পল্লী-সমাজ/উনবিংশ পরিচ্ছেদ

১৯

 সেই দিন অপরাহ্নে একটা অচিন্তনীয় ঘটনা ঘটিল। আদালতের বিচার উপেক্ষা করিয়া কৈলাস নাপিত এবং সেখ মতিলাল সাক্ষীসাবুদ সঙ্গে লইয়া রমেশের শরণাপন্ন হইল। রমেশ অকৃত্রিম বিস্ময়ের সহিত প্রশ্ন করিল,—“আমার বিচার তোমরা মান্‌বে কেন বাপু?”

 বাদী প্রতিবাদী উভয়েই জবাব দিল,—“মান্‌ব না কেন বাবু, হাকিমের চেয়ে আপনার বিদ্যাবুদ্ধিই কোন্‌ কম? আর, হাকিম হুজুর যা’ কিছু তা’ আপনারা পাঁচজন ভদ্রলোকেই ত হ’য়ে থাকেন! কা’ল যদি আপনি সরকারী চাকরি নিয়ে হাকিম হ’য়ে ব’সে বিচার ক’রে দেন, সেই বিচার ত আমাদেরই মাথা পেতে নিতে হবে! তখন ত মান্‌ব না বল্‌লে চল্‌বে না।” কথা শুনিয়া রমেশের বুক গর্ব্বে, আনন্দে স্ফীত হইয়া উঠিল। কৈলাস কহিল,—“আপনাকে আমরা দুজনেই দুকথা বুঝিয়ে বল্‌তে পারব; কিন্তু, আদালতে সেটি হবে না। তা’ ছাড়া গাঁটের কড়ি মুটোভরে উকিলকে না দিতে পার্‌লে, সুবিধে কিছুতেই হয় না, বাবু! এখানে একটি পয়সা খরচ নেই, উকিলকে খোসামোদ কর্‌তে হবে না, পথ হাঁটাহাঁটি ক’রে মর্‌তে হবে না। না বাবু, আপনি যা’ হুকুম কর্‌বেন, ভাল হোক্‌, মন্দ হোক্‌, আমরা তাতেই রাজী হ’য়ে, আপনার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে, ঘরে ফিরে যাব। ভগবান্‌ সুবুদ্ধি দিলেন, আমরা দুজনে তাই আদালত থেকে ফিরে এসে আপনার চরণেই শরণ নিলাম।” একটা ছোট নালা লইয়া উভয়ের বিবাদ। দলিলপত্র সামান্য যাহা কিছু ছিল, রমেশের হাতে দিয়া কা’ল সকালে আসিবে বলিয়া, উভয়ে লোকজন লইয়া প্রস্থান করিবার পর, রমেশ স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। ইহা তাহার কল্পনার অতীত। সুদূর-ভবিষ্যতেও সে কখনও এত বড় আশা মনে ঠাঁই দেয় নাই। তাহার মীমাংসা ইহারা পরে গ্রহণ করুক বা না করুক, কিন্তু, আজ যে, ইহারা সরকারী আদালতের বাহিরে বিবাদনিষ্পত্তি করিবার অভিপ্রায়ে পথ হইতে ফিরিয়া তাহার কাছে উপস্থিত হইয়াছে, ইহাই তাহার বুক ভরিয়া আনন্দস্রোত ছুটাইয়া দিল। যদিচ, বেশী কিছু নয়, সামান্য দুইজন গ্রামবাসীর অতি তুচ্ছ বিবাদের কথা; কিন্তু, এই তুচ্ছ কথার সূত্র ধরিয়াই তাহার চিত্তের মাঝে অনন্ত সম্ভাবনার আকাশ-কুসুম ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। তাহার এই দুর্ভাগিনী জন্মভূমির জন্য ভবিষ্যতে সে কি যে না করিতে পারিবে, তাহার কোথাও কোনো হিসাব-নিকাশ, কূলকিনারা আর রহিল না। বাহিরে বসন্ত-জ্যোৎস্নায় আকাশ ভাসিয়া যাইতেছিল, সেই দিকে চাহিয়া হঠাৎ তাহার রমাকে মনে পড়িল। অন্য কোন দিন হইলে সঙ্গে সঙ্গেই তাহার সর্ব্বাঙ্গ জ্বালা করিয়া উঠিত। কিন্তু, আজ জ্বালা করা ত দূরের কথা, কোথাও সে একবিন্দু অগ্নিস্ফুলিঙ্গের অস্তিত্বও অনুভব করিল না। মনে মনে একটু হাসিয়া তাহাকে উদ্দেশ করিয়া কহিল,—“তোমার হাত দিয়ে ভগবান্‌ আমাকে এমন সার্থক ক’রে তুলবেন, তোমার বিষ আমার অদৃষ্টে এমন অমৃত হ’য়ে উঠ্‌বে, এ যদি তুমি জান্‌তে রমা, বোধ করি, কখনও আমাকে জেলে দিতে চাইতে না! কে গা?”

