পলাশির যুদ্ধ/দ্বিতীয় সর্গ

কাটোয়া-ব্রিটিশ-শিবির।

দিবা অবসান প্রায়; নিদাঘ-ভাস্কর
বরধি অনলরাশি, সহস্র কিরণ,
পাতিয়াছে, বিশ্রামিতে ক্লান্ত কলেবর,
দুর তরুরাজিশিরে স্বর্ণ-সিংহাসন।
খচিত সুবর্ণমেঘে সুনীল গগন
হাসিছে উপরে; নীচে নাচিছে রঙ্গিণী
চুম্বি মৃদু কলকলে মন্দ সমীরণ,
তরল সুবর্ণময়ী গঙ্গা তরঙ্গিণী।
শোভিছে একটি ররি পশ্চিম গগনে,
ভাসিছে সহস্র রবি জাহ্নবী-জীবনে।

অদূরে কাটোয়া-দুর্গে ব্রিটিশ-কেতন
উড়িছে গৌরবে, উপহাসিয়া ভাস্করে।
উঠিতেছে ধূমপুঞ্জ আঁধারি গগন,
ভস্মিয়া যবন-বীর্য্য কাটোয়া-সমরে।
সশস্ত্র ব্রিটিশ সৈন্য তরী আরোহিয়া
হইতেছে গঙ্গাপার,—অস্ত্র ঝলঝলে;
দূর হ’তে বোধ হয়, যাইছে ভাসিয়া
জবা-কুসুমের মালা জাহ্নবীর জলে।
রক্তবস্ত্রে, রণ-অস্ত্রে, রবির কিরণ
বিকাশিছে প্রতিবিম্ব, ধাঁধিয়া নয়ন।


ব্রিটিশের রণবাদ্য বাজে ঝম্ ঝম,
হইতেছে পদাতিক-পদ সঞ্চালন
তালে তালে, বাজে অস্ত্র ঝনন্‌ ঝনন্‌;
হেষিছে তুরঙ্গ রঙ্গে, গর্জ্জিছে বারণ।
থেকে থেকে বীরকণ্ঠ সৈনিকের স্বরে,
ঘুরিছে ফিরিছে সৈন্য ভূজঙ্গ যেমতি
সাপুড়িয়া মন্ত্রবলে;—কভু অস্ত্র করে,
কভু স্কন্ধে; ধীরপদ, কভু দ্রুতগতি।

“ড্রমের’ ঝর্ঝর রব, ‘বিপুল’ ঝঙ্কার,
বিজ্ঞাপিছে ব্রিটিশের বীর্য্য অহঙ্কার।

8


নীরবে—সৈন্যের স্রোত বহিছে নীরবে
অতিক্রমি ভাগীরথী; বিরাজে বদনে
গম্ভীরতা-প্রতিমূর্ত্তি। আসন্ন আহবে
বিমল চিন্তার স্রোত উচ্ছাসিছে মনে
হতভাগাদের, আহা! প্রতিবিম্ব তার
ভাসিছে নয়নে, ওই ভাসিছে বদনে।
পারিতাম যদি আমি চিত্রিতে সবার
বদনমণ্ডল, তবে মানবের মনে
যত সুকুমার ভাব হয় উদ্দীপিত,
এই চিত্রে মূর্ত্তিমান হ’ত বিরাজিত।


কোন হতভাগা আহা! বসিয়া বিরলে
প্রেমের প্রতিমা পত্নী স্মরিয়া অন্তরে
নীরবে ভাসিছে দুই নয়নের জলে;
ভাসে ভারাক্রান্তচিত্ত বিষাদ-সাগরে।
ভুলেছে সমরসজ্জা, না দেখে নয়নে
শিবির,—সৈনিক,—সেনা,—নদী ভাগীরথী;

রণবাদ্য ঘনরোল না পশে শ্রবণে';
প্রেমমন্ত্র-মুগ্ধ-চিত, প্রেম-মুগ্ধ-মতি।
কেবল দেখিছে প্রিয়া-বদন-চন্দ্রিমা,
কেবল শুনিছে প্রেম-ভাষী-মধুরিমা! .


কোথায় বা বিদায়ের হৃদয়বেদনা
স্মরিয়া মরমে, আহা! চিত্রি স্মৃতিবলে
অশ্রুসিক্ত প্রণয়িনী-বদনচন্দ্রমা,
বিকচ গোলাপ যথা শিশিরের জলে;—
নেত্রনীলোৎপল হ’তে প্রেমে উচ্ছ্বাসিয়া
ঝরেছিল যেইরূপে অশ্রুমুক্তাবলী,
প্রফুল্ল পঙ্কজ যথা প্রভাতে ফুটিয়া
বরষে শিশিরবিন্দু সমীরণে টলি;
বেণীমুক্ত কেশরাশি; অলক্ত অধর,
সতত সরস, পূর্ণ অমৃতশীকর;—


কাঁদে কোন হতভাগা। ভাবে নিরস্তর,
আর কি সে চারু মুখ দেখিবে নয়নে?
আর কি সে প্রেমময়ী-কোমল-অধর
চুম্বিবে প্রণয়-উষ্ণ সুদীর্ঘ চুম্বনে?

