পরিচয়/সোনার কাঠি
সোনার কাঠি
রূপকথায় আছে, রাক্ষসের যাদুতে রাজকন্যা ঘুমিয়ে আছেন। যে পুরীতে আছেন সে সোনারপুরী, যে পালঙ্কে শুয়েচেন সে সোনার পলিঙ্ক; সোনা মাণিকের অলঙ্কারে তাঁর গা ভরা। কিন্তু কড়াকড় পাহারা, পাড়ে কোনো সুযোগে বাহিরের থেকে কেউ এসে তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে দেয়! তাতে দোষ কি? দোষ এই যে, চেতনার অধিকার যে বড়। সচেতনকে যদি বলা যায় তুমি কেবল এইটুকুর মধ্যেই চিরকাল থাকবে, তার এক পা বাইরে যাবে না। তাহলে তার চৈতন্যকে অপমান করা হয়। ঘুম পাড়িয়ে রাখার সুবিধা এই যে তা’তে দেহেব প্রাণটা টিঁকে থাকে কিন্তু মনের বেগটা হয় একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, নয় সে অদ্ভুত স্বপ্নের পথহীন ও লক্ষাহীন অন্ধলোকে বিচরণ করে।
আমাদের দেশের গীতিকলার দশাটা এই রকম। সে মোহরাক্ষণের হাতে পড়ে’ বহুকাল থেকে ঘুমিয়ে আছে। যে ঘরটুকু যে পালঙ্কটুকুর মধ্যে এই সুন্দরীর স্থিতি তার ঐশ্বর্য্যের সীমা নেই; চারিদিকে কারুকার্য্য, সে কত সূক্ষ্ম কত বিচিত্র! সেই চেড়ির দল, যাদের নাম ওস্তাদি, তাদের চোখে ঘুম নেই; তারা শত শত বছর ধরে’ সমস্ত আসা যাওয়ার পথ আগ্লে বসে’ আছে, পাছে বাহির থেকে কোনো আগন্তুক এসে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়।
তা’তে ফল হয়েছে এই যে, যে কাল্টা চল্চে রাজকন্যা তার গলায় মালা দিতে পারেনি, প্রতিদিনের নূতন নূতন ব্যবহারে তার কোনো যোগ নেই। সে আপনার সৌন্দর্য্যের মধ্যে বন্দী, ঐশ্বর্য্য্যের মধ্যে অচল।
কিন্তু তার যত ঐশ্বর্য্য যত সৌন্দর্য্যই থাক্ তার গতিশক্তি যদি না থাকে তাহলে চল্তি কান তার ভার বহন করতে রাজি হয় না একদিন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পালঙ্কের উপর অচলাকে শুইয়ে রেখে সে আপন পথে চলে যায়—তখন কালের সঙ্গে কলার বিচ্ছেদ ঘটে। তাতে কালেরও দারিদ্র্য, কলারও বৈকল্য।
আমরা স্পষ্টই দেখ্তে পাচ্চি আমাদের দেশে গান জিনিষটা চল্চে না। ওস্তাদরা বল্চেন, গান জিনিষটা ত চল্বার জন্যে হয় নি, সে বৈঠকে বসে’ থাক্বে তোমরা এসে সমের কাছে খুব জোরে মাথা নেড়ে যাবে। কিন্তু মুষ্কিল এই যে, আমাদের বৈঠকখানার যুগ চলে গেছে, এখন আমরা যেখানে একটু বিশ্রাম করতে পাই সে মুসাফিরখানায়। যা কিছু স্থির হয়ে আছে তার খাতিরে আমরা স্থির হয়ে থাকতে পারব না। আমরা যে নদী বেয়ে চল্চি সে নদী চল্চে, যদি নৌকোটা না চলে তবে খুব দামী নৌকো হলেও তাকে ত্যাগ করে যেতে হবে।
