পলাতকা/মালা
মালা
আমি যেদিন সভায় গেলেম প্রাতে,
সিংহাসনে রানীর হাতে
ছিল সােনার থালা,
তারই ’পরে একটি শুধু ছিল মণির মালা।
কাশী কাঞ্চী কানােজ কোশল অঙ্গ বঙ্গ মদ্র মগধ হতে
বহুমুখী জনধারার স্রোতে
দলে দলে যাত্রী আসে
ব্যগ্র কলােচ্ছ্বাসে।
যারে শুধাই ‘কোথায় যাবে’ সেই তখনি বলে,
‘রানীর সভাতলে।’
যারে শুধাই ‘কেন যাবে’ কয় সে তেজে, চক্ষে দীপ্ত জ্বালা,—
‘নেব বিজয়মালা।’
কেউ বা ঘোড়ায় কেউ বা রথে
ছুটে চলে, বিরাম চায় না পথে।
মনে যেন আগুন উঠল খেপে,
চঞ্চলিত বীণার তারে যৌবন মাের উঠল কেঁপে কেঁপে।
মনে মনে কইনু হর্ষে, ‘ওগাে জ্যোতির্ময়ী,
তােমার সভায় হব আমি জয়ী।
শূন্য ক’রে থালা
নেব বিজয়মালা।’
একটি ছিল তরুণ যাত্রী, করুণ তাহার মুখ,
প্রভাত-তারার মতো যে তার নয়ন-দুটি কী লাগি উৎসুক!
সবাই যখন ছুটে চলে
সে যে তরুর তালে
আপন-মনে বসে থাকে।
আকাশ যেন শুধায় তাকে,
যার কথা সে ভাবে কী তার নাম!
আমি তারে যখন শুধালাম
‘মালার আশায় যাও বুঝি ঐ হাতে নিয়ে শূন্য তোমার ডালা’
সে বলে, ‘ভাই, চাই নে বিজয়মালা।’
তারে দেখে সবাই হাসে;
মনে ভাবে, ‘এও কেন মোদের সাথে আসে—
আশা করার ভরসাও যার নাইকো মনে,
আগে হতেই হার মেনে যে চলে রণে!’
সবার তরে জায়গা সে দেয় মেলে,
আগেভাগে যাবার লাগি ছুটে যায় না আর-সবারে ঠেলে।
কিন্তু নিত্য সজাগ থাকে;
পথ চলেছে যেন রে কার বাঁশির অধীর ডাকে
হাতে নিয়ে রিক্ত আপন থালা;
তবু বলে, চায় না বিজয়মালা।
সিংহাসনে একলা বসে রানী
মূর্তিমতী বাণী।
ঝংকারিয়া গুঞ্জরিয়া সভার মাঝে
আমার বীণা বাজে।
কখনো বা দীপকরাগে
চমক লাগে,
তারা বৃষ্টি করে;
কখনো বা মল্লারে তার অশ্রুধারার পাগল-ঝোরা ঝরে।
আর-সকলে গান শুনিয়ে নতশিরে
সন্ধ্যাবেলার অন্ধকারে ধীরে ধীরে
গেছে ঘরে ফিরে।
তারা জানে, যেই ফুরাবে আমার পালা
আমি পাব রানীর বিজয়মালা।
আমাদের সেই তরুণ সাথি বসে থাকে ধুলায় আসন-তলে;
কথাটি না বলে।
দৈবে যদি একটি-আধটি চাঁপার কলি
পড়ে স্খলি
রানীর আঁচল হতে মাটির ’পরে
সবার অগোচরে
সেইটি যত্নে নিয়ে তুলে
পরে কর্ণমূলে।
সভাভঙ্গ হবার বেলায় দিনের শেষে
যদি তারে বলি হেসে
‘প্রদীপ জ্বালার সময় হল সাঁঝে,
এখনো কি রইবে সভা-মাঝে?’