আসন্ন সমরক্ষেত্রে, নশ্বর সমরে,
প্রহারিবে ষবে অরি অসি উগ্রতর,—
দেখিবে সে মুখচন্দ্র। মধ্যাহ্ন ভাস্করে
জিনি, তোপ-বিনিঃসৃত গোলা ভয়ঙ্কর
আসিবে হুঙ্কারি যবে, দেখিয়া তখন
সে মুখ সজলশশী, ত্যজিবে জীবন।


আবার কোথায় কাঁদে বিকল অন্তরে
অভাগা জনক, স্মরি অপত্য-মমতা!
আর কি লইবে কোলে, চুম্বিবে আদরে,
সুবর্ণকুসুম পুত্র, কন্যা স্বর্ণলতা?
কেহ বা ভাবিয়া বৃদ্ধ জনক জননী
কাঁদিছে নীরবে দুঃখে, আনায় মাঝারে
কুরঙ্গশাবক কাঁদে নীরবে যেমনি,
ভাবি অবিলম্বে যাবে ব্যাধের আহারে।
এইরূপে মনোভাব কুসুম-কোমল,
গঙ্গাতীরে, নীরে, ফুটে ঝরে অবিরল!


শ্বেতদ্বীপ-সুত কেহ ভাবিয়া স্বদেশ—
বীরত্বের রঙ্গভূমি, ঐশ্বর্য্য ভাণ্ডার,

স্বাধীনতা-চিরবাস, গৌরবে দিনেশ,
সভ্যতার সুশিক্ষার উন্নতি-আধার,
(হায় রে পূর্ব্বের রবি গিয়াছে পশ্চিমে!)
অধীর স্মৃতির অস্ত্রে; ভাবে মনে মনে,
দেখিবে সে জন্মভূমি আর কত দিনে।
দেখিবে কি পুনঃ আহা! এ মর জীবনে?
শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ভাবি শ্বেতাঙ্গিনী প্রিয়া,
অধীর বিচ্ছেদ-বাণে, ফাটে বীর হিয়া!

১০


কেহ বা ভাবিছে এই আসন্ন সমরে
কীর্ত্তির কিরীট-রত্ন লভিবে অচিরে;
কেহ ভাবে পদোন্নতি; কেহ অর্থতরে,
আকাশ করিছে পূর্ণ সুবর্ণ মন্দিরে।
কেহ বা কল্পনা-বলে বধিয়া নবাবে,
বিজয়-পতাকা তুলি পশি কোষাগারে,
লুটিতেছে ধনজাল; কল্পনা-প্রভাবে
লুণ্ঠন করিয়া শেষ, ষোড়শোপচারে
পূজিতেছে প্রণয়িনী কোন বীরবর,
সুবর্ণে সৃজিয়া হর্ম্ম্য অতি মনোহর।

১১

ধন্য আশা কুহকিনি! তোমার মায়ায়
মুগ্ধ মানবের মন, মুগ্ধ ত্রিভুবন।
দুর্ব্বল-মানব-মনোমন্দিরে তোমায়
যদি না সৃজিত বিধি; হায়! অনুক্ষণ
নাহি বিরাজিতে তুমি যদি সে মন্দিরে;
শোক দুঃখ, ভয়, ত্রাস, নিরাশ-প্রণয়,
চিত্তার অচিন্ত্য অস্ত্র, নাশিত অচিরে
সে মনোমন্দির শোভা। পলাত নিশ্চয়
অধিষ্ঠাত্রী জ্ঞানদেবী ছাড়িয়া আবাস;
উন্মত্ততা ব্যাঘ্ররূপে করিত নিবাস!

১২


ধন্য, আশা কুহকিনি! তোহার মায়ায়
অসার সংসারচক্র ঘোরে নিরবধি!
দাঁড়াইত স্থিরভাবে, চলিত না হায়!
মন্ত্রবলে তুমি চক্র না ঘুরাতে যদি!
ভবিষ্যত-অন্ধ মূঢ় মানব সকল
ঘুরিতেছে কর্ম্মক্ষেত্রে বর্ত্তুল আকার,
তব ইন্দ্রজালে মুগ্ধ; পেয়ে তব বল
বুঝিছে জীবন-যুদ্ধ হয়ে অনিবার।

নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিকরে,
নাচাও তেমতি তুমি অর্ব্বাচীন নরে।

১৩


ওই যে কাঙ্গাল বসি রাজপথ ধীরে,—
দীনতার প্রতিমূর্ত্তি -কঙ্কাল-শরীর;
জীর্ণ পরিধেয় বস্ত্র, দুর্গন্ধ আধার;
দুনয়নে অভাগার বহিতেছে মীরু।
ভিক্ষা করি দ্বারে দ্বারে এ তিন প্রহর
পাইয়াছে যাহা, তাহে জঠর-অমল
নাহি হবে নির্ব্বাপণ; রুগ্ন কলেবর;
চলে না চরণ, চক্ষে ঘোরে ধরাতল।
কি মন্ত্র কহিলে তুমি অভাগার কাণে,
চলিল অভাগা পুনঃ ভিক্ষায় সন্ধানে।

১৪


ধর্ম্মাধিকরণে বসি মিল্প কর্ম্মচারী,
উদরে জঠর-জ্বালা, গুরু কার্য্যভারে
অবনত মথ,—ওই হংসপুচ্ছধারী
বীররর,—যুঝিতেছে অনন্ত প্রহারে
মসীপাত্র সহ, ম্লেচ্ছ-পদাঘাত-ভয়ে।
যথা শালবৃক্ষ করে, গিরি-শিরোপরে

যুঝিল ত্রেতায় বীর অঞ্জনাতনয়,
নীল সিন্ধু সহ, ডরি সুগ্রীব বানরে।
ঘর্ম্মসহ অশ্রুবিন্দু বহে দর দর,
ভাবিতেছে এই পদ ত্যজিবে সত্বর।

