পল্লী-সমাজ/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
বাহিরে এইমাত্র শ্রাদ্ধ শেষ হইয়া গেছে। আসন হইতে উঠিয়া রমেশ অভ্যাগতদিগের সহিত পরিচিত হইবার চেষ্টা করিতেছে—বাড়ীর ভিতরে আহারের জন্য পাতা পাড়িবার আয়োজন হইতেছে, এমন সময় একটা গোলমাল হাঁকাহাঁকি শুনিয়া রমেশ ব্যস্ত হইয়া, ভিতরে আসিয়া উপস্থিত হইল। সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই আসিল। ভিতরে রন্ধনশালার কপাটের একপাশে একটি ২৫।২৬ বছরের বিধবা মেয়ে জড়সড় হইয়া, পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে এবং আর একটি প্রৌঢ়া রমণী তাহাকে আগলাইয়া দাঁড়াইয়া ক্রোধে চোখমুখ রক্তবর্ণ করিয়া চীৎকারে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাহির করিতেছে। বিবাদ বাধিয়াছে পরাণ হালদারের সহিত। রমেশকে দেখিবামাত্র প্রৌঢ়া চেঁচাইয়া প্রশ্ন করিল, “হাঁ বাবা, তুমিও ত গাঁয়ের একজন জমিদার, বলি, যত দোষ কি এই ক্ষেন্তি বাম্নির মেয়ের? মাথার ওপর আমাদের কেউ নেই ব’লে কি যতবার খুসি শাস্তি দেবে?” গোবিন্দকে দেখাইয়া কহিল, “ঐ উনি মুখুয্যে বাড়ীর গাছ-পিতিষ্ঠের সময় জরিমানা ব’লে ইস্কুলের নামে দশটাকা আমার কাছে আদায় করেননি কি? গাঁয়ের ষোলো–আনা শেতলা-পুজোর জন্যে দুজোড়া পাঁঠার দাম ধ’রে নেননি কি? তবে, কতবার ঐ এক কথা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কর্তে চান, শুনি?” রমেশ ব্যাপারটা কি, কিছুই বুঝিতে পারিল না। গোবিন্দ গাঙুলী বসিয়াছিল, মীমাংসা করিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। একবার রমেশের দিকে, একবার প্রৌঢ়ার দিকে চাহিয়া গম্ভীর গলায় কহিল, “যদি আমার নাম্টাই কর্লে, ক্ষান্তমাসী, তবে সত্যি কথা বলি, বাছা! খাতিরে কথা কইবার লোক এই গোবিন্দ গাঙুলী নয়। সে দেশ শুদ্ধ লোক জানে। তোমার মেয়ের প্রাশ্চিত্যও হয়েচে, সামাজিক জরিমানাও আমরা করেছি—সব মানি। কিন্তু তাকে যজ্ঞিতে কাঠি দিতে ত আমরা হুকুম দিইনি! মর্লে ওকে পোড়াতে আমরা কাঁধ দেব, কিন্তু—” ক্ষান্তমাসী চীৎকার করিয়া উঠিল, “ম’লে তোমার নিজের মেয়েকে কাঁধে ক’রে পুড়িয়ে এসো বাছা—আমার মেয়ের ভাবনা তোমাকে ভাব্তে হবে না। বলি, হাঁ গোবিন্দ, নিজের গায়ে হাত দিয়ে কি কথা কও না? তোমার ছোট–ভাজ যে ঐ ভাঁড়ার ঘরে বসে পান সাজ্চে, সে আর বছর মাসদেড়েক ধ’রে কোন্ কাশীবাস ক’রে অমন হল্দে রোগা শল্তেটির মত হয়ে ফিরে এসেছিল, শুনি? সে বড়লোকের বড় কথা বুঝি? বেশী ঘেঁটিয়ো না, বাপু, আমি সব জারিজুরি ভেঙে দিতে পারি। আমরাও ছেলেমেয়ে পেটে ধরেচি, আমরা চিন্তে পারি। আমাদের চোখে ধূলো দেওয়া যায় না।” গোবিন্দ ক্ষ্যাপার মত ঝাঁপাইয়া পড়িল—“তবে রে, হারামজাদা মাগী—” কিন্তু হারামজাদা মাগী একটুও ভয় পাইল না, বরং এক পা আগাইয়া আসিয়া হাতমুখ ঘুরাইয়া কহিল, “মারবি না কি রে? ক্ষেন্তিবাম্নিকে ঘাঁটালে ঠগ্ বাছতে গাঁ উজোড় হয়ে যাবে, তা’ বলে দিচ্চি। আমার মেয়ে ত রান্নাঘরে ঢুকতে যায়নি; দোর-গোড়ায় আস্তে না আস্তে হালদার ঠাকুরপো যে খামকা অপমান ক’রে বস্ল, বলি তার বেয়ানের তাঁতি-অপবাদ ছিল নাকি? আমি ত