পর্ব্বতবাসিনী/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সেতারা হইতে ক্রোশ দুই অন্তরে ভীলপুর নামে আর একটী গ্রাম। ভীলপুর অপেক্ষাকৃত কিছু বড়। এই গ্রামে প্রতি বৎসর একটা মেলা হয়। সেই উপলক্ষে নানাবিধ উৎসবাদি হইত। নিকটবর্ত্তী গ্রাম সমূহ হইতে অনেক লোক মেলা দেখিতে সমবেত হইত। এই সময় সেই মেলা উপস্থিত হইল।
সেতারা এবং ভীলপুরের মধ্যে পর্ব্বতের কিয়দংশ আর একটা ক্ষুদ্র জঙ্গল ব্যবধান। পর্ব্বতের পাদদেশ বেড়িয়া জঙ্গলের মধ্য দিয়া পথ। পথ দুর্গম নহে। এই সুবিধা পাইয়া গ্রামসুদ্ধ লোক মেলা দেখিতে ভাঙ্গিত।
তিন দিন করিয়া মেলা থাকে। মাঝের দিন বড় জাঁক। সেই দিন রঘুজী মেলা দেখিতে চলিল। শম্ভূজী কোন প্রয়োজনে গ্রামান্তরে গিয়াছিল। দাস দাসীরাও সেই দিন ছুটী পাইল। তাহারা ভাল কাপড় পরিয়া, যথাসাধ্য অর্থ সঙ্গে লইয়া, তাম্বুল চর্ব্বণ করিতে করিতে মেলা দেখিতে চলিল। রঘুজী তারাকে ডাকিয়া আপনার সঙ্গে লইল, আর তাহাকে বলিয়া রাখিল, যদি তুই বরাবর আমার কাছে না থাকিস্, ত তোর হাড় ভাঙ্গিব। অগত্যা তারা মুখ একটু বিকৃত করিয়া পিতার সমভিব্যাহারে চলিল।
সে দিন গ্রামে প্রায় কেহ রহিল না। গ্রাম প্রায় শূন্য হইল। কোন কুটীরের সম্মুখে কদাচিৎ জনেক চলৎশক্তিরহিত বৃদ্ধ, রৌদ্রে বসিয়া তামাকু টানিতে টানিতে, কাসিতে কাসিতে, নিষ্ঠীবন ত্যাগ করিতে করিতে অস্ফুট স্বরে যৌবনকালের ঘটনা সমূহ স্মরণ করিতেছে। কখনও বা, বাড়ীর সকলে চলিয়া গেল, তাহাকে কে তামাকু সাজিয়া দেয়, এই বলিয়া গালি পাড়িতেছে। ঘরের ভিতরে বুড়ী খট্টায় শয়িতাবস্থায়, পুত্রবধূ সাজিয়া গুজিয়া তামাসা দেখিতে গিয়াছে, এই কারণে তাহাকে নানাবিধ মধুর সম্বোধনে অভিহিত করিতেছে।
যাহারা মেলা দেখিতে চলিয়াছে, তাহাদের আজ আর আনন্দের সীমা নাই। যুবকেরা লাঠি হাতে বাঁকা পাগড়ি বাঁধিয়া চলিয়াছে। ছোট ছোট ছেলেরা কেহ দাদার হাত ধরিয়া কেহ মাতার হাত ধরিয়া মহা কুতূহলে চলিয়াছে। সকলের মুখে হাসি, সকলেই মেলার গল্প করিতেছে। তরুণীকুল ললাটপ্রদেশ সিন্দুর ও তৈলনিষিক্ত করিয়া মা শীতলার রূপে চলিয়াছেন। রাঙা জমির উপর নানাবর্ণের চিত্র বিচিত্র করা চৌদ্দহাতি সাড়ী কুঞ্চিত করিয়া