১৫


না জানি কি ভবিষ্যত, আশা মায়াবিনী!
চিত্রয়ে নয়নে তার; মুছি ঘর্ম্মজল,
মুছি অশ্রুজল, পুনঃ লইয়া লেখনী,
আরম্ভিল মসীযুদ্ধ হইয়া সবল।
নবীন প্রেমিক ওই বসিয়া বিরলে,
না পেয়ে প্রিয়ার পত্রে তব দরশন,
নিরাশ প্রণয়ে ভাসে নয়নের জলে,
ভঙ্গ প্রায় অভাগার প্রণয়-স্বপন।
শুনিয়া তোমার মৃদু সুমধুর ভাষা,
বলিল নিশ্বাস ছাড়ি—“না ছাড়িব আশা”।

১৬


যথা যবে বহে বেগে ভীম প্রভঞ্জন,
সামান্য সরসীনীর হয় হিল্লোলিত;
আসন্ন আহবে ক্ষুদ্র পদাতিক মন
করেছে তেমতি হায় আজি উচ্ছসিত।

কিম্বা সৌরকর যথা মুকুটরতন
রচি ইন্দ্রচাপে, রঞ্জে নীল কাদম্বিনী;
তেমতি সৈন্যের স্নান বিষাদিত মন
ছলে দুরাকাঙ্ক্ষা চিত্রে আশা মায়াবিনী।
হয় যদি ইহাদের দুরাশা পূরণ,
কত পর্ণগৃহ হবে রাজার ভবন।

১৭


অথবা সুদুরে কেন করি অন্বেষণ?
দুরাশার মন্ত্রে মুগ্ধ আমি মুঢ়মতি!
নতুবা যে পথে কোন কবি বিচরণ
করেনি, সে পথে কেন হবে মম গতি?
বঙ্গ ইতিহাস, হায়, মণিপূর্ণ খনি!
কবির কল্পনালোকে কিন্তু আলোকিত
নহে যা, কেমনে আমি, বল কুহকিনি!
মম ক্ষুদ্র কল্পনায় করি প্রকাশিত?
না আলোকে যদি শশী তিমির রজনী,
নক্ষত্রের নহে সাধ্য উজলে ধরণী।

১৮


কোন্‌ পুণ্যবলে সেই খনির ভিতরে
প্রবেশি, গাঁথিয়া মালা অবিদ্ধ রতনে,

দোলাইব মাতৃভাষা কম কলেবরে,—
সুকবি সুকরে গাঁথা মহাকাব্য ধনে
সজ্জিত যে বরবপুঃ? কিম্বা অসম্ভব
নহে কিছু, হে দুরাশে! তোমার মাযায়;
কত ক্ষুদ্র নর, ধরি পদছায়া তব,
লভিয়াছে আমবতা এ মর ধরায়।
অতএব দয়া করি, কহ, দষাবতি।
কি চিত্রে রঞ্জিছ আজি শ্বেত-সেনাপতি?

১৯


শিবিব অনতিদূবে, বসি তরুতলে
নীববে ক্লাই ব, মগ্ন গভীব চিন্তাষ।
গম্ভীর মুখশ্রী, কিন্তু বদনমণ্ডলে
নাহি সুরূপের চিহ্ন; মনোহারিতায়
নাহি বঞ্জে শ্বেত কান্তি; অথচ যুবাব
সর্ব্বাঙ্গ সৌষ্ঠবময়। প্রশস্ত ললাট
বীবত্বের রঙ্গভূমি, জ্ঞানের আধার।
বক্ষঃস্থল যেন যমপুবীর কপাট,—
প্রশস্ত সুদৃঢ়; বহে তাহার ভিতর
দুরাকাংক্ষা, দুঃসাহস, স্রোতঃ ভয়ঙ্কর।

২০

যুগল নয়ন জিনি উজ্জ্বল হীরক
আভাময়; অন্তর্ভেদি তীব্র দৃষ্টি তার
স্থির, অপলক, দৃঢ়-প্রতিজ্ঞা-ব্যঞ্জক।
যে অসম সাহসাগ্নি হৃদয়ে তাঁহার
জলে, যথা অগ্নিগিরি অন্তঃস্থ অনল,
প্রদীপ্ত নয়নে সদা প্রতিভা তাহার—
ভুবনবিজয়ী জ্যোতিঃ—বরষে গরল
শত্রুর হৃদয়ে; কিন্তু কখন আবার,
সে নেত্রনীলিমা, নীল নরকাগ্নি মত,
দেখায় চিত্তের সুপ্ত দুষ্প্রবৃত্তি যত।

২১


নীরবে, নির্জ্জনে, বীর বসি তরুতলে;—
অর্থহীন উর্দ্ধদৃষ্টি। বোধ হয় মনে
ভেদিয়া গগন দৃষ্টি কল্পনার বলে
ভবিতব্যতার ঘোর তিমির ভবনে
প্রবেশিয়া, চেষ্টিতেছে দূর ভবিষ্যত
নিরখিতে। নিরখিতে,—যেই দুরাচার
দুরন্ত যুবক ছিল দুষ্প্রবৃত্তি-রত,
নির্ভয় হৃদয় সদা, পিতা মাতা যার

পাঠাল ভারতবর্ষে সৌভাগ্যের তরে,
অথবা মরিতে দূরে মান্দ্রাজের জ্বরে, —

২২


নিরখিতে অদৃষ্টেসে অভাগা যুবার
আর কি লিখেছে বিধি; করিবে দর্শন
অদৃষ্টচক্রের কত আবর্ত্তন আর।
মধ্যাহ্ন রবির জ্যোতিঃ করিয়া হরণ,
জ্বলিতেছে নয়ন; তাহে রূপান্তর
হইতেছে মুহুর্মুহুঃ; আরক্ত এখন
ব্রিটিশ-সুলভ-রাগে; মুহূর্ত্তেক পর,
করিল বিষাদে যেন ঘন আচ্ছাদন।
কভু ক্রোধে বিস্ফারিত, চিন্তায় কুঞ্চিত,
কখন করুণ রসে হতেছে আর্দ্রিত।