আর আজকের নই গো, বলি, আরও বল্ব, না এতেই হবে?” রমেশ কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ভৈরব আচার্য্য ব্যস্ত হইয়া ক্ষান্তর হাতটা প্রায় ধরিয়া ফেলিয়া সানুনয়ে কহিল, “এতেই হবে, মাসি, আর কাজ নেই। নে, সুকুমারী, ওঠ মা, চল্ বাছা, আমার সঙ্গে ওঘরে গিয়ে বস্বি চল্।” পরাণ হালদার চাদর কাঁধে লইয়া সোজা খাড়া হইয়া উঠিয়া বলিল, “এই বেশ্যে মাগীদের বাড়ী থেকে একেবারে তাড়িয়ে না দিলে এখানে আমি জলগ্রহণ কর্ব না, তা’ বলে দিচ্চি। গোবিন্দ! কালীচরণ! তোমাদের মামাকে চাও, ত উঠে এসো বল্চি। বেণী ঘোষাল যে তখন বলেছিল, “মামা, যেয়ো না ওখানে!’ এমন সব খান্কী-নটীর কাণ্ডকারখানা জান্লে কি জাত-জন্ম খোয়াতে এ বাড়ীর চৌকাঠ মাড়াই? কালী! উঠে এসো।” মাতুলের পুনঃ পুনঃ আহ্বানেও কিন্তু কালীচরণ ঘাড় হেঁট করিয়া বসিয়া রহিল। সে পাটের ব্যবসা করে। বছরচারেক পূর্ব্বে কলিকাতাবাসী তাহার এক গণ্যমান্য খরিদ্দার বন্ধু তাহার বিধবা ছোটভগিনীটিকে লইয়া প্রস্থান করিয়াছিল। ঘটনাটি গোপন ছিল না। হঠাৎ শ্বশুরবাটী যাওয়া এবং তথা হইতে তীর্থযাত্রা ইত্যাদি প্রসঙ্গে কিছুদিন চাপা ছিল মাত্র। পাছে সেই দুর্ঘটনার ইতিহাস এত লোকের সমক্ষে আবার উঠিয়া পড়ে, এই ভয়ে কালী মুখ তুলিতে পারিল না। কিন্তু গোবিন্দের গায়ের জ্বালা আদৌ কমে নাই। সে আবার উঠিয়া দাঁড়াইয়া জোর গলায় কহিল, “যে যাই বলুক না কেন, এ অঞ্চলে সমাজপতি হলেন বেণী ঘোষাল, পরাণ হালদার আর যদু মুখুজ্যে মহাশয়ের কন্যা। তাঁদের আমরা ত কেউ ফেলতে পার্ব না! রমেশ বাবাজী সমাজের অমতে এই দুটো মাগীকে কেন বাড়ী ঢুক্তে দিয়েচেন, তার জবাব না দিলে, আমরা এখানে জলটুকু পর্য্যন্ত মুখে দিতে পারব না।” দেখিতে দেখিতে পাঁচসাত-দশজন চাদর কাঁধে ফেলিয়া একে একে উঠিয়া দাঁড়াইল। ইহারা পাড়াগাঁয়েরই লোক, সামাজিক ব্যাপারে কোথায় কোন চাল্ সর্ব্বাপেক্ষা লাভজনক, ইহা তাহাদের অবিদিত নহে।
নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ-সজ্জনেরা যাহারা যা খুসি বলিতে লাগিল। ভৈরব এবং দীনু ভট্চায কাঁদ কাঁদ হইয়া বার বার ক্ষান্তমাসী ও তাহার মেয়ের, একবার গাঙুলী ও হালদার মহাশয়ের হাতে-পায়ে ধরিবার উপক্রম করিতে লাগিল—চারিদিক্ হইতে সমস্ত অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকর্ম্ম যেন লণ্ডভণ্ড হইবার সূচনা প্রকাশ করিল। কিন্তু রমেশ একটি কথা কহিতে পারিল না; একে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় নিতান্ত কাতর, তাহাতে অকস্মাৎ এই অভাবনীয় কাণ্ড। সে পাংশুমুখে কেমন যেন একরকম হতবুদ্ধির মত স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল।
“রমেশ!” অকস্মাৎ এক মুহূর্ত্তে সমস্ত লোকের সচকিত দৃষ্টি এক হইয়া বিশ্বেশ্বরীর মুখের উপর গিয়া পড়িল। তিনি ভাঁড়ার হইতে বাহির হইয়া কপাটের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। তাঁহার মাথার উপর আঁচল ছিল কিন্তু মুখখানি অনাবৃত। রমেশ দেখিল, জ্যাঠাইমা আপনিই কখন্ আসিয়াছেন—তাহাকে ত্যাগ করেন নাই। বাহিরের লোক দেখিল, ইনিই বিশ্বেশ্বরী, ইনিই ঘোষাল বাড়ীর গিন্নী-মা!
