পলাশির যুদ্ধ/পঞ্চম সর্গ



পঞ্চম সর্গ।

শেষ আশা।

মুরশিদাবাদে আজি আমোদ মোহিনী,
নাচিয়া বেড়ায় সুখে প্রতি ঘরে ঘরে;
পরিয়াছে দীপমালা যামিনী কামিনী,
ভাসিতেছে রাজধানী সঙ্গীতসাগরে।
অহিফেন-মুগ্ধ মিরজাফর পামর;
ঢুলু ঢুলু করিতেছে আরক্ত লোচন;
“উড়িষ্যা বেহার বঙ্গ ত্রিদেশ-ঈশ্বর”—
বলিয়া পলাশিজেতা করেছে বরণ।
লভেছে পাতিয়া সেই উর্ণনাভ ফাঁদ,
তীর্থযাত্রা উপদেশ ধূর্ত্ত উমিচাঁদ।

নিমীলিত নেত্রদ্বয়; মুখশ্রী গম্ভীর;
পড়েছে জলদছায়া চৌষট্টি কলায়;
নিরখিতে যেই চন্দ্র নেত্র পদ্মিনীর
হ’ত, উন্মীলিত আজি রাহুগ্রস্ত হায়!
পরিধান পট্টবস্ত্র; উত্তরীয় গলে;
অশিবব্যঞ্জক শ্মশ্রু-আবৃত বদন-
দীর্ঘ কারাবাস হেতু; তপস্যার ছলে
জানুপরে কর, করে অঙ্গুলি-সংযম।
এরূপে মুঙ্গের দুর্গে বসিয়া পূজায়,
কৃষ্ণনগরের পতি কৃষ্ণচন্দ্র রায়।


এ নহে সামান্য পূজা, প্রাণদণ্ড তরে
প্রেরিয়াছে রাজ-আজ্ঞা সিরাজদ্দৌলায়;
হতভাগ্য নরপতি পুজা শেষ করে,
সহিবেক রাজদণ্ড ষমদও প্রায়।
যতক্ষণ পুজা হায়! ততক্ষণ প্রাণ;
সেই হেতু নরপতি পুজায় মগন;
সেই ধ্যানে রাজর্ষির নাহি বাহ্য জ্ঞান;
ক্ষণে ক্ষণে শুধু দীর্ঘনিশ্বাস পতন।

পবন স্বননে ত্রস্তে মেলিছে নয়ন,
মনে ভাবি ক্লাইবের সৈন্য-আগমন।

8


কল্পনে! মুরশিদাবাদে আইস ফিরিয়া!
হেন উৎসবের দিনে ছাড়িয়া নগর,
কে যায়,কোথায়? মঞ্জু নিকুঞ্জ ছাড়িয়া
কে প্রবেশে অন্ধকার কানন ভিতর?
উঠিছে আকাশপথে, নগর হইতে
যেই আলোকের জ্যোতিঃ তিমির উজলি,
বোধ হয় দিগ্‌দাহ, অথবা নিশীথে
জ্বলিতেছে দাবানলে দূর বনস্থলী।
উৎসবের কোলাহলে, দুরে হয় জ্ঞান,
আমোদকাননে যেন ছুটেছে তুফান।


“পলাশির যুদ্ধ”—আজি সহস্র জিহবায়
ঘোষিতেছে জনরব প্রভঞ্জন-গতি;
“পলাশির যুদ্ধ”—আজি মর্ম্মরে পাতায়,
স্বনিতেছে সমীরণ, গায় ভাগীরথী।
“পলাশির যুদ্ধ”—শত সহস্র নয়ন
চিত্রিতেছে অশ্রুজলে সহস্র ধারায়;

“পলাশির যুদ্ধ”—কত প্রফুল্ল বদন
হাসিতেছে মনসুখে; লিখিছে ধাতায়
“পলাশির যুদ্ধ”, ওই বসিযা অম্বরে,
ভারত অদৃষ্ট-গ্রন্থে অমর অক্ষবে।


স্থানে স্থানে সমবেত নাগরিকগ
কবিতেছে পলাশির যুদ্ধ আলোচনা;
তাহাঁদের মধ্যে সত্যপ্রিয় যত জন,
প্রশংসিছে ক্লাইবেব বীর্য্য বীবপণী।
যাহাদের সমধিক কল্পনা প্রবল,
তাহাদের মতে কোনো মহামন্ত্রবলে
ক্লাইব বঙ্গীয সেনা রণে হতবল
কবিয়াছে, কোনো উপদেবতার ছলে!
মুখের কল্পনাস্রোতে হলে উচ্ছ্বসিত,
যত অসম্ভব তাহে হয় সম্ভাবিত।

q


শুদ্ধ উপনদীতেও বরিষার কালে।
প্রভূত সলিল যথা হয় প্রবাহিত,
তেমতি উৎসবে এই পুরী-অন্তরালে
বীথিতেও জনস্রোত আজি সঞ্চারিত।