২৩


নীরবে ভাবিছে বীর,—“হায় উপেক্ষিয়া
সমগ্র সমর-সভা, নিষেধ সবার,
অণুমাত্র ভবিষ্যত মনে না ভাবিয়া,
দিলাম একাকী রণ-সমুদ্রে সাঁতার।
যদি ডুবি, একা নাহি, ডুবিবে সকল
কি পদাতি, অশ্বারোহী, আমার সহিত;

ডুবিবে ব্রিটিশ রাজ্য, যাবে রসাতল
ব্রিটিশ-গৌরব-রবি হবে অন্তর্হিত।
যদি ভীম ভূকম্পনে ভাঙ্গে শৃঙ্গবব,
পড়ে তরু গুল্ম হর্ম্ম্য সহিত শিখর।

২৪


“একই ভরসা মিরজাফর যবন।
যবনেরা যেইরূপ ভীব প্রবঞ্চক,
ইহাদের সন্ধিপত্রে বিশ্বাস স্থাপন
করি কোন্‌ মতে? যেন ভীষণ তক্ষক
আছে পাপী উমিচাঁদ, ফণা আস্ফালিয়া।
যেই মহামন্ত্রে মুগ্ধ কবিয়াছি তাবে
যদি সে জানিতে পাবে, ক্রোধে গবজিয়া
একই নিশ্বাসে পাপী নাশিবে সবাবে।
নর-রক্তে সন্ধিপত্র হবে প্রক্ষালিত,
অন্ধকূপ-হত্যা পুনঃ হবে অভিনীত।

২৫


“যদি প্রতারণা মিরজাফরের মনে
থাকে,—এখনও নাহি চিহ্ন মাত্র তার—
যদি এই সন্ধি মিরজাফরের সনে
হয় দুষ্ট নবাবের ষড়যন্ত্র সার;

সসৈন্য সমরক্ষেত্রে না মিশিয়া যদি,
পশে সেনাপতি নিজে সম্মুখ সমরে;
তবেই ত বিপদের না রবে অবধি,
পড়িব পতঙ্গ যেন অনল ভিতরে।
এই স্বল্প সেনা লয়ে কি হইবে তবে,
ভেলায় ভরসা করি ভাসিয়া অর্ণবে?

২৬


“শুধু পরাজয় নহে; তাহার কারণ
নাহি ভাবি, নাহি, ডরি কালের কবল;—
লভিয়াছি যবে এই মানব-জীবন,
মৃত্যু ত আমার পক্ষে নিয়তি কেবল!
কিন্তু যদি আমাদের হয় পরাজয়,
বাঙ্গালার স্বর্ণ-প্রসূ বাণিজ্যের আশা
ডুবিবে অতল জলে; ঘুচিবে নিশ্চয়
ইংলণ্ডের আন্তরিক রাজ্যের পিপাসা।
শক্রশ্রেষ্ঠ ধরাতলে পতিত দেখিয়া,
দক্ষিণে ফরাশি-সিংহ উঠিবে গর্জিয়া।

২৭


“কিন্তু হস্তচ্যুত পাশা হয়েছে যখন
কি হবে ভাবিয়া এবে? কে কবে ভাবিয়া

আজি জানিয়াছে, কালি কি হবে ঘটন?
যা আছে অদৃষ্টে আর দেখি পরীক্ষিয়া
দুইবার যমদণ্ড হানি শিরোপরে
নিজ হস্তে না মরিনু; না মরিনু হায়!
অব্যর্থ-সন্ধানী সেই সৈনিকের করে;
মরিতে কি অবশেষে,—বুক ফেটে যায়!—
নরাধম কাপুরুষ যবনের কবে“?
মরিলেও এই দুঃখ থাকিবে অন্তরে।

২৮


“সেই দিন প্রভঞ্জন-পৃষ্ঠে আরোহিয়া,
পশিনু সাহসে যবে আর্কট নগরে;
বজ্রাঘাত, ঝঞ্চাবাত, ঝড়ে উপেক্ষিয়া,
পশিনু বিদ্যুতবেগে দুর্গেব ভিতবে।
বীরত্ব দেখিয়া ভয়ে দুর্গবাসিগণ
পলাইল বিনা যুদ্ধে;—কুরঙ্গ যেমতি
যুথমধ্যে ক্রুদ্ধ সিংহ করি দরশন;—
মুহূর্ত্তেকে হইলাম দুর্গ-অধিপতি।
সেই দিন বজ্র নাহি পড়িল মাথাষ;
শত্রুর কৃপাণ নাহি পশিল গলায়।

২৯

“কিম্বা পঞ্চাশত দিন আক্রমণ পরে,
—ম্মরিলে সে কথা, রক্তে বিদ্যুত্ খেলায়—
হোসেনের মৃত্যুদিন উপলক্ষ করে,
উন্মত্ত যবন-সৈন্য করিয়া সহায়,
পশিল কর্ণাটরাজ নিশীথ সমরে।
পঞ্চশত সৈন্যে, দশসহস্র সেনায়
বিমুখিমু সেই দিনে, তুলিনু বিমানে
ব্রিটিশের সিংহনাদ কাঁপায়ে ‘রাজায়’;
মরিতে কি এই ভীরু নবাবের করে?
না—তা নয়! আছে মম এই হস্তোপরে