 “আমি রাধা, ছোটবাবু! রমাদিদি অতি অবিশ্যি করে একবার দেখা দিতে বল্‌চেন।” রমা সাক্ষাৎ করিবার জন্য দাসী পাঠাইয়া দিয়াছে। রমেশ অবাক হইয়া রহিল। আজ এ কোন্‌ নষ্টবুদ্ধি দেবতা তাহার সহিত সকল প্রকারের অনাসৃষ্টি কৌতুক করিতেছেন! দাসী কহিল,—“একবার দয়া ক’রে যদি ছোটবাবু—” “কোথায় তিনি?”

 “ঘরে শুয়ে আছেন।” একটু থামিয়া কহিল,—“কাল ত আর সময় হ’য়ে উঠ্‌বে না; তাই এখন যদি একবার—” “আচ্ছা চল যাই—” বলিয়া রমেশ উঠিয়া দাঁড়াইল।

 ডাকিতে পাঠাইয়া দিয়া রমা একপ্রকার সচকিত অবস্থায় বিছানায় পড়িয়াছিল। দাসীর নির্দ্দেশমত রমেশ ঘরে ঢুকিয়া, একটা চৌকি টানিয়া লইয়া বসিতেই, সে শুদ্ধমাত্র যেন মনের জোরেই নিজেকে টানিয়া আনিয়া রমেশের পদপ্রান্তে নিক্ষেপ করিল। ঘরের এককোণে মিট্‌ মিট্ করিয়া একটা প্রদীপ জ্বলিতেছিল। তাহারি মৃদু আলোকে রমেশ অস্পষ্ট-আকারে রমার যতটুকু দেখিতে পাইল, তাহাতে তাহার শারীরিক অবস্থার কিছুই জানিতে পারিল না। এইমাত্র পথে আসিতে আসিতে সে যে সকল সঙ্কল্প মনে মনে ঠিক করিয়াছিল, রমার সম্মুখে বসিয়া তাহার আগাগোড়াই বেঠিক হইয়া গেল। একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া, সে কোমলস্বরে জিজ্ঞাসা করিল,—“এখন কেমন আছ রাণি?” রমা তাহার পায়ের গোড়া হইতে একটুখানি সরিয়া বসিয়া কহিল,—“আমাকে আপনি রমা বলেই ডাক্‌বেন।” রমেশের পিঠে কে যেন চাবুকের ঘা মারিল। সে একমুহূর্ত্তেই কঠিন হইয়া কহিল,—“বেশ, তাই। শুনেছিলাম, তুমি অসুস্থ ছিলে—এখন কেমন আছ, তাই জিজ্ঞাসা কর্‌ছিলাম। নইলে, নাম তোমার যাই হৌক্‌, সে ধ’রে ডাক্‌বার আমার ইচ্ছেও নেই, আবশ্যকও হবে না।” রমা সমস্তই বুঝিল। একটুখানি স্থির থাকিয়া ধীরে ধীরে কহিল,—“এখন আমি ভাল আছি।” তার পরে কহিল,—“আমি ডেকে পাঠিয়েছি ব’লে আপনি হয় ত খুব আশ্চর্য্য হয়েচেন, কিন্তু—” রমেশ কথার মাঝ্‌খানেই তীব্র স্বরে বলিয়া উঠিল,—“না, হইনি। তোমার কোনো কাজে আশ্চর্য্য হবার দিন আমার কেটে গেছে। কিন্তু, ডেকে পাঠিয়েছ কেন?” কথাটা রমার বুকে যে কতবড় শেল-আঘাত করিল, তাহা রমেশ জানিতেও পারিল না। সে মৌন-নতমুখে কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া বলিল,—“রমেশ দা’, আজ দু’টি কাজের জন্যে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ডেকে এনেচি। আমি তোমার কাছে কত অপরাধ যে ক’রেচি, সে ত আমি জানি। কিন্তু, তবু আমি নিশ্চয় জান্‌তাম, তুমি