অভিষেক উপলক্ষে মিরজাফরের,
সুসজ্জিত রাজহুর্ম্ম্য, অবারিত দ্বার।
রাজপ্রাসাদের সজ্জা, নব নবাবের
নুতন সভার শোভা,—আমোদভাণ্ডার —
দেখিতে শুনিতে ওই দর্শক অশেষ
দীর্ঘ স্রোতে রাজদ্বারে করিছে প্রবেশ।


সম্মুখে বিচিত্র সভা আলোক খচিত,
অমরাবতীর শোভা সৌরভে পূরিত।
বিগত বিপ্লবে হয়! করেনি কিঞ্চিৎ
কপান্তর,—সেই রূপ আছে সুসজ্জিত।
সেই রঙ্গভূমি, সেই আলোকের হার,
সেই সজ্জা, সেই শোভা, সেই সভাজন;
সেই বিলাসিনীবৃন্দ করিছে বিহার;
সেই রাজছত্রদণ্ড, সেই সিংহাসন।
সেই নৃত্য, সেই গীত, রয়েছে সকল;
হায়। সে সিরাজদ্দৌলা নাহিক কেবল!


মিরজাফরের আজি সার্থক জীবন;
ভূতলে ঘুনানী স্বর্গ আজি অনুভব।

যেই সিংহাসনছায়া আঁধারে তখন
ছিল লুকাইয়া, আজি—হায়! অসম্ভব—
সেই মিরজাফরের সেই সিংহাসন!
স্তাবকে বেষ্টিত হয়ে ব’সে সভাতলে,
অহিফেনে সঙ্কুচিত যুগলনয়ন;
হৃদয় করিছে স্ফীত চাটুকার দলে।
প্রাচীন-বয়সে শ্লথ শ্রবণবিবরে,
ঢালিছে কোকিলকণ্ঠা কামিনী কুহরে

১০


বিমল সঙ্গীত-সুধা; নাচিছে আবার
সঙ্গীতের তালে তালে ওই বিনোদিনী,
নাচে যথা, শুনি প্রাতে কোকিলঝঙ্কার,
কাননে গোলাপ, কিম্ব সলিলে নলিনী।
তাম্বুলে রঞ্জিত রক্ত অধরযুগলে
ভাসিছে মোহিনী হাসি; এই হাসি হায়।
—রে মিরজাফর মত্ত কামিনীকৌশলে;!—
তুষিয়াছে রাজ্যচ্যুত সিরাজদ্দৌলায়।
তুমি রাজ্যভ্রষ্ট পুনঃ হইবে যখন,
তব শক্র অভিষেকে হাসিবে তেমন।

১১

সেই নৃত্যগীতে মিরজাফরের মন
নহে মুগ্ধ; নহে মুগ্ধ হাসিতে বামার;
স্তাবকের স্তুতিবাদে হইয়া মগন,
তোষামোদপারাবারে দিতেছে সাঁতার।
কথা—পলাশির যুদ্ধ; স্তাবকসকলে
বর্ণিছে কেমনে রণে নব বঙ্গেশ্বর
লভিয়াছে সিংহাসন বলে ও কৌশলে।
ইহাদের স্তুতি হলে সত্যের আকর,
ইতিহাসে ক্লাইবের হইত নিশ্চয়,
মিরজাফরের সনে স্থানবিনিময়।

১২


স্তাবকের স্তুতিবাদে, রে মুর্খ যবন!
যত ইচ্ছা স্ফীত কেন কর না হৃদয়,
সঙ্গীতের তালে ওই নর্তকী যেমন
নাচিতেছে, সেইরূপ তুমিও নিশ্চয়
নাচিবে দুদিন পরে ইংরাজ ইঙ্গিতে।
ভবিষ্যৎ-অন্ধ মুর্খ! জান নাই আর,
সমুদ্রে ঝটিকাগ্রস্ত তরণী হইতে
অনিশ্চিত সমধিক অদৃষ্ট তোমার।

ইংরাজবণিক্‌ করে, জাননি এখন,
পণ্যদ্রব্য হবে এই বঙ্গ-সিংহাসন!