সে হেসে কয়, ‘সব সময়েই আমার পালা—
আমি যে ভাই, চাই নে বিজয়মালা।’
আষাঢ় শ্রাবণ অবশেষে
গেল ভেসে
ছিন্ন মেঘের পালে—
গুরু গুরু মৃদঙ্গ তার বাজিয়ে দিয়ে আমার গানের তালে।
শরৎ এল, শরৎ গেল চলে;
নীল আকাশের কোলে
রৌদ্রজলের কান্নাহাসি হল সারা;
আমার সুরের থরে থরে ছড়িয়ে গেল শিউলিফুলের ঝারা।
ফাগুন চৈত্র আম-মউলের সৌরভে আতুর,
দখিন-হাওয়ার আঁচল ভরে নিয়ে গেল আমার গানের সুর।
কণ্ঠে আমার একে একে সকল ঋতুর গান
হল অবসান।
তখন রানী আসন হতে উঠে
আমার করপুটে
তুলে দিলেন শূন্য করে থালা
আপন বিজয়মালা।
পথে যখন বাহির হলেম মালা মাথায় প’রে
মনে হল, বিশ্ব আমার চতুর্দিকে ঘোরে
ঘূর্ণিধুলার মতো।
মানুষ শত শত
ঘিরল আমায় দলে দলে—
কেউ বা কৌতূহলে,
কেউ বা স্তুতিচ্ছলে,
কেউ বা গ্লানির পঙ্ক দিতে গায়!
হায় রে হায়,
এক নিমেষে স্বচ্ছ আকাশ ধূসর হয়ে যায়।
এই ধরণীর লাজুক যত সুখ
ছোটোখাটো আনন্দেরই সরল হাসিটুক
নদীচরের ভীরু হংসদলের মতো
কোথায় হল গত।
আমি মনে মনে ভাবি, ‘একি দহনজ্বালা
আমার বিজয়মালা!’
ওগো রানী, তোমার হাতে আর-কিছু কি নেই?
শুধু কেবল বিজয়মালা এই?
জীবন আমার জুড়ায় না যে;
বক্ষে বাজে
তোমার মালার ভার—
এই কি পুরস্কার?
এ তো কেবল বাইরে আমার গলায় মাথায় পরি;
কী দিয়ে যে হৃদয় ভরি
সেই তো খুঁজে মরি।
তৃষ্ণা আমার বাড়ে শুধু মালার তাপে;
কিসের শাপে
ওগো রানী, শূন্য করে তোমার সোনার থালা
পেলেম বিজয়মালা?
আমার কেমন মনে হল, আরো যেন অনেক আছে বাকি—
সে নইলে সব ফাঁকি।
এ শুধু আধখানা—
কোন্ মানিকের অভাব আছে, এ মালা তাই কানা।
হয় নি পাওয়া, সেই কথাটাই কেন মনের মাঝে
এমন করে বাজে!
চল্ রে ফিরে, বিড়ম্বিত, আবার ফিরে চল্,
দেখবি খুঁজে বিজন সভাতল—
যদি রে তোর ভাগ্যদোষে
ধুলায় কিছু পড়ে থাকে খসে।
যদি সোনার থালা
লুকিয়ে রাখে আর-কোনো এক মালা!
সন্ধ্যাকাশে শান্ত তখন হাওয়া;
দেখি, সভার দুয়ার বন্ধ, ক্ষান্ত তখন সকল চাওয়া পাওয়া।
নাই কোলাহল, নাইকো ঠেলাঠেলি,
তরুশ্রেণী স্তব্ধ যেন শিবের মতন যোগের আসন মেলি।
বিজন পথে আঁধার গগনতলে
আমার মালার রতনগুলি আর কি তেমন জ্বলে?
আকাশের ঐ তারার কাছে
লজ্জা পেয়ে মুখ লুকিয়ে আছে।
দিনের আলোয় ভুলিয়েছিল মুগ্ধ আঁখি,
আঁধারে তার ধরা পড়ল ফাঁকি।
এরই লাগি এত বিবাদ, সারা দিনের এত দুখের পালা?
লও ফিরে লও তোমার বিজয়মালা!
ঘনিয়ে এল রাতি।
হঠাৎ দেখি, তারার আলোয় সেই-যে আমার পথের তরুণ সাথি
আপন-মানে
গান গেয়ে যায় রানীর কুঞ্জবনে।
আমি তারে শুধাই ধীরে, ‘কোথায় তুমি এই নিভৃতের মাঝে
রয়েছ কোন্ কাজে?’
সে হেসে কয়, ‘ফুরিয়ে গেলে সভার পালা,
ফুরিয়ে গেলে জয়ের মালা,
তখন রানীর আসন পড়ে বকুল-বীথিকাতে—
আমি একা বীণা বাজাই রাতে।’
শুধাই তারে, ‘কী পেলে তাঁর কাছে?’
সে কয় শুনে ‘এই-যে আমার বুকের মাঝে আলো ক’রে আছে—
কেউ দেখে নি রানীর কোলে পদ্মপাতার ডালা,
তারই মধ্যে গোপন ছিল আপন হাতের গাঁথা বরণমালা।’