আস্‌বে, আর আমার এই দু’টি শেষ অনুরোধও অস্বীকার কর্‌বে না।” অশ্রুভারে সহসা তাহার স্বরভঙ্গ হইয়া গেল। তাহা এতই স্পষ্ট যে, রমেশ টের পাইল, এবং চক্ষের নিমিষে তাহার পূর্ব্বস্নেহ আলোড়িত হইয়া উঠিল। এত আঘাত-প্রতিঘাতেও সে স্নেহ যে আজিও মরে নাই, শুধু নির্জ্জীব, অচৈতন্যের মত পড়িয়াছিল মাত্র, তাহা নিশ্চিত অনুভব করিয়া সে নিজেও আজ বিস্মিত হইয়া গেল। ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া শেষে কহিল,—“কি তোমার আনুরোধ?” রমা চকিতের মত মুখ তুলিয়াই আবার অবনত করিল। কহিল,—“যে বিষয়টা বড়দা’ তোমার সাহায্যে দখল করতে চাচ্চেন, সেটা আমার নিজের; অর্থাৎ আমার পোনর আনা, তোমাদের এক আনা, সেইটাই আমি তোমাকে দিয়ে যেতে চাই।” রমেশ পুনর্ব্বার উষ্ণ হইয়া উঠিল। কহিল,—“তোমার ভয় নেই, আমি চুরি কর্‌তে পূর্ব্বেও কখনো কাউকে সাহায্য করিনি, এখনো কর্‌ব না। আর যদি দান কর্‌তেই চাও—তার জন্যে অন্য লোক আছে—আমি দান-গ্রহণ করিনে।” পূর্ব্বে হইলে রমা তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিত, “মুখুয্যেদের দান-গ্রহণ করায় ঘোষালদের অপমান হয় না।” আজ কিন্তু, এ কথা তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল না। সে বিনীতভাবে কহিল,—“আমি জানি, রমেশ দা’, তুমি চুরি কর্‌তে সাহায্য কর্‌বে না। আর নিলেও যে তুমি নিজের জন্যে নেবে না, সেও আমি জানি। কিন্তু, তা’ত নয়। দোষ কর্‌লে শাস্তি হয়। আমি যত অপরাধ করেচি, এটা তারই জরিমানা ব’লে কেন গ্রহণ কর না!” রমেশ ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল,—“তোমার দ্বিতীয় অনুরোধ?” রমা কহিল,—“আমার যতীনকে আমি তোমার হাতে দিয়ে গেলাম। তাকে তোমার মত ক’রে মানুষ কোরো। বড় হ’য়ে সে যেন তোমার মতই হাসিমুখে স্বার্থত্যাগ কর্‌তে পারে।” রমেশের চিত্তের সমস্ত কঠোরতা বিগলিত হইয়া গেল। রমা আঁচল দিয়া চোখ মুছিয়া কহিল,—“এ আমার চোখে দেখে যাবার সময় হবে না; কিন্তু, আমি নিশ্চয় জানি, যতীনের দেহে তাঁর পূর্ব্বপুরুষের রক্ত আছে। ত্যাগ কর্‌বার যে শক্তি তাঁর অস্থিমজ্জায় মিশিয়ে আছে—শেখালে হয় ত একদিন যে তোমার মতই মাথা উঁচু ক’রে দাঁড়াবে।” রমেশ তৎক্ষণাৎ তাঁহার কোন উত্তর দিল না। জানালার বাহিরে জ্যোৎস্না-প্লাবিত আকাশের পানে চাহিয়া রহিল। তাঁহার মনের ভিতরটা এমন একটা ব্যথায় ভরিয়া উঠিতেছিল, যাহার সহিত কোনদিন তাঁহার পরিচয় ঘটে