১৩


সুসজ্জিত, সুবাসিত, রম্য হর্ম্ম্যান্তরে,
বিরাজিছে মনসুখে কুমার “মিরণ”;
একে সুরা, তাহে সুধা রমণী-অধরে,
অনল-সহায় যেন প্রবল পবন।
নিকটে বসিয়া নীচ উপাসক যত,
বর্ণিছে সুবর্ণ বর্ণে মিরণ নয়নে
নন্দনকানন-শোভা-পূর্ণ ভবিষ্যত।
মিরণ বসিবে যবে বঙ্গ-সিংহাসনে,
পাপিষ্ঠ ভাবিতেছিল, স্বহস্তে তখন
কত শত মানবের বধিবে জীবন।

১৪


এমন সময়ে এক পাপ-অনুচর,
—লেখা যেন ‘নরহস্তা’ কপালে তা হার,
পাপে লৌহবর্ম্মাবৃত পাষাণ-অন্তর,
দুষ্প্রবৃত্তি নিবন্ধন বিকৃত আকার,—
নিবেদিল আভুতল নত করি শির,
ঘোড় করে,—“যুবরাজ! এই অনুচর

হতভাগ্য নবাবের যত মহিষীর
শুনেছে রোদনধ্বনি, চিত্ত দ্রবকর।
জাহ্নবী-তিমির-গর্ভ-খনির ভিতরে
রমণী-রতনরাশি“—বাক্য নাহি সরে।

১৫


দাঁড়াইল অনুচর স্তম্ভিত অন্তরে,
যেন কেই অকস্মাৎ গ্রীবা নিষ্পীড়নে
করিয়াছে কণ্ঠরোধ। মুহূর্ত্তেক পরে,—
“যুবরাজ হায়! এই উদর কারণে
কত হত্যা কত পাপ করেছি সাধন,
কিন্তু এই শেষ”—চর নীরব আবার—
“অন্ধকারে বিদারিয়া জাহ্নবী-জীবন
করুণ মুমুর্ষূ যেই নারী-হাহাকার
উঠিল আকাশপথে,—জীবনে, মরণে,
নিরন্তর সেই ধ্বনি বাজিবে শ্রবণে।

১৬


“বলিল সে ধ্বনি যেন নিয়তিবচন——
‘বিনা দোষে ডুবাইল যত অবলারে,
বিনা মেঘে বজ্রাঘাতে মরিবে মিরণ।”
নারীহস্তা পাপিষ্ঠের এই সমাচারে,

একটি বিদ্যুতজ্যোতিঃ মিরণ-শরীরে
আপাদমস্তক যেন হলো সঞ্চালিত;
স্থিরনেত্রে কিছুক্ষণ চাহিয়া প্রাচীরে;
মাদকে অবশ দেহ হইল কম্পিত।
ইংরাজের বীরকণ্ঠ উঠিল ভাসিয়া,
হেন কালে “হিপ হিপ হুর্‌ রে!” বলিয়া।

১৭


ইংরাজ-শিবির-শ্রেণী, অদুর উদ্যানে,
দাঁড়াইয়া স্থিরভাবে নৈশ অন্ধকারে,
শোভিছে নক্ষত্র যথা নিদাঘ বিমানে,
শোভিছে আলোকরাশি উদ্যান আঁধারে
শূন্য করি বাঙ্গালার রাজ্যের ভাণ্ডার,
বহুমূল্য রাশীকৃত সঞ্চিত রতন,
খুলিয়াছে ইংরাজের আমোদ-বাজার,
সুখের সাগরে চিত্ত হয়েছে মগন।
বাঙ্গালার রাজকোষ,—মণিপূর্ণ খনি,—
নিবিড় তমসে মাত্র পূর্ণিত এখনি।

১৮


হায়! মাতঃ বঙ্গভূমি। বিদরে হৃদয়,
কেন স্বর্ণ-প্রসূ বিধি করিল তোমারে?

কেন মধুচক্র বিধি করে সুধাময়
পরাণে বধিতে হায়! মধুমক্ষিকারে?
পাইত না অনাহারে ক্লেশ মক্ষিকায়,
যদি মকরন্দ নাহি হ’ত সুধাসার;
স্বর্ণ-প্রসবিনী যদি না হইতে হায়,
উঠিত না বঙ্গে আজি এই হাহাকার!
আফ্রিকার মরুভূমি, সুইস্ পাষাণ
হতে যদি, তবে মাতঃ! তোমার সন্তান

১৯


হইত না এইরূপ ক্ষীণকলেবর,
হইত না এইরূপ নারী-সুকুমার।
ধমনীতে প্রবাঞ্ছিত হ’ত উগ্রতর
রক্তস্রোত; হ’ত রুক্ষ বীর্য্যের আধার।
আজি এই বঙ্গভূমি হইত পূরিত
সজীব-পুরুষ-রত্নে; দিগ্‌দিগন্তর
বঙ্গের গৌরবসূর্য্য হ’ত বিভাসিত;
বাঙ্গালার ভাগ্য আজি হ’ত অন্যতর।
কল্পনে! সে দুরাশায় কাষ নাই আর,
ব্রিটিশ শিৱির ওই সম্মুখে তোমায়!

