে,
অদর্শনে ভাবেন কৃষ্ণ গেছেন মধুপুরী।” (কৃ)

 এই বিরহের অবস্থায়
 “ক্ষণে গোরাচাঁদ, হয়ে দিব্যোষ্মান—দুটি চক্ষে ধারা বহে অনিবার, দুঃখে বলে বারবার, স্বরূপ দেখায়ে একবার, নতুবা এবার মরি।” (কৃ) বিরহে তিনি কখনও মুর্চ্ছিত হইয়া পড়েন। তখন ভক্তমণ্ডলী গাহিতেন,

 “গৌর কেন এমন হল,—(স্বরূপের সাথে) এই না কৃষ্ণ কথা কহিতেছিল, তোরা দেখে যা গোরা বুঝি প্রাণে মৈল।”

 সুখের সাগর দেখাইয়া–পূর্ণানন্দের আস্বাদ দিয়া কৃষ্ণ লুকাইয়া পড়েন। ভাব-রাজ্যে তাঁহার এই লুকোচুরী খেলা গৌর-জীবনে প্রতিফলিত হইয়াছে।

 রাধিকা তাঁহার সর্ব্বস্ব কৃষ্ণের পায়ে “কৃষ্ণার নমঃ” বলিয়া ডালি সাজাইয়া দিয়াছেন। বিদ্যাপতির রাধা বলিতেছেন-

‘‘হাতক দরপণ মাথক ফুল,
নয়নক অঞ্জন, মুখক তাম্বুল,
হৃদয়ক মৃগমদ, পীমক হার,
দেহক সরবস্ব, গেহক সার,
পাথীক পাণ, মীনক পানী,
জীবক জীবন হাম তুরা জানি।’’

 অর্থাৎ “তুমি আমার সব, পাখীর পাখা না হইলে উড়িবার শক্তি লোপ পায়, সে মাটীতে পড়িয়া মরে, মৎস্যকে জল হইতে ডাঙ্গায় তুলিলে সে কতক্ষণ বাঁচে? তুমিও আমার কাছে সেইরূপ।” চণ্ডীদাসও লিখিয়াছেন,

‘‘জল বিনু মীন জনু কবহ না জীয়ে’’।

 রাধা নানা উপমায় নিজের প্রেম বুঝাইয়া বলিয়াছেন:—

 “জীবক জীবন হাম তুয়া জানি” “তুমি আমার জীবনের জীবন, আমি ইহাই জানি।”

 এত কথা বলিবার দরকার কি? দরকার কিছু ছিল, “আমার সম্বন্ধে বুঝাইবার কিছু নাই, তুমি সকলই জান”, তোমা ছাড়া রাধা কায়া-ছাড়া ছায়া—তাহার পৃথক্‌ অস্তিত্ব নাই। “আমার মনের ভাব পরিষ্কার, কিন্তু তুমি কেমন, তাহা তো এত দিন ধরিয়াও বুঝিতে পারিলাম না। আমি সকল বিসর্জ্জন করিয়াও সোয়াস্তি পাইতেছি না। আমি কাহার হাতে সর্ব্বস্ব দিলাম, কে সে বিরাট্‌ প্রহেলিকা, তাঁহাকে তো আমি এখনও চিনিতে পারিলাম না।” তাঁহাকে রাধা কত গাল মন্দ দিয়াছেন, “ক্রুর, লম্পট, শঠ,”—এ সেই না চিনার জন্য, বিদ্যাপতির রাধা এই পদের শেষ ছত্রে আর্ত্ত স্বরে জিজ্ঞাসু হইয়াছেন:—

“মাধব, তুহু কৈছে কহবি মোর” তুমি বল তুমি কেমন? তুমি কে? এই চির-রহস্যময় বিশ্বের কারণস্বরূপ ভগবানের সঙ্গে লীলাচ্ছলে নানা অভিনয় করিয়াও যে একটা খোঁচার মত সন্দেহ মনে থাকয়া যায়—এই সন্দেহ, এই আশঙ্কা হইতেই মাথুরের উৎপত্তি।

 আমি তো তাঁহাকে ভালবাসিয়াছি, সে তো বিন্দুর সিন্ধুকে ভালবাসা। আমি তাঁহাকে সমগ্রভাবে চাই—সেই যমুনাতীরকুঞ্জে যত অমৃতোপম কথা শুনিয়াছিলাম, বংশীধর “পরশিতে চাই তোমার চরণের ধূলি” বলিয়া আমার পায়ে ধরিয়া সেবা করিয়াছিলেন,—মাতৃরূপে, সখারূপে তিনি জীবকে সমগ্রভাবে ভালবাসার স্বপ্ন দেখাইয়া থাকেন। আমি যেন তাঁহার সব,

‘‘জ্বালিয়া উজ্জ্বল বাতি,  জাগি পোহাইত রাতি,
  তিল নাহি যায় পিয়া ঘুম,” (ব)
ধরিয়া দুখানি হাতে,  কখন ধরয়ে মাথে,
  ক্ষণে ধরে মাথার উপরে,
ক্ষণে পুলকিত হয়,  ক্ষণে আঁখি মুদে রয়
  বলরাম কি কহিতে পারে?”
“বিনি কাজে কত পুছে,  কত না মুখানি মোছে”
“তুমি মোর প্রাণধন,  তোমা বিনা নাহি আন,
  কহে পিয়া গদ গদ ভাবে।” (ব)