পরিধান; হাতে রাঙের কাঁকণ অথবা কাঁসার তাড়, পায়ে সেই বিষম গুরুভার কাঁসার মল। কেহবা অবসর মতে কজ্জলশোভিত নয়নের দুই চারিটা প্রাণঘাতী কটাক্ষ হানিতেছেন; কেহবা অপাঙ্গে দৃষ্টি করিয়া তাঁহার প্রতিবেশিনীর মল আপন চরণালঙ্কার অপেক্ষা ভারি কি না, অথবা তাহার সাড়ীর ফুলগুলি অধিকতর চাকচিক্যবিশিষ্ট কি না, তাহাই লক্ষ্য করিতেছেন।
সকলে সারি সারি চলিয়াছে। পর্ব্বত পশ্চাতে রাখিয়া সকলে জঙ্গলে প্রবেশ করিল। বনে অনেক জাতীয় গাছ, কোথাও নিবিড় অরণ্য, কোথাও বিটপীশ্রেণী বিরল। তাহারি মধ্য দিয়া মনুষ্যপদচিহ্ণিত সঙ্কীর্ণ পথ। সেই পথে একে একে দর্শকদল চলিল।
কিছু দূর গিয়া তাহারা জঙ্গল পার হইল। তখন, নিদাঘের উত্তপ্ত দিবসে দ্বিপ্রহর সময়ে মধুমক্ষিকার গুন্ গুন্ রব যেমন কাননবিহারীর শ্রবণে মধুর শ্রুত হয়, দূর হইতে জনতাকোলাহল সেইরূপ মধুর হইয়া তাহাদের শ্রবণে পশিল। যুবকবৃন্দ দীর্ঘচরণবিক্ষেপে চলিল, বালকেরা যাহাদের হাত ধরিয়াছিল, তাহাদের হাত ছাড়াইয়া পলায়নের চেষ্টা করিল। ইহ। দেখিয়া সাথীরা, বালক বালিকার হাত চাপিয়া ধরিলেন, কেহ বা সন্তান কোলে করিয়া ছুটিলেন। যুবতীগণ লীলাগমন পরিহার পূর্ব্বক মল বাজাইয়া দ্রুতগমনে চলিল। সিন্দুর, তৈল এবং স্বেদবিন্দু একত্রে মিশিয়া, ললাট বহিয়া, নাসিকার অগ্রভাগ পর্য্যন্ত পঁহুছিয়া দীর্ঘ পুণ্ড্ররূপে পরিশোভিত হইল।
মধুমক্ষিকা গুঞ্জন সাগরগর্জ্জনে পরিণত হইল। বিন্দু বিন্দু জলে বিশাল সমুদ্র হয়, একটী একটী মনুষ্য মিলিত হইয়া বিশাল মনুষ্যজলধি রচিত হইয়াছে। সমুদ্র কদাচ স্থির থাকে না, সেই মানবসমুদ্রও স্থির ছিল না। কখন এ দিকে কখন ও দিকে আলোড়িত, তরঙ্গিত, ক্ষুব্ধ হইতেছে। যে দিকে নূতন আমোদের বা কৌতূহলের বাতাস উঠিতেছে তরঙ্গদল সেই দিকে প্রবলবেগে প্রধাবিত হইতেছে। সে তরঙ্গ রোধ করে, কাহার সাধ্য? তরঙ্গমুখে যাহা পড়িতেছে তাহাই ভাসিয়া যাইতেছে। নিবাত নিস্তব্ধ সমুদ্রও যেমন একেবারে স্তব্ধ না হইয়া, পরিশ্রান্ত মহাকায় সজীব প্রাণীর তুল্য বক্ষঃ স্ফীত ও সঙ্কুচিত করিতে থাকে, মানবসমুদ্র ও সেইরূপ নিরন্তর বিচলিত হইতেছে। যে নূতন আসিতেছে সেই অপার সমুদ্রে জলবিন্দুবৎ মিশাইয়া যাইতেছে। সেতারা হইতে যাহারা আসিল তাহারাও বিশাল সমুদ্রে জলবিন্দুবৎ মিশাইয়া গেল।