৩০


অন্ধকূপহত্যা প্রতিবিধানের ভার;
রক্ষিতে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ-গৌরব
দণ্ডিয়া নবাধে। হেন উদ্দেশ্য যাহার
তার কাছে কি অসাধ্য কিবা অসম্ভব?
অবশ্য পশিব রণে, জিনিব সমর,
অবশ্য সিরাজদ্দৌলা পাবে প্রতিফল;
“হও অগ্রসর, রণে হও অগ্রসর’—
আমার অন্তর আত্মা কহিছে কেবল।

না জানি কি মহাশক্তি অস্তরে আমার
আবির্ভূত আজি, আমি ইঙ্গিতে তাহার

৩১


চলিতেছি ইচ্ছাহীন পুতুলের প্রায়।”—
বলিতে বলিতে বীর, ত্যজিয়া আসন,
ভ্রমিতে লাগিলা দ্রুত, নিরখি ধরায়;
ভূতল ভেদিয়া যেন যুগল নয়ন
গিয়াছে কোথায়, ধরা দেখা নাহি যায়।
কল্পনা-তাড়িত পক্ষে মানস চঞ্চল,
বিরাজে ইংলণ্ডে কভু; ভাবী রণস্থল
চিত্রে কভু; সেই চিত্রে হৃদয়ে তাঁহার,
কত আশা, কত ভয়, হ’তেছে সঞ্চার।

৩২


চিন্তা-অবসন্ন মনে কিছুক্ষণ পরে,
নিমীলিত নেত্রে পুনঃ বসিলা আসনে;
অকস্মাৎ চারিদিকে ভাসিল সত্বরে,
স্বর্গীয় সৌরভরাশি; বাজিল গগনে
কোমল-কুসুম-বাদ্য,—সঙ্গীত তরল;
সহস্র ভাস্কর তেজে গগন-প্রাঙ্গণ

ভাতিল উপরে; নিয়ে হাসিল ভূতল;
নামিল আলোকরাশি ছাড়িয়া গগন;
সবিস্ময়ে সেনাপতি দেখিলা তখনি,
জ্যোতির্বিমণ্ডিত এক অপূর্ব্ব রমণী।

৩৩


যুবতীর শুভ্র কাস্তি নয়ন নীলিমা,
রঞ্জিত ত্রিদিব রাগে অলক্ত অধর,
রাজরাজেশ্বরীরূপ, অঙ্গের মহিমা,
কি সাধ্য চিত্রিবে কোন মর চিত্রকর।
শ্বেতাঙ্গ সজ্জিত শ্বেত উজ্জল বসনে,
খেলিছে বিজলী, বস্ত্র অমল ধবলে;
তুচ্ছ করি মণিমুক্তা পার্থিব রতনে,
ঝলিছে নক্ষত্ররাজি বসন-অঞ্চলে।
বেশ ভূষা ইংলণ্ডীয় ললনার মত,
স্বর্গীয় শোভায় কিন্তু উজ্জল সতত।

৩৪


অর্দ্ধ-অনাবৃত পীন পূর্ণ পয়োধর;
তুষার উরস, স্বচ্ছ স্ফটিক আকার,
দেখাইছে রমণীর অমল অস্তর,—
চিরপ্রসন্নতাময়, প্রীতিপারাবণর।

নহে উপমেয় সেই বদনচন্দ্রমা,
—কিম্বা যদি দেখিতাম লিখিতাম তবে —
স্বর্গীয় শারদ শশী সে মুখ-সুষমা;
বিশ্ববিমোহিনী আহা! অতুলিত ভবে!
বসস্তরূপিণী ধনী; নিশ্বাস মলয়;
কোকিল কোমল কণ্ঠ; নেত্র কুবলয়।

৩৫


কোটি কহিনুর-কান্তি করিয়া প্রকাশ,
শোভিছে ললাট-রত্ন সেই বরাননে;
গৌরবেব রঙ্গভূমি, দয়ার নিবাস,
প্রভুত্ব ও প্রগল্‌ভতা ব’সে একাসনে।
শোভে বিমণ্ডিত যেন বালার্ক-কিরণে
কনক-অলকাবলী-—বিমুক্ত কুঞ্চিত,
অপূর্ব্ব খচিত চারু কুসুম রতনে—
চির-বিকসিত পুষ্প, চিব-সুখাসিত।
বামাব সুরভি শ্বাস, কুসুম-সৌরভ,
ঘ্রাণে মর অমরত করে অনুভব।

৩৬


ঝলসিছে শীর্ষোপরি কিরীট উজ্জ্বল,
নির্ম্মিত জ্যোতিতে, জ্যোতির্ম্মালায় খচিত

জ্যোতিরত্নে অলংকৃত, জ্যোতিই সকল;
জ্বলিছে হাসিছে জ্যোতিঃ চিরপ্রজ্বলিত।
উজ্জ্বল সে জ্যোতিঃ, জিনি মধ্যাহ্ন-তপন;
অথচ শীতল নেন শারদ চন্দ্রিমা;
যেমন প্রখর তেজে ঝলসে নয়ন,
তেমতি অমৃতমাখা পূর্ণ মধুরিমা।
ক্লাইব মুদিত নেত্রে জাগ্রত স্বপনে,
ভুবন-ঈশ্বরী-মূর্ত্তি দেখিলা নয়নে।