কত ছন্দ-বন্ধে নানা কথা বিলয়া আমাকে ভুলাইয়াছিলেন, কত রাত্রি জাগিয়া অভিসারের পথে “পততি পতত্রে বিচলিত পত্রে” আমার পদক্ষেপ শুনিবার জন্য কাণ পাতিয়া প্রতীক্ষা করিয়াছেন, কত তিমির রজনীর মেঘের ঘটা, পিচ্ছিল বাটে অতি সম্ভর্পণে আসিয়া আমার আঙ্গিনার এক কোণে অপরাধীর মত দাঁদাইয়াছেন, সেই প্রেমের কল্পতরু আমাকে বুঝাইয়াছিলেন, তাঁহার সকল ফুল-ফল আমারই প্রেমের নৈবেদ্য, আমি ছাড়া তাঁহার আর কেহ নাই—আমারও যেমন তাঁহাকে ছাড়া আর কেহ নাই! কিন্তু তিনি যদি তাহা না হন? তিনি যে জগদীশ্বর—সমস্ত জগতের, আমার মত তাঁহার শত শত আছে,

‘‘আমার মতন তোমার অনেক রমণী
তোমার মত আমার তুমি গুণমণি,
যেমন দিনমণির অনেক কমলিনী,
(কিন্তু) কমলিনীগণের ঐ একই দিনমণি।’’

 তবে কি আমি শত শত কোটীর একজন?

 এই অবস্থায় রাধা অতি ব্যাথা সহকারে বলিতেছেন

‘‘রাধানাথ বলিতে ভয় হয় চিতে, তাই গোপীনাথ বলিয়া ডাকি।’’

 আমায় যদি বহুর মধ্যে একজন হইয়া তাহার প্রেমের ভিখারী হইতে হয়, তবে তো আমি প্রাণে মরিব,—

‘‘রাধা ভাগের প্রেম নেবে না।’’

 কাহাকে সর্ব্বস্ব দিলাম, সে কি সত্যই বিরাট্? হিমাদ্রির পাদমূলে মাথা ঠেকাইয়া—আমি নগণ্য—নিলাম হইয়া গেলাম, এত ক্ষুদ্রকে সেই বিরাট্‌ পুরুষ কি মনে রাখিবেন? “দুঁহু সম” না হইলে প্রেম হইবে কিরূপে? ক্ষুদ্রের ভালবাসার আর গৌরব কি? মহানের কাছে অণু হইয়া কৃপাকণার জন্য ভিক্ষুক সাজিব? বিদ্যাপতির রাধার ন্যায় চণ্ডীদাসের রাধাও বলিতেছেন:—

 আমি তোমার জন্য,

“ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর,
পর কৈনু আপন আপন কৈনু পর।
রাতি কৈলাম দিবস দিবস কৈনু রাতি।
বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পীরিতি।’’

 নিজের রাজতুল্য স্বামীর ঘর ছাড়িয়া আমি যমুনার তীরে শ্যাম কুণ্ড—স্পৃষ্ট অনিলবাসিত কুঞ্জই গৃহ বলিয়া জানিয়াছি–—সে তোমারই জন্য, যাঁহারা আপন তাঁহাদিগকে পর মনে করিয়া তুমি একান্ত পর (পরাৎপর) তোমাকে আপন জ্ঞান করিয়াছি। দিনের বেলা ঘুমাইয়া কাটাইয়া দিনকে রাত্রি করিয়াছ, তোমার জন্য সারা রাত্রি কুঞ্জে কুঞ্জে ঘুরিয়া জাগরণ করিয়াছি, রাত্রিই আমার কাছে দিন হইয়াছে। এ তো তোমারই জন্য, হে মাধব, এত করিয়াও “বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পীরিতি” তুমি আমার কাছে রহস্যই রহিয়া গিয়াছ।

 এই সংশয় রাধার সমস্ত যন্ত্রণার মূলে। এজন্য একটা ‘হারাই’-‘হারাই’ ভাব চণ্ডীদাসের অনেক গানে দৃষ্ট হয়। যাহা অতি মূল্যবান্‌, তাহা লইয়া এজন্য লোকে সোয়ান্তি পায় না; আঁচলের গেরো খুলিয়া এজন্য সে বারংবার দেখে, তাহা কেউ লইয়া গেল কি না। বিশ্বনাথকে লইবার জন্য তো বিশ্বের সকলেই হাত পাতিয়া আছে।

 এই সন্দেহ সর্ব্বত্রই গভীর প্রেমের লক্ষণ। অপোগণ্ড শিশুও তাহার মায়ের কোলে পাছে অপরে উঠে, এজন্য উৎকণ্ঠিত থাকে। চণ্ডীদাসের রাধা বলিতেছেন:—

“এই ভয় উঠে মনে, এই ভয় উঠে।
না জানি কানুর প্রেম তিলে যেন ছুটে।”