২০

একটী শিবির মধ্যে টেবিল বেষ্টিয়া
বিরাজিছে কাষ্ঠাসনে যুবা কত জন;
যেই বীর্য্য আসিয়াছে পলাশি জিনিয়া,
সুরাহস্তে পরাজিত হয়েছে এখন।
ভগ্ন কাঁচপাত্র, শূন্য সুরার বোতল,
যায় গড়াগড়ি পাশে। তা সবার সনে
কত বীরবর হয়ে আনন্দে বিহবল,
বিস্মৃতির ক্রোড়ে ন্যস্ত ভূতল-শয়নে।
ত্রিভঙ্গ করিয়া অঙ্গ কেহ বা উঠিতে,
সুরার লহরী পুনঃ ফেলিছে ভূমিতে।

২১


শ্রেণীবদ্ধ কাঁচপাত্র টেবিল উপরে
বিরাজিছে—শূন্য কিম্বা অর্দ্ধশূন্য সব।
এই পূর্ণ করিতেছে বোতল-নির্ঝরে;
মধুর নিক্কণে এই—সুমধুর রব!—
প্রণয়মিলনে সবে চুম্বি পরস্পরে
উঠিল, হইয়া শূন্য যেন ইন্দ্রজালে,
উক্তরিল বজ্রনাদে টেবিল উপরে।
সুরাসঙ্কোচিত রক্ত নেত্রে হেন কালে,

মদিরামার্জ্জিত কণ্ঠে যুবক সকল,
আরম্ভিল উচ্চৈঃস্বরে সঙ্গীত সরল।

২২


গীত।



এ সুখের দিনে প্রফুল্ল অন্তরে
গাও মিলি সবে ব্রিটনের জয়!
বীরপ্রসবিনী পৃথিবী ভিতরে,
ভূতলে অজেয় বৃটনতনয়!
ব্রিটনের কীর্ত্তি করিতে প্রচার,
পিয়ে এই গ্লাস, অমৃত-আসার,
গাও সবে মিলি, গাও তিন বার,—
হিপ্‌—হিপ্‌—হুর রে!
হিপ্‌— হিপ্‌—হুর রে!
হিপ্‌-হিপ্‌—হুর রে!


ভূপতির শ্রেষ্ঠ বৃটন-ঈশ্বর;
সমুদ্র রাজ্যের পরিখা যাহার;
জিনিয়া অনস্ত অসীম সাগর,
দ্বিতীয় জর্জের মহিমা অপার।

দীর্ঘজীবী তাঁরে করুন ঈশ্বরে!—
পান কর সবে এ কামনা করে।
গাও তিন বার প্রফুল্ল অন্তরে,—
হিপ্‌—হিপ্‌—হুর রে!
হিপ্‌—হিপ্‌—হুর রে!
হিপ্‌—হিপ্‌—হুর রে!


জিনিয়াছি সবে যেই সিংহবলে,
পলাশির রণ হাসিতে হাসিতে;
গাও জয় তাঁর,—ধ্বনি কুতূহলে
উঠুক আকাশে ভূতল হইতে!
ঢাল সুরা ঢাল, ঢাল আরবার!
সুদীর্ঘ জীবন হউক তাঁহার!
পান কর মুখে! গাও তিন বার,—
হিপ্‌—হিপ্‌-হুর রে!
হিপ্‌—হিপ্‌—হুর রে!
হিপ্‌—হিপ্‌-হুর রে!

8


ডুব ডুব করি ঢাল এই বার,
এবার অনুঢ়া বৃটিশ-ললনা!

স্মরি শ্বেতবক্ষঃ, হিমানী-আকার,
রক্তওষ্ঠাধরা, শ্বেতবরাননা,
স্মরিয়া নয়ন বিলাস-আধার,
শূন্য কর সবে গ্লাস এই বার,
গাও উচ্চৈঃস্বরে, গাও তিন বার—
হিপ্‌—হিপ্‌-হুর রে!
হিপ্‌—হিপ্‌-হুর রে!
হিপ্‌—হিপ্‌-হুর রে!