নাই। বহুক্ষণ নিঃশব্দে কাটার পরে, রমেশ মুখ ফিরাইয়া কহিল,—“দেখ, এ সকলের মধ্যে আর আমাকে টেনো না। আমি অনেক দুঃখ-কষ্টের পর, একটুখানি আলোর শিখা জ্বাল্‌তে পেরেচি;—তাই আমার কেবল ভয়, পাছে একটুতেই তা’ নিবে যায়।” রমা কহিল,—“আর ভয় নেই রমেশ দা’, তোমার এ আলো আর নিব্‌বে না। জ্যাঠাইমা বল্‌ছিলেন, তুমি দূর থেকে এসে বড় উঁচুতে ব’সে কাজ করতে চেয়েছিলে বলেই এত বাধা-বিঘ্ন পেয়েচ। আমরা নিজেদের দুষ্কৃতির ভারে তোমাকে নাবিয়ে এনে এখন ঠিক জায়গাটাতেই প্রতিষ্ঠিত ক’রে দিয়েচি। এখন তুমি আমাদের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েচ বলেই তোমার ভয় হচ্চে; আগে হ’লে এ আশঙ্কা তোমার মনে ঠাঁই পেত না। তখন তুমি গ্রাম্য-সমাজের অতীত ছিলে, আজ তুমি তারই একজন হয়েচ। তাই এ আলো তোমার আর ম্লান হবে না—এখন প্রতিদিনই উজ্জ্বল হ’য়ে উঠ্‌বে।” সহসা জ্যাঠাইমার নামে রমেশ উদ্দীপ্ত হইয়া উঠীল—কহিল,—“ঠিক জানো কি রমা, আমার এই দীপের শিখাটুকু আর নিবে যাবে না?” রমা দৃঢ়কণ্ঠে কহিল,—“ঠিক জানি। যিনি সব জানেন, এ সেই জ্যাঠাইমার কথা। এ কাজ তোমারি। আমার যতীনকে তুমি হাতে তুলে নিয়ে, আমার সকল অপরাধ ক্ষমা ক’রে আজ আশীর্ব্বাদ ক’রে আমাকে বিদায় দাও রমেশদা’, আমি যেন নিশ্চিত হ’য়ে আমার স্বামীর কাছে যেতে পারি।” ব্রজ্রগর্ভ মেঘের মত রমেশের বুকের ভিতরটা ক্ষণে ক্ষণে চমকিয়া উঠিতে লাগিল; কিন্তু, সে মাথা হেঁট করিয়া স্তব্ধ হইইয়া বসিয়া রহিল। রমা কহিল,—“আমার আর একটা কথা তোমাকে রাখতে হবে। বল রাখ্‌বে?” রমেশ মৃদুকণ্ঠে কহিল,—“কি কথা?” রমা বলিল,—“আমার কথা নিয়ে বড়দা’র সঙ্গে তুমি কোন দিন ঝগড়া কোরো না।” রমেশ বুঝিতে না পারিয়া প্রশ্ন করিল—“তার মানে?” রমা কহিল,—“মানে যদি কখনও শুন্‌তে পাও, সেদিন শুধু এই কথাটি মনে করো, আমি কেমন ক’রে নিঃশব্দে সহ্য ক’রে চলে গেছি,—একটি কথারও প্রতিবাদ করিনি। একদিন যখন অসহ্য মনে হয়েছিল, সে দিন জ্যাঠাইমা এসে বলেছিলেন,—‘মা, মিথ্যেকে ঘাঁটাঘাঁটি ক’রে জাগিয়ে তুল্‌লেই তার পরমায়ু বেড়ে ওঠে। নিজের অসহিষ্ণুতায় তার আয়ু বাড়িয়ে তোলার মতোন পাপ অল্পই আছে।’ তাঁর এই উপদেশটি মনে রেখে, আমি সকল দুঃখ-দুর্ভাগ্যই কাটিয়ে উঠেচি—এটি তুমিও কোন দিন ভুলো না রমেশ দা’।” রমেশ নীরবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। রমা ক্ষণেক পরে কহিল,—“আজ আমাকে তুমি ক্ষমা কর্‌তে পার্‌চ না মনে ক’রে দুঃখ কোরো না, রমেশ দা’। আমি নিশ্চয় জানি, আজ যা’ কঠিন ব’লে মনে হচ্চে, একদিন তাই সোজা হয়ে যাবে। সেদিন আমার সকল অপরাধ তুমি সহজেই ক্ষমা কর্‌বে জেনে আমার মনের মধ্যে আর কোন ক্লেশ নেই। কা’ল আমি যাচ্চি।”