পল্লীগ্রামে সহরের কড়াপর্দ্দা নাই। তত্রাচ বিশ্বেশ্বরী বড়বাড়ীর বধূ বলিয়াই হৌক্, কিংবা অন্য যে-কোন কারণেই হৌক, যথেষ্ট বয়ঃপ্রাপ্তিসত্ত্বেও সাধারণতঃ কাহারো সাক্ষাতে বাহির হইতেন না। সুতরাং, সকলেই বড় বিস্মিত হইল। যাহারা শুধু শুনিয়াছিল, কিন্তু ইতিপূর্ব্বে কখনো চোখে দেখে নাই, তাহারা তাঁহার আশ্চর্য্য চোখ দুইটির পানে চাহিয়া একেবারে অবাক্ হইয়া গেল। বোধ করি, তিনি হঠাৎ ক্রোধবশেই বাহির হইয়া পড়িয়াছিলেন। সকলে মুখ তুলিবামাত্রই তিনি তৎক্ষণাৎ থামের পার্শ্বে সরিয়া গেলেন। সুস্পষ্ট, তীব্র আহ্বানে রমেশের বিহ্বলতা ঘুচিয়া গেল। সে সম্মুখে অগ্রসর হইয়া আসিল। জ্যাঠাইমা আড়াল হইতে তেম্নি সুস্পষ্ট, উচ্চকণ্ঠে বলিলেন, “গাঙুলী মশায়কে ভয় দেখাতে মানা ক’রে দে, রমেশ! আর হালদার মশায়কে আমার নাম ক’রে বল্ যে, আমি সবাইকে আদর ক’রে বাড়ীতে ডেকে এনেচি—সুকুমারীকে অপমান কর্বার তাঁর কোন প্রয়োজন ছিল না। আমার কাজকর্ম্মের বাড়ীতে হাঁকাহাঁকি, চেঁচাচেঁচি, গালিগালাজ কর্তে আমি নিষেধ কর্চি। যাঁর অসুবিধে হবে, তিনি আর কোথায় গিয়ে বসুন।” বড়গিন্নীর কড়া হুকুম সকলে নিজের কানেই শুনিতে পাইল। রমেশের মুখ ফুটিয়া বলিতে হইল না—হইলে সে পারিত না। ইহার ফল কি হইল, তাহা সে দাঁড়াইয়া দেখিতেও পারিল না। জ্যাঠাইমাকে সমস্ত দায়িত্ব নিজের মাথায় লইতে দেখিয়া, সে কোনমতে চোখের জল চাপিয়া দ্রুতপদে একটা ঘরে গিয়া ঢুকিল; তৎক্ষণাৎ তাহার দুই চোখ ছাপাইয়া দর-দর করিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। আজ সারাদিন সে নিজের কাজে বড় ব্যস্ত ছিল, কে আসিল না আসিল, তাহার খোঁজ লইতে পারে নাই। কিন্তু আর যেই আসুক, জ্যাঠাইমা যে আসিতে পারেন, ইহা তাহার সুদূর কল্পনারও অতীত ছিল। যাহারা উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, তাহারা আস্তে আস্তে বসিয়া পড়িল। শুধু গোবিন্দ গাঙুলী ও পরাণ হালদার আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কে একজন তাহাদিগকে উদ্দেশ করিয়া ভিড়ের ভিতর হইতে অস্ফুটে কহিল, “বসে পড় না খুড়ো! ষোলখানা লুচি, চারজোড়া সন্দেশ কে কোথায় খাইয়ে দাইয়ে সঙ্গে দেয়, বাবা!” পরাণ হালদার ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। কিন্তু আশ্চর্য, গোবিন্দ গাঙুলী সত্যই বসিয়া পড়িল। তবে মুখখানা সে বরাবর ভারী করিয়া রাখিল এবং আহারের জন্য পাতা পড়িলে তত্ত্বাবধানের ছুতা করিয়া সকলের সঙ্গে পংক্তিভোজনে উপবেশন করিল না। যাহারা তাহার এই ব্যবহার লক্ষ্য