সংসারের স্থাবর অস্থাবর দুই জাতের মানুষ আছে অতএব বর্ত্তমান অবস্থাটা ভালো কি মন্দ তা নিয়ে মতভেদ থাক্বেই। কিন্তু মত নিয়ে করব কি? যেখানে একদিন ডাঙা ছিল সেখানে আজ যদি জল হয়েই থাকে তবে সেখানকার পক্ষে দামী চৌঘুড়ির চেয়ে কলার ভেলাটাও যে ভালো।
পঞ্চাশ বছর আগে একদিন ছিল যখন বড় বড় গাইয়ে বাজিয়ে দূরদেশ থেকে কলকাতা সহরে আস্ত! ধনীদের ঘরে মজ্লিস বস্ত, ঠিক সমে মাথা নড়তে পারে এমন মাথা গুন্তিতে নেহাত কম ছিল না। এখন আমাদের সহরে বক্তৃতা সভার অভাব নেই, কিন্তু গানের মজলিস বন্ধ হয়ে গেছে। সমস্ত তানমানলয় সমেত বৈঠকী গান পূরোপূরী বরদাস্ত করতে পারে এত বড় মজ্বুত লোক এখনকার যুবকদের মধ্যে প্রায় দেখাই যায় না।
চর্চ্চা নেই বলে’ জবাব দিলে আমি শুব না। মন নেই বলেই চর্চ্চা নেই! আকবরের রাজত্ব গেছে এ কথা আমাদের মানতেই হবে। খুব ভালো রাজত্ব, কিন্তু কি করা যাবে—সে নেই। অথচ গানেতেই যে সে রাজত্ব বহাল থাক্বে এ কথা বললে অন্যায় হবে। আমি বল্ছিনে আকবরের আমলের গান লুপ্ত হয়ে যাবে— কিন্তু এখনকার কালের সঙ্গে যোগ রেখে তাকে টিকতে হবে— সে যে বর্ত্তমান কালের মুখ বন্ধ করে দিয়ে নিজেরই পুনরাবৃত্তিকে অন্তহীন করে তুল্বে তা হতেই পারবে না।
সাহিত্যের দিক থেকে উদাহরণ দিলে আমার কথাটা স্পষ্ট হবে। আজ পর্য্যন্ত আমাদের সাহিত্যে যদি কবিকঙ্কণ চণ্ডী, ধর্ম্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, মনসার ভাসানের পুনরাবৃত্তি নিয়ত চল্তে থাক্ত তাহলে কি হ’ত? পনেরো আনা লোক সাহিত্য পড়া ছেড়েই দিত। বাংলার সকল গল্পই যদি বাসবদত্তা কাদম্বরীর ছাঁচে ঢালা হ’ত তাহলে জাতে ঠেলার ভয় দেখিয়ে সে গল্প পড়াতে হত।
কবিকঙ্কণ চণ্ডী কাদম্বরীর আমি নিন্দা করচিনে। সাহিত্যের শোভাযাত্রার মধ্যে চিরকালই তাদের একটা স্থান আছে কিন্তু যাত্রাপথের সমস্তটা জুড়ে তারাই যদি আড্ডা করে’ বসে, তাহলে যে পথটাই মাটি, আর তাদের আসরে কেবল তাকিয়া পড়ে থাক্বে, মানুষ থাকবে না।
বঙ্কিম আনলেন সাতসমুদ্রপারের রাজপুত্রকে আমাদের সাহিত্য রাজকন্যার পালঙ্কের শিয়রে। তিনি যেমনি ঠেকালেন সোনার কাঠি, অমনি সেই বিজয়-বসন লয়লামজুনুর হাতীর দাঁতে বাঁধানো পালঙ্কের উপর রাজকন্যা নড়ে’ উঠলেন। চল্তিকালের সঙ্গে তাঁর মালা বদল হয়ে গেল, তার পর থেকে তাঁকে আজ আর ঠেকিয়ে রাখে কে?