রঘুজীর বাহুতে বিপুল বল। সেই ভুজযুগল সঞ্চালিত করিয়া মনুষ্যতরঙ্গ বিদীর্ণ করিয়া সমুদ্রগর্ভে প্রবেশ করিল। তারা তাহার পশ্চাতে পশ্চাতে চলিল, নয়নে চঞ্চল জ্যোতি, অধরে কুটিল হাসি। দুই একজন ঠেলা খাইয়া রঘুজীর প্রতি ক্রোধকষায়িত লোচনে চাহিয়া রহিল, কিন্তু তাহার মূর্ত্তি দেখিয়া আর কিছু করিতে বা বলিতে সাহস হইল না। সে অঞ্চলে অনেকেই রঘুজীকে চিনিত, তাহাকে দেখিয়া অনেকে পথ ছাড়িয়া দিল।
চারিদিকে লোকারণ্য। পণ্যবীথিকায় বসিয়া বিক্রেতা চীৎকার করিয়া ক্রেতা ডাকিতেছে। অসাবধানতাপ্রযুক্ত কেহ একটা বালকের চরণ মর্দ্দিত করিয়া গিয়াছে; বালক মাতার হাত ধরিয়া হাঁ করিয়া কাঁদিতেছে ও দরবিগলিত অশ্রুলোচনে সন্নিহিত মিষ্টান্নের দোকানের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া আছে। মাতা, সন্তানের চরণমর্দ্দনকারীর উদ্দেশে উচ্চরবে গালি দিতেছেন। কোন রমণীর সাড়ীতে চরণধূলি লাগিয়াছে, যাঁহার চরণ, গালির ধমকে তিনি পালাইবার পথ পান না। বর্দ্ধিত-নখ, শীর্ণকলেবর, বিভূতিভূষিত উর্দ্ধবাহু নিঃশব্দে ভিক্ষা চাহিতেছে, যুবতী সম্মুখে পাইলে আরও চাপিয়া ধরিতেছে। এদিকে রমণীর লোল কটাক্ষ, ওদিকে তর্জ্জন গর্জ্জন আর মারামারি। এখানে ঐন্দ্রজালিকের কৌতুক প্রদশন; ওখানে মল্লের আস্ফোট ধ্বনি। কোথাও নাগরদোলায় আরোহণ করিয়া বালকেরা ঘুরিতেছে; কোথাও কোন সুন্দরী কাচের কর্ণাভরণ ক্রয় করিয়া পুলকিত মনে বার বার তাহাই নিরীক্ষণ করিতেছেন। একস্থানে মাটীর পুতুল বিক্রীত হইতেছে; কতকগুলি বালক অনিমেষ লোচনে সেই স্থলে দণ্ডায়মান হইয়া খেলনা দেখিতেছে। কেহ চায় ঘোড়া, কেহ চায় মাটীর হাতী, কেহ চায় মাটীর মহাদেব। চারিদিকে ঠেলাঠেলি, হুড়াহুড়ি সর্ব্বত্র কোলাহল আর সর্ব্বত্র ধূলা।
এক দিকে বড় ভিড়। রঘুজী তারাকে সঙ্গে করিয়া সেই দিকে গেল। সেখানে নানাবিধ ব্যায়াম ক্রীড়া প্রদর্শিত হইতেছে। দর্শকেরা তাহাতে বড় মনোযোগ না করিয়া যেন আর কিছুর অপেক্ষা করিতেছে। রঙ্গস্থলের বাহিরে একটা পর্কটী বৃক্ষ ছিল, তারা সেই বৃক্ষে পৃষ্ঠ দিয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাহার পাশে একজন দীর্ঘকায় তরুণবয়স্ক যুবা অন্যমনে মৃদু মৃদু গান করিতেছিল, তারা তাহাকে বড় লক্ষ্য করিয়া দেখে নাই।