২৩


নীরব নিশীথে এই আনন্দের ধ্বনি
উঠিল গগনপথে; নৈশ সমীরণে
ভাসিল সে ধ্বনি; ক্রমে হলো প্রতিধ্বনি
উদ্যান-অদূরস্থিত ইষ্টকভবনে।
সমীপ পাদপে সুপ্ত বিহঙ্গনিচয়
জাগিল সে ভীম নাদে কলরব করি;
জাগিল গৃহস্থগণ হইয়া সভয়,
তস্করের সিংহনাদ মনে স্থির করি।
প্রবেশিল এই ধ্বনি মিরণ-শ্রবণে
সভাতলে। কারাগারে একটী রমণী

২৪

চিন্তা অভিভূত তন্দ্র ভাঙ্গিলে, অমনি
জাগিল সত্রাসে বামা; সিরাজদ্দৌলার
শিবির-সঙ্গিনী, হায়! সেই বিষাদিনী!
বিষাদজলদে আরও গাঢ়তা সঞ্চার
হইয়াছে রমণীর; অশ্রু বরিষণে।
লিখেছে যুগলরেখা কপোল-কমলে।
নাহি সে বিলাসজ্যোতিঃ যুগল নয়নে;
পশিয়াছে কীট ওষ্ঠ বাঁধুলী দলে।
সে নযন, সে বরণ, অতুল বদন,
ছায়ামাত্রে পরিণত হয়েছে এখন!

২৫


সুকুমার দেহলত কোমলতাময়
চিন্তার তরঙ্গোপরি ভাসি বহুক্ষণ,
না নিদ্রিত, না জাগ্রত, অবশ হৃদয়,
পড়েছিল ধরাতলে অবসন্ন মন।
বিজাতীয় গীতধ্বনি করিয়া শ্রবণ,
দাঁড়াইয়া তীরবৎ কাঁপিতে লাগিল;
আপন সর্ব্বস্ব ধন করিতে হরণ
আসিতেছে দস্যুবৃন্দ মনেতে ভাবিল।

সঙ্গীতের ধ্বনি মনে সিংহনাদ গণি,
ভূতলে মূচ্ছিত হয়ে পড়িল রমণী!

২৬


কিছুক্ষণ পরে বাম হয়ে সচেতন,
ভাবিতে লাগিল,—“আহা! প্রাণেশে আমার
নিশ্চয় এসেছে দস্যু করিতে নিধন;
জন্মের মতন নাথে দেখি একবার,”—
ছুটিল বিদ্যুত্‌বেগে উন্মাদিনী প্রায়।
অবরুদ্ধ কক্ষ হ’তে হইতে নির্গত,
অমনি কপালে দৃঢ় কপাটের ঘায়ে
পড়িল ভূতলে স্বর্ণ-প্রতিমার মত।
ছুটিল শোণিতস্রোত তিতিয়া কপাল,
ভাসিল লোহিত জলে সোণার মৃণাল!

২৭


হায় রে অদৃষ্ট! যেই রমণী-শরীর
সুকুমার-শয্যা-গর্ভে হইয়া শায়িত
হইত ব্যথিত; এ কি নির্ব্বন্ধ বিধির,
ইষ্টক উপরে ওই আছে নিপতিত।
পিপীলিকা-দস্তাঘাতে, বেষ্টিয়া যাহারে
শুশ্রূষা করিত শত পরিচারিকায়;

আজি সে যে নিদারুণ লোহার প্রহারে
মূর্চ্ছাপন্ন একাকিনী ইষ্টক-শয্যায়;
রাজরাণী পড়ে হায়! ভিখারিণী মত,
সোণার কমল, আহা, এইরূপে ক্ষত!

২৮


যায় নাই প্রাণ,—প্রাণ যাইবে বা কেন?
এত সুকুমার নহে দুঃখের জীবন।
দুঃখীর মরণ হলে স্বল্পে সিদ্ধ হেন,
ধরায় অর্দ্ধেক দুঃখ হইত স্বপন।
যায় নাই প্রাণ;—বামা কিছুক্ষণ পরে,
সুদীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ি জাগিল আবার।
লৌহাঘাত, রক্তপাত, পড়িয়া প্রস্তরে—
নাহি কিছু জ্ঞান; কিসে প্রাণেশে উদ্ধার
করিবে ভাবিছে মনে; কিসে একবার
লহবে হৃদয়ে সেই প্রেম-পারাবার।

২৯


“হে বিধাতঃ!”—শোকে সতী নিবিড় আঁধারে
বলিতে লাগিল ধীরে করি যোড় কর,
চাহি উর্দ্ধ পানে, ভাসি নয়ন-আসারে,
অশ্রু সহ রক্তবিন্দু ঝরে দরদর;—