যারা মনুষ্যত্বের চেয়ে কৌলীন্যকে বড় করে’ মানে তারা বল্বে ঐ রাজপুত্রটা যে বিদেশী। তারা এখনো বলে, এ সমস্তই ভুয়ো; বস্তুতন্ত্র যদি কিছু থাকে ত সে ঐ কবিকঙ্কণ চণ্ডী, কেননা এ আমাদের খাঁটি মাল। তাদের কথাই যদি সত্য হয় তাহলে এ কথা বলতেই হবে নিছক খাঁটি বস্তুতন্ত্রকে মানুষ পছন্দ করে না। মানুষ তাকেই চায় যা বস্তু হয়ে বাস্তু গেড়ে বসে না, বা তার প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে চলে, বা তাকে মুক্তির স্বাদ দেয়।
বিদেশের সোনার কাঠি যে জিনিষকে মুক্তি দিয়েছে সে ত বিদেশী নয়—সে যে আমাদের আপন প্রাণ। তার ফল হয়েচে এই, যে, যে বাংলাভাষাকে ও সাহিত্যকে একদিন আধুনিকের দল ছুঁতে চাইত না এখন তাকে নিয়ে সকলেই ব্যবহার করচে ও গৌরব করচে। অথচ যদি ঠাহর করে’ দেখি তবে দেখ্তে পাব, গদ্যে পদ্যে সকল জায়গাতেই সাহিত্যের চালচলন সাবেক কালের সঙ্গে সম্পূর্ণ বদ্লে গেছে। যারা তাকে জাতিচ্যুত বলে’ নিন্দা করেন ব্যবহার করবার বেলা তাকে তাঁরা বর্জ্জন করতে পারেন না।
সমুদ্রপারের রাজপুত্র এসে মানুষের মনকে সোনার কাঠি ছুঁইয়ে জাগিয়ে দেয় এটা তার ইতিহাসে চিরদিন ঘটে আসচে। আপনার পূর্ণ শক্তি পাবার জন্যে বৈষম্যের আঘাতের অপেক্ষা তাকে করতেই হয়। কোনো সভ্যতাই একা আপনাকে আপনি সৃষ্টি করে নাই। গ্রীসেব সভ্যতার গোড়ায় অন্য সভ্যতা ছিল এবং গ্রীস বরাবর ইজিপ্ট্ ও এসিয়া থেকে ধাক্কা পেয়ে এসেছে। ভারতবর্ষে দ্রাবিড় মনের সঙ্গে আর্য্য মনের সংঘাত ও সম্মিলন ভারতসভ্যতা সৃষ্টির মুল উপকরণ, তার উপরে গ্রীস্ রোম পারস্য তাকে কেবলি নাড়া দিয়েছে। য়ুরোপীয় সভ্যতায় যে সব যুগকে পুনর্জন্মের যুগ বলে সে সমস্তই অন্য দেশ ও অন্য কালের সংঘাতের যুগ। মানুষের মন বাহির হতে নাড়া পেলে তবে আপনার অন্তরকে সত্যভাবে লাভ করে এবং তার পরিচয় পাওয়া যায় যখন দেখি সে আপনার বাহিরের জীর্ণ বেড়াগুলোকে ভেঙে আপনার অধিকার বিস্তার করচে। এই অধিকার বিস্তারকে একদল লোক দোষ দেয়, বলে ওতে আমরা নিজেকে হারালুম— তারা জানে না নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া নিজেকে হারিয়ে যাওয়া নয়—কারণ বৃদ্ধি মাত্রই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া।
সম্প্রতি আমাদের দেশে চিত্রকলার যে নবজীবন লাভের লক্ষণ দেখচি তার মূলেও সেই সাগরপারের রাজপুত্রের সোনার কাঠি আছে। কাঠি ছোঁয়ার প্রথম অবস্থায় ঘুমের ঘোরটা যখন সম্পূর্ণ কাটে না, তখন আমরা নিজের শক্তি পূরোপূরি অনুভব করিনে, তখন অনুকরণটাই বড় হয়ে ওঠে, কিন্তু ঘোর কেটে গেলেই আমরা নিজের জোরে চল্তে পারি। সেই নিজের জোরে চলার একটা লক্ষণ এই যে তখন আমরা পরের পথেও নিজের শক্তিতেই চল্তে পারি। পথ নানা অভিপ্রায়টি আমার, শক্তিটি আমার। যদি পথের বৈচিত্র্য রুদ্ধ করি, যদি একই বাধা পথ থাকে, তাহলে অভিপ্রায়ের স্বাধীনতা থাকে না—তাহলে কলের ঢাকার মত চল্তে হয়। সেই কলের চাকার পথটাকে চাকার স্বকীয় গথ বলে গৌরব করার মত অদ্ভুত প্রহসন আর জগতে নেই!