 “কা’ল?” রমেশ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল,—“কোথায় যাবে কা’ল?” রমা কহিল,—“জ্যাঠাইমা যেখানে নিয়ে যাবেন, আমি সেইখানেই যাব।” রমেশ কহিল,—“কিন্তু, তিনি ত আর ফিরে আস্‌বেন না শুন্‌চি।” রমা ধীরে ধীরে বলিল,—“আমিও না। আমিও তোমাদের পায়ে জন্মের মত বিদায় নিচ্চি।” বলিয়া সে হেঁট হইয়া মাটীতে মাথা ঠেকাইল। রমেশ মুহূর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল,—“আচ্ছা, যাও। কিন্তু, কেন বিদায় চাইচ, সেও কি জান্‌তে পার্‌ব না?” রমা মৌন হইয়া রহিল। রমেশ পুনরায় কহিল, “কেন যে তোমার সমস্ত কথাই লুকিয়ে রেখে চ’লে গেলে, সে তুমিই জানো। কিন্তু, আমিও কায়মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, একদিন যেন তোমাকে সর্ব্বান্তঃকরণেই ক্ষমা কর্‌তে পারি। তোমাকে ক্ষমা কর্‌তে না পারায় যে আমার কি ব্যথা, সে শুধু আমার অন্তর্যামীই জানেন।” রমার দুই চোখ বাহিয়া ঝর্‌-ঝর্‌ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। কিন্তু, সেই অত্যন্ত মৃদু-আলোকে রমেশ তাহা দেখিতে পাইল না। রমা নিঃশব্দে দূর হইতে তাহাকে আর একবার প্রণাম করিল, এবং পরক্ষণেই রমেশ ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। পথে চলিতে চলিতে তাহার মনে হইল, তাহার ভবিষ্যৎ, তাহার সমস্ত কাজকর্ম্মের উৎসাহ যেন এক নিমিষে, এই জ্যোৎস্নার মতই অস্পষ্ট-ছায়াময় হইয়া গেছে।

 পরদিন সকালবেলায় রমেশ এ বাড়ীতে আসিয়া যখন উপস্থিত হইল, তখন বিশ্বেশ্বরী যাত্রা করিয়া পাল্কীতে প্রবেশ করিয়াছেন। রমেশ দ্বারের কাছে মুখ লইয়া অশ্রু-ব্যাকুলকণ্ঠে কহিল,—“কি অপরাধে আমাদের এত শীঘ্র ত্যাগ ক’রে চল্‌লে জ্যাঠাইমা?” বিশ্বেশ্বরী ডানহাত বাড়াইয়া রমেশের মাথায় রাখিয়া বলিলেন,—“অপরাধের কথা ব’ল্‌তে গেলে ত শেষ হবে না বাবা। তায় কাজ নেই।” তাঁর পরে বলিলেন,—“এখানে যদি মরি রমেশ, বেণী আমার মুখে আগুন দেবে। সে হ’লে ত কোনমতেই মুক্তি পাব না। ইহকালটা ত জ্বলে জ্বলেই গেল, বাবা, পাছে পরকালটাও এম্‌নি জ্বলে-পুড়ে মরি, আমি সেই ভয়ে পালাচ্চি রমেশ।” রমেশ বজ্রাহতের মত স্তম্ভিত হইয়া রহিল। আজ এই