“হে বিধাত! দুঃখিনীরে এবে দয়া কর,
আর এ যাতনা নাহি সহে নারীপ্রাণ,
জানি আমি পতি মম নৃশংস পামর,
হৃদয় পাষাণ তাঁর; কিন্তু সে পাষাণ
দুঃখিনীরে বাসে ভাল; দুঃখিনী তেমন
করিয়াছে সে পাষাণে আত্ম-সমর্পণ।

৩০


“কহ কোন মন্ত্র, বিধি, দুঃখিনীর কাণে,
যার বলে ওই রুদ্ধ কপাট-অর্গল
খুলিবে পরশে মম, যেমতি বিমানে
খোলে পরশনে উষা-কর সুকোমল,
ধীরে পুর্ব্বাশার দ্বার নীরবে প্রভাতে!
অথবা যে বিধি হায়! নিষ্ঠুর এমন,
দিয়া রাজ্য সিংহাসন বিপক্ষের হাতে,
বঙ্গেশ্বরে কাৱাগারে করিল প্রেরণ,—
নরহন্তা-হস্তে,—মরি, বুক ফেটে যায়,
সে বিধির কাছে কাঁদি কি হইবে হায়!

৩১


“সতী নারী আমি, মম পতিগত প্রাণ,
অবশু খুলিবে দ্বার পরশে আমার।

পবিত্র-প্রণয়-পথে হয় তিরোধান
পর্ব্বত, সমুদ্র, বন; তুলনায় তার
তুচ্ছ ওই ক্ষুদ্র দ্বার”—বলি উন্মাদিনী
টানিতে লাগিল দ্বার সুকুমার করে,
যেমতি পিঞ্জরবদ্ধ বনবিহঙ্গিনী
চঞ্চুতে কাটিতে চাহে লোহার পিঞ্জরে।
রমণীর কর-রক্তে দ্বার কলঙ্কিল,
রমণীর কত অশ্রু কপাটে ঝরিল।

৩২


“রে পাপিষ্ঠ নরাধম নৃশংস মিরণ।
হরি রাজ্য সিংহাসন, ওরে দুরাচার!
তোর পাপতৃষা কি রে হলো না পুরণ?
রমণীর প্রতি শেষে এই অত্যাচার!
বরঞ্চ ত্যজিব প্রাণ এই কারাগারে,
লইব পাতিয়া বুকে উলঙ্গ কৃপাণ,
তথাপি এ রমণীর প্রেমপারাবারে
বিন্দুমাত্র বারি তোরে করিবে না দান।
যে চাহে পশুত্ব-বলে রমণী-প্রণয়,
অনলে সে চাহে জল, পাষাণে হৃদয়।”

৩৩

লৌহের কবাট, দৃঢ় লৌহের অর্গল,
খুলিল না রমণীর করুণ রোদনে,
দ্রবিল না দুঃখিনীর ঝরি অশ্রুজল।
বৃথাশ্রমে বিষাদিনী অবসন্ন মনে
বসিল ভুতলে; আহা! শিথিল শরীর,
আশ্রয়বিহীন চারু লতার মতন,
পড়িল ভূতলে ক্রমে হইয়া অধীর।
রক্তস্রোত শোকস্রোতে করি উন্মোচন,
মৃত্যুর অশোক অঙ্কে করিল শয়ন।

৩৪


নীরব অবনী; নিশি দ্বিতীয় প্রহর;
নীরব নিদ্রিত পুরী; আমোদ-তুফান
বিলোড়ন করি পুরী এবে স্থিরতর;
হয়েছে নগর যেন অবসরপ্রাণ।
প্রহরীর পদশব্দ; ঝিল্লীর ঝঙ্কার;
পবনে শঙ্কিত দুর সারমেয় রব;
কেবল মধুর স্বনে সমীর-সঞ্চার
কারা-বাতায়নে;—আর সকলি নীরব।

কেবল রমণী শোকে নীরবে রজনী
বর্ষিতেছে শিশিরাশ্রু তিতিয়া অবনী।

৩৫


কারাগার-কক্ষান্তরে গভীর নিশীথে,
কে ও দাঁড়াইয়া ওই অবনত মুখে?
বাতায়ন-কাষ্ঠে বক্ষ, নেত্র পৃথিবীতে,
শ্মশ্রু বহি অশ্রুধারা পড়িতেছে বুকে?
কেবল অভাগা হায়! একতান মন,
শুনিয়াছে রমণীর বিষাদ সঙ্গীত;
করিয়াছে প্রতিপদে অশ্রু বরিষণ: '
প্রতিতানে চিত্ত তার হয়েছে দ্রবিত।
যেন পদে পদে ক্রমে আয়ু হয় ক্ষয়,
শেষ তানে জীবনের হইয়াছে লয়।,