আমাদের সাহিত্যে চিত্রে সমুদ্রপারের রাজপুত্র এসে পৌঁছেচে। কিন্তু সঙ্গীতে পৌঁছয়নি। সেই জন্যেই আজও সঙ্গীত জাগ্তে দেরি করচে অথচ আমাদের জীবন জেগে উঠেচে। সেই জন্যে সঙ্গীতের বেড়া টলমল করচে! এ কথা বল্তে পারব না, আধুনিকের দল গান একেবারে বর্জ্জন করেচে। কিন্তু তারা যে গান ব্যবহার করচে, যে গানে আনন্দ পাচ্চে সে গান জাত-খোয়ানো গান। তার শুদ্ধাশুদ্ধ বিচার নেই। কীর্ত্তনে বাউলে বৈঠকে মিলিয়ে যে জিনিষ আজ তৈরি হয়ে উঠচে সে আচারভ্রষ্ট। তাকে ওস্তাদের দল নিন্দা করচে। তার মধ্যে নিন্দনীয়তা নিশ্চয়ই অনেক আছে। কিন্তু অনিন্দনীয়তাই যে সব চেয়ে বড় গুণ তা নয়। প্রাণশক্তি শিবের মত অনেক বিষ হজম করে’ ফেলে। লোকের ভালো লাগ্চে, সবাই শুন্তে চাচ্চে, শুন্তে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়চে না,—এটা কম কথা নয়। অর্থাৎ গানের পঙ্গুতা ঘুচ্ল, চল্তে শুরু করল। প্রথম চালটা সর্ব্বাঙ্গসুন্দর নয়, তার অনেক ভঙ্গী হাস্যকর এবং কুশ্রী—কিন্তু সব চেয়ে আশার কথা যে, চল্তে শুরু করেচে—সে বাঁধন মান্চে না। প্রাণের সঙ্গে সম্বন্ধই যে তার সব চেয়ে বড় সম্বন্ধ, প্রথার সঙ্গে সম্বন্ধটা নয়, এই কথাটা এখনকার এই গানের গোলমেলে হাওয়ার মধ্যে বেজে উঠেচে। ওস্তাদের কারদানিতে আর তাকে বেঁধে রাখতে পারবে না
দ্বিজেন্দ্রলালের গানের সুরের মধ্যে ইংরেজি সুরের স্পর্শ লেগেচে বলে’ কেউ কেউ তাকে হিন্দুসঙ্গীত থেকে বহিষ্কৃত করতে চান। যদি দ্বিজেন্দ্রলাল হিন্দুসঙ্গীতে বিদেশী সোনার কাঠি ছুঁইয়ে থাকেন তবে সরস্বতী নিশ্চয়ই তাঁকে আশীর্ব্বাদ করবেন। হিঁদুসেঙ্গীত বলে’ যদি কোনো পদার্থ থাকে তবে সে আপনার জাত বাঁচিয়ে চলুক: তার প্রাণ নেই, তার জাতই আছে। হিন্দুসঙ্গীতের কোনো ভয় নেই —বিদেশের সংস্রবে সে আপনাকে বড় করেই পাবে। চিত্তের সঙ্গে চিত্তের সংঘাত আজ লেগেচে—সেই সংঘাতে সত্য উজ্জ্বল হবে না, নষ্টই হবে, এমন আশঙ্কা যে ভীরু করে, যে মনে করে সত্যকে সে নিজের মাতামহীর জীর্ণ কাঁথা আড়াল করে ঘিরে রাখ্লে তবেই সত্য টিঁকে থাকবে, আজকের দিনে সে যত আস্ফালনই করুক তাকে পথ ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে। কারণ, সত্য হিঁদুর সত্য নয়, পল্তেয় করে’ ফোঁটা ফোঁটা পুঁথির বিধান খাইয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখ্তে হয় না; চারদিক থেকে মানুষের নাড়া খেলেই সে আপনার শক্তিকে প্রকাশ করতে পারে।