করিল, তাহারা সকলেই মনে মনে বুঝিল, গোবিন্দ সহজে কাহাকেও নিষ্কৃতি দিবে না। অতঃপর আর কোন গোলযোগ ঘটিল না। ব্রাহ্মণেরা যাহা ভোজন করিলেন, তাহা চোখে না দেখিলে প্রত্যয় করা শক্ত; এবং প্রত্যেকেই খুদি, পটল, ন্যাড়া, বুড়ী প্রভৃতি বাটীর অনুপস্থিত বালক–বালিকার নাম করিয়া যাহা বাঁধিয়া লইলেন, তাহাও যৎকিঞ্চিৎ নহে। সন্ধ্যার পর কাজকর্ম্ম প্রায় সারা হইয়া গেছে, রমেশ সদর-দরজার বাহিরে একটা পেয়ারাগাছের তলায় অন্যমনস্কের মত দাঁড়াইয়াছিল, মনটা তাহার ভাল ছিল না। দেখিল দীনু ভট্টাচার্য্য ছেলেদের লইয়া, লুচি-মণ্ডার গুরুভারে ঝুঁকিয়া পড়িয়া, একরূপ অলক্ষ্যে বাহির হইয়া যাইতেছে। সর্ব্বপ্রথমে খেঁদির নজর পড়ায় সে অপরাধীর মত থতমত খাইয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়া শুষ্ককণ্ঠে কহিল,“বাবা, বাবু দাঁড়িয়ে—” সবাই যেন একটু জড়সড় হইয়া পড়িল। ছোট মেয়েটির এই একটি কথা হইতেই রমেশ সমস্ত ইতিহাসটা বুঝিতে পারিল; পলাইবার পথ থাকিলে সে নিজেই পলাইত। কিন্তু সে উপায় ছিল না বলিয়া, আগাইয়া আসিয়া সহাস্যে কহিল, “খেঁদি, এ সব কার জন্যে নিয়ে যাচ্ছিস্ রে?” তাহাদের ছোট বড় পুঁটুলিগুলির ঠিক সদুত্তর খেঁদি দিতে পারিবে না আশঙ্কা করিয়া দীনু নিজেই একটুখানি শুষ্কভাবে হাসিয়া বলিলেন, “পাড়ার ছোটলোকদের ছেলেপিলেরা আছে ত বাবা, এঁটোকাঁটাগুলো নিয়ে গেলে তাদের দু’খানা চারখানা দিতে পার্ব। সে যাই হোক্, বাবা, কেন যে দেশসুদ্ধ লোক ওকে গিন্নী-মা ব’লে ডাকে, তা’ আজ বুঝ্লুম।” রমেশ তাহার কোন উত্তর না করিয়া সঙ্গে সঙ্গে ফটকের ধার পর্য্যন্ত আসিয়া হঠাৎ প্রশ্ন করিল, “আচ্ছা ভট্চায্যি মশাই, আপনি ত এদিকের সমস্তই জানেন, এ গাঁয়ে এত রেষারেষি কেন বল্তে পারেন?” দীনু মুখে একটা আওয়াজ করিয়া বার দুই ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “হায় রে বাবাজী, আমাদের কুঁয়াপুর ত পদে আছে। যে কাণ্ড এ ক’দিন ধরে খেঁদির মামার বাড়ীতে দেখে এলুম! বিশঘর বামুন-কায়েতের বাস নেই, গাঁয়ের মধ্যে কিন্ত চারটে দল! হরনাথ বিশ্বেস, দুটো বিলিতি আমড়া পেড়েছিল বলে তার আপনার ভাগ্নেকে জেলে দিয়ে তবে ছাড়লে। সমস্ত গ্রামই, বাবা, এই রকম—তা’ ছাড়া মাম্লায় মাম্লায় একেবারে শতচ্ছিদ্র! খেঁদি, হরিধনের হাতটা একবার বদলে নে, মা।” রমেশ আবার জিজ্ঞাসা করিল, “এর কি কোন প্রতীকার নেই’ ভট্চায্যিমশাই?” “প্রতীকার আর কি ক’রে হবে, বাবা—এ যে ঘোর কলি!” ভট্টাচার্য্য একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “তবে