এমন সময়ে সেতারানিবাসী একজন যুবক সেই স্থলে উপস্থিত হইল, এবং তারাকে নির্দ্দেশ করিয়া পূর্ব্বোক্ত যুবককে কহিল, এই সেই তারা। দীর্ঘকায় যুবক এই কথা শ্রবণ করিয়া সাগ্রহে ও সমুৎসুকভাবে তারাকে ভাল করিয়া দেখিল।
তারার পরিধানে পূর্ব্বের মত পুরুষের বস্ত্রই ছিল। মস্তকে কোন আবরণ ছিল না।
আপনার নাম শুনিয়া তারা সবিস্ময়ে ফিরিয়া দেখিল, একজন অতি তরুণবয়স্ক, দীর্ঘাকৃতি, মনোহরকান্তি, যুবা পুরুষ, বামহস্তে সূর্য্যকিরণ আবৃত করিয়া সোৎসুক নয়নে তাহার প্রতি চাহিয়া রহিয়াছে। তেমন রূপ তারা কখন দেখে নাই। কুঞ্চিত কেশ স্কন্ধে পড়িয়াছে; ললাট প্রশস্ত, নির্ম্মল; ভ্রুযুগ সূক্ষ্ম, দীর্ঘ, তুলিচিত্রিত; চক্ষু দীর্ঘায়ত, কৃষ্ণতার, সমুজ্জ্বল, হাস্যপূর্ণ; নাসিকা দীর্ঘ, সরল, উন্নত; ওষ্ঠাধর ভাস্করের শিক্ষাস্থল; মুখে অতি মধুর, অতি সরল হাসি; চিবুকে নবীন কোমল শ্মশ্রু; দেবাকৃতি বীরাবয়ব। চাহিয়া চাহিয়া অবশেষে তারা চক্ষু অবনত করিল; লজ্জায় গণ্ডস্থল রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল, চক্ষে অভূতপূর্ব্ব মোহের আবেশ আসিল; তারা লজ্জায় অধোবদনে রহিল।
এতদিনে তারা বুঝিল, সে গর্ব্বিতপ্রকৃতি, কঠিনহৃদয়া বীরনারী নহে, অবশচিত্ত সামান্য মানবী মাত্র।
এই সময়ে যুবককে কে ডাকিল, গোকুলজী, আর কেন বিলম্ব করিতেছ? তোমার জন্য এত লোকে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, দেখিতেছ না?
যুবক হাসিয়া রঙ্গভূমি মধ্যে প্রবেশ করিল।
রুদ্ধ নিশ্বাসে তারা সেই দিকে চাহিয়া রহিল।
গোকুলজী ঈষৎ হাস্য করিয়া অঙ্গবস্ত্র খুলিয়া রাখিল। তখন তাহার বর্ত্তুলাকার বাহুমূল, দৃঢ় মাংসপেশী, বিশাল বক্ষ, ক্ষীণ কটি দর্শন করিয়া লোকে অস্ফুটস্বরে অনেক সুখ্যাতি করিল।
ভিড়ের ভিতরে শব্দ হইল, পথ ছাড়, অশ্ব আনিতেছে। আহত সলিলরাশি তুল্য দুই দিকে লোক সরিয়া গেল। ছয়জন লোকে দুইটা স্থূল রজ্জু ধরিয়া, দীর্ঘকেশরযুক্ত, আচ্ছাদিতচক্ষু একটা অশ্ব রঙ্গস্থলে আনয়ন করিল। চক্ষু আবৃত বলিয়া অশ্ব স্থির ছিল; লোকে বুঝিল পার্ব্বতীয় অশ্ব, এ পর্য্যন্ত বশীকৃত হয় নাই।