৩৭


বিস্মিত ক্লাইবে চাহি সম্মিত বদনে,
আরম্ভিলা মুরবালা—“কি ভয় বাছনি?”—
রমণীর কলকণ্ঠ সায়াহ্ন পবনে
বহিল উল্লাসে মাতি, সেই কণ্ঠধ্বনি
শুনিতে জাহ্নবীজল বহিল উজান;
আচল হইল রবি অস্তাচল-শিরে,
মুহূর্ত্ত করিতে সেই স্বরসুধা পান।
সঞ্জীবনী সুধারাশি সমস্ত শরীরে
প্রবেশিল ক্লাইবের, বহিল সে ধ্বনি
আনন্দে ধমনী-স্রোতে; বাজিল অমনি

৩৮

শ্লথ হৃদয়ের যন্ত্রে,—“কি ভয় বাছনি?
ইংলণ্ডের রাজলক্ষ্মী আমি, সুভাগিনী,
লক্ষ্মীকুললক্ষ্মী আমি, শুন বীরমণি!
রাজলক্ষ্মী মধ্যে আমি শ্রেষ্ঠ আদরিণী
বিধাতার; পরাক্রমী পুত্রের গৌরবে
আমি চিরগৌরবিণী। ত্রিদিবে বসিয়া
কটাক্ষে জানিতে আমি পারি এই ভবে
কখন কি ঘটে; দেখি অদৃশ্যে থাকিয়া
পার্থিব ঘটনাস্রোতঃ; চিন্তি অনিবার
ইংলণ্ডের রাজ্যস্থিতি, উন্নতি, বিস্তার।

৩৯


“তোমার চিন্তায় আজি টলিল আসন,
আসিনু পৃথিবীতলে, তোমারে, বাছনি!
শুনাইতে ভবিষ্যত বিধির লিখন;—
শুনিলে উল্লাসে তুমি নাচিবে এখনি!
এই হ’তে ইংলণ্ডের উন্নতি নিয়তি;
এই সমুদিত মাত্র সৌভাগ্য-ভাস্কর।
মধ্যাহ্ন গৌরবে যবে ব্রিটন-ভূপতি
উজলিবে দশ দিক্‌, দেশ দেশান্তর,

তাঁর ছত্র ছায়াতলে, জানিবে নিশ্চিত,
অর্দ্ধ সসাগরা ধরা হবে আচ্ছাদিত।

৪০


“সোণার ভারতবর্ষে, বহু দিন আর
মহারাষ্ট্রী মোগল বা ফরাশি দুর্জ্জয়
করিবে না রক্তপাত; দ্বিতীয় বাবর,
ভারতের রঙ্গভূমে হইয়া উদয়,
অভিনব রাজ্য নাহি করিবে স্থাপন;
কিম্বা অতিক্রমি দূর হিমাদ্রি-কাস্তার,
দিল্লীর ভাণ্ডাররাশি করিতে লুণ্ঠন,
ভীম বেগে দস্যুস্রোতঃ আসিবে না আর।
ভারতের ইতিহাসে উপস্থিত প্রায়
অচিন্ত্য, অশ্রুত, এক অপূর্ব্ব অধ্যায়।

৪১


“অজ্ঞাতে ভারতক্ষেত্রে কিছু দিন পরে
যেই মহাশক্তি, বাছা, করিবে প্রবেশ,
মেষবৎ শৃঙ্খলিবে দিল্লীর ঈশ্বরে।
তেয়ীগিয়া রঙ্গভূমি, ছাড়ি রণবেশ
ভয়ে মহারাষ্ট্র-সিংহ পশিবে বিবরে।
যেমতি প্রভাতরবি ভেদিয়া তুষার

যতই উঠিতে থাকে গগন উপবে,
ততই পাদপছায়া হয় খর্ব্বাকাব,
তেমতি এ শক্তি যত হইবে প্রবল,
ভাবতে ফবাশি তত হবে হতবল।

৪২


“তুমি সে শক্তিব মূল, আদি অবতাব।
হইও না চমৎকৃত, ভেবো না বিস্ময,
ভাবত অদৃষ্টচক্র, কৃপণে তোমাব
সমর্পিত, যেই দিকে তব ইচ্ছা হয
ঘুবিবে ফিবিবে চক্র তব ইচ্ছামত।
বঙ্গে যেই ভিত্তি-ভূমি কবিবে স্থাপন,
সমযেতে তদুপবি, ব্যাপিযা ভাবত
অটল অচল বাজা হইবে স্থাপন।
বিধিব মন্দিব হ’তে আনিযাছি আমি
ভাবতবর্ষেব ভাবী মানচিত্রখানি।

৪৩


'অনন্ত তুষাবাবৃত হিমাদ্রি উত্তরে
ওই দেখ ঊর্দ্ধ শিবে পবশে গগন;—
অদ্রিব উপবে অদ্রি, অদ্রি তদুপবে,
কটিতে জীমূতবৃন্দ কবিছে ভ্রমণ।

দক্ষিণে অনন্ত নীল ফেণিল সাগর,
ঊর্ম্মির উপরে ঊর্ম্মি, ঊর্ম্মি তদুপরে,—
হিমাদ্রির অভিমানে উন্মত্ত অন্তর
তুলিছে মস্তক দেখ ভেদি নীলাম্বরে।
অচল পর্ব্বত শ্রেণী শোভিছে উত্তরে,
চঞ্চল অচলরাশি ভাসে সিন্ধুপরে।

88


“বেগবতী ঐরাবতী পূর্ব্ব সীমানায়;
পঞ্চভূজ সিন্ধুনদ বিরাজে পশ্চিমে;
মধ্যদেশে, ওই দেখ, প্রসারিয়া কায়
শোভে যে বিস্তৃত রাজ্য রঞ্জিত রক্তিমে,
বিংশতি ব্রিটন নাহি হবে সমতুল।
তথাপি হইবে—আর নাহি বহু দিন,
অভাগিনী প্রতি বিধি চির প্রতিকুল—
বিপুল ভারত, ক্ষুদ্র ব্রিটন-অধীন।
বিধির নির্ব্বন্ধ বাছা খণ্ডন না যায়,
কিবা ছিল রোমরাজ্য এখন কোথায়?