৩৬


প্রস্তর-পুতুল যেন গবাক্ষে স্থপিত,
হতভাগা দাঁড়াইয়া রয়েছে এখন;
অস্পন্দ শরীর, সর্ব্ব ধমনী স্তম্ভিত,
অনিশ্বাস, অপলক, নাসিক, নয়ন
তুমুল-ঝটিকা-বেগে কিন্তু স্মৃতিপথে,
বহিতেছে জীবনের ঘটনানিচয়;

সুখের শৈশবকাল, কৈশোরসুরতে,
বঙ্গসিংহাসন, ঘোর অত্যাচারচয়,
প্রজার বিরাগ, পরে পলাশিসমর,
পরাজয়, পলায়ন, ধূত, কারাঘর,

৩৭


অবশেষে প্রিয়তম-পত্নী-কারাবাস,—
একে একে সব মনে হইল উদিত।
শেষ চিন্তা-দাবানলে ছুটিল বাতাস,—
চিন্তায় মস্তিষ্ক এবে হইল ঘূর্ণিত।
সহিতে না পারি যেন এই গুরু ভার
ভূতলে পতিত হ’ল শ্লথ-কলেবর;
কমলিনীদলনিভ শয্যায় যাহার
সতত শয়ন, তার শয্যা কি প্রস্তর!
অবিচ্ছিন্ন চিন্তারাশি নয়নে তাহার
ঘোরতর কুজ্ঝটিকা করিল সঞ্চার।

৩৮


কুজ্ঝটিকা ব্যাপ্ত সেই তমিস্র ভিতরে,
নিরথিল হতভাগা মানস-নয়নে,
ভীষণ উন্মত্ত নীল বহ্নির সাগরে
প্রচণ্ড তরঙ্গরাশি ভীম আবর্ত্তনে

গর্জ্জিছে জীমূত-নাদে; নাহি বেলাসীমা,
ছুটিছে অনল-উর্ম্মি দিগন্ত ব্যাপিয়া;
অতি ভয়ঙ্কর সেই অনল-নীলিমা।
সে নীল তরল বহ্নিসাগরে ভাসিয়া
অসংখ্য মানববৃন্দ, দগ্ধ কলেবর,
অনন্ত কালের তরে দহে নিরস্তর।

৩৯


এই দগ্ধ দেহে তপ্ত তরঙ্গ-প্রহারে,
অস্থি হ’তে মাংসরাশি ফেলিছে খুলিয়া,
উলঙ্গ করস্কে পুনঃ, প্রচণ্ড হুঙ্কারে,
দিতেছে স্খলিত মাংস সংলগ্ন করিয়া।
অনুভব-অতিক্রম দারুণ পীড়ায়
করিতেছে দগ্ধ দেহ ভীষণ চীৎকার।
এই দৃশ্যে, হাহাকারে, অনল-শিখায়,
কেশরাশিতেও কম্প হ’ল অভাগার।
অকস্মাৎ হতভাগা দেখিল তখন,
এ অনল-পারাবারে হয়েছে পতন।

8O


কি যন্ত্রণা নিদারুণ করংক ভিতর!
দংশিতেছে বজ্রদন্তে কীট সংখ্যাতীত

হুঙ্কারিয়া চতুর্দ্দিক নীল বৈশ্বানর,
অভাগারে একেবারে করিল গ্রাসিত।
সাঁতারিতে চাহে, কিন্তু দগ্ধ দুই করে
শিলাবৎ অবশতা হয়েছে সঞ্চার,—
যন্ত্রণার পরাকাষ্ঠা! কম্পিত অস্তরে
উঠিল অভাগা মনে করিয়া চীৎকার।
কক্ষে আলো, অসি করে সম্মুখে শমন,—
চীৎকার করিয়া ভুমে হইল পতন!

8১


এই কি সিরাজদ্দৌলা? এই সে নবাব
যার নামে বঙ্গবাসী কাঁপে থর থর?
যার এই বঙ্গে ছিল প্রচণ্ড প্রভাব,
সেই কি পতিত আজি ধরার উপর?
কোথায় সে সিংহাসন? পারিষদগণ?
কোথায় সিরাজ তব মহিষীমণ্ডল?
কোথায় সে রাজদণ্ড? খচিত ভূষণ?
কেন আজি অশ্রুপূর্ণ নয়ন যুগল?
এ যে মহক্ষূদিবেগ তব অনুচর,
তুমি কেন পড়ে তার চরণ উপর?