একটি কথায় সে জ্যাঠাইমার বুকের ভিতরটায় জননীয় জ্বালা যেমন করিয়া দেখিতে পাইল, এমন আর কোন দিন পায় নাই। কিছুক্ষণ স্থির হইয়া থাকিয়া কহিল,—“রমা কেন যাচ্চে জ্যাঠাইমা?” বিশ্বেশ্বরী একটা প্রবল বাষ্পোচ্ছ্বাস যেন সংবরণ করিয়া লইলেন। তার পরে গলা খাটো করিয়া বলিলেন,—“সংসারে তাঁর যে স্থান নেই, বাবা, তাই তাকে ভগবানের পায়ের নীচেই নিয়ে যাচ্চি। সেখানে গিয়েও সে বাঁচে কি না, জানিনে। কিন্তু, যদি বাঁচে, সারা জীবন ধরে এই অত্যন্ত কঠিন প্রশ্নের মীমাংসা কর্‌তে অনুরোধ কর্‌ব, কেন ভগবান্‌ তাকে এত রূপ, এত গুণ, এত বড় একটা প্রাণ দিয়ে সংসারে পাঠিয়েছিলেন এবং কেনই বা বিনা দোষে এই দুঃখের বোঝা মাথায় দিয়ে আবার সংসারের বাইরে ফেলে দিলেন। এ কি অর্থপূর্ণ মঙ্গল অভিপ্রায় তাঁরই, না, এ শুধু আমাদের সমাজের খেয়ালের খেলা। ওরে রমেশ, তাঁর মত দুঃখিনী বুঝি আর পৃথিবীতে নেই।” বলিতে বলিতেই তাঁহার গলা ভাঙ্গিয়া পড়িল। তাঁহাকে এতখানি ব্যাকুলতা প্রকাশ করিতে কেহ কখনও দেখে নাই। রমেশ স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। বিশ্বেশ্বরী একটু পরেই কহিলেন,—“কিন্তু, তোর ওপর আমার এই আদেশ রইল রমেশ, তাকে তুই যেন ভুল বুঝিস্‌নে। যাবার সময় আমি কারো বিরুদ্ধে কোন নালিশ ক’রে যেতে চাইনে, শুধু এই কথাটা আমার তুই ভুলেও কখনো অবিশ্বাস করিস্‌নে যে, তার বড় মঙ্গলাকাঙ্ক্ষিণী তোর আর কেউ নেই।” রমেশ বলিতে গেল,—“কিন্তু, জ্যাঠাইমা—” জ্যাঠাইমা তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিলেন,—“এর মধ্যে কোন ‘কিন্তু’ নেই রমেশ। তুই যা’ শুনেছিস্‌ সব মিথ্যে; যা’ জেনেছিস্‌, সব ভুল। কিন্তু, এ অভিযোগের এইখানেই যেন সমাপ্তি হয়। তোর কাজ যেন সমস্ত অন্যায়, সমস্ত হিংসা-বিদ্বেষকে সম্পূর্ণ তুচ্ছ ক’রে চিরদিন এম্‌নি প্রবল হ’য়ে ব’য়ে যেতে পারে, এই তোর ওপর তার শেষ অনুরোধ। এই জন্যই সে মুখ-বুজে সমস্ত সহ্য ক’রে গেছে। প্রাণ দিতে বসেচে, রে রমেশ, তবু কথা কয়নি।” গতরাত্রে রমার নিজের মুখের দুই একটা কথাও রমেশের সেই মুহূর্ত্তে মনে পড়িয়া দুর্জ্জয় রোদনের বেগ যেন ওষ্ঠ পর্য্যন্ত ঠেলিয়া উঠিল। সে তাড়াতাড়ি মুখ নীচু করিয়া প্রাণপণ-শক্তিতে বলিয়া ফেলিল,—“তাকে বোলো জ্যাঠাইমা, তাই হবে।” বলিয়াই হাত বাড়াইয়া কোন মতে তাঁহার পায়ের ধূলা লইয়া ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল!


সম্পূর্ণ