গোকুলজী অগ্রসর হইয়া অশ্বের কেশর মুষ্টিমধ্যে ধরিল। দর্শকেরা অনেক পশ্চাতে সরিয়া গেল, অতএব রঙ্গভূমির পরিসর বর্দ্ধিত হইল! রজ্জুধারিগণ রজ্জু উন্মোচন পূর্ব্বক পলায়ন করিল। তখন গোকুলজী স্বহস্তে অশ্বের চক্ষের আবরণ খুলিয়া দূরে নিক্ষেপ করিল। সেই মুহূর্ত্তে অশ্ব লম্ফ প্রদান করিয়া বেগে পলায়নের চেষ্টা পাইল।
গগনবিহারী শ্যেনপক্ষী দেখিলে কপোতকূল যেরূপ ভীত হয়, গোকুলজীর রিক্তহস্তে সেই ঘোটক দেখিয়া দর্শককুল সেইরূপ ত্রস্ত হইয়া উঠিল। সকলে আত্মরক্ষায় যত্নবান রহিল, কিন্তু কেহ সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া গেল না। কৌতূহলের আকর্ষণ এমনি বলবৎ।
পর্কটীবৃক্ষে পৃষ্ঠরক্ষা করিয়া তারা স্থিরভাবে দণ্ডায়মান রহিল। যৎকালে ভীতির অস্ফুট শব্দ করিয়া আর সকলে ইতস্ততঃ করিতেছে, তারা শিলাখণ্ডবৎ অটল রহিল, কোন দিকে এক পদ সরিল না।
অনন্তর দর্শকমণ্ডলী অতি অদ্ভুত দৃশ্য দেখিল। লোকালয়ের মানব বনের পশুকে, প্রভূত বলসম্পন্ন পর্ব্বতের অশ্বকে একা বাহুবলে বশীকৃত করিতেছে। অশ্ব কদাচ পৃষ্ঠে মনুষ্যভার বহে নাই, মনুষ্যের হস্ত অঙ্গস্পর্শ করিলে চমকিয়া উঠে; সম্মুখে বিপুল মানবসমুদ্র এবং তাহার ভীতিবদ্ধক মনুষ্যের কোলাহল; ভয়ে সে নিতান্ত উচ্ছৃঙ্খল হইয়া সাধ্যমত পলায়নের চেষ্টা করিতেছে। গোকুলজী বজ্রমুষ্টিতে তাহার কেশর ধরিয়া রহিয়াছে। অদ্ভুত দ্বন্দ্বযুদ্ধ! বিচিত্র প্রতিদ্বন্দীদ্বয়! মানবে আর অশ্বে বলের পরীক্ষা! মানুষের বুদ্ধি, কৌশল, চাতুরী, কিছু নাই; মাত্র বাহুবল। একবার অশ্ব গোকুলজীকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে, আবার গোকুলজী সিংহবলে তাহাকে টানিয়া আনিতেছে। অশ্বক্ষুরে অন্ধকার ধূলিরাশি উঠিল।
উভয়ে ঘর্ম্মাক্তকলেবর হইল। অশ্বের নাসারন্ধ্রে ফেন ছুটিল। গোকুলজী ধূলি এবং ঘর্ম্মে আপাদমস্তক কর্দ্দমাক্ত হইল। অবশেষে গোকুলজী অশ্বের কেশর পরিত্যাগ করিয়া তাহার নাসিকার উপরিভাগ চাপিয়া ধরিল। অশ্ব তখন নিশ্চেষ্ট হইয়া কাঁপিতে লাগিল। গোকুলজী বারবার অশ্বের স্কন্ধে করতাড়না করিল। তথাপি অশ্ব নিশ্চেষ্ট রহিল। অশ্ব বশীকরণ সমাধা হইল।
ধন্য বাহুবল!