৪২

দুই দিন আগে এই দুর্দ্দান্ত সিরাজ,
চাহিত না মুখ তুলি যেই অনুচরে;
আজি সে নবাব আহা! বিধির কি কায।
কাঁদিছে চরণে তার জীবনের তরে।
শত নরপতি পড়ি যাহার চরণে
কাঁদিত,—অদৃষ্ট আহা কে দেখে কখন।
সে মাগিছে ক্ষমা; যাহা এ পাপ জীবনে
জানে নাই, শিখে নাই, ভ্রমে বিতরণ
করে নাই। কি আশ্চর্য্য বিধির বিধান!—
যাহার যেমত দান, তথা প্রতিদান!

৪৩


রে পাপিষ্ঠ, দুরাচার, নিষ্ঠুর, দুর্জ্জন!
পায়ে পড়, ক্ষমা চাহ, সকলি বিফল।
কর্ম্মক্ষেত্রে যেই বীজ করেছ বপন,
ফলিবে তেমন তরু, অনুরূপ ফল।
আজন্ম ইন্দ্রিয়-সুখ পাপের মায়ায়,
কি পাপে না বঙ্গভূমি করেছ দুষিত?
নরনারী-রক্তস্রোতে, ভুলেছ কি হায়!
কি পাপকামনা নাহি করেছ পুরিত?



ভাবিতে পরের ভাগ্য-বিধাতা তোমায়;
নিজ ভাগ্যে এই ছিল জানিতে না হায়!

88


রে নির্দ্দয় অনুচর, কৃতঘ্ন-হৃদয়!
কি কাযে উদ্যত আজি নাহি কি রে জ্ঞান?
কেমনে রে দুরাচার! কেমনে নির্ভয়ে,
নাশিতে উদ্যত আজি নবাবের প্রাণ?
ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও, আপনার পাপে
ডুবিতেছে যেই পাপী, কি কাষ তাহারে
বধিয়া আবার? আহা! নিজ অনুতাপে
জ্বলিতেছে যেই জন, অকারণ তারে
কি ফল বল না প্রাণে করিয়া সংহীর?
মরার উপরে কেন খাঁড়ার প্রহার?

৪৫


ডুবিবে, ডুবিছে পাপী, আপনি আপন;
শৃঙ্গচ্যুত শিলাখণ্ড ত্যজিয়া শিখর
পড়ে,যবে ধরাতলে, কি কায তখন
আঘাত করিয়া তার পৃষ্ঠের উপর?
সৌভাগ্য-আকাশ-চ্যুত অভাগা যবন
ভূতলে পতিত এবে নক্ষত্রের প্রায়;

কি হইবে অভাগার বধিলে জীবন?
থাক্ হত গৌরবের পতাকার ন্যায়।
হাবাইয়া ধন, মান, রাজ্য, সিংহাসন,
কারাগারে হতভাগা কাটাক্ জীবন!

৪৬


গভীর নিশীথ; নৈশ প্রকৃতি গভীর;
স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া বিশ্ব চবাচর;
কৃষ্ণপক্ষ রজনীর ববণ তিমির,
ক্রমে ক্রমে হইয়াছে আরো গাঢ়তব।
মাতঃ বসুন্ধবে! হেন নিবিড় নিশীথে
হিংস্র জন্তুবাও বনে বিববে নিদ্রিত;
হায়! এ সমযে কেন ধরা কলঙ্কিতে,
মানবের পাপলিপ্সা হয় উত্তেজিত?
বসুমতি। বঙ্গভূমি! যাও রসাতল!
লইও না এই পাপ পাতি বক্ষঃস্থল।

8৭


কি করিস্! কি কবিস্‌ ওরে অনুচর।
তুলিস্ না তীক্ষ্ণ অসি, ওরে নৃশংসয়।
ক্ষমা কব্‌! ক্ষমা কর্‌। অনুরোধ ধর।
এই পাপে যবনের ঘটিবে নিরয়।

উঠিল উজ্জ্বল অসি করি ঝলমল,
দুর্ব্বল প্রদীপালোকে; নামিল যখন,
সিরাজের ছিন্ন মুণ্ড চুম্বিয়া ভূতল
পড়িল, ছুটিল রক্ত স্রোতের মতন।
নিবিল গৃহের দীপ; নিবিল তখন
ভারতের শেষ-আশা,—হইল স্বপন!


সম্পূর্ণম্।