একটা কথা ব’ল্তে পারি বাবাজী। আমি ভিক্ষেসিক্ষে ক’র্তে অনেক জায়গাতেই ত যাই—অনেকে অনুগ্রহও করেন। আমি বেশ দেখেচি, তোমাদের ছেলেছোকরাদের দয়াধর্ম্ম আছে—নেই কেবল বুড়ো ব্যাটাদের। এরা একটু বাগে পেলে আর একজনের গলায় পা দিয়ে জিভ বার না ক’রে আর ছেড়ে দেয় না।” বলিয়া দীনু যেমন ভঙ্গী করিয়া জিভ বাহির করিয়া দেখাইল, তাহাতে রমেশ হাসিয়া ফেলিল। দীনু কিন্তু হাসিতে যোগ দিল না—কহিল, “হাসির কথা নয় বাবাজী, অতি সত্য কথা। আমি নিজেও প্রাচীন হয়েচি—কিন্ত—তুমি যে অন্ধকারে অনেকদূর এগিয়ে এলে, বাবাজী।” “তা’ হোক্ ভট্চায্যিমশাই, আপনি বলুন।” “কি আর বল্ব বাবা, পাড়াগাঁ মাত্রই এই রকম। এই গোবিন্দ গাঙুলী—এ ব্যাটার বাপের কথা মুখে আন্লে প্রায়শ্চিত্ত কর্তে হয়। ক্ষান্তবাম্নি ত আর মিথ্যে বলেনি—কিন্তু সবাই ওকে ভয় করে! জাল করতে, মিথ্যেসাক্ষী, মিথ্যে মোকদ্দমা সাজাতে ওর জুড়ি নেই। বেণীবাবু হাতধরা—কাজেই কেউ একটি কথা কইতে সাহস করে না, বরঞ্চ ওই-ই পাঁচজনের জাত-মেরে বেড়াচ্চে!” রমেশ অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত আর কোন প্রশ্ন না করিয়া, চুপ করিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল। রাগে তাহার সর্ব্বাঙ্গ জ্বালা করিতেছিল। দীনু নিজেই বলিতে লাগিল—“এই আমার কথা তুমি দেখে নিয়ো বাবা, ক্ষেন্তিবাম্নি সহজে নিস্তার পাবে না। গোবিন্দ গাঙুলী, পরাণ হালদার দু-দুটো ভীমরুলের চাকে খোঁচা দেওয়া কি সহজ কথা! কিন্তু যাই বল বাবা, মাগীর সাহস আছে। আর সাহস থাক্বে নাই বা কেন? মুড়ী বেচে খায়, সব ঘরে যাতায়াত করে, সকলের সব কথা টের পায়। ওকে ঘাঁটালে কেলেঙ্কারির সীমা-পরিসীমা থাক্বে না, তা ব’লে দিচ্চি। অনাচার আর কোন্ ঘরে নেই বল? বেণীবাবুকেও—” রমেশ সভয়ে বাধা দিয়া বলিল, “থাক্, বড়দার কথার আর কাজ নেই”—দীনু অপ্রতিভ হইয়া উঠিল। কহিল, “থাক্, বাবা, আমি দুঃখী মানুষ, কারো কথায় আমার কাজ নেই। কেউ যদি বেণীবাবুর কানে তুলে দেয় ত আমার ঘরে আগুন”- রমেশ আবার বাধা দিয়া কহিল, “ভট্চায্যি মশায়, আপনার বাড়ী কি আরো দূরে?”
“না, বাবা, বেশী দূর নয়, এই বাঁধের পাশেই আমার কুঁড়ে—কোন দিন যদি—” “আস্ব বই কি, নিশ্চয় আসব”- বলিয়া রমেশ ফিরিতে উদ্যত হইয়া কহিল, “আবার কাল সকালেই ত দেখা হবে—কিন্তু তাঁর পরেও মাঝে মাঝে পায়ের ধুলো দেবেন।” বলিয়া রমেশ ফিরিয়া গেল। “দীর্ঘজীবী হও—বাপের মত হও!” বলিয়া দীনু ভট্চায অন্তরের ভিতর হইতে আশীর্ব্বচন বাহির করিয়া ছেলেপুলে লইয়া চলিয়া গেল।