মানবসমুদ্র মধ্যে সন্তোষসূচক মহাকোলাহল উঠিল। তারাবাই পূর্ব্ববৎ স্থির রহিল।
গোকুলজী ললাটে স্বেদ মুছিতে মুছিতে রঙ্গস্থলের বাহিরে আসিল। অমনি একজন তাহার হাত ধরিয়া বলিয়া উঠিল, এদেশে গোকুলজীকে বলে আঁটে এমন কেহ নাই। রঘুজী পাশে দাঁড়াইয়া এই কথা শুনিল। কথাটা তাহার বড়ই অসহ্য বোধ হইল। কর্কশ স্বরে চীৎকার করিয়া কহিল, একটা বালককে লইয়া মিথ্যা বড়াই কেন? বালাজীর বেটা গোকুলজী, আমি তাহাকে জানি।
গোকুলজী হাঁপাইতে হাঁপাইতে স্বেদ মুছিতেছিল। সে রঘুজীকে চিনিত। তাহার কথা শুনিয়া হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি জান রঘুজী?
রঘুজী সেইরূপ কর্কশ স্বরে উত্তর করিল, আমি তোমার পিতাকে বিলক্ষণ জানি। তাহার কত বল ছিল, তাহাও জানি। আজ তুমি একটা ঘোড়া ধরিয়া দিগ্বিজয়ী হইলে। কি বাপের বেটা রে!
গোকুলজী রঘুজীকে চিনিত বটে, কিন্তু তাহাকে ভয় করিত না। রঘুজীর কথা শুনিয়া গম্ভীর ভাবে কহিল, দেখ, রঘুজী! আমার পিতা ইহলোকে নাই। তিনি থাকিলে আমাকে তোমার কথার উত্তর দিতে হইত না। আমার পিতার কত বল ছিল, তাহা তুমি জান। যখন আর কেহ তোমার বলে পারিত না, তখন তিনি তোমার সমকক্ষ ছিলেন, এ কথা তোমার স্মরণ থাকিতে পারে।
রঘুজী উত্তরে কটু করিয়া গালি দিল, তোর বাপ যেমন মিথ্যাবাদী ও দাম্ভিক ছিল, তুইও সেইরূপ হইয়াছিস্।
মর্ম্মাহত সিংহের ন্যায় গোকুলজী লম্ফ দিয়া রঘুজীর গলদেশে হস্ত অর্পিত করিল, তৎপরে ক্রোধকম্পিত স্বরে কহিল, রঘুজী, তোমার শুভ্রকেশ বলিয়াই আজ আমার হাতে রক্ষা পাইলে, নহিলে আমার পিতার নিন্দা বা অপমান করিয়া তুমি অক্ষত শরীরে গৃহে ফিরিয়া যাইতে পারিতে না।
গোকুলজী সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। রঘুজীর হাতে লাঠি ছিল। লাঠি ত্যাগ করিয়া কহিল, বালক, পলিতকেশ হইলেও তোর অপেক্ষা হীনবল নহি। এই বলিয়া তাহাকে মুষ্ট্যাঘাত করিল। তখন দুইজনে হাতাহাতি আরম্ভ হইল।
অশ্ব বশীকরণের পর সকলে মনে করিয়াছিল, এখানে আর কিছু দেখিবার নাই, এই ভাবিয়া অনেকে চলিয়া যাইতেছে, এমন সময় নূতন ব্যাপারটা দেখিতে দাঁড়াইল। রঘুজীকে অনেকেই চিনিত; তাহার সামর্থ্য প্রচুর, এ কথাও অনেকে জানিত। এই কারণে অনেকে আরও কুতূহলী হইয়া দাঁড়াইল। কিন্তু কেহ মধ্যস্থ হইয়া তাহাদিগকে নিরস্ত করিবার প্রয়াস করিল না।