৪৫


“ওই শোভে শতমুখী ভাগীরথীতীরে
কলিকাতা, ভারতের ভাবী রাজধানী,

আবৃত এখন যাহা দরিদ্র কুটীরে,
শোভিবে, অমরাবতীরূপে করি গ্লানি,
রাজ-হর্ম্ম্যে, দৃঢ় দুর্গে, আলোকমালায়।
ওই যে উড়িছে উচ্চ অট্টালিকা-শিরে
ব্রিটিশ পতাকা, যেন গৌরবে হেলায়
খেলিছে পবনসনে অতি ধীরে ধীরে;
তুমিই তুলিয়া সেই জাতীয় কেতন,
ভারতে ব্রিটিশরাজ্য করিবে স্থাপন।

৪৬


“নব রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া তোমায়,
আমি বসাইব ওই রত্নসিংহাসনে;
আমি পরাইব রাজমুকুট মাথায়।
সমস্ত ভারতবর্ষ আনত বদনে
পালিবে তোমার আজ্ঞা, অদৃষ্টের মত।
তোমার নিশ্বাসে এই ভারত ভিতরে
কত রাজ্য রাজা হবে আনত উন্নত;
ভাসিবে যবনলক্ষ্মী শোণিত সমরে।
প্রণমিবে হিমাচল সহিত সাগর,—
ইংলণ্ডের প্রতিনিধি—ভারত-ঈশ্বর।'

৪৭

“শতেক বৎসর রাজবিপ্লবের পরে
ইংলণ্ডের সিংহাসন হইবে অচল;
উদিবে যে তীব্র রবি ভারত-অম্বরে
ভাতিবে ধবলগিরি, সমুদ্রের তল।
কঙ্কালবিশিষ্ট পূর্ব্ব নৃপতি সকল
ঘুরিবে বেষ্টিয়া সৌর উপগ্রহ মত;
আশু রাহুগ্রস্ত হয়ে দুর্দ্দান্ত মোগল,
ছায়া কিম্বা স্বপ্নে শেষে হবে পরিণত।
বিক্রমে শার্দ্দূল মেষ, অহিংস অন্তরে,
নির্ভয়ে করিবে পান একই নির্ঝরে।

৪৮


“ধর, বৎস! এই ন্যায়পরতা-দর্পণ
বিধিকৃত, ব্রিটিশের রাজ্য নিদর্শন!
ষত দিন পুর্ব্ব রাজ্যে ব্রিটিশ শাসন
থাকিবে অপক্ষপাতী বিশদ এমন,
তত দিন এই রাজ্য হইবে অক্ষয়।
এই মহারাজনীতি মোহান্ধ যবন
ভুলিয়াছে, এই পাপে ঘটিছে নিরয়;
এই পাপে কত রাজ্য হয়েছে পতন।

ভীষণ সংহার অসি রাজ্যের উপরে
ঝোলে সূক্ষ্ম ন্যায়-স্বত্রে বিধাতার করে।

৪৯


“যবনের অত্যাচাব সহিতে না পারি
হতভাগ্য বঙ্গবাসী—চিরপরাধীন—
লয়েছে আশ্রয় তব, দমি অত্যাচারী,
—যেই ধূমকেতু বঙ্গ-আকাশে আসীন,
স্বর্গচ্যুত কবি তারে নিজ বাহুবলে,—
শাস্তির শারদ শশী করিতে স্থাপন।
ভাবে নাই এই ক্ষুদ্র নক্ষত্রের স্থলে
উদিবে নিদাঘতেজে ব্রিটিশ তপন।
এই আশ্রিতের প্রতি হইলে নির্দ্দয়,
ডুবিবে ব্রিটিশ রাজ্য, ডুবিবে নিশ্চয়।

৫০


“রাজার উপরে রাজা, রাজরাজেশ্বর,
জেতার উপরে জেতা, জিতের সহায়,
আছেন উপরে বৎস, অতি ভয়ঙ্কর।
দয়ালু, অপক্ষপাতী, মূর্ত্তিমান ন্যায়।
তাঁর রবি শশী তারা নক্ষত্রমণ্ডলে
সমভাবে দেয় দীপ্তি ধনী ও নির্ধনে;

সমভাবে, সর্ব্বদেশে, শ্বেতে ও শ্যামলে,
বরষে তাঁহার মেঘ, বাঁচায় পবনে।
পার্থিব উন্নতি নহে, পরীক্ষা কেবল;
সম্মুখে ভীষণ, বৎস, গণনার স্থল।”

৫১


অদৃশ্য হইলা বামা; পড়িল অর্গল
ত্রিদিব-কপাটে যেন, অন্তর-নয়নে
ক্লাইবের; গেল স্বর্গ, এল ধরাতল।
হায়! যথা হতভাগ্য জলমগ্ন জনে,
সৌরকর ক্রীড়াচ্ছলে সলিল ভিতরে
শত শত ইন্দ্রচাপ, আলোক তরল
রাশি রাশি, নিরখিয়া, মুহূর্ত্তেক পরে
মৃত্যুমুখে দেখে বিশ্ব আঁধার কেবল;
অন্তর-নয়নে বীর ব্রিটননন্দন
স্বপ্নান্তে আঁধার বিশ্ব দেখিলা তেমন।

৫২


ভাঙ্গিল বিস্ময় স্বপ্ন; মেলিল নয়ন।
নাহি সে আলোকরাশি, নাহি বিদ্যমান
আলোকমণ্ডিত সেই রমণীরতন,—
নির্ম্মল আলোকে শ্বেতভূজা অধিষ্ঠান!