গোকুলজী দীর্ঘাকৃত, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্ফূর্ত্তিপূর্ণ; রঘুজী খর্ব্বকায়, কঠিন গ্রন্থি, কিন্তু অসীম সামর্থশালী। দুইজনে ক্রোধান্ধ; দুইজনে মহা বলবান; গোকুলজী পূর্ব্বপরিশ্রমে পরিক্লান্ত, রঘুজী অশ্রান্ত। প্রথমেই রঘুজী গোকুলকে দুই হস্তে ধরিয়া ভূত্বলে নিক্ষেপ করিবার উপক্রম করিল। সে হস্তে মত্তহস্তীর বল। ব্যয়িতবল গোকুলজী স্রোতোমুখে বেতসীতুল্য অবনত হইয়া প্রায় ধরাশায়িত হইল। সেই সময় তাহার স্ফূর্ত্তি কাজে লাগিল। চরণদ্বর ভূমিতে সবলে স্থাপিত করিয়া, জলে মীনবৎ ঘুরিয়া রঘুজীর ভুজবন্ধন হইতে বাহির হইয়া গেল। রঘুজী চক্ষু পালটিতে দীর্ঘ বাহুদ্বারা গোকুলজী তাহার কটিদেশ বেষ্টিত করিল। একবার, দুইবার, তিনবার রঘুজী প্রবলবেগে সে বন্ধন হইতে মুক্ত হইবার চেষ্টা করিল, তিনবার সে চেষ্টা বিফল হইল। যে বাহুতে অশ্ব বশীভূত হইয়াছিল, সে বাহুর বল সহজ নয়। রঘুজী কঠিন বন্ধনে পড়িল। গোকুলজী তাহার কটি আরও দৃঢ়রূপে ধরিল। তাহার পর তাহাকে ভূমি হইতে উঠাইবার চেষ্টা করিল। সকলে দেখিল রঘুজী বিপদে পড়িয়াছে, এইবার যদি গোকুলজী তাহাকে তুলিয়া ধরণীতে নিক্ষেপ করে, তাহা হইলে তাহার পরাজয় হয়। গ্রামবাসী যেমন সভয়ে বহুপুরাতন, পূর্ব্বপুরুষ প্রতিষ্ঠিত, বৃহৎ অশ্বত্থবৃক্ষের উপর ভীম প্রভঞ্জনের দৌরাত্ম্য দেখে, প্রভঞ্জনবলে তরুশাখা মড়মড় করিতেছে, দুর্দ্দমনীয় আঘাতে প্রকাণ্ড তরু ধীরে ধীরে উন্মূলিত হইতেছে, দেখিয়া যেমন ভীত হয়, যে মুহূর্ত্তে উন্নতমস্তক তরুবর ভূমিশায়ী হইবে, সভয়ে সেই মুহূর্ত্তের প্রতীক্ষা করিতে থাকে, দর্শকশ্রেণীও সেইরূপ সভয়ে রঘুজীর যে মুহূর্ত্তে পরাজয় হইবে, সেই মুহূর্ত্তের অপেক্ষা করিতে লাগিল।
তিনবার গোকুলজী রঘুজীকে শূন্যে তুলিবার উদ্যম করিল! তিনবার রঘুজী মৃত্তিকাপ্রোথিত প্রস্তরবৎ অটল রহিল। চতুর্থবার রঘুজী শূন্যে উঠিল। গোকুলজী তাহাকে মাথার উপরে তুলিয়া দূরে নিক্ষেপ করিবার উপক্রম করিল, অপর মুহূর্ত্তে কি মনে করিয়া তাহাকে ধীরে ধীরে নামাইয়া দিল। তৎপরে ধীরস্বরে কহিল, রঘুজী, তোমাকে বলে পরাজিত করিয়া অপমানিত করিলে, আমার পৌরুষ বাড়িবে না। আমাকে গালি দিতে হয় দিও, তোমায় আমি কিছু বলিব না, আমার পিতার অবমাননা সহ্য করিতে পারি না।
এইমাত্র বলিয়া গোকুলজী ধীর গমনে চলিয়া গেল।
পর্কটীবৃক্ষতলে চিত্রার্পিত মূর্ত্তিতুল্য তারা দাঁড়াইয়াছিল। গমনকালে গোকুলজী তাহাকে বলিয়া গেল, তোমার সাহসের ও বলের অদ্ভুত পরিচয় শুনিয়া তোমার সহিত আলাপ করিবার ইচ্ছা ছিল। তোমার পিতার দোষে তাহাতে বঞ্চিত হইলাম। এই বলিয়া, উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া চলিয়া গেল। তারার সহিত গোকুলজী কথা কহিয়াছে, রঘুজী তাহা দেখিতে পাইল না।
রঘুজী বিনাবাক্যে লাঠি তুলিয়া লইয়া, চারিদিকে চাহিয়া তারাকে দেখিল, তাহার পর তাহাকে অনুসরণ করিতে সঙ্কেত করিয়া গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিল।
জঙ্গলের পথে সে সময় অন্য পথিক ছিল না। রঘুজী আগে আগে তারা পশ্চাতে পশ্চাতে চলিল। বনমধ্যে গাছে গাছে পক্ষীর কূজন শ্রুত হইতেছিল। বৃক্ষচ্ছায়া দীর্ঘ হইয়া পূর্ব্বদিকে হেলিতে আরম্ভ করিয়াছিল। তারা মাথা তুলিয়া গাছের পাতা, গাছের মাথা, তাহার উপরে সূর্য্যকিরণ, আর বৃক্ষশাখায় বিহঙ্গের পক্ষবিধুনন দেখিতেছিল। অকস্মাৎ তাহার নয়নদ্বয় অশ্রুপূর্ণ হইল। তাহার পর একটা বৃক্ষমূলে বসিয়া কাঁদিয়া বলিল, আমি বাড়ী যাইব না।
রঘুজী ফিরিয়া চাহিল। সে অদ্যাবধি তারাকে কখন রোদন করিতে দেখে নাই। তাহাকে রোদন করিতে দেখিয়া, দন্ত নিষ্পেষিত করিয়া কহিল, তুই কি পাগল হয়েছিস্ নাকি? কাঁদিতেছিস্ কেন? উঠিয়া দাঁড়া।
তারা উঠিয়া দাঁড়াইল। পুনরপি কাঁদিয়া কহিল, আমি বাড়ী যাইব না।
রঘুজী আবার জিজ্ঞাসা করিল, তুই কাঁদিতেছিস্ কেন?
তারা আর থাকিতে পারিল না। উন্মত্তার মত কহিল, তুমি অনর্থক সকলের সঙ্গে কেন অসদ্ভাব কর? গোকুলজী তোমার কি করিয়াছিল, যে তুমি তাহার সহিত কলহ করিলে?
অসহ্য অপমান রঘুজীর হৃদয়ে জাগরূক ছিল। বৈরসাধনের কোন উপায় ছিল না, এ কারণে অপমানানল আরও প্রজ্জ্বলিতভাবে জ্বলিতেছিল। উত্তরে রঘুজী দুই হাতে লাঠি ধরিয়া ঘুরাইয়া তারার পৃষ্ঠে প্রহার করিল। ছিন্নকদলীবৎ তারা ভূতলে পতিত হইল। মেরুদণ্ড প্রায় ভগ্ন হইয়া গেল। তারা যন্ত্রণায় চীৎকার করিল না, কোনও শব্দ করিল না। গতজীবন মানবদেহের তুল্য নিস্পন্দ রহিল।
রঘুজী তাহার পর তাহাকে লাথি মারিয়া উঠাইল, কহিল, বাড়ী যা। আবার এরূপ কথা শুনিলে তোকে প্রাণে রধ করিব।
তারা বিনাশব্দে, বাষ্পবিহীন চক্ষে, ধুলিধূসরিত অঙ্গে, মজ্জাগত যন্ত্রণায়, ধীরে ধীরে উঠিয়া বাড়ী গেল। কাহাকেও কোন কথা বলিল না।
দুইটি মাত্র পরিবর্ত্তন ঘটিল। সেই দিন অবধি তারা পুরুষের বেশ পরিত্যাগ করিল। সেই দিন অবধি পিতাকে পিতৃসম্বোধন রহিত করিল।