স্বর্গীয় সৌরভ আর না বহে পবনে,
স্বর্গীয় সঙ্গীত-সুধা না হয় বর্ষণ,
আর সেই মানচিত্র না দেখে নয়নে,
মুষ্টিবদ্ধ করে আর নাহি সে দর্পণ।
অথবা থাকিবে কেন, থাকিলে কি আর,
ভারতে উঠিত আজি এই হাহাকার?

৫৩


“সেনাপতি ভাগীরথী তীর অতিক্রমি,
আজ্ঞা অপেক্ষায সৈন্য আছে দাঁড়াইয়া,
বেলা অবসানপ্রায়, অস্ত দিনমণি—”
বলিল জনৈক সৈন্য। চমকি উঠিয়া
ছুটিলা ক্লাইব বেগে, নাহি কিছু জ্ঞান
কোথায় পড়েছে পদ, শূন্যে কি ধরায়।
মানসিক শক্তিচয় যেন তিরোধান
হয়েছে রমণীসনে; দৈববাণী প্রায়
এখনো গম্ভীরে কর্ণে বাজিছে কেবল,—
“সম্মুখে ভীষণ, বৎস! গণনার স্থল”।

৫৪


সজ্জিত তরণী ছিল তীরে দাঁড়াইয়া,
লম্ফ দিয়া যেই বীর তরী আরোহিল,

স্থির ভাগীরথী জল করি উচ্ছ্বসিত,
অমনি ব্রিটিশ বাদ্য বাজিয়া উঠিল।
ছুটিল তরণী বেগে বারি বিদারিয়া,
তালে তালে দাঁড়ী দাঁড়ে পড়িতে লাগিল;
আঘাতে আঘাতে গঙ্গা উঠিল কাঁপিয়া,
সুনীল আরশি খানি ভাঙ্গিল গড়িল।
একতনে বীরকণ্ঠ ব্রিটিশ-তনয়
গায়—“জয় জয় জয় ব্রিটিশের জয়!”

গীত।



চির-স্বাধীনতা অনন্ত সাগরে,
নিস্তারা আকাশে যেন নিশামণি,
সুখে 'ব্রিটনিয়া' আনন্দে বিহরে,
বীরপ্রসবিনী ব্রিটিশজননী।
যেই নীল সিন্ধু অসীম দুর্জ্জয়,
বিক্রমে যাহার কাঁপে ত্রিভুবন,
ব্রিটনের কাছে মানি পরাজয়,
সেই সিন্ধু চুম্বে ব্রিটনচরণ।
ঘোষে সেই সিন্ধু করি দিগ্বিজয়,—
“জয় জয় জয় ব্রিটিশের জয়!”

সমুদ্রের বুকে পদাঘাত করি
অভযে আমরা ব্রিটননন্দন,
আজ্ঞাবহ করি তরঙ্গলহরী,
দেশদেশান্তরে কবি বিচরণ।
নব আবিষ্কৃত আমেরিকাদেশে,
কিম্বা আফ্রিকাব মৃগতৃষ্ণিকায়,
ঐশ্বর্য্যশালিনী পূবব প্রদেশে,
ইংলণ্ডের কীর্ত্তি না আছে কোথাষ?
পূরব পশ্চিম গায সমুদয,—
“জয় জয় জয় ব্রিটিশেব জয।”


সম্পদ সাহস, সঙ্গী তরবার;
সমুদ্র বাহন; নক্ষত্র কাণ্ডারী;
ভবসা কেবল শক্তি আপনাব;
শয্যা রণক্ষেত্র, ঈষা ত্রাণকারী।
বজ্রাগ্নি জিনিষা! আমাদেব গতি,
দাবানল সম বিক্রম বিস্তার,
আছে কোন্‌ দুর্গ, কোন্‌ অদ্রিপতি,
কোন্‌ নদ, নদী, ভীম পারাবার

শুনিয়া সভয়ে কম্পিত না হয়,
“জয় জয় জয় ব্রিটিশের জয়”?

8


আকাশের তলে এমন কি আছে
ডরে যারে বীর ব্রিটিশতনয়?
কেবল ব্রিটিশললনার কাছে,
সে বীরহৃদয় মানে পরাজয়।
বীরবিনোদিনী সেই বামাগণে
স্মরিয়া অন্তরে, চল রণে তবে;
হায়! কিবা মুখ উপজিবে মনে,
গুনে রণবার্ত্তা বামাগণে যবে
গাবে বামাকণ্ঠস্বর করি লয়,—
“জয় জয় জয় ব্রিটিশের জয়!”


দাও তবে সবে অভয় অস্তরে,
বারি বিদারিয়া দাও দাঁড়ে টান,
ব্রিটনিয়াপুত্র রণে নাহি ডরে,
খেলার সামগ্রী বন্দুক কামান।
ব্রিটিশের নামে ফিরে সিন্ধুগতি,
বিক্ষিপ্ত অশনি অর্দ্ধপথে রয়

কিছাব দুর্ব্বল যবনভূপতি,
অবশ্য সমবে হবে পবাজয়।
গাবে বঙ্গ সিন্ধু, গাবে হিমালয,—
“জয় জয জয় ব্রিটিশেব জয!”

দ্বিতীয় সর্গ সমাপ্ত।